মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো শারীরিক সুস্থতা। শরীর সুস্থ না থাকলে আমরা এক মুহূর্তও চলতে পারি না। আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি কোষ একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাঝে চলছে। কোনো কারণে এই নিয়মে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলে তার প্রভাব পুরো শরীরের উপর পড়ে। প্রত্যেকটা সেকেন্ডেই আমাদের শরীর প্রায় লক্ষ লক্ষ কাজ করছে। একজন গড়পড়তার মানুষ সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্তিতে ঠিকই রাতে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। তবে আমরা হাফিয়ে উঠলেও আমাদের শরীর কিন্তু কখনো থেমে থাকে না। ঘুমের মধ্যেও আমাদের স্বপ্নে নিমজ্জিত রেখে শরীর তার নানা বিপাকীয় প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে থাকে।
আমাদের দেহ প্রত্যেকটা মুহূর্ত কোনো না কোনো কাজ করতে থাকে। শরীরের সকল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে এর নানা উপাদান। অসুস্থ হলে কিংবা কোনো রোগ হলে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। শরীরের এমন নানা ক্রিয়ার মধ্যে অনেক কিছুই আছে যা সম্পর্কে আমাদের অনেকের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আজ এই লেখাটিতে মানবদেহ সম্পর্কে এমনই কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
১) আমাদের শরীরে যে ঘাম হয়, তাতে কিন্তু আসলে কোনো দুর্গন্ধ নেই। মূলত এই লবণাক্ত তরলে ত্বকের নানা ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। ঘাম থেকেই এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের খাদ্য লাভ করে। আর ঘামেই এদের বর্জ্য ত্যাগ করে। ব্যাকটেরিয়ার এই বর্জ্য থেকেই ঘামে দুর্গন্ধ হয়।
২) আমাদের শরীরের যেখানে হাড়ের সন্ধি আছে, যেমন- হাত, পা, ঘাড় ইত্যাদিতে আমরা কটমট শব্দ তৈরি করতে পারি। দুই হাতের আঙ্গুলগুলো একত্র করে ভাঁজ করলে এমন কটমট শব্দ হয়। একে আমরা হাত ফুটানো বলে থাকি। কখনো কী ভেবেছেন এরকম শব্দ কেন হয়?
আমাদের শরীরের সন্ধিতে একধরনের তরল থাকে। এদের সাইনোভিয়াল ফ্লুইড বলে। কোমড়, ঘাড় ও বাহুর সন্ধিগুলোতে এই তরলের বুদবুদ তৈরি হয়। সন্ধিতে আমরা যখন একটু চাপ প্রয়োগ করি, তখনই এই বুদবুদ ফুটে ওঠে আর শব্দ তৈরি হয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন হাড় ফুটানো শরীরের জন্য ক্ষতিকর কি না। প্রকৃতপক্ষে এর কোনো খারাপ প্রভাব নেই। তবে ক্রমশ এই কাজ করতে থাকলে লিগামেন্ট (হাড়ের নমনীয় সন্ধিস্থান) আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
৩) হেটেরোক্রোমিয়া একটি বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য, যার কারণে একটি প্রাণীর দুটি ভিন্ন রঙয়ের চোখ থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য বিরল হলেও কিছু প্রজাতির কুকুরের মাঝে এটি প্রায়ই দেখা যায়। বেশ কয়েকজন হলিউড অভিনেতার এই হেটেরোক্রোমিয়া রয়েছে।
৪) মস্তিষ্ক আমাদের দেহের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঙ্গ। কুঞ্চিত এই অঙ্গটিকে যদি সম্প্রসারিত করা হয়, তাহলে এটি একটি বালিশের সমান আকার ধারণ করতে পারে। আর ছয় বছর বয়সের মধ্যেই আমাদের মস্তিষ্ক প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
৫) যকৃত আমাদের দেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একে আমাদের শরীরের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। এই যকৃতের কিন্তু এক বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। কোনো দুর্ঘটনার কারণে বা সার্জারির সময় যদি যকৃতের অংশবিশেষ কেটে ফেলা হয়, তবে এটি আপনাআপনি কেটে যাওয়া অংশ পুনরুৎপাদন করতে পারে। এভাবে এটি একেবারে তার আগের স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসার ক্ষমতা রাখে।
৬) একটি সূচের মাথায় মানবদেহের প্রায় দশ হাজার কোষ স্থাপন করা সম্ভব।
৭) আমাদের শরীরে মাত্র একটি অঙ্গ রয়েছে যাতে রক্ত পরিবাহিত হয় না। আর এটি হলো আমাদের চোখের কর্নিয়া। সরাসরি বাতাস থেকে এটি নিজের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকলে কিন্তু তাতে আমাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে।
৮) আমাদের শরীরে যে পরিমাণ ফ্যাট রয়েছে, তা দিয়ে প্রায় সাতটি বড় আকৃতির সাবান তৈরি করা সম্ভব।
৯) একজন নারীর গর্ভধারণের তিন মাসের মধ্যেই ভ্রূণের ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি হয়ে যায়।
১০) জন্ম নেওয়ার সময় একটি নবজাতক ৩০০টি হাড় নিয়ে জন্মায়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এই সংখ্যা ২০৬-এ নেমে আসে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাচ্চার কিছু হাড় জোড়া লেগে একটি হাড়ে পরিণত হয়। আর আমাদের শরীরের মোট হাড়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ কেবল পায়ের পাতাতেই রয়েছে।
১১) আমরা যখন খুব লজ্জা পাই কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন হরমোন ক্ষরণ হয়। একই সাথে আমাদের হৃদকম্পনও বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ত্বকের রক্তনালীগুলোতে রক্তপ্রবাহ সামান্য পরিমাণে বাড়তে থাকে। একেই মূলত আমরা ‘লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া’ বলি।
১২) মানবদেহের কিছু টিউমার রয়েছে যেগুলোর নিজেদের দাঁত ও চুল তৈরি হতে পারে। এ ধরনের টিউমারকে টেরাটোমা বলে।
১৩) মানুষের শরীরের বায়োলুমিনিসেন্স ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ শরীর থেকে অতি অল্প পরিমাণে আলো নির্গত হয়। তবে এটি খালি চোখে দেখা যায় না।
১৪) মহাকাশে ভ্রমণরত নভোচারীদের উচ্চতা প্রায় দুই ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ভরশূন্য পরিবেশে থাকার কারণে তাদের মেরুদন্ড সামান্য পরিমাণে সম্প্রসারিত হয়। তবে পৃথিবীতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এই উচ্চতা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।
১৫) আমাদের মস্তিষ্ক সর্বোচ্চ দশ মিনিট অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে।
১৬) অনাহারে থাকার মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে আমাদের মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করতে শুরু করে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও নিউরনের কোষ নিজেরাই নিজেদের ভক্ষণ করে। এই প্রক্রিয়াকে অটোফেজি বলে।
১৭) মানবদেহের ক্ষুদ্রান্ত্র দেহের ভেতর প্যাচানো অবস্থায় থাকে। একে সম্প্রসারণ করলে প্রায় ২৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
১৮) আমাদের দেহে জোড়ায় জোড়ায় যত অঙ্গ রয়েছে, তাদের যেকোনো একটি বাদ দিলেও আমরা বেঁচে থাকতে পারবো।
১৯) আমাদের দেহে প্রায় এক লক্ষ মাইলের সমপরিমাণ রক্তশিরা রয়েছে।
২০) আমরা একইসাথে নিঃশ্বাস নিতে ও খাদ্য গলাধঃকরণ করতে পারি না। এর চেষ্টা করাও কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ শ্বাসনালীতে খাদ্য প্রবেশ করার ঝুঁকি রয়েছে।
২১) আমাদের শরীরের ভেতর বাম কিডনি ডান কিডনি হতে সামান্য উপরে অবস্থিত।
২২) গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, অমনোযোগিতা ইত্যাদি বেড়ে যায়। এ সময় তাদের মস্তিষ্কও কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
২৩) আমাদের পাকস্থলীতে যে এসিড থাকে, তা ধাতু গলিয়ে দিতে সক্ষম। আবার এই এসিড আমাদের ত্বকের উপর ফেললে তা ত্বক পুড়ে ভেতরে চলে যাবে।
২৪) জীবনের কোনো না কোনো সময় ঠিকই আমাদের শরীর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করেছে।
২৫) একজন মানুষ তার পুরো জীবনে যতটুকু মুখের লালা উৎপন্ন করে, তা দিয়ে অন্তত দুটি সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব।
২৬) মানুষের ফিংগার প্রিন্টের মতো জিহ্বার প্রিন্টও একজনেরটা আরেকজনের থেকে আলাদা।
২৭) ছোট শিশুরা মিনিটে এক কী দুবার চোখ পিট পিট করে, যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মিনিটে দশবার এই কাজটি করে।
২৮) আমাদের উরু বা রানের হাড় ফিমার হলো পুরো শরীরের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ।
২৯) আমাদের মস্তিষ্ক একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর সমান বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে।
৩০) একটি ক্যামেরার ক্ষমতা অনুযায়ী বিচার করলে আমাদের চোখ ৫৭৬ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার সমান।
৩১) এখন পর্যন্ত জ্বর হওয়ার কারণে দেহের তাপমাত্রা ১১৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
৩২) আমাদের হাতের সমস্ত শক্তির প্রায় অর্ধেক আসে আমাদের কনিষ্ঠ আঙ্গুল থেকে।
৩৩) পুরুষদের অন্ডকোষ শরীরের বাইরে থাকে, কারণ দৈহিক তাপমাত্রায় শুক্রাণু বাঁচতে পারে না।
৩৪) মানুষ কখনো ঘাস হজম করতে পারে না। এর কারণ হলো, ঘাসের মধ্যে যে বিটা সেলুলোজ থাকে, তা ভাঙার মতো এনজাইম মানুষের পাকস্থলীতে থাকে না, যে এনজাইম কিনা গরু, ছাগল ইত্যাদি তৃণভোজী প্রাণীর থাকে।
৩৫) একজন গড়পড়তা মানুষের নাভিতে প্রায় ৬৭ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে।
৩৬) প্রতি বছর আমাদের অন্তত চার কেজির সমপরিমাণ ত্বকের কোষ ঝরে যায়।
৩৭) মানুষের দাঁত একটি হাঙরের দাঁতের সমপরিমাণ শক্তিশালী।
৩৮) আমাদের শরীরের প্রায় ৮ শতাংশ ওজন আসে আমাদের রক্ত থেকে।
৩৯) যে এনজাইমগুলো মানুষকে তার খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে, মৃত্যুর পর সেই এনজাইমগুলোই মৃতদেহকে পরিপাক করা শুরু করবে।
৪০) আমাদের পাকস্থলীর আবরণ ৩-৪ দিনের মধ্যে আপনাআপনি পরিবর্তিত হয়, যাতে পাকস্থলী নিজেই নিজেকে পরিপাক করে না ফেলে।
অত্যন্ত রহস্যময় বস্তু আমাদের এই শরীর। এর প্রত্যেকটি অংশ অনেক সূক্ষ্মভাবে নকশা করা। এই দেহ সম্পর্কে মানুষ কখনোই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য উদঘাটন করছে। আমাদের নিজেদের কাছে আমাদের শরীরের অগ্রাধিকার সবচেয়ে বেশি। এই শরীরের প্রত্যেকটি কোষ নিরলসভাবে কাজ করছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য।