গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রোর বাংলায় প্রকাশিত এক লেখায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মডার্না আর ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি কোভিড ভ্যাক্সিনের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সময় পর্যন্ত সাতটি ভ্যাক্সিন বিভিন্ন দেশে অনুমোদিত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুটি, চীনের তিনটি এবং রাশিয়ার দুটি। তবে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব চিন্তা করে আরো অনেকেই কিন্তু কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ৬৪টির মতো ভ্যাক্সিন এখনও মানবশরীরে পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার অন্তত ১৯টি পৌঁছেছে তৃতীয় ধাপের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। বিভিন্ন দেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরও যাচাইবাছাই চালিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন ভ্যাক্সিনের।
২৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পর কানাডা দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মডার্নার ভ্যাক্সিন অনুমোদন করে, এবং এই দুটি দেশই তাদের জনগোষ্ঠীর উপর দুটি টিকাই প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঔষধ বিষয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি বা ইএমএ-ও পূর্ণোদ্যমে মডার্নার তথ্য যাচাইবাছাই করছে। সব ঠিক থাকলে জানুয়ারির প্রথম ভাগেই তারা ইউরোপে কোভিডের দ্বিতীয় টিকা হিসেবে মডার্নার ভ্যাক্সিন অনুমোদন করবে।
গত লেখাতেই আলোচনা করা হয়েছিল যে মডার্না আর ফাইজারের ভ্যাক্সিনের মূল সমস্যা হচ্ছে উৎপাদনকারী স্থান থেকে প্রয়োগের স্থানে এর পরিবহন ও সংরক্ষণ, যা ফাইজারের ক্ষেত্রে অধিকতর কঠিন। দুটি ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেই এজন্য বেশ নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন হবে। সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণের সময়সীমাও বেশ সীমিত। এই সমস্যাগুলোর পেছনে মূল কারণ ছিল মডার্না আর ফাইজারের ভ্যাক্সিনের অপ্রথাগত প্রস্তুত পদ্ধতি। এমআরএনএভিত্তিক ভ্যাক্সিন তারাই সর্বপ্রথম বাজারে আনল। সেগুলোর মূল্যও কিন্তু কম নয়। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার দুই ডোজের প্রতিটির জন্য খরচ পড়বে ১৮-২০ মার্কিন ডলারের মতো, সেখানে মডার্নার ভ্যাক্সিনের দাম প্রায় দ্বিগুণ, ৩৭ মার্কিন ডলার।
যদিও উন্নত বিশ্বের সরকার জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যেই ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করছে, তবে ঔষধ কোম্পানিকে দাম তো পরিশোধ করতে হবে। সেই অর্থ আসবে সরকারের পকেট থেকে, যার পরিমাণ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সুতরাং উন্নয়নশীল দেশ, যেমন বাংলাদেশসহ দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে কিন্তু এসব ভ্যাক্সিন কেনা কষ্টকর। তাছাড়া এগুলো পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোরও আমাদের দেশে অভাব রয়েছে। এজন্য সবাই তাকিয়ে ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে তৈরি কোভিড ভ্যাক্সিনের দিকে। প্রথাগত পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত এই ভ্যাক্সিনের মূল্য হওয়ার কথা অনেক কম এবং সাধারণ ফ্রিজেই দীর্ঘ সময় এর রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। চীন এবং রাশিয়ার সুলভ মূল্যের টিকাগুলোর বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন থাকায় বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের টিকা হতে পারে এক সম্ভাব্য বিকল্প।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সরকারি ঔষধ কর্তৃপক্ষ এমএইচআরএ প্রথম অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে। তবে তাদের এই টিকা উত্তর আমেরিকাতে অনুমোদন পেতে আরেকটু বেশি সময় লাগবে, কারণটি নিচের আলোচনায় চলে আসবে। এরপর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত নতুন বছরের পয়লা জানুয়ারি সরকারি একটি বিশেষজ্ঞ দলের বিচার-বিশ্লেষণ শেষে জরুরি ব্যবহারের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ড (Covishield) নামে অবিলম্বে জনগোষ্ঠীর উপর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
সবথেকে বেশি কোভিড আক্রান্তের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের এই সিদ্ধান্ত অনুমিতই ছিল। ফাইজারের ভ্যাক্সিন এবং কোভ্যাক্সিন নামে ভারত বায়োটেক (Bharat Biotech) ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের স্থানীয়ভাবে তৈরি করা একটি টিকাও অনুমোদনের পথে রয়েছে, খুব সম্ভব সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এই দুটিও অনুমতি পেয়ে যাবে।
কীভাবে কাজ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন
অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড কোভিডের টিকা তৈরিতে নতুন কোনো রাস্তা অনুসরণ না করে হেঁটেছে চিরচেনা পথেই। বাজারে যেসব ভ্যাক্সিন পাওয়া যায় সেগুলোর একটি বড় অংশই বানানো হয় রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর কোনো অংশ ব্যবহার করে, সম্পূর্ণ জীবাণু থাকে না বলে এর রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা নেই। এই অংশ মানবদেহে প্রবেশ করালে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা, বা ইমিউন সিস্টেম একে চিনে রাখে। পরবর্তীতে যখন পূর্ণ জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়ে তখন ইমিউন সিস্টেম তড়িৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলে খুব সহজে।
এই অ্যান্টিবডি তখন জীবাণুদের ধরে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তবে জীবাণুর অংশ শরীরে সরাসরি প্রবেশ করানো যায় না, একে মানবকোষে বহন করে নিয়ে যেতে দরকার হয় একটি বাহক বা ভেক্টরের। ভেক্টর হিসেবে সাধারণত এমন একটি ভাইরাস ব্যবহার করা হয় যা মানবশরীরে রোগ সৃষ্টি করে না, অথবা যার রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন প্রচলিত এই পদ্ধতিতেই প্রস্তুত করা। ভেক্টর হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে অ্যাডেনোভাইরাস নামে এক ভাইরাস প্রজাতি। অ্যাডেনোভাইরাস আমাদের সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দায়ী। অক্সফোর্ডের গবেষকদল এমন একটি অ্যাডেনোভাইরাস বেছে নিয়েছেন যা শুধুমাত্র শিম্পাঞ্জির দেহে সর্দি-কাশি তৈরি করে থাকে। তবে চূড়ান্ত সাবধানতার খাতিরে জিনগত কারিকুরি করে এই অ্যাডেনোভাইরাসকেও দুর্বল করা হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই তা মানবদেহে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে না পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করে এর আগে ইবোলা, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের ভ্যাক্সিন তৈরির প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছে, তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন অবধি কোনো অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টরবাহী ভ্যাক্সিন অনুমোদন করেনি।
ভেক্টর অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের হাতে অনেক আগে থেকেই ছিল, দরকার শুধু করোনাভাইরাসের কোন অংশটি ভ্যাক্সিনে ব্যবহৃত হবে তা নির্ধারণ। চীনের বিজ্ঞানীরা যখন করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জেনেটিক মানচিত্র প্রকাশ করেন, এরপর সেখানে থেকে বেছে নেয়া হলো স্পাইক প্রোটিন। এই স্পাইক প্রোটিন করোনাভাইরাসের বহিরাবরণ থেকে উত্থিত বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূচাল অংশ, যা জীবকোষ আঁকড়ে ধরে সংক্রমণ নিশ্চিত করে। ফাইজার আর মডার্না সরাসরি স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার না করে এই প্রোটিন তৈরির অন্যতম কারিগর, এমআরএনএ দিয়ে তাদের টিকা বানিয়েছে। অক্সফোর্ড সরাসরি স্পাইক প্রোটিনকেই জুড়ে দিয়েছে ভেক্টর অ্যাডেনোভাইরাসের সাথে। উদ্দেশ্য কিন্তু একই। মানবকোষে প্রবেশ করলে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে স্পাইক প্রোটিনের অনেক কপি তৈরি হবে। এতে তৎপর হয়ে উঠবে আমাদের ইমিউন সিস্টেম, তৈরি করবে ভাইরাস বিধ্বংসী অ্যান্টিবডি। এরা মেরে কেটে সাফ করে ফেলবে স্পাইকবাহী অ্যাডেনোভাইরাসকে। পরবর্তীতে করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তারও পরিণতি হবে একই।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনের পেছনের কথা
অক্সফোর্ডের গবেষকরা বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন একটি ভেক্টর তৈরির চেষ্টা করছিলেন, যা বিভিন্ন রোগের ভ্যাক্সিন বানাতে ব্যবহার করা সম্ভব। শুধুমাত্র উদ্দিষ্ট জীবাণুর অংশ এই ভেক্টরের উপর বসিয়ে দিলেই টিকা হয়ে যাবে। এতে ভ্যাক্সিন প্রস্তুতের সময় ও খরচ দুটোই কমবে। এজন্য অ্যাডেনোভাইরাস নিয়ে তারা কাজ করছিলেন।
২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া শ্বাসতন্ত্রের একটি রোগে (Middle East respiratory syndrome/ MERS) পরীক্ষামূলকভাবে তারা এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। সৌদি আরবে তারা যখন দ্বিতীয় আরেকটি পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, সেসময় মূর্তিমান বিভীষিকা হিসেবে আবির্ভূত হলো কোভিড। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের হাতে তখন ভ্যাক্সিনের প্রাথমিক কাঠামো রয়েছে, তারা অপেক্ষা করছিলেন করোনাভাইরাসের পূর্ণ জেনেটিক কোড জানার জন্য। ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি চীন সেটি প্রকাশ করলে পরদিনই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সারা গিলবার্টের নেতৃত্বাধীন গবেষকদল। মার্চের মধ্যেই তারা প্রাণীদেহে পরীক্ষানিরীক্ষা আরম্ভ করেন। এর পরবর্তী ধাপ ছিল মানবশরীরে ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ। তবে তার আগে খুঁজে বের করতে হবে কোনো ওষুধ প্রতিষ্ঠান যারা ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে অক্সফোর্ডের সঙ্গী হবে।
প্রশ্ন আসতে পারে- অক্সফোর্ডের কেন ওষুধ কোম্পানির সাহায্য দরকার হলো? স্মরণ রাখতে হবে- অক্সফোর্ড একটি অ্যাকাডেমিক ইন্সটিটিউট, বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ঔষধ বা ভ্যাক্সিন প্রস্তুত ও বিপণন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আজকের যুগে বহু বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানই ওষুধ নিয়ে গবেষণা সফল হলে বড় কোনো ওষুধ কোম্পানির কাছে ফলাফল বিক্রি করে দেয়, যাতে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এই গবেষণার সুফল পৌঁছতে পারে। অক্সফোর্ডের উদ্দেশ্যও তা-ই ছিল, তবে ব্রিটিশ কোম্পানি হলেও তাদের লিস্টে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ছিল অনেক নিচে। এর কারণ ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে অ্যাস্ট্রাজেনেকার অভিজ্ঞতা অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানির তুলনায় প্রায় শূন্য। তবে তালিকার উপরের দিকে থাকা ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আলোচনা ফলপ্রসু না হলে শিকে ছিঁড়ল তাদের ভাগ্যেই।
এখানে ব্রিটিশ সরকারেরও কিছুটা চাপ ছিল, যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে তারাই এই গবেষণাতে অর্থায়ন করে। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক এবং ব্রিটিশ সরকারের ভ্যাক্সিন টাস্ক ফোর্সের সদস্য ডক্টর জন বেল জানিয়েছেন, বরিস জনসনের সরকার প্রথম থেকেই চাচ্ছিল যাতে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি অক্সফোর্ডের সাথে যুক্ত হয়। তাদের যুক্তি ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি ভ্যাক্সিন অধিক দ্রুততার সাথে সরবরাহ করা যাবে। সরাসরি উচ্চারিত না হলেও জাতীয় গর্বের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তি হয়ে যায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে, শর্ত ছিল ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত তারা একদমই স্বল্পমূল্যে সবখানে এই ভ্যাক্সিন সরবরাহ করবে, আর মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো এর পরেও স্বল্পমূল্যে টিকা পেয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্য চুক্তি হয়ে যাবার পরপরই অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে ১০০ মিলিয়ন ডোজের চাহিদা দিয়ে রাখে । যুক্তরাষ্ট্রও পিছিয়ে ছিল না। কোভিড ভ্যাক্সিন বিষয়ক প্রকল্প, অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের আওতায় তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে ১.২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়, এর বিনিময়ে তাদের দিতে হবে ৩০০ মিলিয়ন ডোজ। অন্যান্য অনেক দেশও অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে চুক্তি করে ফেলে। এক হিসেবে দেখা গেছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর ভ্যাক্সিনের চাহিদার শতকরা ৪৩ ভাগ মেটাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
২০২০ সালের জুন মাসে, যখন কোনো কোভিড ভ্যাক্সিন অনুমোদিত হয়নি, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনকে চিহ্নিত করেন প্রথম অনুমোদন পাবার জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য হিসেবে। জুলাইয়ে ব্রিটিশ ভ্যাক্সিন টাস্ক ফোর্সের প্রধান কেট বিংহ্যাম একে প্রযুক্তিগতভাবে অন্য যেকোনো কোভিড ভ্যাক্সিনের থেকে অগ্রসরমান দাবি করেন, তবে তার কথা কিছুটা অতিরঞ্জিত ছিল। হোয়াইট হাউজের তৎকালীন চিফ অফ স্টাফ মার্ক মিডোসও ধারণা দিয়েছিলেন সেপ্টেম্বরের মধ্যেই হয়তো এফডিএ অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনের অনুমোদন দিতে সক্ষম হবে। পরবর্তীতে প্রমানিত হয়েছে সবই ছিল কষ্টকল্পনা, কারণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে গিয়ে ভ্যাক্সিন বিষয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকার অনভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
কার্যকারিতা
জুন থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সম্মিলিতভাবে শুরু করে। প্রথম অবস্থায় ইংল্যান্ড ও ব্রাজিলে চালানো হয় পরীক্ষা। দুই ডোজ টিকা ১ মাসের ব্যবধানে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মোটামুটিভাবে ১৮ বছর ও তদুর্ধ্ব ১১,৬৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবক নাম লেখান এতে। ৫,৮০৭ জন পান ভ্যাক্সিন আর বাকিদের দেয়া হচ্ছিল প্লাসেবু। তবে এখানে ভজঘট পাকিয়ে ফেলে অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
দুর্ঘটনাবশত দেখা যায়, যাদের ভ্যাক্সিন দেবার কথা ছিল তাদের ১,৩৬৭ জন প্রথম ডোজে যে মাত্রার টিকা পাবার কথা তার অর্ধেক পেয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজ আবার সবাই নির্ধারিত মাত্রাতেই পান। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, যারা পূর্ণ মাত্রায় টিকা নিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন ৬০-৭০ শতাংশ কার্যকর, কিন্তু অদ্ভুতভাবে যারা প্রথমে অর্ধেক এবং পরে পূর্ণমাত্রায় ভ্যাক্সিন লাভ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা দেখাচ্ছে শতকার ৯০ ভাগ। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা মোটামুটি হতভম্ব হয়ে যান।
পরবর্তীকালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ কর্তৃপক্ষ যখন অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ট্রায়ালের তথ্য নিজেরা বিশ্লেষণ করেন তখন বের হয় যে যাদের অর্ধেক মাত্রায় প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছিল তাদের কেউ ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে ছিলেন না, অথচ এই বয়সীদের মধ্যে কার্যকারিতা না জেনে ভ্যাক্সিন অনুমোদন করা সম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয়, এদের অনেকেই এক মাসের বদলে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন তিন মাসের মাথায় গিয়ে। ফলাফলে পরিসংখ্যানগত সমস্যার উল্লেখও তারা করেন। ফলে যুক্তরাজ্য সরকার অনুমোদন দেয় পূর্ণ মাত্রায় দুই ডোজকে। তাদের মতামত ছিল- এই ভ্যাক্সিন শতকরা ৬২ ভাগ কার্যকর। প্রথম ডোজের ২১-২২ দিনের মাথায় কার্যকারিতা তৈরি হওয়া শুরু করে, এবং দ্বিতীয় ডোজের দুই সপ্তাহ পরে তা পূর্ণমাত্রায় পৌঁছে।
যুক্তরাজ্যের কর্তৃপক্ষ দুই ডোজের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বেধে দিয়েছে ১-৩ মাস। কারণ তাদের মতে, প্রথম ডোজের ৩ মাসের মধ্যেই সর্বোচ্চ কার্যকারিতা দেখা যায়, যা দ্বিতীয় ডোজ দ্বারা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হবে।ফলে ৩ মাসের ব্যবধানেও দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে, তবে এর থেকে দেরি করা যাবে না।
কিন্তু এফডিএ আরো তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বসে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ট্রায়াল চালানোর নির্দেশনা ছিল তাদের। আরেকটি ব্যাপার হলো- কোভিড ভ্যাক্সিন অনুমোদনে অন্তত ৩০,০০০ লোকের মধ্যে ট্রায়ালের যে শর্ত এফডিএ-র তা-ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা পূরণ করে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩০,০০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা যুক্তরাষ্ট্রে ট্রায়াল শুরু করেছে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ফাইজার আর মডার্নার মতোই টিকা দেবার স্থানে হাল্কা ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব ইত্যাদি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনেও দেখা যায়। ভ্যাক্সিন পাওয়াদের ৩০ জন আর প্লাসেবু গ্রুপে ১০১ জন কোভিডের লক্ষণ প্রকাশ করেন, তবে কেউই মারাত্মক রকম অসুখে ভোগেননি, ফলে হাসপাতালের প্রয়োজন হয়নি। তবে ট্রায়াল চলাকালে দুটি ঘটনার জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকা পরীক্ষা সাময়িকভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
প্রথম ঘটনা ঘটে জুলাইয়ে। ইংল্যান্ডে ট্রায়ালের একজন স্বেচ্ছাসেবক স্নায়বিক অসুখে আক্রান্ত হন, ফলে সেখানে সাময়িকভাবে ট্রায়াল বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় সেই স্বেচ্ছাসেবক স্নায়ুর একটি অসুখে ভুগছেন যা থেকে এই সমস্যার উৎপত্তি, এর সাথে ভ্যাক্সিনের সম্পর্ক নেই। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা অক্সফোর্ড কেউই সাময়িক বিরতির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি, এবং এফডিএ-কেও সমস্ত কিছু জানানো হয় বেশ বিলম্বে। এতে তাদের ব্যাপারে এফডিএ-র নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে আবারও একই ঘটনা ঘটল। আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক একই লক্ষণ দেখাতে থাকলে ৬ সেপ্টেম্বর অ্যাস্ট্রাজেনেকা ট্রায়াল আবার বন্ধ করে। এই সময় ইংল্যান্ড আর ব্রাজিল ছাড়াও জাপান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ট্রায়াল চলছিল। ৮ তারিখে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর দেখে এফডিএসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা জানতে পারে, যদিও অ্যাস্ট্রাজেনেকার দায়িত্ব ছিল তাদেরকে ট্রায়াল বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে জানানো।
বলা বাহুল্য, এর ফলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভাবমূর্তি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এবারও ভ্যাক্সিনের সাথে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হলে তারা ট্রায়াল পুনরায় চালু করতে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে। জাপান ছাড়া সবাই ১ সপ্তাহের মাঝেই অনুমতি দিয়ে দেয়, জাপান দেয় ১ মাসের মাথায়। কিন্তু এফডিএ-র সবুজ সংকেত পেতে লেগে যায় পাক্কা ৪৭ দিন। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রে যে সহসাই অ্যাস্ট্রাজেনেকা অনুমোদন পাবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। তাদের নিজেদের মতেই জানুয়ারির তৃতীয় অথবা চতুর্থ সপ্তাহে হয়তো তারা এফডিএ-র অনুমোদন আশা করতে পারে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার মূল সুবিধা
কার্যকারিতার দিক থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিছিয়ে আছে মডার্না আর ফাইজারের ভ্যাক্সিনের থেকে। তবে তাদের প্রধান সুবিধা দাম, যা সাধারণের হাতের নাগালে বলে এমনকি দরিদ্র দেশের পক্ষেও ক্রয় করা সম্ভব। দ্বিতীয় সুবিধা এই ভ্যাক্সিন সাধারণ ফ্রিজেই সরবরাহ ও ছ’মাস পর্যন্ত সংরক্ষণযোগ্য, যেটা মডার্না আর ফাইজারের টিকায় সম্ভব নয়। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করেই বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এই ভ্যাক্সিন বিপুল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা ইতোমধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভ্যাক্সিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সাথে চুক্তি করেছে আগামি বছর নাগাদ অন্তত এক বিলিয়ন ডোজ তৈরি করবার জন্য। সুলভ মূল্যে এগুলো পাবে অনেক দেশই।
শেষ কথা
গত লেখার কথার পুনরাবৃত্তি করা যাক। ভ্যাক্সিন যাদুর কাঠি নয়, কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অংশমাত্র। জরুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানেন না কতদিন ভ্যাক্সিন দেয়ার পর কোভিডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আমাদের শরীরে থেকে যাবে। জানেন না এই ভ্যাক্সিন সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে কি না। এটুকু আমরা জানি যে সংক্রমণ হলেও তা মারাত্মক পর্যায়ে যাবে না, তবে সংক্রমিত ব্যক্তি সুস্থ মানুষের সাথে সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারবেন কিনা তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। ফলে সাধারণ জনতার মধ্যে প্রয়োগ শুরু হলেও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ চলবে, এবং নিয়মিত সেগুলো যাচাইবাছাই করে কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ একটি চিত্র দাঁড়া করাতে পারবেন।
আরেকটি ব্যাপার হলো অনেক দেশে এখন দুই-তিনটি করে ভ্যাক্সিন অনুমোদিত, কে কোন ভ্যাক্সিন পাবে সেটা কীভাবে ঠিক হবে? বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়, তবে এটি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করবে না। সরকারিভাবেই এর সমাধান হবে। কেউ যদি ৬২ শতাংশ কার্যকর ভ্যাক্সিন না নিয়ে ৯৫ শতাংশ কার্যকর টিকা নিতে চান সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে প্রতিবছর উন্নত বিশ্বে ফ্লুর যে টিকা দেয়া হয় তা কেবল ৫০ শতাংশ কার্যকর। কাজেই ৬২ শতাংশ কার্যকারিতা অঙ্কের হিসেবে ৯৫ শতাংশ থেকে কম মনে হলেও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট।
তবে সবকিছুর পর একটা কথাই আবার বলতে হবে, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি, এবং ভ্যাক্সিন দেয়ামাত্রই সমস্ত বিধিনিষেধ উঠে যাবে এটা ভাবা ঠিক হবে না। এই বিষয়টি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, তারাই পরামর্শ দেবেন কখন আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব। কষ্ট হলেও তার আগপর্যন্ত মেনে চলতে হবে কোভিড-১৯ বিষয়ক সমস্ত নিয়মকানুন।