পুরনো পাথর জমিয়ে রাখার শখ থাকে অনেকেরই। দেশ-বিদেশের মুদ্রা বা ডাকটিকিট জমানোর মতো পাথর সংগ্রহের শখটাও ফেলনা নয়। আপনিও কি এমনই এক শৌখিন ব্যক্তি? কতই বা হবে আপনার সংগ্রহের পাথরগুলোর বয়স! আজ এমন এক পাথরের গল্প বলব, যার বয়স পৃথিবীতে এখন অব্দি খুঁজে পাওয়া যেকোনো পাথরের চেয়েই অনেক বেশি। শুধু পাথর নয়, নিজের সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়া ইতিহাসও বেশ প্রাচীন এই পাথরের। বলছিলাম কানাডার বেডরকে অবস্থিত ন্যুভুয়াজিটক গ্রিনস্টোন বেল্টের পাথরের কথা!
টানা সাত বছর গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান যে, পৃথিবীর অন্য সব পাথরের চেয়ে বেশি বয়সী কানাডার এই পাথরের বয়স প্রায় ৪২৮ কোটি বছর। এর আগে বয়স্ক পাথরের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল ২৫ কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া এক পাথর। তবে ন্যুভুয়াজিটকের কাছে সেসব যেন একদম নস্যি! শুধু যে পাথর নিয়েই মানুষের চিন্তাকে বদলেছে এটি তা নয়, একইসাথে বয়স্ক এই পাথরের মাধ্যমে মানুষের চোখে পৃথিবীর জন্ম নেওয়ার ইতিহাসও অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এর আগে মানুষ খোদ পৃথিবীর বয়সকেই ৪৬ও কোটি বছর হিসেবে ধরে নিয়েছিল। সেসময় ভূপৃষ্ঠ তৈরি হওয়ার পেছনে বিশাল সব টেকটোনিক প্লেটের স্থানান্তরের কারণ হিসেবে কাজ করেছিল- এমনটাই জানা ছিল। ন্যুভুয়াজিটক এই পুরো তত্ত্বকেই অনেকটা বদলে দেয়।
ন্যুভুয়াজিটকের পাথর পরীক্ষা করে আমেরিকা ও কানাডার বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন একদম ভিন্ন তথ্য। অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে পুরনো পাথরের বয়স আগে ৪০৩ কোটি বছর মনে করা হলেও সেই চিন্তা বদলায় নতুন এই পাথর খুঁজে পাওয়ার কারণে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আকাস্তা নেসিস নয়, ন্যুভুয়াজিটকই সবচেয়ে বয়স্ক পাথর হিসেবে এগিয়ে আছে এখন!
মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে জনাথন ও’নিল, এবং ওয়াশিংটন ডিসির কার্নেগি ইন্সটিটিউশন ফর সায়েন্স থেকে ডক্টর রিচার্ড কার্লসন মিলিতভাবে এই অনুসন্ধান চালান। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবী কখন ও কীভাবে গড়ে উঠেছিল সেটা নিয়েও নতুন তথ্য যোগ করেন। মজার ব্যাপার হলো, শুধু একটি-দুটি পাথর নয়, কানাডার এই স্থানটির বেশিরভাগ পাথরের বয়সই ৩৮০ থেকে ৪২৮ কোটি বছর বলেও দাবি করেন তারা।
ন্যাভুয়াজিটকের পাথরগুলো কী দিয়ে তৈরি?
যেমনটা পূর্বেই বলা হয়েছে, এই স্থানের পাথরগুলোর প্রধান উৎপত্তির উৎস মূলত অগ্ন্যুৎপাত। তিনটি প্রধান উপাদান এই পাথরগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়:
- কিউমিংটোনাইটস,
- ম্যাফিক, এবং
- ব্যান্ডেড আয়রন ফরমেশন।
এই তিনটি উপাদানের মধ্যে ন্যুভুয়াজিটকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কিউমিংটোনাইটসের উপস্থিতি। ফলে এই পাথরের রঙও অন্য সব একই প্রকারের পাথর থেকে কিছুটা আলাদা। মেটামরফিক অ্যামফিবোলস উপাদানে তৈরি পাথরটি সবুজাভ নয়, বরং অনেকটা ধূসর। পাথরে এই উপাদান সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বিধায় এই স্থানের ডাকনাম দেওয়া হয়েছে ফক্স অ্যামফিবোলাইট।
ন্যুভুয়াজিটক ও পাথরের বয়স সংক্রান্ত সমালোচনা
২০০৭ সালে প্রাপ্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক পাথরের তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৎকালীন ধ্যানধারণা অনেকটা বদলে গেলেও এ নিয়ে পরবর্তীতে আরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন অনুসন্ধানী ব্যক্তিবর্গ। প্রথম অনুসন্ধান জিরকয়েনে ইউরেনিয়াম-লিড ডেটিংয়ের মাধ্যমে হলেও ২০১২ সালে সামারিয়াম-নিওডাইমিয়াম ডেটিং এবং নিওডাইমাম আইসোটোপ ফ্র্যাকশনেশন ব্যবহার করে আরেকটি পরীক্ষা চালানো হয়। সর্বশেষ এনজিবি রিপোর্টে বলা হয়, পাথরের বয়স নিয়ে বলা বছরের এই সংখ্যা ঠিক পাথরের বয়স নয়, হেডেন ক্রাস্ট থেকে প্রাপ্ত আইসোটোপ রেশিওর অনুপাত ইঙ্গিত করে। ২০১৭ সালে পাওয়া তথ্যানুযায়ী অবশ্য ন্যুভুয়াজিটক পাথরে পাওয়া প্রাণের উৎসকেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম প্রাণ বলে মনে করা হয়। তবে পাথরের বয়স নিয়ে এই তর্ক এখনও চলমান।
পৃথিবীতে ন্যুভুয়াজিটকের চেয়ে পুরনো আর কোন পাথর কি পাওয়া যায়নি?
এই প্রশ্নের উত্তর একইসাথে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুটোই দেওয়া যায়। কারণটাও খুব সহজ। সত্যি বলতে, পৃথিবীতে ন্যুভুয়াজিটকের চেয়ে বয়স্ক পাথরের উপস্থিতি আছে। তবে ঠিক যে কারণে তাদের সবগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় ন্যুভুয়াজিটক, শুধু এর উৎপত্তিস্থলের কারণে। চলুন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীতে উপস্থিত সবচেয়ে বেশি বয়সী পাথরগুলো।
লুনার স্যাম্পল ৬৭২১৫, যেটি কিনা ৪৪৬ কোটি বছরের পুরনো হলেও ভূপৃষ্ঠ থেকে জন্মানো পাথর নয়। এটি আনা হয় অ্যাপোলো ১৬ মিশনের সময়, চাঁদ থেকে। অ্যানোর্থোসাইট উপাদানে তৈরি এই পাথরকে তাই ন্যুভুয়াজিটকের সাথে তুলনা দেওয়া সমীচীন নয়। তাই সবমিলিয়ে কানাডার ন্যুভুয়াজিটক পাথরকেই এখন অব্দি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী পাথর বলে ধরে নেওয়া যায়। যে তালিকায় ঠিক এর পেছনের সারিতেই আরো আছে অন্যগুলো।
জেনেসিস রক
অ্যাপোলো ১৫ মিশন থেকে আসার সময় সাথে নিয়ে আনা হয় পৃথিবীতে। আনুমানিক ৪১০ কোটি বছর বয়সী এই পাথরের বয়স চাঁদের থেকে অনেক কম হলেও জেনেসিস পাথরে প্রচুর পরিমাণে পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাই একে চাঁদের প্রথমদিককার পাথর বলে অনেকেই মনে করেন। একেও সবচেয়ে বেশি বয়সী পাথর হিসেবে ধরা হয় না এর উৎসের কারণে।
অ্যালান হিলস
মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা ৪০৯ কোটি বছর বয়সী এই পাথর পাওয়া যায় অ্যান্টার্কটিকার অ্যালান হিলস থেকে। ১৯৯৪ সালে খুঁজে পাওয়া এই পাথরটি নিয়ে ১৯৯৬ সালে হুট করেই বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বেড়ে যায়। ঠিক সেই বছর বিজ্ঞানীরা এতে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পান! চাঁদের মতোই মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে আসায় একেও বাতিল করে দেওয়া যায় এই তালিকা থেকে।
পৃথিবীর হাতেগোনা কিছু পাথরই শুধু এখন অব্দি ন্যুভুয়াজিটকের সাথে টক্কর দিতে পেরেছে। এর মধ্যে শুরুর দিকেই থাকবে জ্যাক হিলস জিরকন, যেটি পাওয়া গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক হিলসে। বয়স আনুমানিক ৪৩৭ কোটি বছর হলেও জিরকন ঘরানার এই রত্নপাথরকে ঠিক সাধারণ পাথর বলা যায় না।
এছাড়া তালিয়ায় রাখা যায় ইসুয়া গ্রিনস্টোন বেল্টের পাথরকেও, যেটির বয়স প্রায় ৩৭০ থেকে ৩৮০ কোটি বছর। তবে পৃথিবীর পাথর হিসেবে ন্যুভুয়াজিটকের কাছাকাছি বয়সী হিসেবে আকাস্তাকেই ধরে নেওয়া যায়।
রেডিওমেট্রিক এইজ-ডেটিংয়ের তথ্যানুযায়ী পৃথিবীর বয়স বর্তমানে আনুমানিক ৪৫৪ কোটি বছর মনে করা হয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধনের মাধ্যমে সেজেছে পৃথিবী। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে নানা পাথর ও পাথর দ্বারা সৃষ্ট স্থান। তবে পৃথিবীর উপরিভাগ সবসময় পরিবর্তনশীল হওয়ায় এর কোন অংশকে সবচেয়ে পুরনো বলে মনে করা উচিত সেই বিষয়ে দ্বিধা রয়েছে অনেক। একদম পৃথিবীর বয়সের সাথে মিলে না গেলেও এর কাছাকাছি বয়সের পাথর আজ অব্দি পাওয়া গিয়েছে অনেক। এই পাথর ও পাথরে ভরা স্থানগুলোর মধ্যেই এখন অব্দি খুঁজে পাওয়া স্থান হিসেবে ন্যুভুয়াজিটককেই এগিয়ে রাখা হয়।