পটাসিয়াম হলো গুরুত্বপূর্ণ মিনারেলগুলোর মধ্যে একটি, যেগুলো শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি আমাদের শরীরে অধিক ও ঢের পরিমাণে পাওয়া মিনারেলগুলো মধ্যে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ মিনারেল, যা আমাদের হৃদপিণ্ড, বৃক্ক, মস্তিষ্ক এবং পেশীবহুল টিস্যু কার্যকরী করার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। রক্তে পটাসিয়ামের ঘাটতি (হাইপোক্যালেমিয়াও বলা হয়ে থাকে) প্রচন্ড মাথাব্যথা, হৃদযন্ত্রের রোগ এবং অন্যান্য সমস্যা কারণ হয় দাঁড়ায়। এই বিষয়গুলো জেনে নিশ্চয়ই এখন মনে হচ্ছে যে, প্রতিদিন আপনার শরীরে কী পরিমাণ পটাশিয়ামের চাহিদা রয়েছে, তাই না? দিনে ১,৬০০-২,০০০ মিলিগ্রাম পরিমাণ পটাসিয়ামের চাহিদা থাকে শরীরে। এই পরিমাণটি পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার ও সাপ্লিমেন্ট মিলে একদিনের মোট চাহিদা।
১) আলু বোখরা
এক কাপ আলু বোখরাতে ১,২৭৪ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৪১৮ ক্যালরি থাকে। এতে প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ৩৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন এ যা চোখের স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন ধরনের চোখের রোগ যেমন- চোখের শুষ্কতা, ম্যাকুলার অবক্ষয় এবং ছানির সমস্যা প্রতিরোধ করে। ফ্রুট সালাদ, সকালের স্মুদিতে আলু বোখরা মিশিয়ে খেতে পারেন। এছাড়াও এর স্বাদ ভালো হওয়ায় শুধু আলু বোখরাও খাওয়া যায়। আলু বোখরা রুচিবর্ধক হিসেবেও কাজ করে।
২) পালং শাক
এক কাপ (৩০ গ্রাম) পালং শাকে রয়েছে ১৬৭ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৭ ক্যালরি রয়েছে, যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। এছাড়াও পালং শাক আয়রনের বেশ ভালো একটি উৎস (পাপাই কার্টুন চরিত্রটির কথা মনে থাকলে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে)। আয়রন চুলকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে এবং ক্লান্তি বা অবসাদ ও রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে। পালং শাক দিয়ে আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয় দেশীয় রেসিপি রয়েছে যা তৈরি করে নিতে পারেন সহজেই। এছাড়াও স্মুদি বা স্যুপ বানিয়েও খেয়ে নিতে পারেন।
৩) স্যামন মাছ
স্যামন মাছের ফিলের অর্ধেকটাতে (১৯৮ গ্রাম) ৯৭০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম ও ২৮১ ক্যালরি থাকে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ২৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। সম্ভবত, স্যামন মাছে সবচাইতে উপকারী উপাদানটি হলো ওমেগা-৩। আর এই ওমেগা-৩ জ্বালাপোড়াভাব দূর করে এবং হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। স্যামন মাছের ফিলে দিয়ে আপনার কোনো প্রিয় রেসিপি আছে কী?
৪) কলা
একটি বড় কলাতে (১৩৬ গ্রাম) ৪৮৭ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ১২১ ক্যালরি থাকে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ১৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। এছাড়াও কলা কর্মশক্তি বৃদ্ধির বেশ ভালো একটি উৎস। এতে আরও রয়েছে ফাইবার যা হজমশক্তি বাড়ায়। সকালে নাস্তার সাথে বা বিকেলে কোনো স্ন্যাকসের সাথে কলা খেয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেম বা কলার স্মুদি বানিয়ে খেয়ে নিতে পারেন।
৫) মিষ্টি আলু
এক কাপ মিষ্টি আলুতে (১৩৩ গ্রাম) ৪৪৮ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ১১৪ ক্যালরি থাকে, যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ১৩ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। মিষ্টি আলু গ্লাইসেমিক সূচকে (মানুষের শরীরে ব্লাড সুগারের মাত্রায় খাবারে থাকা কার্বোহাইড্রেটের প্রভাবের মান) নিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এই সবজিটি ডায়াবেটিকস্ রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। মিষ্টি আলু সেদ্ধ বা বেক করে খেতে পারেন। এতে এর পুষ্টিগুণও যথাযথভাবে বজায় থাকবে।
৬) গাজরের জুস
এক কাপ গাজরের জুসে (২৩৬ গ্রাম) রয়েছে ৬৮৯ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৯৪ ক্যালরি রয়েছে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। গাজরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন- বেটা-ক্যারোটিন, লুতিন এবং যিযানথিন, যা চোখকে রাখে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে নাস্তার সাথে গাজরের জুস পান করতে পারেন।
৭) ডাবের পানি
এক কাপ ডাবের পানিতে (২৪০ গ্রাম) আছে ৬০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৪৬ ক্যালরি আছে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ১৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। ডাবের পানি ব্লাড সুগারের মাত্রা কম করে ডায়াবেটিসের উপকারী খাবার হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও ডাবের পানি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে প্রচুর ডাবের পানি পাওয়া যায়। আপনি প্রতিদিন ডাবের পানি খাচ্ছেন তো?
৮) আনার
একটি আনারে (২৮২ গ্রাম) ৬৬৬ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম ও ২৩৪ ক্যালরি থাকে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ১৯ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। আনারে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনলস্ নামে এক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা জ্বালাপোড়াভাব এবং আর্থাইট্রিসের সমস্যা প্রতিরোধ করে। আনারে থাকা এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। ফ্রুট সালাদ বা যেকোনো ধরনের ডেজার্টে আনার মিশিয়ে খেতে পারেন।
৯) টক দই
এক বাটি টক দইতে (২২৭ গ্রাম) ৩৫২ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম ও ১৩৮ ক্যালরি থাকে যা প্রতিদিন আমাদের শরীরে পটাসিয়ামের ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। এতে রয়েছে প্রোবায়োটিকস্ যা ভেতর থেকে শরীরকে সুস্থ রাখে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং এটি হাড়ের বিভিন্ন রোগ, যেমন- অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। আর টক দইতে যে প্রোটিন রয়েছে তা শরীরের সার্বিক উন্নয়নেও সহায়ক। আপনি শুধু টক দই, ফ্রুট সালাদের সাথে মিশিয়ে বা ডেজার্ট আইটেম বানিয়েও খেয়ে নিতে পারেন।
শরীরে সঠিক পরিমাণে পটাসিয়ামের চাহিদা পূরণের উপকারিতাগুলো নিচে দেয়া হলো।
১) হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
গবেষণা মতে, পটাসিয়াম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে সেগুলো রক্তচাপ কম করতে সাহায্য করে যা যেকোনো ধরনের হৃদরোগের মুখ্য কারণ।
২) সেলুলাইটের আবির্ভাবের ঝুঁকি কমায়
ফ্লুইড ধারণ করার কারণেই সেলুলাইটের আবির্ভাব হয়। আর পটাসিয়াম কোষগুলো থেকে সেই অতিরিক্ত ফ্লুইড বের করে দিতে সাহায্য করে। এর জন্যই সেলুলাইটের ঝুঁকি কমে যায়।
৩) খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে সাহায্য করে
পটাসিয়াম শরীরে কার্বোহাইড্রেট কার্যকরী এবং প্রক্রিয়াকরণ করতে সাহায্য করে। এটি সার্বিকভাবে শরীরের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪) অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সাহায্য করে
শরীরে পটাসিয়ামের পর্যাপ্ত পরিমাণ চাহিদা পূরণ হলে অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমে যায়। এই মিনারেলটি হাড় সুস্থ রাখতে এবং হাড়ের যেকোনো ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো যেসব প্রতিরোধ করে, সেগুলো নিয়ে আমরা কতই না চিন্তিত থাকি এবং সতর্কতা অবলম্বন করার কথা ভাবি। সতর্কতা অবলম্বন তো অবশ্যই করতে হবে, তবে এখানে উল্লেখিত খাবারগুলো নিয়মিত খাবার তালিকায় রাখলে কিন্তু সহজেই শরীরে পটাসিয়ামের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর এতে করে পটাসিয়ামের ঘাটতির কারণে হওয়া রোগগুলোর ঝুঁকিও কমে যাবে।
Feature Image Source: YouTube