‘কন্টিনেন্ট’ বা ‘মহাদেশ’ সম্পর্কে সবাই কম-বেশি অবগত। প্রত্যেকটি দেশই কোনো না কোনো মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ভূগোল বা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা না করেও ‘কন্টিনেন্ট’ কি সেই সম্পর্কে ধারণা করা যায়। একদম সহজ ভাষায় বলতে গেলে এমন একটি বিশাল ভূখণ্ড হলো ‘কন্টিনেন্ট’ বা মহাদেশ’ যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কয়েকটি দেশ। অবশ্য মহাদেশের সংজ্ঞা এতটুকু নয়। বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরও এক্ষেত্রে কাজ করে। যেমন- জনসংখ্যা, টেকটোনিক প্লেট, সংস্কৃতি ইত্যাদি। এখন এমন কোনো ভূখণ্ডের কথা যদি বলি যা একের অধিক মহাদেশ নিয়ে গঠিত তাহলে সেই ভূখণ্ডকে কী বলা হবে? মহাদেশ থেকেও বড় তথা এসব অতিরিক্ত বৃহৎ ভূখণ্ডকে বলা হয় ‘সুপারকন্টিনেন্ট’ বা ‘অতি-মহাদেশ’। এর প্রচলিত সংজ্ঞা অনুসারে বিদ্যমান মহাদেশীয় ভূত্বকের শতকরা ৭৫ ভাগ ভূখণ্ড একত্রে থাকলে তা অতিমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত হবে। অবশ্য সংজ্ঞাটি কতটা যুক্তিসংগত তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে এসব সুপারকন্টিনেন্ট চিরস্থায়ী নয়।
দেশ হোক কিংবা মহাদেশ; সব ধরনের ভূখণ্ডই প্রতিনিয়ত নিজেদের অবস্থানের পরিবর্তন করছে। সুতরাং সুপারকন্টিনেন্টেরও কোনো স্থায়ী অবস্থান নেই। সাধারণত যতগুলো সুপারকন্টিনেন্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তার মধ্যে চারটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এগুলো হলো- কেনরল্যান্ড, কলাম্বিয়া, রডিনিয়া এবং প্যানজিয়া। এই প্যানজিয়া সম্পর্কেই সবচাইতে বেশি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য এবং মানচিত্র সংগ্রহ করতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানের সাতটি মহাদেশই সুপারকন্টিনেন্ট প্যানজিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এখন আর এর দেখা মেলে না। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই সুপারকন্টিনেন্টের অস্তিত্ব ঘুরপাক খেতে থাকে।
প্যানজিয়া
প্যানজিয়া শব্দটি প্রাচীন গ্রিক ভাষার, যার অর্থ ‘সব ভূমি’। এই শব্দটির ব্যবহার মূলত ২০ শতকের দিকে শুরু হয়, যখন জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়াগনার সর্বপ্রথম এই অতি-মহাদেশের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, পূথিবীর মহাদেশগুলোকে একসাথে জোড়া লাগালে ভূখণ্ডগুলো জিগস পাজলের মতো একত্রে যুক্ত হয়ে যায়। এ থেকে তিনি ধারণা করেন যে, এসব মহাদেশ পূর্বে একত্রে যুক্ত ছিল তথা অতি-মহাদেশ ছিল। তার মতে, আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে প্যানজিয়া গড়তে শুরু করে। ২৭০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এটি একত্রিত হয়। তবে ১৭৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে এটি আবার ভাঙতে শুরু করে। অর্থাৎ প্যানজিয়া নামক সুপারকন্টিনেন্টের অস্তিত্ব ছিল পেলিওজোয়িক যুগের শেষের দিকে এবং মেসোজোয়িক যুগের শুরুর দিকে।
প্যানজিয়ার গঠন
৪৮০ মিলিয়ন বছর আগে ‘লরেশিয়া’ নামক একটি মহাদেশ ছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউরোশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার কিছু অংশ। উত্তর আমেরিকা থেকে মূলত গ্রিনল্যান্ডই লরেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই মহাদেশটি কয়েকটি মাইক্রো বা ছোট কন্টিনেন্ট নিয়ে গঠন করে ইউরামেরিকা। পরবর্তীতে এই ইউরামেরিকা গন্ডোয়ানার সাথে যুক্ত হয়ে অতি-মহাদেশ প্যানজিয়া গঠন করে। উল্লেখ্য, গন্ডোয়ানার অন্তর্ভুক্ত ছিল আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা মহাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশ। ভারত এই সময়ে এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। প্যানজিয়া সুপারকন্টিনেন্টটি মূলত দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত ছিল। আর পান্থশালা নামক সুপার সমুদ্র দ্বারা ঘেরা ছিল।
পেনসিলভেনিয়ায় যে কয়লা পাওয়া যায় তার গঠন পোল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও জার্মানির থেকে একই সময়ের প্রাপ্ত কয়লার গঠন একই। এ থেকে বোঝা যায় যে এমন একটা সময় ছিল যখন উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল। তাছাড়া একই প্রজাতি এবং একই ধরনের জীবাশ্ম দেখে প্রমাণ করা যায় যে, এসব মহাদেশ পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল। যেমন- থেরাপসিড লিস্ট্রোসরাসের জীবাশ্ম উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে পাওয়া যায়।
আবার ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের জীবাশ্ম গ্লোসোপটেরিসের উপস্থিতি রয়েছে বর্তমানের মানচিত্র অনুসারে মেরু অঞ্চল থেকে বিষুবীয় অঞ্চল। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি বিশেষ উদ্ভিদ ব প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যায়। বর্তমানের অবস্থানের প্রেক্ষিতে এসব জীবাশ্ম রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে, তবে এদের উপস্থিতিই প্রমাণ করছে যে এরা পূর্বে একই ভূখণ্ডের অংশ ছিল। জীবাশ্ম বাদে ভূমির ধরন বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতেও সুপারকন্টিনেন্টের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে একই পাহাড়-পর্বতের অংশ পাওয়া যায়। যেমন- দ্য সেন্ট্রাল প্যানজিয়া পর্বতমালার কথাই ধরা যাক। সুপারকন্টিনেন্ট গন্ডোয়ানা এবং লরেশিয়া পরস্পরের সাথে ধাক্কা লাগার ফলে এরা যুক্ত হয় এবং এই অতি-মহাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বভাবতই একটি পর্বতশ্রেণীর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য তো থাকেই যা দিয়ে সেটি শনাক্ত করা যায়। একসময় পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, মরক্কোর আটলাস পর্বতমালা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালেচিয়ান পর্বতমালার মধ্যে প্যানজিয়া পর্বতমালার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
তবে এগুলোর অবস্থান আলাদা আলাদা মহাদেশে। তাছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বাংশ এবং আফ্রিক মহাদেশের পশ্চিমাংশের শিলা এবং মাটির ধরনেও রয়েছে মিল। এর মানে কোনো না কোনো একসময়ে অবশ্যই তারা পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল নতুবা এরকম সামঞ্জস্য পাওয়া সম্ভব হত না।
প্যানজিয়ার ভাঙন
আমাদের এই পৃথিবীর ভূখণ্ড সর্বক্ষণই ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, তবে খুবই ধীরে ধীরে। ভূত্বকের উপরে থাকা দুর্বল প্লেটগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে গেলে ভূখণ্ডে ভাঙন দেখা যায়। প্লেটগুলোর এই আন্দোলন বা ভাঙন বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্প, পাহাড়-পর্বতের গঠন, আগ্নেয়ক্রিয়া, পুরনো ভূত্বকের ভাঙন কিংবা নতুন ভূত্বকের গঠন ইত্যাদি। এগুলোর ফলে যেসব প্লেট সৃষ্টি হয় সেগুলো ভূত্বকেরই ভাঙা অংশ। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ১২টি প্রধান প্লেট রয়েছে। এসব প্লেট বছরে মাত্র আধা থেকে চার ইঞ্চি (১.৩ থেকে ১০ সেন্টিমিটার) পর্যন্ত অবস্থানের পরিবর্তন করতে পারে। পরিবর্তনটা যৎসামান্য। কিন্তু বছরের পর বছর এই ছোট ছোট পরিবর্তনের ফলাফল দাঁড়ায় অনেক বিশাল। আর এই সুপারকন্টিনেন্টের ভাঙা-গড়ার হিসাবটা কয়েক মিলিয়ন বছরের। তাই পরিবর্তনের হিসাবটাও বড়।
প্যানজিয়া ভাঙতে শুরু করে জুরাসিক যুগে তথা আজ থেকে প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। বিজ্ঞানীদের মতে, এর ভাঙনের পেছনের কারণ, আর বর্তমানে প্লেটগুলোর আন্দোলনের কারণ একই। ভূত্বকের উপরে পরিচলন বিদ্যুৎপ্রবাহই এর জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক কারণেই প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে সুপারকন্টিনেন্ট প্যানজিয়ায় ভাঙনের আরম্ভ হয়। শুরুতে এটি ভেঙে গিয়ে দুটি নতুন মহাদেশের সৃষ্টি করে- গন্ডয়ানা এবং লরেশিয়া। উল্লেখ্য, প্যানজিয়া গঠনের শুরুতেও এই দুটি মহাদেশের অবদান ছিল। অর্থাৎ এদের সংযুক্তির কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল প্যানজিয়া। আবার প্যানজিয়ার ভাঙনেও সৃষ্টি হয় এই দুটি ভূখণ্ড। আজ থেকে ১৩৫ মিলিয়ন বছর আগে লরেশিয়া ভাঙতে শুরু করে। পান্থশালা নামক বিশাল সমুদ্রের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখা না গেলেও নতুন একটি সমুদ্রের সমাগম ঘটে এই পৃথিবীর বুকে। উত্তর আমেরিকা ইউরেশিয়ান প্লেট থেকে আলাদা হয়ে গেলে বাকি ভূখণ্ড ও উত্তর আমেরিকার মাঝে আটলান্টিক মহাসাগরের উৎপত্তি হয়। পরবর্তীতে লরেশিয়া বাকি ভূখণ্ড ভেঙে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, গন্ডোয়ানা ভেঙে আফ্রিকা, এন্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্ভব ঘটে। এদিকে আবার আফ্রিকা থেকে আরব আলাদা হতে শুরু করে, যার ফলে লোহিত সাগরের উৎপত্তি হয়।
প্লেটগুলোর আন্দোলন এখনও বন্ধ হয়নি। ক্রমাগত এই প্রক্রিয়া চলছে এবং এই কারণে আটলান্টিক মহাসাগরের আকার বড় হচ্ছে এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আকার ছোট হচ্ছে। আজ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পর দেখা যাবে যে, আটলান্টিক মহাসাগরের তুলনায় প্রশান্ত মহাসাগর অনেক ছোট হয়ে দাঁড়াবে। ভবিষ্যতে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা পশ্চিম দিকে সরে যাবে। আফ্রিকার পশ্চিম দিক ঘড়ির দিকে ঘুরবে এবং ইউরোপের সাথে যুক্ত হবে। অন্যদিকে, আফ্রিকার পূর্বাংশ আরবীয় পেনিনসুলার দিকে সরে আসবে। আর নিউজিল্যান্ডের নতুন অবস্থান হবে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাংশে। বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যতে নতুন একটি সুপারকন্টিনেন্ট বা অতি-মহাদেশের সৃষ্টি হতে পারে। তবে এসব হিসাব শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের ধারণা। ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তার আসলে কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেখানে আজকে বা এখন কী হবে বা হতে যাচ্ছে তার নিশ্চয়তাই নেই, সেখানে আজ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পর কী হবে তা সঠিকভাবে ধারণা করা অসম্ভব। অবশ্য ধারণাগুলো নিতান্ত অযৌক্তিকও নয়।