পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড: শতাব্দীর কান্না জড়ানো এক ভয়ঙ্কর অভিশপ্ত দ্বীপ

হঠাৎ দেখলে মনে হবে এক অপরূপ মায়াবী নগর আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চারদিকে নীল জলরাশি দেখে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। মনে হবে কল্পনার কোনো এক দ্বীপে চলে এসেছেন। মনে হতেই পারে যেন সাগরের মাতাল হাওয়ায় কেউ হালকা ছুঁয়ে চলে যায়। কিন্তু এ দ্বীপটি নিঝুম দ্বীপ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। দ্বীপ থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলেই দ্বীপের সৌন্দর্যের চেয়ে হাহাকার ধ্বনিই আপনাকে তাড়া করবে প্রতিনিয়ত। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে যেন এক অজানা আতঙ্ক আর ভয়। ভয়ে কেউ দ্বীপেই নামতে চায় না। বাতাসে হাজার বছরের পুরনো কান্না যেন জমে রয়েছে এই দ্বীপে। কিভাবে দ্বীপটি সকলের কাছে অভিশপ্ত আর ভংযঙ্কর হয়ে উঠলো সেই অজানা কাহিনী নিয়ে আজকের এই লেখা।

চতুর্দিকে জলবেষ্টিত পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড

ইতালির ভেনিস এবং লিডো এই দুই অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত ছোট এক দ্বীপ। লেগুন সেইন্ট মার্ক্স স্কয়ারে অবস্থিত এই দ্বীপ ‘পোভেগ্লিয়া ভেনিস’ বা পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড হিসেবে পরিচিত। ১৭ একর জায়গা জুড়ে পোভেগ্লিয়া দ্বীপ ঘিরে রয়েছে নানা ভৌতিক কাহিনী।

প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড

৪২১ খ্রিষ্টাব্দে এই দ্বীপে প্রথম বসতি গড়ে ওঠে। এই দ্বীপে ছিল না শাসকদের কড়াকড়ি। করের বোঝা বা আইন আদালতের ঝক্কিও তেমন একটা ছিল না। ফলে পরবর্তীতে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে দ্বীপের অধিবাসীরা সুখে, শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। ৯ম শতকের দিকে দ্বীপের জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই সাথে বাড়তে থাকে দ্বীপের গুরুত্ব। এই সময়টায় দ্বীপটি ছিল পোদেস্টা শাসকদের অধীনে।

মানচিত্রে পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ডের অবস্থান

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপরূপ লীলাভূমি ছিল এই দ্বীপ। আর সেই কারণেই এই দ্বীপ দখলের জন্য চতুর্দশ শতকে ভেনেটিয়ানস ও জেনোইসদের মধ্যে বাঁধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ৷ যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় প্রচুর কামান ও বন্দুকের গুলি যার শব্দ আজও সে দ্বীপে নাকি প্রতিধ্বনিত হয় রাতের ঘন অন্ধকারে। দ্বীপের লোকজন এলাকা ত্যাগ করতে থাকে। সেদিনের যুদ্ধে জয়ী হয় ভেনেটিয়ানস সরকার।

দ্বীপের অধিকার নেয়াকে কেন্দ্র করে ভেনেটিয়ানস ও জেনোইসদের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

দ্বীপ জনশুন্য হয়ে পড়ায় ভেনিস সরকার ক্যামান্ডলিসের সন্ন্যাসীদের এই দ্বীপে থাকার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু সন্ন্যাসীরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরে দ্বীপটির চারপাশে পাঁচটি অষ্টভুজাকৃতির খাল নির্মাণ করে দ্বীপের প্রবেশদ্বারকে সৈন্যদ্বারা রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।

যুদ্ধের ভয়াবহতায় জনমানবশুন্য হয়ে পড়া পভেগ্লিয়া দ্বীপ

অষ্টাদশ শতকে দ্বীপটিকে বিভিন্ন দেশের জাহাজের মালপত্র ওঠা-নামার জন্য এক অস্থায়ী বন্দর নির্মাণ করে। তখন এটি ব্যবহার হতে থাকে জাহাজ বন্দর হিসেবে। এরপর থেকেই যেন সূচিত হতে থাকে দ্বীপটির অভিশপ্ততার গল্প।

জাহাজ থেকে মালামাল উঠানামার জন্য দ্বীপে তৈরি করা হয় অস্থায়ী বন্দর

১৩৪৮ সালটি পোভেগ্লিয়া দ্বীপের অধিবাসীদের জন্য এক আতঙ্কের বছর, এক বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাসের বছর। কারণ এ সময় দ্বীপের নোঙর ফেলা দুইটি জাহাজে বিউবোনিক প্লেগ দেখা দেয় এবং এই রোগে আক্রান্ত দুইজন মারা যায়। কিন্তু এখানে কাজ করা এবং অতিথিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়নি। ধীরে ধীরে প্লেগের মহামারী আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যেতে থাকে। চিকিৎসা করেও লাভ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বন্দরটি সিল করে দেওয়া হয, পভেগ্লিয়া জনশুন্য হয়ে পড়ে।

প্লেগের মহামারীর কারণে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পভেগ্লিয়া দ্বীপ শয়ে শয়ে মানুষ মরতে থাকে, পরিণত হতে থাকে মৃত্যুপুরীতে

পরবর্তীতে ইতালির বিভিন্ন শহরে প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে প্লেগ রোগে আক্রান্তদের ওই নিঝুম, জনমানবশূন্য পভেগ্লিয়া দ্বীপে পাঠানো হত। রোগীরা মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন সেই নির্জন দ্বীপে। ফলে এই দ্বীপ ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠতে থাকে সংক্রামিত রোগীর নির্বাসন কেন্দ্র।

প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের নির্বাসন কেন্দ্র হিসেবে পভেগ্লিয়া দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

পরে ক্রমেই বাড়তে থাকা রোগীর সংখ্যায় উদ্বিগ্ন ইটালি সরকারের এক নির্মম নির্দেশে ওই দ্বীপেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষকে। সেই থেকে মৃত মানুষের হাজার-হাজার কঙ্কাল ছড়িয়ে পড়ে দ্বীপের চারপাশে। তারপর থেকেই মৃত্যুপুরী বা Island of Dead নামেই পরিচিতি পেতে থাকে পভেগ্লিয়া। এত মানুষকে একসাথে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্মম ঘটনা দ্বীপটিকে ধীরে ধীরে সকলের অজান্তেই রহস্যময় করে তোলে। এরপর থেকেই এটি কিংবদন্তি দ্বীপে পরিণত হয়। অনেকেরই বিশ্বাস জন্মায় যে, মারা যাওয়া সেই মানুষগুলোর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে ফেরে এই দ্বীপে।

মৃত মানুষের কঙ্কালে ভরে উঠে পভেগ্লিয়া দ্বীপ

বিংশ শতাব্দীতে এসে দ্বীপটিতে আবার জাহাজ খালাসের ব্যবস্থা করা হলেও দ্বীপটি পূর্বের ন্যায় আর জমে ওঠেনি। ১৯২২ সালের দিকে ইটালির সরকার মানসিক রোগীদের জন্য ঐ এলাকায় একটি মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খুব বেশিদিন সেই হাসপাতাল চালু রাখা সম্ভবপর হয়নি। হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা আর অন্যান্য কর্মরত লোকজন হাসপাতালে চাকুরি করতে চাইতেন না। কিছুদিন কাজ করার পরেই তারা হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন।

মানসিক রোগীদের জন্য পভেগ্লিয়া দ্বীপে তৈরি হওয়া মানসিক হাসপাতাল

কয়েকজন চিকিৎসক এবং সেবিকাদের কথায় জানা যায়, তারা প্রতিনিয়ত অদৃশ্য কারও অনুভূতি পেতে থাকেন। প্রতিমুহূর্ত চাপা আতঙ্ক ও ভয় কাজ করতো তাদের মনের মধ্যে। এই ধরনের ভৌতিক পরিবেশে কাজ করতে তারা নারাজ ছিলেন। এছাড়াও হাসপাতালে থাকা ভর্তি হওয়া মানসিক রোগীরা সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকে।

অতৃপ্ত আত্মাদের ভয়ে বেশি দিন চালানো যায়নি মানসিক হাসপাতালটি

স্থানীয় লোকমুখে জানা যায়, প্লেগে মৃতদের অতৃপ্ত আত্মা নাকি এখনো দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়। তাদের দীর্ঘশ্বাসে ধ্বনি নিয়ত বাজতে থাকে মানুষের মনের মধ্যে। অনেকেরই বিশ্বাস , এসব আত্মা অন্যের আধিপত্য মেনে নিতে পারে না। একে একে রোগী থেকে কর্মী সকলেই উন্মাদ আচরণ করতে  থাকে।

রোগীশূণ্য ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া হাসপাতাল

লোকের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় যখন খোদ হাসপাতালের পরিচালক উন্মত্ত হয়ে হাসপাতালেরই ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ফলে দ্বীপে ঐ হাসপাতাল দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব হয়নি। ১৯৬৮ সালের পর দ্বীপের এই মানসিক হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় ইটালি সরকার।  জনশূন্য দ্বীপ আরও রোমহর্ষক গল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

নির্জন দ্বীপটিতে চারদিকে বিরাজ করে অতৃপ্ত আত্মাদের হাহাকার ধ্বনি

এরপর লোকশুন্য এই দ্বীপ পর্যটকদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও একজন মার্কিন উপস্থাপক দ্বীপটিতে ভ্রমণে আসেন। তিনি মার্কিন টেলিভিশনের জন্য  দ্বীপটি আর নিষিদ্ধ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে একটি রোমাঞ্চকর সিরিজ তৈরি করেন, যেখানে তিনি তুলে ধরেন এই দ্বীপে নানা ভয়ঙ্কর ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা।

নির্জন দ্বীপে পরিত্যক্ত একমাত্র গোয়ালঘর

এখন নির্জন দ্বীপটিতে থাকার মধ্যে রয়েছে কেবলমাত্র একটি মঠ ও গোয়াল ঘর। আর রয়েছে অদৃশ্য অতৃপ্ত আত্মারা। এই দ্বীপে আর কোন জাহাজ নোঙর ফেলে না। ইটালির ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষ এই দ্বীপে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এখনো জারি রেখেছে। যদি কেউ এই দ্বীপে ভ্রমণে যেতে ইচ্ছা পোষণ করেন, তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষ হতে অনুমোদন নিতে হবে। তা এক বিশাল প্রস্তুতি।

নি:শব্দ , নি:শ্চুপ হয়ে প্রকৃতির কোলে দাড়িয়ে থাকা ভূতুড়ে পোভেগ্লিয়া দ্বীপে

দ্বীপে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া  হাসপাতালটির আনাচে-কানাচে ছড়াতে থাকে অদ্ভুত সব  ভয়ের গল্প। শতাব্দীর অগণিত মানুষের জমে থাকা কান্না সর্বক্ষণ প্রতিধ্বনিত হয় নির্জন, নিঃশব্দ পোভেগ্লিয়া দ্বীপের চারপাশে। জঙ্গলে, রাস্তায়, এখানে সেখানে পড়ে রয়েছে মৃত মানুষের কঙ্কালের হাড়গোড়। রাতের অনেক দূর থেকে পোভেগ্লিয়া দ্বীপের দিকে তাকাতে বুক কেঁপে যায় পোড় খাওয়া জাহাজের ক্যাপ্টেনেরও। সকলেরই মনে ভয় জাগানিয়া এক প্রশ্ন- ওখানে কারা থাকে ? নিঝুম মৃত্যুর দ্বীপ হাতছানি দিয়ে ডাকে আশেপাশে আগত  সবাইকে। কে যাবে সেখানে…

তথ্যসূত্র

১. travelchannel.com/shows/ghost-adventures/articles/poveglia-islands-haunted-history

২. huffingtonpost.com/off-track-planet/poveglia-island-like-hell_b_4188986.html

৩. news.com.au/travel/travel-updates/a-night-on-the-haunted-poveglia-island-in-italy/news-story/

৪. mysteriousfacts.com/mystery-of-the-poveglia-worlds-most-haunted-island/

৫. mysteriousfacts.com/mystery-of-the-poveglia-worlds-most-haunted-island/

৬. geek.com/geek-cetera/the-most-haunted-places-in-the-world-the-island-of-poveglia/

Related Articles

Exit mobile version