বিশ্বজুড়ে করোনার গতি কমে এসেছে, তবে এখনও মৃত্যুর মিছিল পুরোপুরি থামেনি। ভ্যাক্সিন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়ে গেছে বৈষম্য। ফলে ভয় আছে হয়তো হঠাৎ করেই আবার নতুন করে করোনার ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে। অনেকদিন বন্ধ রাখা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগাক্রান্তের সংখ্যাতেও বাড়তিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এমতবস্থায় প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রতিকারও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এর পেছনে ভ্যাক্সিন না নেয়ার ব্যাপারে বহু মানুষের অনীহাও কাজ করছে। উপযুক্ত কোনো ওষুধ না থাকায় ভ্যাক্সিন সন্দেহবাদিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক কিছু কোভিড-১৯ দূর করে বলে দাবি করছেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অনুমোদিত একমাত্র ওষুধ রেমডিসিভির। এর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ধরনের কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুযোগ আছে। সমস্যা হলো, এগুলো সবই শিরাপথে প্রয়োগের জন্যে, যা কেবল হাসপাতালে ভর্তি খারাপভাবে আক্রান্ত কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
কিন্তু এর বাইরেও আরও যে বহুসংখ্যক মানুষ কোভিডের হালকা বা মাঝারি ধরনের লক্ষণ প্রকাশ করছেন, তাদের কেবল সাধারণ সতর্কতা মানা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত তাদের জন্য অনুমোদিত হয়নি। অথচ এই মানুষগুলোই একপর্যায়ে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। তখন সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও হয়তো অনেককে বাঁচানো সম্ভব হয় না। আবার দলে দলে এই কোভিড রোগীরা হাসপাতালমুখী হতে থাকলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরও প্রবল চাপ পড়ে, ফলে অনেকেই উপযুক্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।
এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই গবেষণা করছে মুখে খাবার একটি বড়ি তৈরি করতে, যা হাসপাতালে না আসা এই কোভিড রোগীদের সেরে উঠতে সাহায্য করবে। ফলে মৃত্যুহার যেমন কমবে, তেমনি স্বাস্থ্যব্যবস্থাও কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবে। এ ধারায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে জার্মান আন্তর্জাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি মার্ক সেরোনো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিক্স। তাদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি মলনুপিরাভির (Molnupiravir) এই রোগীদের জন্য বেশ কার্যকর বলে পরীক্ষায় ফল এসেছে।
পেছনের কথা
মলনুপিরাভির একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। এর আবিষ্কার খুঁজতে চলে যেতে হবে আরো প্রায় আঠার বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা শহরের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এমোরি পরিচালিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ড্রাইভে’র (DRIVE-Drug Innovation Ventures ) কাছে।
ড্রাইভ মূলত একটি অলাভজনক বায়োটেক সংস্থা, যারা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিয়ে কাজ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক্ষেত্রেই কিন্তু নিজেরা ওষুধ আবিষ্কার করে না। বহু হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বাধীন গবেষণা সংস্থা নিজ উদ্যোগে নানারকম রোগ নিয়ে অনুসন্ধান করে। তাদের লক্ষ্যই থাকে এমন কোনো একটি উপাদান খুঁজে বের করা, যা সেই রোগের চিকিৎসায় কাজ করবে। তাদের কাছে যখন সেরকম কোনো উপাদান আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয় তারা তখন ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন। কারণ একটি ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ ও অর্থের দরকার, তাদের সেই সক্ষমতা নেই। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো চুক্তি করে এসব উপাদান নিয়ে কাজ করে। এবং কখনো কখনো তারা সফল হয় এটা থেকে একটি ওষুধ বানাতে।
ড্রাইভও ঠিক এভাবেই কাজ করে। তারা ২০০৩ সালে এমন একটি পদার্থের সন্ধান পান যা কিনা বিভিন্নরকম আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কিন্তু এটি মুখে খাবার যোগ্য ছিল না, এবং তারা দেখতে পান প্রাণীকোষে এর দ্বারা মিউটেশন ঘটতে পারে। ফলে সমস্ত তথ্য ডাটাবেসে রেখে তারা আর অগ্রসর হলেন না।
২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি (The Defense Threat Reduction, যারা গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে কাজ করে) ভেনেজুয়েলান এনকেফালাইটিস ভাইরাস (Venezuelan equine encephalitis virus) একটি আরএনএ ভাইরাসের কার্যকরী প্রতিষেধক প্রস্তাব করতে দরপত্র আহ্বান করে। এই ভাইরাস জীবাণু অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগের ভয় ছিল।
উৎসাহিত ড্রাইভের গবেষকরা এবার তাদের তথ্যকেন্দ্র ঘেঁটে দশ বছর আগের সেই উপাদানের সন্ধান পেলেন। তারা এর রাসায়নিক গঠনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। ফলে এটি পরিণত হলো প্রোড্রাগ নামে একটি বস্তুতে, যা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মানবশরীরে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে এটি সক্রিয় হয়। এর সাংকেতিক নাম হয় EIDD-2801, যা আমরা এখন মলনুপিরাভির নামে জানি।
মলনুপিরাভির নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় যে এটি বেশ কয়েক রকম আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম। বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা সারাতে এর কার্যক্ষমতা নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক ফলাফল দেখা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ সংস্থা (National Institute of Allergy and Infectious Diseases,NIAID) মলনুপিরাভির নিয়ে আরো পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়।
২০১৯ সালের শেষদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জার উপর মলনুপিরাভির নিয়ে মানবদেহে পরীক্ষা চালাতে ড্রাইভের গবেষকেরা এফডিএ’তে আবেদন চূড়ান্ত করার পর্যায়ে ছিলেন। এমন সময় আঘাত হানল করোনাভাইরাস। করোনা ছিল আরএনএ ভাইরাস। ফলে ড্রাইভ কোভিডের উপর মলনুপিরাভিরের প্রভাব দেখতে সংকল্পবদ্ধ হলো।
তবে ড্রাইভ নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ছিল সচেতন। কোভিড বিষয়ে পরীক্ষা চালাতে যে অর্থ ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তার যোগান দিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তারা চুক্তি করল রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিক্সের সঙ্গে। শুরু হলো নতুন যাত্রা।
মলনুপিরাভির নিয়ে মানবদেহে পরীক্ষা
রিজব্যাক ড্রাইভের সাথে প্রথম ধাপের পরীক্ষা (phase I) সম্পন্ন করে। এতে মানবশরীরে মলনুপিরাভিরের বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি এটাও প্রতীয়মান হয় যে খারাপ কোনো প্রতিক্রিয়া মলনুপিরাভির সৃষ্টি করছে না।
রিজব্যাক উপলব্ধি করল তারা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের দোরগোড়ায়। কিন্তু এটাও তারা বুঝতে পারল যদি তাদের এই ওষুধ সত্যিই কোভিডে কার্যকর হয়, তাহলে যে বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার সামর্থ্য রিজব্যাকের মতো ছোট কোম্পানির নেই। ফলে তারা জোট বাঁধল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মার্ক সেরোনোর সাথে।
মার্ক ও রিজব্যাক দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ করে ২০২১ সালের মার্চে একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত সম্মেলনে ফলাফল উপস্থাপন করে। ১৭৫ জন কোভিড রোগীর উপর এই পরীক্ষায় মলনুপিরাভির প্রাথমিকভাবে করোনাকে ঘায়েল করতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হয়।
মার্ক এবার তৃতীয় বা অনুমোদনের আবেদন দাখিলের চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার তোড়জোড় শুরু করে। প্রায় ৩,০০০ স্বেচ্ছাসেবী নেবার কথা ছিল। তবে প্রাথমিকভাবে তারা ৭৭৫ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে। এরা সকলেই হালকা বা মাঝারি ধরনের কোভিডে আক্রান্ত এবং তাদের লক্ষণ দেখা দিয়েছে পাঁচ দিনের মধ্যে। এরা কেউই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন না এবং তারা ভ্যাক্সিনও নেননি।
৭৬২ জন শেষপর্যন্ত ওষুধ পান, যাদের ৩৮৫ জন মলনুপিরাভির এবং ৩৭৭ জন পেয়েছিলেন প্ল্যাসেবু। মলনুপিরাভির দেয়া হয়েছিল দুটি করে দু’বেলা দৈনিক চারটি হিসেবে পাঁচ দিন, মোট বিশটি বড়ি। অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফলে দেখা যায় মলনুপিরাভির মৃত্যুঝুঁকি এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রবণতা শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ কমিয়ে দেয়। মলনুপিরাভির যারা নিয়েছিল তাদের মধ্যে কোনো মৃত্যু দেখা যায়নি, কিন্তু প্ল্যাসেবুপ্রাপ্তদের আটজন মৃত্যুবরণ করেন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও দুই দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো ফারাক ছিল না।
প্রতিটি চিকিৎসা গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য পর্যবেক্ষণ করতে বাইরে থেকে কাজ করে বিশেষজ্ঞদের একটি দল। মার্কের অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল দেখে তারা অবিলম্বে পরীক্ষা বন্ধ করতে মত দেন। কারণ মলনুপিরাভিরের এরকম কার্যকারিতার পর প্ল্যাসেবু দিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া স্বীকৃত রীতিনীতির (GCP/ Good clinical practice) পরিপন্থী।
মার্ক একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মধ্য দিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। তবে এখন অবধি সমস্ত তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি। তবে মার্কের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এফডিএ’র সাথে কাজ করছেন যাতে জরুরি ভিত্তিতে হালকা বা মাঝারি লক্ষণ দেখানো কোভিড রোগীদের জন্যে ওষুধটি অনুমোদন পায়। আগেই বলা হয়েছে, এসব রোগীর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো অনুমোদনপ্রাপ্ত ওষুধ নেই।
উৎপাদন
মার্ক এরই মধ্যে মলনুপিরাভিরের বাণিজ্যিক উৎপাদন আরম্ভ করেছে। তারা বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ১০ মিলিয়ন কোর্স বানানোর আশা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাদের সাথে চুক্তি করেছে যে এফডিএ’র অনুমতি পেলে তারা ১.৭ মিলিয়ন কোর্স কিনে নেবে, যার মাথাপিছু দাম পড়বে ৭০০ মার্কিন ডলার। এই দাম রেমডিসিভির আর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির তুলনায় অনেক কম।
বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা মার্কের ঘোষিত ফলাফলের ব্যাপারে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি একে আশাব্যঞ্জক বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাইমন ক্লার্কের ভাষায় মলনুপিরাভিরের প্রাথমিক ফলাফল উচ্ছ্বসিত হবার মতো। তবে তথ্যের স্বাধীন যাচাই দরকার আছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার হর্বি বলেছেন, মলনুপিরাভির কোভিড চিকিৎসায় দারুণ অগ্রগতির সংকেত দিচ্ছে, তবে সত্যিই এটি কতটুকু ভাল তা প্রমাণিত হবে যখন গবেষণাগার থেকে বাইরের পৃথিবীতে এর প্রয়োগ আরম্ভ হবে।
যা-ই হোক না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে মলনুপিরাভির আমাদের সামনে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ভ্যাক্সিনের বাইরে রোগের চিকিৎসা করার ওষুধের দরকার আছে, আর সেখানে বাড়িতে থাকা মিলিয়ন মিলিয়ন কভিড রোগীর কষ্ট ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে এমন কিছুরই প্রয়োজন।