তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক এই যুগে গুগল ম্যাপ, জিপিএস সিস্টেম প্রভৃতি ব্যবহার করে যেমন আমরা ঠিকঠাক আমাদের গন্তব্য খুঁজে বের করতে পারি, তেমনি আগেকার দিনেও জাহাজ পরিচালনা, মরুভূমিতে পথ চলা, যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি কাজে মানচিত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হতো। সে সময়ের নামজাদা ভূগোলবিদগণ সেসব মানচিত্র তৈরি করে দিতেন। ইতিহাসের পাতায় তেমনই অনেক নামজাদা মুসলিম ভূগোলবিদের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা মধ্যযুগের ভূগোল, বিশেষত মানচিত্র অংকনে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।
মানচিত্র জগতে মুসলমানদের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে সর্বপ্রথম স্মরণ করতে হয় আল ইদ্রিসের (১১০০-১১৮৪) নাম। স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই মহামনীষী শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছিলেন। ব্যাপক ভ্রমণের ফলে তিনি সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে এত ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যে, সিসিলের রাজা দ্বিতীয় রজার্স পৃথিবীর নিখুঁত মানচিত্র অংকনের জন্য আল ইদ্রিসের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
সুদীর্ঘ ১৫ বছরের অক্লান্ত অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি ‘আল কিতাব আল রজারী’ নামের একটি ভূ-চিত্র সম্বলিত গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। এই পুস্তকে তিনি বিভিন্ন স্থানের ৭০টি মানচিত্র এবং ২৫৫৮টি প্রসিদ্ধ ভৌগোলিক স্থানের বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। উক্ত মানচিত্রে মরুভূমি, বন, সমুদ্রপথ প্রভৃতিকে আলাদা আলাদাভাবে বোঝানোর জন্য আলাদা আলাদা বর্ণের ব্যবহার করেছিলেন। এই মানচিত্রে ডিগ্রি, ল্যাটিচিউড প্রভৃতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যা আধুনিক যুগের মানচিত্রাবলীর বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়। এ সম্পর্কে ‘সাগর ও আমেরিকা বিজয়ে মুসলিম’ গ্রন্থে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ বাসার মঈনউদ্দীন বলেন,
আল ইদ্রিসের মানচিত্র এতটাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, সমগ্র ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তার মানচিত্রকে ওয়ালম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করতো। এছাড়া তিনি রাজা রজার্সের জন্য রৌপ্যের পাত্রে ভূমণ্ডলের একখানি মানচিত্র অংকন করে দিয়েছিলেন। আল ইদ্রিসের মনীষার বৈশিষ্ট্য এখানে যে, তিনি গ্রিসের কোনো মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হননি। এমনকি টলেমির মতো ভূগোলবিদও আল ইদ্রিসের রচনায় সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। টলেমীর মানচিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, উত্তর দিকটা উপরের দিকে স্থান পেতো। রোমানরা তাদের মানচিত্রে পূর্বদিকটা উপরে এবং গ্রিকরা উত্তর দিক উপরে নির্দিষ্ট করতো। অক্সফোর্ড, প্যারিস, লেলিনগ্রাদ, ইস্তাম্বুল ও কায়রোর লাইব্রেরিসমূহে রক্ষিত আল ইদ্রিসের মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া যায় যে, তার মানচিত্রের দক্ষিণ দিকটা উপরে নির্দেশ করেছেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক যেহেতু খ্রিস্ট-ইউরোপ, সেহেতু সে তার স্বধর্মাবলম্বী টলেমীর কীর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য টলেমীর রীতি অনুসরণ করছে। তবে একথা সত্য যে, যদিও পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে টলেমীর রীতি অনুসরণ ও প্রসার করার জন্য খ্রিস্ট-ইউরোপ চেষ্টা চালিয়ে আসছিল, তথাপি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব আল ইদ্রিস তথা আরবীয় রীতি অনুযায়ী মানচিত্র অংকন করতো।
ভূগোলবিদ হিসেবে মুহাম্মদ মূসা আল খাওয়ারিজমীর (৭৮০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) নাম সম্ভবত সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে বাদশাহ মামুনের রাজত্বকালে এই প্রতিভাবান মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ছিল তার ছিল অনন্য প্রভাব। তার নানামুখী প্রতিভা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। তবে আধুনিক সভ্যতায় তার অবদানের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা খুব বেশি অপ্রাসঙ্গিক হবে না বোধ করি; তার সম্বন্ধে ফ্রান্সের বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ক্যারে ডি ভক্স বলেছেন,
অষ্টাদশ শতাব্দীর পিসার বিখ্যাত বীজগণিতবিদ লিওনার্দো ফি ফোন্সি বলেছেন যে, তিনি আরবদের নিকট বড় রকমের ঋণী। তিনি মিশর, সিরিয়া, গ্রিস, সিসিলি ইত্যাদি ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে আরবদের নিকট ভূগোল ও জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরবদের পদ্ধতিকে পিথাগোরীয় পদ্ধতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ১৫ পরিচ্ছেদ বিশিষ্ট একটি আরবি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেই গ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদে তিনি বীজগণিতের গণনা সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন। সেখানে লিওনার্দো বর্গীয় সমীকরণের ছয়টি পদ্ধতির বিবরণ তুলে ধরেছিলেন, যা আল খাওয়ারিজমির ‘অ্যালজেবরা’ গ্রন্থের অনুকরণে করা হয়েছিল। খাওয়ারিজমির সেই পদ্ধতি ইউরোপের গণিত বিদ্যায় এক নবযুগের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল। রবার্ট চেস্টার কর্তৃক আল খাওয়ারিজমির ‘অ্যালজেবরা’ গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে জনৈক আধুনিক গবেষক মনে করেন যে, “এই গ্রন্থটি ইউরোপে বীজগণিত চর্চার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল”।
খাওয়ারিজমি শুধুমাত্র বীজগণিত নয়- জ্যামিতি, পাটিগণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রকে মৌলিক অবদানে পরিপুষ্ট করেছেন। খাওয়ারিজমি রচিত ‘কিতাব সুরাত আল আরদ’কে (পৃথিবীর আকৃতি সংক্রান্ত গ্রন্থ) ভূগোল বিজ্ঞানের ভিত্তিস্থাপক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি এখনো জার্মানির স্ট্রাসবার্গ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বিভিন্ন মানচিত্রে সুশোভিত এই মূল্যবান গ্রন্থটির গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে এর ল্যাটিন অনুবাদক সি. এ. নালিনো বলেন,
খাওয়ারিজমির এই গ্রন্থটি এমন এক রচনা ছিল, যার তুল্য ইউরোপের কোনো জাতি তার বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ শুরুর সময়ে উৎপাদন করতে পারেনি।
এই বইটিতে টলেমীর অনেক দাবি যুক্তি সহকারে পর্যালোচনা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে তা সংশোধন করা হয়েছে। এইচ ভন মাজিক এই পুস্তকটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। খাওয়ারিজমি খলিফা আল মামুনের জন্য একটি বিখ্যাত মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। এ বিষয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ বাসার মঈনউদ্দীন বলেন,
খাওয়ারিজমি খলিফা মামুনের জন্য যে বিশ্ববিশ্রুত মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, সেই শ্রমসাধ্য সাধনায় তাকে সাহায্য করেছিল ৬৯ জন প্রখ্যাত ভূগোলবিদ। মধ্যযুগের একটি স্বল্পকালীন ও সীমিত প্রেক্ষাপটে একইসাথে একটি বিশেষ বিষয়ে এত ব্যাপক পণ্ডিতের সমাগম যেকোনো সভ্যতার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সন্দেহ নেই।
আমরা যে সময়কালের মনীষীদের নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময়টা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, ঐ সময় যদি মুসলমান মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে দূরে সরে থাকত, তাহলে হয়তো ইউরোপীয় সভ্যতা এত দ্রুত উন্নতি লাভ করতে পারত না। ফলে এমন একটি ভিত্তিমূলক ও সংযোগকারী যুগে যেসব প্রতিভাবান গবেষকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছিলেন, তাদের মর্যাদা পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষভাবে বিবেচিত।
এ সময়ে ভূগোল ও মানচিত্র অংকনে যেসকল মুসলমান মনীষী অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে আল ইদ্রিস ও আল খাওয়ারিজমির অবদান সবার উপরে। যাদের অবদান উপরে স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ছাড়াও আরও অনেক মুসলিম মনীষী মানচিত্র অংকনে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এদের মধ্যে আল বালখী সুপ্রসিদ্ধ মানচিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাত। কাজবীনি ও আল ওয়াদিবী মানচিত্র নির্মাণে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
আল বেরুনী যদিও আমাদের কাছে ঐতিহাসিক হিসেবে অধিক পরিচিত, কিন্তু তার ভৌগোলিক গবেষণাও ভূগোল শাস্ত্রকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রতিভাবান গবেষক জোয়ার-ভাঁটার হ্রাস-বৃদ্ধি ও চন্দ্রের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয় ও আরও অন্যান্য বিষয়ে যেসব বিজ্ঞানসম্মত তথ্য তুলে ধরেছিলেন, তার গুরুত্ব আজও আধুনিক ভূগোলবিদরা স্বীকার করেন।
ইবনে ওয়াহেদ ইয়াকুবির ‘কিতাবুল বুলদান’ এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, এই গ্রন্থের জন্য তাকে মুসলিম ভূগোল বিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। ইরানের ইবনুল ফকীহ বিখ্যাত ভূগোলবিদ ছিলেন।
ইবনে খুরদাদবিহ সেই দুর্গম যুগে আরব বিশ্বের বিভিন্ন বাণিজ্য পথ, যোগাযোগ পথ এবং সুদূর চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের বিবরণসহ একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মাসালিকা’।
ইরানের প্রখ্যাত ভূগোলবেত্তা ইবনে রুস্তাহ একটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন, যার সপ্তম খণ্ডে ভূগোল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। বিখ্যাত গবেষক আবু জায়েদ বলখীর ‘মুরাবুল আকালীম’ এবং ‘কিতাবুল মাসালিক অয়াল মাসালিকা’ গ্রন্থদ্বয় আজও পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়া ইরানের ইস্তেখারি ও প্যালেস্টাইনের মাকদিসি প্রসিদ্ধ ভূগোলবিদ ছিলেন।
এশিয়া মাইনরের উল্লেখযোগ্য ভূগোলবিদ ছিলেন ইয়াকুত হাসাবীর । তার রচিত ‘মুয়াজ্জামুল বুলদান’ নামক ভৌগোলিক বিশ্বকোষে একদিকে যেমন ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি ভূগোল নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ইয়াকুত হাসাবীর ‘মাজমাউল উদাবা’ নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূগোল বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
ইরানের আল ফাজবিমীর ভৌগোলিক জ্ঞান আজও আমাদের বিস্মিত করে। মরক্কোর আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা শুধুমাত্র পর্যটকই ছিলেন না, তিনি প্রসিদ্ধ ভূগোলবিদও ছিলেন। কর্ডোভার আল বাকরী একটি ভৌগোলিক অভিধান রচনা করেছিলেন, যেখানে মানচিত্র সহকারে বিভিন্ন অঞ্চলের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছিল।
গ্রানাডার উম ইবনে আবু বকর আল জুহুরী, আল মাজানী প্রমুখ ভূগোল শাস্ত্রবিদ তাদের মৌলিক অবদানের জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। স্পেনের ইবনে জুবায়েরার ‘রিহিলাত ইবনে জুবায়ের’ নামক পুস্তক আজও তার ভূগোল বিষয়ক অগাধ পাণ্ডিত্যের চিহ্ন বহন করে।
৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে হায়কল যে মানচিত্র অংকন করেছিলেন, তাতে পৃথিবীকে যেমন গোলাকৃতি দেখানো হয়েছিল, তেমনি উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম এই চারটি গোলার্ধ নির্ণয় করে দেখানো হয়েছিল। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আল দামিস্কীর প্রখ্যাত মানচিত্রে পৃথিবীর আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল।
তাদের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আধুনিক ইউরোপের ভূগোলবিদগণ বিশ্ব মানচিত্রের উত্তর উত্তর উন্নতি সাধন করেন। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সেই কাজ স্যাটেলাইট নিজেই করতে পারে। কিন্তু ‘সংযোগ যুগ’ হিসেবে মধ্যযুগের এসব মনীষীদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র:
১। বাসার মঈনউদ্দীন, সাগর ও আমেরিকা বিজয়ে মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮
২। Carra de Vaux, The legacy of Islam, Beauchesne, Paris, 1909
৩। Ahmad Nefis, Muslim Contribution to Geography, lahore, 1947