প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়। রহস্যে ঘেরা এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে কতই না বিচিত্র সব উপাদান। এই যেমন ধরুন, বর্ষার কোন এক দিনে হঠাৎ প্রকৃতিতে শোভা মেলে সাত রঙা রামধনুর এক অনাবিল সৌন্দর্য্য। কিন্তু যদি সেই রঙধনু বৃষ্টি ছাড়াই দেখা যেত কোন পাহাড়ে বা পাহাড়টিই যদি হয়ে যেতো একটি রঙবেরঙের পাহাড়! তবে কত মজা হতো ভাবুন তো! আর ভেবে কাজ নেই। জেনে রাখুন তবে, সত্যিই কিন্তু আছে এমন রামধনু পাহাড়। ভাবছেন মজা করছি! একেবারেই তা নয়।
আমাদের চারপাশে আমরা সাধারণত সবুজে ঘেরা পাহাড় দেখতেই অভ্যস্ত। সেসব পাহাড়ের রঙ তেমন খুব একটা আমাদের চোখে পড়ে না। তাই গাছপালার রঙের সাথে মিশিয়ে পাহাড়ের রঙও আমরা ভেবে বসি, হয়তো সে হবে সবুজ কিংবা মেটে রঙের। খুব কম লোকই আছেন যারা বলতে পারবেন, পাহাড়ও লাল-নীল কিংবা হলুদ-কমলা হয়।
সত্যি অবাক করা ব্যাপার হলো এ পৃথিবীতে এমন এক পাহাড় আছে যাকে আপনি নির্দ্বিধায় রঙধনুর পাহাড় বলতেই পারেন। আর সেটি রযেছে আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেই।
সুদূর চীনে রয়েছে এি বাহারি রঙের পাহাড়টি। শুধু একটা পাহাড় নয়, গোটা একটা পর্বতশ্রেণী সাতটি বাহারি রঙে সেজে আলিঙ্গন করছে ভ্রমণ পিপাসুদের। কৃত্রিমভাবে তৈরি নয়, প্রকৃতির আজব খেয়ালেি রামধনুর এই পর্বত তৈরি হয়েছে চীনে। প্রকৃতির তুলিতে এ যেন এক অবিশ্বাস্য রঙের ফোয়ারা।
এই পাহাড়টিকে ‘দাংজিয়া ল্যান্ডফর্ম জিওগ্রাফিক্যাল পার্ক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গানসু প্রদেশের অন্তর্গত ঝাংগিয়ে শহরের কাছেই অবস্থিত জিওগ্রাফিক্যাল পার্কটি। ঝাংগিয়ে শহর থেকে গাড়ি করে যেতে সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট।
চীনের ঝাংগিয়ে দাংজিয়া ল্যান্ডফর্ম জিওগ্রাফিক্যাল পার্ক বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। এখানে পা রাখা মাত্রই পর্যটকদের চোখে ঝলসে ওঠে বেগুনি-নীল-আসমানি-সবুজ-হলুদ-কমলা-লালের বাহারি রঙে। আকাশে নয় এই রংমহল পাহাড়ের গায়েই। মনে হয়, কেউ যেন দানবীয় তুলিতে রং বুলিয়েছে পাহাড়ের গায়ে।
এই পর্বতশ্রেণীর কোথাও দেখতে সমতল, কোথাও বা খাড়া এবড়ো থেবড়ো। আবার কোথাও মসৃণ যেখানে সবুজের পসরা বসিয়ে রেখেছে নানা রকমের গাছপালা। পাহাড়ের পাথরের সজ্জাগুলো নানা রকম রঙের সমাবেশের পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি দিনের শুরুটা ঘটে বৃষ্টি দিয়ে তাহলে প্রকৃতি আরও জাঁকজমক রূপে উপস্থিত হয় সেখানে। তবে মেঘাচ্ছন্ন এবং বর্ষণ মুখর দিনে দাংজিয়া ভ্রমণ অনেক পর্যটকেরই কাছে সুখকর নয়।
আমাদের কৌতুহলী মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কীভাবে তৈরি হলো এই পাহাড়? পাহাড়ে এতো রঙই বা আসল কোথা থেকে? পৃথিবীর বিভিন্ন ভূবিজ্ঞানীর মতে, এই রঙিন পাহাড় একদিনে বা অকস্মাৎ তৈরি হয়নি। হিমালয়ের গঠন শুরুরও অনেক আগে থেকে এই পাহাড় তৈরি হতে শুরু হয়। এটি তৈরি হতে সময় লেগেছে প্রায় ২৪ মিলিয়ন বছর। টেকটনিক প্লেটের সরণের ফলে এই পাহাড়ের খাড়াইগুলো তৈরি হয়েছে বলে তাদের মত। কিন্তু তার গায়ে এই বিচিত্র রঙের বাহার তা কীসের কারণে?
চীনের এই বিস্ময়কর পর্বতশ্রেণী নিয়ে বিজ্ঞানীদের মন্তব্য, এমন বিচিত্র রঙের বাহারের কারণ খুঁজতে অনেক পিছিয়ে যেতে হবে। এই পর্বত তৈরি হয়েছে মূলত বেলেপাথর দিয়ে। বালি পাথরে জমাট বাঁধার সময়ে তাতে মিশে গিয়েছিল বিভিন্ন খনিজ, গাছপালার অবশেষ ইত্যাদি। সেই মিশ্রণগুলিই এই রঙিন দুনিয়া তৈরি করে। তবে ভূ-বিজ্ঞানীদের দাবি, এই পাহাড়ের প্রাথমিক রংটি কিন্তু টকটকে লাল। তার উপরেই ক্রমে জমেছে অন্য রঙের উপাদান। ক্রমাগত রঙের পরিবর্তনে এই পাহাড় তার বর্তমান রূপটি পেয়েছে বলেও জানান ভূ-বিজ্ঞানীরা।
মূলত, বাহারি রঙই পাহাড়টির অনন্য বৈশিষ্ট্য। শুধুমাত্র এই পাহাড় দেখতেই প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শকের ভিড় জমে জিওগ্রাফিক্যাল পার্কটিতে, এ বিস্ময়ের সাক্ষী হতে। অনেকেই ফিরে ফিরে আসেন বারবার। তবু যেন মন ভরে না।
উত্তর-পশ্চিম চীনের সবচেয়ে আকর্ষণের বড় একটি কেন্দ্র বলা যেতে পারে ল্যান্ডফর্ম জিওগ্রাফিক্যাল এই পার্কটিকে। এই এলাকায় পা রাখা মাত্রই পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ছন্দময় সাত রঙের তরঙ্গমুখর বন্যায়। বেগুনি নীল আসমানি সবুজ হলুদ কমলা ও লালের বাহার সকলকে বাকরুদ্ধ করে রাখে।
দাংজিয়া ভ্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময় হলো জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে, কারণ তখন আবহাওয়া যথেষ্ট অনুকূলেই থাকে। তাছাড়া গনগণে সূর্যতাপ ও মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিছটা প্রকৃতির আসল রং নিংড়ে বের করে আনে। বছরের অন্যান্য সময়গুলোতে দাংজিয়া ধারণ করে তার রুক্ষ-শুষ্ক রূপ।
পার্কটিতে অন্যান্য টুরিস্ট বাস প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পার্কটির ভেতরেই রয়েছে পার্কের নিজস্ব উদ্যোগে সাইট ভিউ উপভোগ করার জন্য কারের সুব্যবস্থা। পার্কের মধ্যেই সরকারি কিছু গাড়ির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার সাহায্যে দৃশ্য দেখতে দেখতে চারটি পার্ক ভিউ প্ল্যাটফর্ম পয়েন্ট ঘুরে আসতে সময় লাগবে প্রায় দুই ঘণ্টা। প্ল্যাটফর্ম চারটির মোট মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার।
দাংজিয়ার রূপ অবলোকন করার জন্য মূলত নির্দিষ্ট কিছু সময় মাথায় রেখে বের হওয়া ভালো। একটি হলো সকালবেলা এবং অন্যটি গোধূলির প্রাক্কালে। কারণ এই সময়েই চারপাশের আলোর খেলায় পাহাড়ের রং পরিবর্তন হতে শুরু করে। সকাল বা গোধূলিতেই হলুদ ও রক্তিম লাল বর্ণের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে হালকা ধূসর রং এ বদলাতে থাকে।
দাংজিয়ের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম পূর্ব-পশ্চিম দিকে বিস্তৃত। এটি মূলত বিশাল বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী যার উপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পর্যটকগণ সাত রঙা পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন। এই স্থানটি হলো সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তকালীন সময়ের সবচেয়ে সুন্দর মনলোভা ছবি ধারণের জন্য উপযোগী জায়গা।
সাদা-কালো যুগ পেরিয়ে এসেছি তাও বহুদিন হয়ে গেলো। এই রঙিন দুনিয়ায় মনে রঙের ফোঁয়ারা না থাকলে, জীবনই যেন বৃথা! সেই রঙের রামধনু যদি হাত বাড়িয়ে ছোঁয়াও যায়, তাহলে কেমন হতো? ভাবছেন অলীক স্বপ্ন? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আকাশে নয়, মাটিতেই রয়েছে এই রঙের মেলা। শিল্পীর মনের কল্পনা নয়। ক্যানভাসের ওপর তুলিতে ফুটিয়ে তোলা ছবিও নয়। লাল-নীল, হলুদ-সবুজের, নীল-বেগুনির এই সমাহার, খাঁটি বাস্তব।
দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। একটা গোটা পর্বতশ্রেণী যে এভাবে রঙের মিশেল হয়ে উঠতে পারে, ভাবলে সত্যিই স্বপ্ন মনে হয়। শুষ্ক, রুক্ষ মাটিই এখানে ক্যানভাস। প্রকৃতি নিজের খেয়ালে রঙের তুলি বুলিয়ে গিয়েছে পরের পর। প্রকৃতির আজব খেয়ালে এই রঙিন পর্বতমালা মাথা তুলেছে চিনের ঝিয়াংগি দাংজিয়া ল্যান্ডফর্ম জিওগ্রাফিক্যাল পার্কে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এক আজব বিস্ময়- সাতরঙা এই পাহাড়ের সারি।