প্রায় ২০ মাসেরও বেশি সময়। শনাক্তের সংখ্যা ২২০ মিলিয়ন। ৪ মিলিয়নেরও অধিক মৃত্যু। দীর্ঘ এই সময়ের এখনও হয়নি শেষ, মৃত্যুর সংখ্যাও থামেনি। কষ্টকর, দুর্বিষহ এই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেককিছু শিখিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে একাধিক কার্যকরী টিকা বাজারে এত দ্রুত আগে কখনো আসেনি। গণহারে টিকাদান কর্মসূচি চলছে, লকডাউন শিথিল হচ্ছে দেশে দেশে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে, সর্বোপরি মানুষ তার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহামারির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার।
সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সমস্যার উৎস কী তা জানাটাও সমান জরুরি। টিকা প্রদানের পাশাপাশি সবাইকে মাস্ক পরতে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। এসবের মাঝে একটি বিষয় ভুলে যাওয়া যাবে না যে ভাইরাসটির উৎস কোথায়? মূলত এই প্রশ্নটির সুলুক সন্ধান ভবিষ্যতের মহামারি ঠেকাতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে ভূমিকা রাখবে।
চলতি বছরের আগস্টের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ অনুসন্ধানী দল একটি আনক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয় যে,
সার্স কোভ-২ কোনো জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস নয়। অর্থাৎ, চীনের কোনো ল্যাব বা দেশটির প্রশাসন জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ভাইরাসটিকে তৈরি করেনি।
ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানের জন্য একাধিক বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। করোনা মহামারির ক্ষেত্রে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন যে, চীন ভাইরাসটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তৈরি করেছে। অর্থাৎ, এই মহামারির সূত্রপাত জানাতে চাইলে উহান ইন্সটিটিউট অভ ভাইরোলজির গবেষণাগার, সংশ্লিষ্ট গবেষকদল, অদূরেই অবস্থিত বন্যপ্রাণীর বাজার ও অন্যান্য প্রাণী, নিকটবর্তী লোকালয়ের অধিবাসী এদের সকলেই তদন্তের আওতাভুক্ত হবে। বিষয়টি এরকম নয় যে সকল প্রাণীই বা প্রতিটি মানুষকেই টেস্ট করতে হবে। আর সন্তোষজনক গবেষণার স্বার্থে পর্যাপ্ত নমুনা অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে।
জুনোটিক অসুখ হলো যেসব রোগ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। অর্থাৎ, সার্স কোভ-২ এর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রাণী অর্থাৎ, বাদুড়কে নমুনা হিসেবে পরীক্ষা করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে পোষক প্রাণী মাত্রই কোনো লক্ষণ প্রদর্শন করবে বিষয়টি এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ভাইরাসটি পোষক দেহের সাথে একধরনের সহাবস্থানে চলে আসে, যে কারণে অসুস্থতার কোনো চিহ্ন প্রকাশ পায় না। রোগের উৎস অনুসন্ধানের জন্য সম্ভাব্য যে প্রাণীটিকে দায়ী করা হচ্ছে সেটির অসুস্থ সদস্যকেই শুধু পরীক্ষা করলে চলবে না। অসুস্থ প্রাণীটি ছাড়াও অন্যান্য সুস্থ বাদুড়ও ভাইরাসের পোষক হিসেবে কাজ করতে পারে।
এরপর যা পুরো ব্যপারটিকে আরও কঠিন করে তোলে সেটি হচ্ছে প্রাণী ও মানুষের চলনশীলতা। মানুষ ক্রমাগতই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া-আসা করছে। ধরা যাক, ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া প্রথম মানুষটিকে ‘ক’ নামক জায়গায় পাওয়া গেছে। এ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, ভাইরাসের উৎসস্থলও একই জায়গায়। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্রস্থল আর প্রথম শনাক্ত হওয়া মানুষের অবস্থান দু’টি ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যে কারণে দু’টি বিষয় থেকে চট করে কোনো উপসংহারে আসা যায় না।
কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী সার্স কোভ-২ ভাইরাসটির সবচেয়ে নিকটবর্তী ভাইরাসটি হলো বাদুড়ের করোনা ভাইরাস পরিবারের সদস্য BatCoV RaTG13। এই ভাইরাসটিকে উহান ইন্সটিটিউট অভ ভাইরোলজির গবেষকরা ২০১১-‘১২ সালে শনাক্ত করেন। ২০০৩ সালে সার্স কোভ-১ ঘটিত মহামারীইর পর থেকে উহানের ভাইরোলজিস্টরা বাদুড়ে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে টানা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উহানের ল্যাব থেকে প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটার দূরের ইউনান প্রদেশে বাদুড়ের একটি আবাসস্থল থেকে তারা নমুনা সংগ্রহ করেন যার মাঝে ছিল বাদুড়ের গলার সোয়্যাব এবং মল।
গবেষকরা জানতে চাচ্ছিলেন যে বাদুড়ের করোনা ভাইরাস সত্যিই মানুষকে সংক্রমিত করে কি না? এজন্য তারা ইউনান থেকে সংগৃহীত নমুনা দিয়ে বানরের কিডনি সেল লাইন এবং মানুষের টিউমার সেল লাইনে পরীক্ষা চালালে দেখতে পান যে নমুনাসমূহের মাঝে কিছু সংখ্যক ভাইরাস মানুষের সেল লাইনে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে বাদুড় ও মানুষ একে অপরের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে খুব একটা বেশি আসে না। অর্থাৎ, বাদুড় থেকে করোনা ভাইরাসকে মানুষের দেহে আসতে হলে একটি ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট বা মধ্যবর্তী পোষকদেহের প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কী?
এর পরের ধাপ হলো মানুষকে অসুস্থ করে দেওয়া করোনা ভাইরাসের সাথে বন্য প্রাণীর দেহে বিদ্যমান করোনা ভাইরাসের সম্পর্ক নির্ণয় করা। BatCoV RaTG13 এর জেনেটিক সিকোয়েন্সের সাথে মানুষকে আক্রমণ করা করোনা ভাইরাসের সিকোয়েন্স তুলনা করলে ৯৬% সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এর অর্থ এই যে সম্ভবত বাদুড়ই সার্স কোভ-২ এর উৎপত্তি স্থল। তবে ৯৬% সাদৃশ্য শুনতে অনেক মনে হলেও জেনেটিক সিকোয়েন্সের প্রেক্ষাপটে ৪% বৈসাদৃশ্যও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা মানুষ ও বনোবোর জেনেটিক সাদৃশ্য ৯৮.৭% হওয়ার পরেও তারা দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি। অর্থাৎ, মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস ঘাঁটি গড়ে তোলার আগে অন্য কোনো অন্তর্বর্তীকালীন পোষক হয়ে এসেছে। পরবর্তীতে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে যে বাদুড় থেকে সিভেট হয়ে মানুষে ভাইরাসটি এসেছে।
এ যাবত কাল পর্যন্ত অসংখ্য গবেষণা হয়েছে সার্স কোভ-২ এর উৎস নিরূপণে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় বাদুড় থেকেই এসেছে ভাইরাসটি তাহলেও একটা মুশকিল থেকেই যায়। এশিয়া মহাদেশে চীন ছাড়াও জাপান, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস ইত্যাদি দেশেও বাদুড়ের যথেষ্ট অস্তিত্ব রয়েছে। তাহলে ঠিক কোন জায়গা থেকে এসেছে সেটির জন্য যে পরিমাণ বাদুড়কে পরীক্ষা করতে হবে তার অর্থনৈতিক বোঝা হবে তুলনারহিত এবং গবেষণাটি হবে অত্যন্ত দুরূহ যেহেতু এ ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বায়োসেইফটি লেভেল ৪ ল্যাব সারা বিশ্বে হাতে গোণা কয়েকটি আছে।
ইউনিভার্সিটি অভ মন্টানা ইন মিসৌলার ভাইরোলজিস্ট জ্যাক নানবার্গের মতে সার্স কোভ- ২ এর ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এ বিষয়ে তার বক্তব্য,
একমুহূর্তের জন্যও যদি বিবেচনা করা হয় যে, ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্যসূচক ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট সত্যিই ইঞ্জিনিয়ার্ড তবুও এটি ভাইরাসের দেহে কীভাবে এলো- প্রাকৃতিক নির্বাচন না কি মানুষের মাধ্যমে সেই সদুত্তর দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
সার্স কোভ-২ এর উৎস কিংবা বিবর্তন জানাটা সত্যিই ভীষণ দরকারি। ভবিষ্যতের মহামারি সম্পর্কে আগে থেকেই প্রস্তুত হওয়া এবং এর গতিবিধি বোঝা উভয়ের জন্যই চলমান মহামারির প্যাটার্ন বোঝাটা আবশ্যক। তবে সম্ভবত আমাদের পক্ষে কখনোই শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে না যে, ভাইরাসটির উৎস প্রকৃতপক্ষে কী ছিল?
বায়োসেইফটি বা জৈব নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যখন চীনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে চলেছে তখন এমআরআই গ্লোবালের কর্মকর্তা ফ্র্যাংক হামিল খুব চমৎকার একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এমআরআই গ্লোবাল বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারের জৈব নিরাপত্তা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকে। চীনের উহানের ল্যাব প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
আমরা বর্তমানে খুব সংকটময় মুহূর্তে অবস্থান করছি। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে উহানের ল্যাবের কাছে স্বচ্ছতার দাবী জানাচ্ছি যখন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবগুলোর নিজেদের অবস্থাই খুব একটা সন্তোষজনক নয়। স্বাভাবিকভাবেই জনগণ বিরূপ মন্তব্য তো করবেই। বস্তুত এ ধরনের আচরণ কিছুটা হলেও ভণ্ডামি।