বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। লন্ডনের রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলেন এক নারী। তাকে হাসপাতালে নিয়ে সার্জারির জন্য দ্রুত স্থানান্তর করা হলো। সবকিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছিলো, তারপরও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এর কারণ জানতে কর্তব্যরত ডাক্তার তার মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখতে পান দুর্ঘটনার পর তার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ব্যাপারটি যদি সার্জারির আগে পরীক্ষা করা যেত, তবে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত।
এটা কেবল অনেকগুলো ঘটনার একটি। এরকম অনেকগুলো ঘটনাকে একসাথ করলেই একটি নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা যায়, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুপথযাত্রীর শরীরের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাবে এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণ করা সহজ হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারের ধারণা চলতি বছরগুলোতে বেশ আলোচিত হচ্ছে। সবার মতে, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে আমাদের চিরায়ত ওষুধের ব্যবহার ও চিকিৎসা সেবার ধারণা বদলে যাবে।
ওষুধ গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
চিকিৎসাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার মূলত এমন একটি ধারণা, যেখানে যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী সেবা দেয়া হবে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই হবে স্বয়ংক্রিয়, যেখানে ব্যবহৃত মেশিনের নিজে থেকেই শেখার ক্ষমতা থাকবে। আপাতদৃষ্টিতে পুরো জিনিসটি সরল মনে হলেও তেমনটা নয়, মূলত অনেকগুলো বিষয়কে একসাথে করে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে। যেমন- সবার প্রথমেই একজন রোগীর সাক্ষাৎকার নেয়া হবে এবং পাশাপাশি কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা হবে।
তারপর প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর্ব চলবে। যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের পর কোন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে সেটা নির্ধারিত হবে। চিকিৎসা পরবর্তী নির্দেশনা প্রদান এবং মনিটরিংয়ের দায়িত্ব থাকবে এসব মেশিনের উপর। মেশিনগুলো একজন রোগীর রোগের ইতিহাস, বয়স, লিঙ্গ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল, সেনসিটিভিটি, ডিএনএ সিকোয়েন্স এবং অসংখ্য ক্যাটাগরির তথ্য মজুদ রাখবে। যে পরিমাণ তথ্য একজন মানুষের মনে রাখা সম্ভবের বাইরে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক ব্যবহার
চিকিৎসাক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার শুরু হতে পারে ইমেজিংয়ের ক্ষেত্রে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত কতগুলো ইমেজিং হলো এক্সরে, ইসিজি, সিটি স্ক্যান, ইকোকার্ডিওগ্রাম, এমআরআই ইত্যাদি। এগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণ হিসাবের বাইরে। এগুলোর খুব সামান্যই আমরা কাজে লাগাতে পারি। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য আমরা আর রেকর্ড করে রাখি না।
কিন্তু আমরা যখন তথ্যগুলোর রেকর্ড রাখতে শুরু করবো, তখন দেখা যাবে, কী পরিমাণ নতুন তথ্য আমাদের নাগালে থাকছে। এগুলোর বেশিরভাগই বিশ্লেষণ করে কোনো রোগের সিকোয়েন্স বোঝা যাবে এবং রোগীভেদে মিল-অমিল বুঝে ওষুধ প্রদানে সতর্ক হওয়া যাবে।
আর এতসব কাজ করে দেবে মেশিন, যার নিজস্ব শেখার অ্যালগরিদম রয়েছে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি ভেদে ফলাফল প্রদানে পারদর্শীতা দেখাবে। একজন ঝানু বিশেষজ্ঞের চোখ ফাঁকি দিয়ে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ডাটা কিংবা সিকোয়েন্স ফসকে যেতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি সচল মেশিন কখনো ভুল করবে না।
অনেক সময়ই কোনো রোগীর ডাটা অ্যানালাইসিস করে এমন কিছু পাওয়া যেতে পারে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন। কিন্তু বহু বছর পর অন্য আরেকজন রোগীর ঠিক একই রকম জটিলতায় এই ডাটা সিকোয়েন্স কাজে লেগে যেতে পারে। আর বিরল সিকোয়েন্সের ঘটনাগুলো যদি আবার নতুন করে সামনে এসে যায়, সেটা কারও মৃত্যুর কারণ না হয়ে বরং পুরনো কোনো চিকিৎসাকেই সামনে এনে দেবে। আর এই কাজটি করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! কিন্তু জরুরি মুহূর্তে এত জটিল ডাটা বিশ্লেষণ করে কোনো মনুষ্য জিনিয়াসের পক্ষেও নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। যদি কালেভদ্রে হয়েও যায়, সেটা হবে মেডিক্যাল মিরাকল!
তাহলে কি মানুষের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাচ্ছে?
একটি কথা আগেই বলা হয়েছে, একজন বিশেষজ্ঞের পক্ষেও এত বিশাল পরিমাণ ডাটা কিংবা সেগুলোর সিকোয়েন্স মনে রাখা সম্ভব নয়। এটি কেবল একটি যন্ত্রেরই কাজ। এর দ্বারা এটাই বোঝানো হচ্ছে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনো একজন বিশেষজ্ঞ কিংবা এখানে কর্মরত কাউকে সরিয়ে দেবে না। বরং তাদের কাজকে সহজতর এবং নির্ভূল করতে সহায়তা করবে।
চিকিৎসা সেবা প্রদানে প্রতি মুহূর্তেই নিত্যনতুন সব বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়, যার ভেতর যথাযথ তথ্যের অভাবে ভুল চিকিৎসা প্রদানের ব্যাপার সামনে নিয়ে আসা যায়। কিংবা একজন রোগীর সব তথ্যই সংগ্রহে রয়েছে, কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নজরের বাইরে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই সবার আলাদা তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে, সেইসাথে একই ধরনের সিকোয়েন্সে ব্যবহারের জন্য কী করা যেতে পারে তার ধারণাও দিতে পারে।
তাই দেখা যাচ্ছে, যিনি চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন, তিনি আরও বেশি সময় ধরে সবাইকে গড়পরতা বেশি সময় দিতে পারছেন আলাদাভাবে।
একটি মেশিন যতই তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারুক না কেন, সেটি কখনো মানবিকভাবে চিন্তার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। মেশিন কখনো ভাবতে যাবে না একজন রোগীর আসলে কী প্রয়োজন, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন, পরিবারের লোকজনদের কাছে সে কতটা গুরুত্ব বহন করে! এটা একজন মানুষেরই কাজ যে, তার রোগীর মানসিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনা।
মেশিনের কাজ হবে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা, তথ্য সম্পর্কযুক্ত করা, সিকোয়েন্স তৈরি করা এবং সবশেষে ফলাফল দাঁড় করানো। তাই যারা চিকিৎসা সেবার চর্চা করবেন তাদের কাজ হবে রোগীকে আরও বেশি সময় দেয়া এবং প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে মানবিক সিদ্ধান্ত নেয়া, প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অবস্থা দেখভাল করা। সবচেয়ে বড় কথা, এই মেশিনগুলোকে চালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন লোকবল লাগবে, যা একজন মেডিক্যাল প্র্যাকটিসিয়ান হিসেবে অপারেট করতে জানতে হবে। মেশিন নিজে থেকে কখনোই বুঝতে পারবে না যে, তাকে আসলে ঠিক কী করতে হবে! তার কাছে অযুত তথ্যের ভান্ডার থাকবে ঠিকই, কিন্তু মানুষ কী জানতে চাচ্ছে সেটা মেশিনকে বলে দিতে হবে।
ব্যাপারটি যখন গোপনীয়তার
একজন রোগীর তথ্যের গোপনীয়তার ব্যাপারে পেশাদাররা সবসময়ই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নৈতিকতার প্রশ্নে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে গোপনীয়তা নিয়ে কখনোই ভাবতে হয়নি। এটা বহুকাল থেকেই চলে আসছে। তাই একটি মেশিনকে যখন তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সেগুলো বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন মেশিনকে চালনা করা মানুষটিই গোপনীয়তার জন্য দায়ী থাকবেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই নিজেদের ভেতর অথবা অপর কারও সাথে একজন রোগীর তথ্য আদানপ্রদান করতে যাবে না, যদিও একটি ডিভাইসের সাথে অনেকগুলো ডিভাইসের যোগাযোগ থাকে। তাই গোপনীয়তার ব্যাপারটি আগে যেমন মানুষের হাতে ছিলো, প্লাটফর্ম বদলানোর কারণে কখনোই অন্য কারও হবে না। সবক্ষেত্রে মানুষই এর নিয়ন্ত্রক।
দৈনন্দিন রুটিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব
এখন একজন রোগীকে ক্লিনিকে আসতে হয় নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য। ওষুধ গ্রহণ, সময় নির্ধারণ এবং অবস্থার উন্নতি-অবনতি পর্যবেক্ষণের জন্য ডাক্তারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়। অনেকের জন্যই এটা বিরক্তিকর যে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে নিজের চেকআপ করাতে হয়।
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এরকম কোনো সমস্যাই তৈরি হবে না। একজন রোগীর পুরো সময়টিই পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত থাকবে অসংখ্য সেন্সর। সেগুলো শরীরে এবং বাসস্থানের বিভিন্ন জায়গায় সেট করা থাকবে। তাদের কাজ হবে প্রতিনিয়ত একজন রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা- রক্তচাপের তারতম্য, হৃদস্পন্দন, ওষুধ ব্যবহারের সময়, কোনো জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না ইত্যাদি।
স্বাভাবিকভাবে একজন ডাক্তার একসাথে নিজের সব রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সেন্সরগুলো সবাইকে সতর্ক করতে পারবে এবং ক্লিনিক্যাল জটিলতা তৈরি হলে নিয়োজিত ডাক্তারকে দ্রুত অবহিত করতে পারবে। এই ধরনের সিস্টেম ইন্সটল করার কারণে সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচবে, সেই সাথে কম সময়েই দেয়া যাবে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট।
বলা বাহল্য, ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মেডিকেল সেক্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তৎপর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। আগামী দশকে গিয়ে বিলিয়ন ডলার খরচের যে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, সেই স্রোতে যোগ দেবেন অনেকেই। তাই এত বড় একটি পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিয়ে নিরাপদ সেবা প্রদান করাটাই হওয়া উচিত আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য।