মানসিক অসুস্থতার প্রতি আমাদের সবসময় প্রচণ্ড একটি ভীতি কাজ করে। সেই অতীতকাল থেকে চলে আসছে এমনটি। এজন্যই যুগে যুগে সমাজ থেকে তাদের পৃথক করে রাখার একটি প্রবণতা দেখা গেছে মানুষের ভেতর! কিন্তু আজ যদি আপনাকে বলি, মানসিক অসুস্থতার কল্যাণেই আপনি হয়ে উঠরে পারেন একজন সুপার হিরো, তাহলে নিশ্চয়ই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাবেন আপনি! কিন্তু আপনার মুখের হাসি অজান্তেই বন্ধ হয়ে যাবে, যখন এই লেখাটি পড়ে শেষ করবেন!
চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু মানসিক অসুস্থতার কথা, যা মানুষকে করে তুলতে পারে অতি মানবীয় দক্ষতাসম্পন্ন সুপার হিউম্যান!
শুচিবাই থেকে অতি মেধাবী
আমাদের চারপাশে এমন কিছু মানুষের দেখা পাই, যারা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে হয়ে থাকে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে দশবার চেক করে নেবে গ্যাসের চাবি বন্ধ করেছে কিনা, দু’পায়ে ঠিক মতো জুতো পরেছে কিনা, মোজার কোনো অংশে কণামাত্র ময়লা লেগে আছে কিনা? হয়ত অফিসে মিটিংয়ের তাড়া আছে, জলদি ঘর থেকে বেরিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসবে এটা দেখতে যে ঘরের জানালা বন্ধ করেছে কিনা? একবার কিংবা দুবার নয়, বারবার করতে থাকে এমনটি। এরা শুচিবাই কিংবা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার এ আক্রান্ত!
সাধারণত সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরা নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। পারিবারিক অশান্তির একটা আবহাওয়াও তৈরি হয়। কিন্তু এসব তো গেলো মন্দ দিক। যদি বলি, এর একটা অবিশ্বাস্য ভালো দিক আছে! এটি আপনার স্মৃতিশক্তিকে করে তুলতে পারে ক্ষুরধার!
Journal of Psychiatric research একটি সমীক্ষা চালায়। একদল লোককে দু’ভাগে ভাগ করে তাদের সামনে ৩২০টি শব্দ এবং অর্থহীন ১৪০টি শব্দ উপস্থাপন করা হয়। তাদের কাজ ছিল সেগুলোকে স্মরণ করা। দেখা গেলো, যারা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত, তারা অন্যদের তুলনায় নিখুঁতভাবে এবং দ্রুততার সাথে অধিক শব্দ স্মরণ করতে পাচ্ছে।
এরপর তাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হল। দেখা গেলো মস্তিষ্কের যে অংশ স্মৃতি ধারণের সাথে সংযুক্ত, শুচিবাইতে আক্রান্ত মানুষদের ঐ অংশটি তূলনামুলকভাবে বড়। ফলে আগের স্মৃতিগুলো তারা অন্যদের তুলনায় ভালোভাবে মনে রাখতে পারে।
আচ্ছা, তাহলে অফিসে যাওয়ার সময় এতবার ঘরে এসে দেখার দরকার কি যে জানালা-দরজা বন্ধ হয়েছে কিনা? দুঃখের ব্যাপার, উত্তরটা এই মুহূর্তে জানা নেই।
অমনোযোগিতা-অতিচাঞ্চল্য থেকে সৃষ্টিশীল তুখোড় শিল্পী
অংকের ক্লাস করতে কিংবা ইতিহাসের লেকচার শুনতে কারই বা ভালো লাগে? জটিল বিরস ক্লাসগুলোতে আমরা কমবেশি সবাই একটু অমনোযোগী থাকি, ফাঁকিও দেই। কিন্তু কিছু বাচ্চা আছে, যারা ক্লাসে একেবারে মনোযোগ দেয় না। মনোযোগ তো দূরের কথা, চুপচাপ দশটি মিনিট এক জায়গায় বসে থাকাই তাদের জন্য কষ্টকর। সারাক্ষণ উসখুস করতেই থাকে। ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ নেই, বাড়ির কাজ করার খেয়াল নেই, এক জায়গায় কিছুক্ষণ বসে থাকতে বলা হলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো তার আর পাত্তাই নেই। এরা আসলে একধরনের মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। যার নাম দেওয়া হয়েছে Attention deficit Hyperactive Disorder বা অমনোযোগিতা-অতিচাঞ্চল্য সমস্যা।
এসব খেয়ালী ছেলেরা, যারা কিনা একটি জায়গায় পাঁচটি মিনিট বসে কোনো কাজ স্থির হয়ে করতে পারে না, তারা কিভাবে কোনো কাজে ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারে? এখানে তাদের ব্যাপারে আমাদের একটি ভুল ধারণা রয়েছে। যেসব ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই, সেসব ক্ষেত্রে তাদের মস্তিষ্ক কোনোভাবেই সময় ব্যয় করতে রাজী নয়। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ জন্মায় সেখানে তারা জান-প্রাণ দিয়েই কাজ করে!
আর যে সে ব্যাপার তাদের আগ্রহ কেড়ে নেওয়ার সক্ষমতা রাখে না। এমন একটি কাজ যা যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক এবং যা অর্জন করতে হলে বেশ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয় সেসব জিনিসই তাদের আগ্রহ কেড়ে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিনিসগুলো সৃজনশীল হয়ে থাকে।
আবার তারা অন্যসব মানুষ থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক যখন মিলিয়ন মিলিয়ন হিসাব কষে বের করে, একটি কাজ আমাদের করা উচিত কিনা, তখন তাদের মস্তিষ্ক এসব প্রক্রিয়া বাইপাস করে যায়। সুতরাং আপনি হয়ত রাস্তা পার হচ্ছেন, হঠাৎ আবিষ্কার করলেন একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে আপনার দিকে তেড়ে আসছে! এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে হয়ত আপনি মুহূর্তের জন্য জমে যাবেন, আপনার মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মিলি সেকেন্ড দেরি করে ফেলবে! কিন্তু তারা কখনোই নয়।
সুতরাং আপনি যখন নিবিষ্টমনে বসে ক্লাসের পড়া পড়ছেন, তখন দিবাস্বপ্ন দেখা এই খেয়ালী মানুষেরা হয়ত ভবিষ্যৎ কালজয়ী কোনো উপন্যাসের কাঠামো খাড়া করছে কিংবা কোনো ব্যবসার ছক কষছে অথবা হয়তো এমন কোন সুর ভাঁজছে , যা হয়তো হয়ে উঠবে পরবর্তী ডেসপাসিতো। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না?
আচ্ছা, তাহলে একটি ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করি, কেমন? বলুন তো লর্ড বায়রন, কার্ট কোবেইন, জাস্টিন টিম্বারলেক, উইল স্মিথ এবং মাইকেল ফেলপ্সের ভেতরে মিল কোথায়? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। তারা সবাই অমনোযোগিতা-অতিচাঞ্চল্যের শিকার ছিলেন।
মনোব্যধি থেকে ম্যাথ জিনিয়াস!
একদল গণিত পাগল লোকদের বেছে নেওয়া হলো একবার। তারপর তাদের গণিত নিয়ে কাজ করতে দেওয়া হলো। শেষে তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হলো। এবার তাদের মধ্যে যারা গণিতে বেশি পারদর্শী তাদের পৃথক করা হলো। দেখা গেলো, তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সেটা হলো সবাই কোন না কোনো মনোব্যধির শিকার। গোটা সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিলো আইসল্যান্ডের রেইকজাভিক ইউনিভার্সিটিতে।
এখানেই শেষ নয়, পরবর্তীতে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে এসব গণিত বিশেষজ্ঞ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নয়, তারা সবাই কমবেশি খাটি স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন।
আসুন, বরং আমরা এই সময়ের একজন জনপ্রিয় গণিতবিদের কথা শুনি। তার নাম জন ন্যাশ। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গণিতবিদের গেম থিওরি, ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি, পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। তার সমস্যাটি কীরকম একটু বয়ান করা যাক, নাকি? তিনি একজন স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন।
স্কিজোফ্রেনিক রোগীদের চিন্তাধারা এবং অনুভূতিতে পরিবর্তন আসে। তারা প্রায়শই অলীক বস্তু দেখে, অলীক শব্দ শোনে এবং আপাত অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা করে! তো জন ন্যাশের ক্ষেত্রে কী সমস্যা ছিল? তিনি গণিত দেখতে পেতেন! একেবারে জলজ্যান্ত রূপে গণিত নাকি হাজির হতো তার সামনে! বলা হয়ে থাকে, স্কিজোফ্রেনিক রোগীদের নাকি মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন আসে, যাতে নাকি তাদের অঙ্কের গিটগুলো জলের মতো খুলতে থাকে! তারা হয়ে ওঠে ম্যাথ জিনিয়াস!
ট্যুরেট সিনড্রোম থেকে দক্ষ এথলেট?
আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ আছে যারা কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী! যেমন ধরুন, কেউ হঠাৎ হঠাৎ চোখ টিপুনি দেয়, কেউ বা কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে নেয়, কেউ বা মুখ কুঁচকে ফেলে। এর পেছনে রয়েছে ট্যুরেট সিনড্রোম নামে এক অদ্ভুত সমস্যা।
বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে ট্যুরেট সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষেরা ভারী অসুবিধায় পড়েন। আপনার হাত-পা যদি আপনাআপনি নড়াচড়া করতে থাকে, তাহলে অসুবিধার কথাই বটে! কিন্তু কেউ কেউ এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে নিজের দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিয়েছেন বহুগুণ।
ফুটবল জগতের বিখ্যাত গোলরক্ষক টিম হাওয়ার্ড তার দক্ষতাকে অনেকাংশে ট্যুরেট সিনড্রোমের অবদান বলে মনে করেন! আমেরিকার জাতীয় বাস্কেটবল এ্যাসোসিয়েশনের ক্রিস জ্যাকসন একজন ট্যুরেট সিন্ড্রোমের রোগী। আপনি যদি কোর্টে তার খেলা দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন বিষয়টি। তিনিও তার ট্যুরেট সিনড্রোমকে কাজে লাগিয়েছেন তার দক্ষতাকে আরো বাড়িয়ে নিতে!
এই সমস্যাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানুষের জীবনে যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক না কেন, জীবনে চলার পথে তা কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যে জিনিসকে আপনি হয়তো ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকছেন, পিছিয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধে- সেটি আসলে হয়তো সমস্যাই নয়, আপনার জন্য এক সুপ্ত আশীর্বাদ! শুধু সঠিকভাবে সঠিক স্থানে প্রয়োগ করার অপেক্ষা!
Feature Image: Atkins