ভিয়েতনাম শব্দটি শুনলেই আমাদের প্রথমে মনে পড়ে এক ভয়াবহ যুদ্ধের কথা। উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যকার সেই গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার গল্প যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় পঠিত হচ্ছে। অবশ্য ইতিহাসের বই, ম্যাগাজিন বা চলচ্চিত্রে ভিয়েতনামের সাথে আমাদের টুকটাক যা পরিচিতি, তার অধিকাংশ এই ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই। ২০২০ সালের মহামারি জর্জরিত এই অসহায় পৃথিবীতে পুনরায় সেই ভিয়েতনামের নাম আলোচিত হচ্ছে। তবে এবার এর কারণ কোনো গৃহযুদ্ধ নয়। বরং, করোনা নামক অদম্য ভাইরাসকে বধ করার দৌড়ে পৃথিবীর অগ্রদূত হয়ে দেশটি পুনরায় উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ভিয়েতনামের অবস্থান মধ্যম হলেও বেশ দক্ষতার সাথে এই মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি, যেখানে বেশ বড় বড় দেশ হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম কি হুট করে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ কব্জা করে ফেললো? মোটেও না। ভিয়েতনামের সাফল্যের তথ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশটির কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বহু প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন পর্যালোচনা করেছেন। এর মাধ্যমে উঠে এসেছে এক সুশৃঙ্খল ফর্মুলা, যা অন্যান্য যেকোনো দেশের জন্য মহামারি মোকাবেলার পাথেয় হিসেবে গণ্য হবে। আবার অনেকে আঙুল তুলেছেন ভিয়েতনামের কম পরীক্ষা নীতির উপর। আমাদের আজকের প্রবন্ধে ভিয়েতনাম এবং তাদের করোনা যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে সেসব বিষয় তুলে ধরা হবে।
ভিয়েতনাম এবং মহামারি
ভিয়েতনামের জাতির পিতা হো চি মিন একবার বলেছিলেন-
“নিজের সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য একটি পাইন গাছের কাছে ঝড়-তুফান হচ্ছে সর্বোত্তম সময়।”
আঙ্কেল হো-এর এই মন্ত্রে উজ্জীবিত ভিয়েতনাম তাই তাদের সক্ষমতা এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাকে পৃথিবীবাসীর নিকট তুলে ধরতে বেছে নিলো কোভিড-১৯ মহামারিকে। প্রায় আড়াই হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের দেশ ভিয়েতনামের জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন। ২০২০ সালের সমীক্ষা মতে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩১১ জনের বসতিপূর্ণ দেশটির জনবসতির ঘনত্বের দিক দিয়ে পৃথিবীতে অবস্থান ৪৫ তম। তাছাড়া করোনার উৎস চীনের সাথে এর সরাসরি সীমান্ত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে পণ্য আদান-প্রদান হচ্ছে নিয়মিত। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভিয়েতনামকে বেশ কাটখড় পোড়াতে হবে। কিন্তু Worldometers–এর করোনা ট্রেকার অনুযায়ী ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ৩৯৬ জন (২১ জুলাই পর্যন্ত)। আর মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকালে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কারণ, সেই ঘরে জ্বলজ্বল করছে একটি শূন্য। করোনায় বিভিন্ন দেশে আরোপিত লকডাউন বা কারফিউ ভিয়েতনামেও ছিল। কিন্তু এ ধরনের কড়াকড়ি অবস্থা প্রত্যাহারের দিক দিয়ে ভিয়েতনাম ছিল সারাবিশ্বে প্রথমদের কাতারে।
ভিয়েতনামের করোনা যুদ্ধ পন্থা পর্যালোচনার পূর্বে আমাদের জেনে নিতে হবে, ভিয়েতনামের সাথে মহামারির ইতিহাস বেশ পুরাতন। সার্স, মার্স, বার্ড-ফ্লুসহ বেশ কয়েকটি মহামারির শিকার হয়েছে দেশটি। তাই মহামারির সাথে তাদের যুদ্ধের ইতিহাসও নতুন নয়। উল্টো ২০০৩ সালে সার্স প্রাদুর্ভাবে পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে সার্স-মুক্ত হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি অর্জনকারী দেশটির নাম ভিয়েতনাম। গত শতাব্দী থেকে বর্তমান পর্যন্ত এসব মহামারির সাথে মোকাবেলার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভিয়েতনাম তাদের স্বাস্থ্যখাতের পরিমার্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক দিক বিবেচনায় দেশটিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ না হলেও তাদের মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ছিল চৌকস। সার্স প্রাদুর্ভাবের পর ভিয়েতনাম জনস্বাস্থ্য বিভাগে তাদের বিনিয়োগ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। গঠিত হয় জাতীয় জরুরি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং জনস্বাস্থ্য তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা। যার সুফল তারা ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে।
ভিয়েতনামে করোনা আক্রমণ
ভিয়েতনামে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সূচনা হয় ২৩ জানুয়ারি উহান থেকে আসা এক চীনা নাগরিকের মাধ্যমে। প্রথম ভিয়েতনামি কোভিড-১৯ রোগীও ছিলেন উহান থেকে দেশে ফেরত একজন ২৫ বছর বয়সী নারী। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে ভিয়েতনামের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় সরকার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিভিন্ন অঞ্চল লকডাউন করে দেওয়া শুরু করে। রাজধানী হ্যানয়ের অদূরে অবস্থিত ভিন ফুক প্রদেশে সর্বপ্রথম কমিউনিটি সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথম সংক্রমণের পর ভিয়েতনামে দ্বিতীয় ধারার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল ৬ মার্চ। সেবার ভিয়েতনামে করোনা এসেছিল যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত নাগরিকের মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাপে সরকারি তত্ত্বাবধানে কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে আসা ২০০ ব্যক্তিকে আলাদা করা হয়েছে।
প্রথম ১০০ দিনে ভিয়েতনামে মাত্র ২৭০ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়। তাছাড়া ১৫ এপ্রিলের পর নতুন করে কোনো অঞ্চলে কমিউনিটি সংক্রমণের প্রমাণ মেলেনি। আশ্চর্যজনকভাবে, ভিয়েতনামে করোনায় কেউ মৃত্যুবরণ করেননি। ভিয়েতনামের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞরা ভিয়েতনামের নাগরিকদের নিম্ন স্থূলতা হার এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্যকে দায়ী করেন। ভিয়েতনামের নাগরিকদের বয়সের মধ্যমা ৩০.৫ বছর। পুরো জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬.৯% এর বয়স ৬৫ এর উপর। কিন্তু এসব পরোক্ষ কারণের বাইরে ভিয়েতনামের করোনা যুদ্ধকে সফল করতে ভূমিকা রেখেছে সরকার এবং জনগণের দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ।
করোনার পূর্ব প্রস্তুতি এবং দ্রুত কড়াকড়ি আরোপ
ভিয়েতনামের করোনা সাফল্যের পেছনে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের করোনা পূর্ব প্রস্তুতি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে যখন অস্বাভাবিক নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামে করোনা সংক্রমণ পাওয়ার ২ দিন আগে সরকার থেকে মহামারি প্রতিরোধ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। জানুয়ারি মাসের শেষদিকে করোনা প্রতিরোধে বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় এবং সকারি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির কাজ ছিল সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন নীতিমালা জারি করা। করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিতেই দেশের সমস্ত বিমান এবং স্থল বন্দরে তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথম সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর বিদেশি নাগরিকদের ভিয়েতনাম প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সামাজিক দূরত্ব মানার উপর বিশেষ জোরদার এবং বিধি অমান্য করলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর বিদেশ ফেরতদের জন্য ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়।
ভিয়েতনামের প্রবেশপথগুলোতে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস করতে শুরু থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, বিপণন কেন্দ্র, পার্ক, সিনেমা হল, উপসনালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সবধরনের অনুষ্ঠান বাতিল এবং স্থগিত করে দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ আসার বহু আগেই ভিয়েতনামে অফিস, আদালতসহ অন্যান্য উন্মুক্ত স্থানে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক ঘোষিত হয়। নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ব্যতীত অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এপ্রিলের শুরুতে জনসাধারণের চলাচলের উপর সারাদেশে ৩ সপ্তাহব্যাপী কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
সাশ্রয়ী পরীক্ষা এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং
করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে গণহারে পরীক্ষার উপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়ে কোভিড রোগী শনাক্ত করে আলাদা করা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি বেশ সময়সাধ্য এবং ব্যয়বহুল। ভিয়েতনাম সরকার তাই গণহারে পরীক্ষার বদলে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এবং উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করে দেয়। সারাদেশে মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যক্তির দেহে করোনা পরীক্ষা করা হয়। ভিয়েতনামের এই পন্থা কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে কম পরীক্ষা করলেও ভিয়েতনাম সরকার হাত গুঁটিয়ে বসে থাকেনি। কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত ব্যক্তিদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া সকল ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করার ব্যবস্থা করে সরকার। এমনকি রোগীর সাথে পূর্বে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নাম তালিকাভুক্ত করে তাদের আলাদা করে সতকর্তামূলক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এভাবে পুরো একটি গ্রাম বা শহর কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তাই পরীক্ষা কম থাকলেও সরকারের বিস্তৃত কন্টাক্ট ট্রেসিং অভিযানের ফলে ভিয়েতনামে কমিউনিটি সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ রোধ হয়।
ভিয়েতনামে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ নাগরিককে সরকারি, বেসরকারি এবং নিজ ব্যবস্থাপনায় আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ভার সম্পূর্ণভাবে সরকার নিজের হাতে তুলে নেয়। সরকারের এমন পদক্ষেপ কার্যকর প্রমাণিত হলেও এর খরচ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। করোনা যুদ্ধে ভিয়েতনাম তাদের দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ০.২% ব্যয় করে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই করোনা চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যবহৃত হয়।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের অভিনব ব্যবহার
সরকারের পদক্ষেপকে ফলপ্রসূ করতে অন্যতম অবদান ছিল ভিয়েতনামের গণমাধ্যমের। কোনোরকম গোপনীয়তা না করে তারা শুরু থেকে করোনার ভয়াবহ রূপ এবং এর প্রতিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন করতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভিয়েতনামে করোনা নিয়ে বেশ মজাদার একটি গান ভাইরাল হয়ে যায়। গানটির নাম Ghen Co Vy. নিয়মিত হাত ধৌত করার অভ্যাস নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় ছন্দ ব্যবহার করে লেখা এই গান ভিয়েতনামিদের ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে যায়। সরকারিভাবে এই ভিডিও প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। বিশেষ করে, শিশুদের মাঝে এই ভিডিও সংগীত সহজ শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
ভিয়েতনামের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এনকোভি নামক একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে ভিয়েতনামিরা দৈনিক তাদের স্বাস্থ্য যাচাই করতে পারতো। তাছাড়া হটস্পট অঞ্চল এবং কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্যেও সহায়ক ছিল এই অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে ভিয়েতনামিরা প্রতিবেশি বা পরিচিত কেউ বিদেশ ফেরত হয়েও কোয়ারেন্টিনে না গেলে তা সরকারকে জানিয়ে দিতে পারতো। যদিও এই কাজটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বেশ সমালোচিত হয়েছে। এছাড়া কোভিড রোগীদের সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য মেডিকেল দ্রব্য এবং সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ১৯ মার্চ একটি তহবিল গঠন করে দেশবাসীর নিকট অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়। ৫ এপ্রিলের মধ্যে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অনুদানে সেখানে ২.১ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ জমা হয়। এভাবে দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কড়াকড়ির মধ্যেও মহামারি মোকাবেলা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
নিজস্ব টেস্ট কিট প্রস্তুতকরণ
পরীক্ষার সংখ্যা তুলনামূলক কম করলেও ভিয়েতনাম সরকার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রায় ২ লাখ টেস্ট কিট আমদানি করে। তবে বিদেশি টেস্ট কিটের উপর নির্ভরশীল থাকার ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না ভিয়েতনামিরা। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পদ্ধতি ব্যবহার করে তার দ্রুত এবং ঝামেলামুক্ত কোভিড শনাক্তকরণ কিট প্রস্তুত করে। মহামারি দেখা দেওয়ার একমাসের মাথায় ভিয়েতনামি বিজ্ঞানীরা এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। এই কিটের সাহায্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এবং কম খরচে করোনা শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া করোনার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আলাদা করার জন্যেও এই কিট ব্যবহার করা হয়।
খেসারত যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়
কোভিড-১৯ এর লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত বিজয়ী হিসেবে গণ্য হচ্ছে ভিয়েতনাম। তবে এই বিজয়ের খেসারত দিতে হচ্ছে দেশটির অর্থনীতিকে। জানুয়ারিতে করোনাভাইরাস দেশে মহামারি আকার ধারণ করার পূর্বেই আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে কড়াকড়ি আরোপ করার ফলে ভিয়েতনামের অর্থনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ভিয়েতনামে ধীর প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে যা ২.৭% এ গিয়ে নামতে পারে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বেশ বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। তবে বর্তমানে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকায় লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো সংক্রমণ দেখা না দিলে হয়তো কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে ভিয়েতনাম। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুরোদমে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভিয়েতনামিরা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে সেটা সময়সাধ্য হবে এবং সরকারি সহায়তায় বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি হতে হবে।
২২ এপ্রিল ভিয়েতনাম সরকার সারাদেশে চলমান কড়াকড়ি ব্যবস্থা প্রত্যাহার ঘোষণা করে। মে মাসের শুরুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভিয়েতনামে সিনেমা হল, গণপরিবহন, অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল, পার্ক, অফিস-আদালত- সবকিছু চলছে আপন গতিতে। তবে জনসাধারণের উপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে এখনো কঠোর অবস্থানে আছে সরকার। বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান নিয়ম অমান্য করলে আছে জেল-জরিমানা।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, ১৬ এপ্রিলের পর স্থানীয়ভাবে কোনো ভিয়েতনামি করোনায় আক্রান্ত হননি এবং মৃতের ঘরের সংখ্যা শূন্য। তবে বিদেশফেরত ৫৪ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তাদের যথাযথ কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ভিয়েতনাম করোনা যুদ্ধে সফল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। করোনা শুরু হওয়ার পূর্বে নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি সেরে মহামারির সময়ে সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ কার্যকর করার মাধ্যমে তারা বিশ্ববাসীর নিকট নজির স্থাপন করেছে। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে করোনার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিয়েতনাম এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করছে। দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সামনে হয়তো ভিয়েতনামকে তাদের সীমান্ত পুনরায় খুলে দিতে হবে। সেক্ষত্রে ভিয়েতনাম নতুন কী কী পদক্ষেপ নেয়, তা সবার আগ্রহের বিষয়।