উত্তর-পূর্ব ইউরোপে বাল্টিক সাগরের একটি দেশ এস্তোনিয়া। দেশটির উত্তরের দিকের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি অপরূপ সুন্দর গ্রাম তুহালা। গ্রামটির চারিদিক গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। এই অপার সৌন্দর্যের মাঝে আছে রহস্যঘেরা এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মাঝেই আছে মানুষের তৈরি এক কূপ, যেটিকে সকলে ‘ডাইনি কূপ’ নামে ডাকে। আর এই কূপের কারণেই তুহালা এস্তোনিয়ার এক পরিচিত নাম।
গল্পটা এমন- বর্ষার মাঝামাঝি সময়, জ্যোৎস্না ঝরানো রাত। জঙ্গলের চারপাশে চাঁদের আলোয় চাদর মুড়িয়ে গাছপালা নীরবে স্থির হয়ে আছে। এমন মনোহর পরিবেশই যেন খুঁজছিল এক ডাইনির দল, তারা নেমে এলো সেই জঙ্গলের মাঝে। কিছুটা ঘুরতেই চোখে পড়ে গেল একটি কুয়া। কুয়াটি বেশ পছন্দ হয়ে গেল ডাইনিগুলোর। সেই কুয়ার পাদদেশে পৌঁছে গেল তারা। বিপুল আনন্দে মাথা ডুবিয়ে পানির মধ্যে তারা খেলা করতে লাগল। কিন্তু তাদের এই আনন্দ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ করেই তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল। ফলে শুরু হলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ। একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে বসল। আর এই আক্রমণের তাণ্ডবেই পানি উঠে এলো কুয়ার উপরে। কুয়ার চারপাশ ভরে যেতে থাকল বাধ না মানা পানির স্রোতে। ডাইনিদের এই যুদ্ধ যেন বন্ধই হতে চায় না!
এই গল্প পড়ে অনেকেই হয়তো ভিড়মি খেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সত্যিই কুয়ার পানির এ ধরনের কাণ্ড দেখে সাধারণ গ্রামের লোকেদের ভিন্ন কিছু ভাবার তো কোনো কারণ নেই। তাই তো এই কূপের নাম হয়ে গেল ডাইনি কূপ। আর তুহালাবাসীদের অনেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে লোকগাঁথাটি।
প্রায় তিন হাজার বছর আগের কথা, যখন গ্রামে চলছিল পানির সংকট। গ্রামের লোকেরা পানির উৎস খুঁজতে গিয়ে এই জায়গা পরীক্ষা করে দেখলেন যে, এখানে পানি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটুখানি খুঁড়তেই পাওয়া গেল পানি। খুব বেশি আর খনন করার প্রয়োজন পড়েনি কূপটি। মাত্র আড়াই মিটার গভীরতা এই কূপের। কূপের উপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একটি কাঠের বালতি। প্রথম প্রথম বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই পানির চাহিদা মেটাচ্ছিল এই কূপ। কিন্তু একদিন এক গ্রামবাসী পানি নিতে এসে দেখেন কূপটি থেকে আপনা আপনি পানি উপরে উঠে আসছে। এই দৃশ্য দেখে সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। দৌড়ে চলে গেল গ্রামের সকলকে জানাতে। গ্রামবাসীদের কানে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগেনি এই খবর। সাথে সাথে সকলেই দেখতে এলো মূল ঘটনা কী। নিজের চোখে না দেখে তো আর বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের সকলে কুয়ার কাছে এসে বেশ অবাক হলো। সবাই দেখল ঘটনা সত্যি। আসলেই কুয়া থেকে উপচে পড়ছে পানি।
সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন, কী করে আসছে এত পানি? প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে জন্ম নিল ভয়ের আর তৈরি হলো এক লোকগাঁথা। এছাড়াও আরও অনেক মজার মজার ভাবনাও আছে এই কুয়াকে নিয়ে। অনেকে বলে যে, তারা রাতের বেলা এই কুয়ার উপর দিয়ে আগুনের গোলক উড়ে যেতে দেখেছে। আবার অনেকে মনে করেন, সৃষ্টিকর্তার এক অলৌকিক নিদর্শন এই কুয়া, যা গ্রামের মধ্যে আশীর্বাদ হয়ে বয়ে এসেছে।
তবে নিজের চোখে এমনটা দেখলে এই লোককথার উপর বিশ্বাস জন্মানো অবাক করা কোনো ব্যাপার নয়। আমরা যখন কোনো কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি না, তখন শেষমেষ তা অলৌকিক হিসেবেই ধরা দেয়।
খুব শীঘ্রই এস্তোনিয়ার এই কুয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকেরা ভিড় করে এই কুয়ার পানির অবারিত ধারা দেখার জন্যে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বছরের বারো মাসেই যে কুয়ার পানি বের হয়, তা কিন্তু নয়। মূলত শীতকাল আর বর্ষাকালে বের হয় এই কুয়ার পানি। তবে যখন পানি বের হয় তখন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। রীতিমতো একটি পুকুরের মতো হয়ে যায় কুয়ার চারপাশ।
এটি সেকেন্ডে ৫,০০০ লিটারের উপর পানি উদগিরন করে বলে ধারণা করা হয়। টানা এক থেকে তিন সপ্তাহের মতো এভাবে পানির প্রবাহ থাকতে পারে। কুয়ার উপরে রাখা বালতিটি অনেকটা ডাইনিদের খাঁচার মতো দেখায়।
এই ঘটনা নজর কাড়ে অনেক বিজ্ঞানীর। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদও আসেন এই কুয়ার সরেজমিন পরীক্ষায়। অনেক খোঁজাখুঁজি ও গবেষণা চালানো হয় এই কুয়ার পানির উৎস সন্ধানের উদ্দেশ্যে। তাদের মতে কুয়ার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে এর ভৌগোলিক গঠনে। বাল্টিক সাগরের উত্তরে অবস্থিত হওয়ায় এস্তোনিয়ার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো নদী। তেমনি তুহালা অঞ্চলের ভূগর্ভেও লুকিয়ে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট নদী। শীতকালে এসব অঞ্চলে প্রচুর তুষারপাত হয়। দিনের বেলায় রোদের প্রভাবে বরফ গলতে শুরু করে। এই বরফ গলা পানি ভূগর্ভস্থ নদীগুলোর মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে ভূগর্ভস্থ এই সকল নদীর পানি অনেক বেড়ে যায়। আর এই কূপ যখন খনন করা হয়, তখন কোনোভাবে কোনো এক নদীর কোনো এক শাখার সাথে কুয়াটি মিলে যায়। ফলে যখন নদীতে পানির স্রোত বৃদ্ধি পায়, তখনই পানি উপচে পড়ে কুয়ো থেকে। আর বর্ষাকালের ব্যাপারটি তো সহজেই বোঝা যায়।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আড়ালে অনেক কিছুই আমাদের কাছে অলৌকিক বলে মনে হয়ে থাকে। কিন্তু যখন বিজ্ঞানের ভাষায় এর সঠিক ব্যাখ্যা বের হয়ে আসে, তখন সকল অলৌকিক কর্মকান্ডের একটি বাস্তবিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
তবে অনেকের মনে আজও প্রশ্ন জাগে, এত বছর আগে এতো সূক্ষ্মভাবে কী করে মাটির নিচে থাকা নদীর কোনো প্রশাখার সাথে মিল রেখে মাটির উপর দিয়ে এমন একটি কূপ খনন করা হয়েছিল? কী করেই বা নদীর একটি বহমান শাখার সাথে কুয়োটির পাদদেশের মিলন ঘটেছিল? তবে কাকতালীয়ভাবেই হোক আর পরিকল্পনামাফিকই হোক, কোনো অলৌকিক কারণে যে এই পানি মাটির ভূগর্ভ থেকে উঠে আসছে না তা রীতিমত পরীক্ষিত।
ডাইনি কূপ এস্তোনিয়ার জন্য খুলে দিয়েছে এক অবারিত দ্বার। ২০১২ সালে এস্তোনিয়ানরা এই কুয়াকে তাদের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় দাবি করেছে। ফলে এই কুয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে চলেছে। তাই দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও অনেকে দেখতে আসছে প্রকৃতির এই বিস্ময়।
রহস্যঘেরা গল্প-উপন্যাস আমরা সকলেই পড়তে ভালোবাসি। আর সেই সকল গল্পের মতো আমাদের কল্পনার জগতও অনেক সময় বাস্তবতায় কল্পনার আশ্রয় নিয়ে তৈরি করে এক একটি রহস্যের। আর সেই রকমই রহস্যে ঘেরা প্রকৃতির এক অদ্ভুত বিস্ময় তুহালা গ্রামের এই কূপ।