প্লেগসহ বেশ কিছু রোগের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এখন অবধি ব্ল্যাক ডেথ বা এর পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট মহামারি নিয়ে সুস্পষ্ট ইতিহাস বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো গবেষকের মতে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যেরও হাজার বছর আগে ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল এই পৃথিবীতে। ইউরোপিয়ান গবেষকরা এসব মহামারির উৎস খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ানদের দুষতেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর দায় এশিয়ানদের থেকে কম নয়।
মহামারি তৎক্ষণাৎ লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করলেও মানুষ নিজেরাই ধীরে ধীরে মোকাবেলার পথ খুঁজে নিয়েছে। ব্ল্যাক ডেথ মানুষকে কোয়ারেন্টিন এবং সামাজিক দূরত্বের মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা শিখিয়েছে। কিন্তু মহামারি মোকাবেলায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছিল প্রতিষেধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্লেগ অভ জাস্টিনিয়ান থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে চলমান করোনাভাইরাসের সময় অবধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শুধুমাত্র সামাজিক দূরত্ব মহামারি সৃষ্টিকারী রোগগুলোকে একেবারে ঘায়েল করতে পারেনি; বরং মানুষের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত করেছিল।
ভ্যাকসিনকে মানবসভ্যতার জন্য একটি আশির্বাদ বলে থাকেন অনেক গবেষক। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। হয়তো বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হলে গুটিবসন্ত এবং প্লেগের কারণে এতদিনে পৃথিবীর জনসংখ্যা অর্ধেক কমে যেত। ঠিক যেভাবে প্লেগ অভ জাস্টিনিয়ানের সংক্রমণে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ মিলিয়নের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যা ছিল তখনকার পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। আনুমানিক ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে এটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে সংক্রমিত হয়।
ভ্যাকসিন মানুষকে নিশ্চিন্তে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে। প্রতিষেধকের কারণে পৃথিবী থেকে অনেক রোগ একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম সফলতা। আজ আমরা আলোচনা করব এমন কয়েকটি রোগ নিয়ে, ভ্যাকসিনের কল্যাণে যেগুলোর নাম ভুলতে বসেছে মানুষ।
গুটিবসন্ত
১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত একেবারে নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। মূলত গবেষকদের দীর্ঘদিনের গবেষণায় আবিষ্কৃত প্রতিষেধকের মাধ্যমে পুরো পৃথিবী থেকে রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। যদিও শত শত বছর যাবত কম ক্ষতি করেনি এটি। ১৭৮০ এর দশকে বা তারও আগে গুটিবসন্তে আক্রান্ত ৩০ শতাংশ রোগীই মৃত্যুবরণ করত। সেসময় ইউরোপিয়ান নাগরিকদের নিয়মিত ভ্রমণের কারণে দুই আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছে গিয়েছিল এই প্রাণঘাতী রোগটি। শুধুমাত্র এ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকা এবং মেক্সিকোতে আদিবাসীদের সংখ্যা ১০ মিলিয়ন থেকে ১ মিলিয়নে নেমে আসে। মূলত এ ধরনের রোগের সঙ্গে আগে কখনোই পরিচিত ছিল না ঐ অঞ্চলের মানুষজন।
গুটিবসন্ত থেকে মানবজাতিকে পরিত্রাণ দিতে দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়েছিলেন ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার। ১৭৯৬ সালে তিনি গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। মূলত এটিই ছিল মানবজাতির ইতিহাসে মহামারি সৃষ্টিকারী যেকোনো রোগ নির্মূলে আবিষ্কৃত প্রথম প্রতিষেধক। ডাক্তার জেনার ভ্যাকসিনের নাম দেন ‘কাউফক্স’। প্রাণীদেহে একাধিক পরীক্ষা চালানোর পর তিনি আট বছর বয়সী একটি ছেলের উপর ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালান। বালকের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর যখন ডাক্তার জেনার দেখলেন, গুটিবসন্তে আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে গিয়েও ছেলেটি আক্রান্ত হচ্ছে না, তখন তিনি বুঝতে পারেন- তার ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা রয়েছে।
বর্তমান সময়ের তুলনায় ফলাফল খুব একটা ভালো মনে না হলেও সেসময়ের জন্য ডাক্তার জেনারের সফলতা ছিল বিশাল ব্যাপার। ইউরোপীয়দের মধ্যে স্পেন সর্বপ্রথম গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করে। পুরো স্প্যানিশ সাম্রাজ্যে পৌঁছানো হয়েছিল এ প্রতিষেধক। স্পেনের পর ব্রিটিশরাও আনুষ্ঠানিকভাবে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়। অতঃপর ১৮৫০ এর দশকে ম্যাসাচুসেটস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাজ্য হিসেবে গুটিবসন্ত নির্মূলে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করে। যদিও গুটিবসন্ত নির্মূলে বৈশ্বিক কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৯৭৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ এবং নেতৃত্বদানকারী দেশ সমূহ বৈশ্বিকভাবে এটি নির্মূলের কার্যক্রম হাতে নেয় এবং সফল হয়।
র্যাবিস বা জলাতঙ্ক
এ রোগের ইতিহাস বেশ পুরনো। গবেষকদের ধারণা, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকেই এটি পৃথিবীতে বিরাজ করছে। ১৭৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে সর্বপ্রথম র্যাবিস ধরা পড়ে। মূলত বিভিন্ন প্রাণীর কামড়ে বা আঘাতের কারণে রোগটি প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এ রোগের সংক্রমণ আমেরিকা মহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র্যাবিসের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। সে সময় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনে বিলবোর্ড ঝোলানো হয়।
তবে এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারে বেশি সময় নেননি গবেষকরা। প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন প্রদানের প্রচলন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সময়ের সাথে সাথে মানুষ নিজ বাড়িতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী লালন-পালনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর তাই মানুষের দেহে নয়, বরং বাড়িতে পালনকৃত সে সমস্ত প্রাণীদেহে র্যাবিসের প্রতিষেধক প্রদানের পদ্ধতি চালু হয়। যদিও মানবদেহে প্রতিষেধক প্রদানের পদ্ধতি এখনো চালু রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা মার্কিনিরা এ রোগকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করলেও আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক অঞ্চলে এখনো র্যাবিস বা জলাতঙ্কে প্রতিনিয়ত মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ১৭,০০০ এর বেশি মানুষ এ রোগে প্রাণ হারায়। এজন্য অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশসমূহে প্রতিষেধক সহজলভ্য করা অত্যন্ত জরুরি।
পোলিও
এ রোগ সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত। কারণ, ছোটবেলায় সবাই পোলিওর প্রতিষেধক গ্রহণ করেছি। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ প্রায় সবক’টি দেশের সরকারই এ রোগের প্রতিষেধক বিনামূল্যে বিতরণ করছে। অথচ কয়েক দশক আগেও পোলিও রোগের ব্যাপারে রীতিমতো অমনোযোগী ছিল বিশ্ববাসী। যদিও হাজার বছর আগেও এ রোগের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন গবেষকরা। খ্রিস্টপূর্ব ১,৪০০ অব্দে মিশরে এ রোগে আক্রান্ত রোগী ছিল বলে জানা যায়। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পোলিও রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। তবে তখন এটি একেবারেই তোয়াক্কা করেনি চিকিৎসাবিজ্ঞান।
পোলিওতে আক্রান্ত হলে শরীরের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থায়ীভাবে কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, গত শতাব্দীতে পোলিওর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিনিরা। চল্লিশের দশকে প্রায় ৩৫,০০০ মার্কিন নাগরিক পোলিও আক্রান্ত হন। ১৯৫২ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দেশটিতে ৫৭,৮৭৯ জন পোলিও আক্রান্ত রোগী ছিলেন, যাদের মধ্যে ৩,১৪৫ জন মৃত্যুবরণ করেন।
তৎকালীন বিশ্বে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত আর কোনো দেশ পোলিও মোকাবেলায় এতটা তৎপর হয়নি। আর এ কারণেই পোলিও রোগের প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন মার্কিন গবেষক জোনাস এডওয়ার্ড সাল্ক। ১৯৫৪ সালে তিনি শিশুদের উপর এই ভ্যাকসিনটির পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেন। সেসময় ৬,২৪,৯৭২ শিশু ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিল। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জোনাস সাল্কের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ৮০-৯০ শতাংশ। তার এ ভ্যাকসিন মার্কিনিদের জন্য নবযুগের সূচনা করে। ১৯৭৯ সালের পর দেশটিতে আর কোনো পোলিও রোগীর দেখা মেলেনি। তবে ২০১৬ সালের হিসেবে দেখা গেছে, পোলিও এখনও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়নি। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে এখনও পোলিও আক্রান্ত রোগী আছে বলে ধারণা গবেষকদের।
ইনফ্লুয়েঞ্জা
যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন অনেকেই বলাবলি করছিলেন এটি ফ্লু থেকে মারাত্মক কিনা। দীর্ঘ এক বছর পর আমরা সবাই কম-বেশি বুঝতে পেরেছি, করোনাভাইরাস কতটা ক্ষতিসাধন করেছে। তবে ইতিহাস বলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করেছে ১৯১৮-১৯ সালে। স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত মহামারির সংক্রমণে ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়। কোনো কোনো হিসেবে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি। এছাড়াও পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সেসময় স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল।
আর এই ইনফ্লুয়েঞ্জা পৃথিবী থেকে একেবারেই নির্মূল করতে পারেননি গবেষকরা। তবে একে দমিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিষেধক প্রয়োগের মাধ্যমে। অন্যথায় প্রতি দশকে একবার করে মহামারির রূপ নিতে পারত রোগটি। চল্লিশের দশকে থমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র এবং জোনাস সাল্কের নেতৃত্বে একদল গবেষক মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। পরের বছর এটি সাধারণ নাগরিকদের জন্যও সরবরাহ করা হয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার পরেই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে নতুন গবেষণাগার নির্মাণ করে। ১৯৪৮ সালে লন্ডনে অবস্থিত ইংল্যান্ডের জাতীয় ওষুধ গবেষণাকেন্দ্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য নতুন বিভাগ চালু করা হয়।
যদিও অন্যান্য রোগের মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা বিলুপ্ত হয়নি, বরং নতুন রূপে ফিরে এসে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত করেছিল এবং গবেষকদেরও নিয়মিত ব্যস্ত রেখেছিল এটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি প্রতিটি মহাদেশীয় সংস্থা ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবুও দমিয়ে রাখা যায়নি একে। বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, হংকং ফ্লু-র মতো রোগ ছড়িয়ে পৃথিবীতে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ইনফ্লুয়েঞ্জা। তবে সঠিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের কারণে একে দমিয়ে রাখার জন্য যে পদ্ধতি চিকিৎসাবিজ্ঞান শিখিয়েছে, সেটাকেই ভবিষ্যতের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে দেখছেন বর্তমান সময়ের চিকিৎসকেরা। সময়ের পরিক্রমায় নতুন রূপে হানা দিতে পারে এটি, অন্ততপক্ষে অতীতের ইতিহাস এমনটাই ইঙ্গিত করে।