X এর জীবনটা ঠিকঠাকই চলছিলো। এক-চতুর্থাংশ মার্কের ব্যবধানে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেলো। অতঃপর অাকন্ঠ ডিপ্রেশনে ডুব। তবে যাত্রাটা খুব একটা দীর্ঘায়িত হলো না। নিন্দুকদের সকল অাশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত করে সে ভর্তি হলো একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকে সব ব্যাপারে X এর বেজায় অাগ্রহ। গ্রুপ চ্যাট থেকে শুরু করে ক্লাসমেটদের টাইমলাইন, সবখানেই তার সরব উপস্থিতি।
একদিন ওদের ব্যাচের সবচেয়ে সপ্রতিভ মেয়েটি (যার প্রতি X খানিকটা দুর্বলও!) গ্রুপ ডিসকাশনের মাঝে X কে চা খাওয়ালো। সেই রাতে আনন্দে ওর ঘুম হলো না। সহপাঠিনীর সাথে চা-পান নিঃসন্দেহে অন্যরকম অনুভূতি, কিন্তু এজন্য আনন্দে সারারাত ঘুম হবে না- এমনটা হবার কথা নয়। কিন্তু X এর বেলায় সেরকমটিই হলো। রাতটা ওর খুব ভালো কাটলো। পরের দিনটাও। প্রায়ই এমনটা হতে লাগলো। তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু অাত্মতৃপ্তিটা বিশাল। মনে অাত্মবিশ্বাসী একটা ভাব। অনুভূতিটা এমন যে, ওর মতো সৃজনশীল সচরাচর হয় না। তাই চাইলেই ওর পক্ষে যেকোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব।
কিছুদিন এভাবে চলার পর X এর মনে হতে লাগলো, “এগুলো শুধুই অাদিখ্যেতা! এগুলোর কি কোনো দরকার অাছে!” শুরু হলো নিজেকে খোলসবন্দী করার এক নিরন্তন চেষ্টা, যা ওর ’অসামাজিক’ খেতাবটিকেই প্রতিষ্ঠিত করলো।
ক্রমেই X খেয়াল করলো, মুড সুইংয়ের পিংপং বলের এই কোর্টটা অারো সরু হয়ে যেতে শুরু করেছে। অার অাত্মবিশ্বাস? ওয়ান মিনিট অাপ, তো নেক্সট মিনিট ডাউন। খাচার ভেতর অচিন পাখির এমন যাতায়াত অাশেপাশের মানুষের কাছেও প্রকট হয়ে উঠতে লাগলো। এতে করে ‘খেয়ালী মানুষ’ খেতাবটাও কপালে জুটতে বাদ থাকলো না।
চোখের নিচে কালি পড়া শীর্ণকায় ছেলেটির দিকে তাকালে কে বলবে, এ ছেলে একসময় প্রাণোচ্ছল অার হাস্যোজ্জ্বল ছিলো? বিষয়টা পরিবারের নজর এড়ালো না। সন্দিহান পিতা ছেলেকে নিয়ে গেলেন একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। দীর্ঘ সিটিং শেষে তিনি জানালেন, ও বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ভূগছে।
মুড সুইংয়ের কথা তো অামরা সকলেই জানি। এই মন ভালো, তো এই মন খারাপ। কিন্তু মুড সুইংয়ের পেন্ডুলামটা যখন একটু বেশি জোরে দুলতে শুরু করে, তখনই মুখোমুখি হতে হয় এক নতুন পরিস্থিতির, যার নাম ‘বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার’ (BMD) বা ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’।
বাংলায় একে বলে ‘দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য’। একদিকে ডিপ্রেসিভ কন্ডিশনের কারণে ব্যক্তি প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভোগে। অন্যদিকে ম্যানিক কন্ডিশনের কারণে ব্যক্তি অতিরিক্ত আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে থাকে। অবাক করা বিষয় হলো, এ দুটোই ঘটে যথোপযুক্ত কারণ ছাড়া।
ইতিহাস
রোগটি অনেক পুরোনো হলেও এর ইতিহাসটা দীর্ঘ নয়। যুগে যুগে এই ব্যাধিটি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মনে কৌতুহলের উদ্রেক করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে থিওফেলাস বনেট নামক একজন বিজ্ঞানী এই রোগকে “ম্যানিকো মেলাঙ্কোলিকাস” নামে অভিহিত করেন। এরপর ১৮৫১ সালে ফরাসি মনোচিকিৎসক জ্যঁ পিয়েরে ফ্যাল্রেত তার একটি বইয়ে ‘ম্যানিয়া’ ও ‘ডিপ্রেশন’ পর্যায়ের ওপর বিস্তারিত অালোকপাত করেন, যাকে বাইপোলারিটি নির্ণয়ের প্রথম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এছাড়া এই রোগের শ্রেণীবিন্যাসে ক্রেপলিনেরও (১৯২১) অবদান ছিলো। তবে জার্মান মনোচিকিৎসক কার্ল লিওনার্দো ও তার সহযোগীরা ১৯৫০ সালে BMD-কে ভালোভাবে অনুধাবনের উদ্দেশ্যে একটি পেশাদার শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি প্রস্তুত করেন। ১৯৮০ সালে আমেরিকান সাইক্রিয়াট্রিস্ট অ্যাসসিয়েশনের ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল রোগটির নামের সাথে ‘বাইপোলার’ শব্দটি যোগ করে।
শ্রেণীকরণ
আচরণগত বৈশিষ্ট্যের তীব্রতা অনুযায়ী BMD কে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- Bipolar I, Bipolar II, Mixed State, Rapid Cycling, Cyclothymia এবং Psychosis।
এছাড়া বিশ্লেষকরা বাইপোলারিটির চারটি পর্যায় বা স্টেজ দেখতে পেয়েছেন, যেগুলো হচ্ছে-
১. ম্যানিক পর্যায় (Manic Episodes)
ম্যানিক পর্যায় বা ম্যানিয়া হলো বাইপোলারিটির প্রথম স্তর। প্রথম লক্ষণও বলা যায়। পরিপার্শ্বের সাথে সামাজিক যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া কমে যাবার সাথে সাথে ম্যানিয়ার মাত্রা বাড়তে থাকে। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তা তিন থেকে ছ’মাস পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।
চরম পর্যায়ে চলে গেলে ব্যক্তির মনে এই উপলব্ধি জাগে যে তিনি হলেন “The chosen one”, এবং তাকে পৃথিবীতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ বাইপোলার এ ধরনের ডিল্যুশন কিংবা হ্যালুসিনেশনে ভুগে থাকেন, যা স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় রূপ নিতে পারে।
উপসর্গ
১) আচরণে অাবেগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ।
২) কথার্বাতায় অাগ্রাসী মনোভাবের প্রতিফলন।
৩) বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অস্বাভাবিক রকমের অার্কষণ অনুভব বা হাইপারসেক্সুয়ালিটিতে ভোগা।
৪) নিদ্রাহীনতা ও ছটফটানির মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
৫) বিচারবোধে তীক্ষ্ণতা বা দুর্বলতা প্রদর্শন।
২. ডিপ্রেশন পর্যায় (Depression Episodes)
ম্যানিক পর্যায় উত্তরণের সাথে সাথে ডিপ্রেশন পর্যায় শুরু হয়। নিজেকে পদে পদে অপ্রয়োজনীয় অার অপাংক্তেয় মনে হতে অারম্ভ করে। এ পর্যায়ের প্রধান লক্ষণ হীনমন্নতায় ভোগা। চারদিকের সবাইকে পর মনে হয়। একে একে দুঃখবোধ, উৎকণ্ঠা, অপরাধবোধ, ক্রোধ, একাকিত্ব, অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে।
অবস্থা খুব চরমে গেলে আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগে; প্রথমদিকে আত্মহত্যার বিস্তর পরিকল্পনায় সময় কাটে। এর চেয়ে বেশিদূর এগোয় না। কিন্তু কেউ কেউ একপর্যায়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী তা করেও ফেলেন।
উপসর্গ
১) কম কথা বলা ও ঘন ঘন বিরতি নেয়া।
২) চ্যাটে কিংবা মুখোমুখি কথাবার্তায় বিষাদপূর্ণ মন্তব্য বা কবিতার ব্যবহার।
৩) নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা।
৪) সচরাচর যেগুলো ভালো লাগে, সেগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
৩. হাইপোম্যানিয়া পর্যায় (Hypomania Episodes)
ম্যানিয়ার লঘুতর মাত্রাকে হাইপোম্যানিয়া বলে। এটি ব্যক্তির সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় কোনো প্রভাব ফেলে না। একে ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধে একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম বলা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাইপোম্যানিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে বাড়তি সৃজনশীলতার পাশাপাশি বিচারবোধে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়।
৪. মিশ্র পর্যায় (Mixed affective episodes)
এ পর্যায়ে একইসাথে ম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশন অনুভূত হয়। একদিকে বড় বড় পরিকল্পনা মাথাচাড়া দেয়, অন্যদিকে নানা অপ্রাপ্তির বেদনা অার অনুশোচনায় মন অপরাধবোধে ভোগে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা সৃজনশীল পেশার সাথে জড়িত (সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, নাট্যকার, নির্মাতা, চিত্রশিল্পী প্রমুখ), তাদের বাইপোলারিটিতে আক্রান্ত হবার অাশঙ্কা অনেক। মার্কিন মনোচিকিৎসক এবং লেখক কাই রেডফিল্ড জেমিসন, (যিনি নিজেও একজন BMD ভিকটিম) ১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমির ৪৭ জন লেখক এবং চলচ্চিত্র কলাকুশলীর ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জনেরই বাইপোলারিটি পজিটিভ পাওয়া গেছে।
ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে এরকম অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে, যারা BMD আক্রান্ত হয়ে শেষে আত্মহত্যা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলফ এর নাম। তিনি BMD আক্রান্ত ছিলেন এবং শেষমেশ অাত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
চিকিৎসা
এ পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে, রোগটির কি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব? এ ব্যাপারে মনোবিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ‘সম্ভব’, অাবার কারো মতে ‘সম্পূর্ণ নিরাময় নয়, তবে উপসর্গগুলো প্রশমিত করে রাখা যায়।’
কয়েক ধরনের ওষুধ দিয়ে ম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশন পর্যায়ের একসঙ্গে চিকিৎসা করা হয়। এছাড়া ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার জন্য অ্যান্টিডিপ্রেশন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ম্যানিয়ার চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়।
অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধগুলো ম্যানিয়া থেকে নামিয়ে ডিপ্রেশন পর্যায়ে নিয়ে আসে। ডিপ্রেশন অথবা ম্যানিয়া- কোনোটিই যেন রোগীকে পেয়ে না বসে, সেজন্য মুড স্ট্যাবিলাইজার দেওয়া হয়।
অামাদের সমাজে যারা বাইপোলার, তাদের প্রতিটি পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। সামাজিক মেলামেশা থেকে শুরু করে নানা সম্পর্ক ঠিক রাখতেও বেগ পেতে হয় তাদের। পরস্পরবিরোধী মনোভাবের কারণে তারা কাছের মানুষের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়। ডিপ্রেসিভ অবস্থায় চলে গেলে কেউ সম্পর্কছেদ করে, কেউ অাত্মহত্যার পথে পা বাড়ায়। অাবার ম্যানিয়ার কারণে গুরুতর অপরাধের দিকেও ঝুঁকে পড়তে কুন্ঠাবোধ করে না। অথচ কেবল ভালোবাসাই পারে সমস্যাটির নিরাময় করতে।