বেশ কয়েকদিন ধরেই গন্ধটা পাচ্ছে নুহাশ (ছদ্মনাম)। বেশ অদ্ভুত একটা গন্ধ। ঠিক দুর্গন্ধের কাতারেও ফেলা যায় না ওটাকে। গন্ধটা পেলে মনে হয়, যেন আশেপাশের কেউ রাবার বা প্লাস্টিকজাতীয় কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
সে যখন প্রথম প্রথম গন্ধটা পায়, তখন ভেবেছিলো, হয়তো বাসার আশপাশের কোথাও কিছু পোড়ানো হচ্ছে। পোড়ানো শেষ হলেই গন্ধটা চলে যাবে। কিন্তু সপ্তাহখানেক বাদেই টের পেলো, সে যেখানেই যাক না কেন, গন্ধটা তার পিছু ছাড়ছে না। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, গন্ধটা একমাত্র সেই টের পায়, অন্য কেউ নয়।
শুরুতে নাকের এক পাশের ছিদ্র দিয়ে গন্ধটা পেতো সে। এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছে উভয় পাশেই। গন্ধটা এতই তীব্র যে নাকে রুমাল চেপে ধরলেও ওটা পাওয়া বন্ধ হয় না। বিদঘুটে এ গন্ধের উৎসটা কোথায় তা নিয়ে কোনো ধারণাই নেই নুহাশের। গন্ধের উৎস সন্ধানে বাসা-অফিস কোনোটিই তল্লাশি করা বাদ রাখেনি সে। কিন্তু ফলাফল শুন্য।
একপর্যায়ে এই অদ্ভুতুড়ে গন্ধের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে নুহাশ দেখা করলো এক নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের সাথে। নুহাশের মুখে সব শুনে বিশেষজ্ঞ এমন জবাব দিলেন, যা শুনলে চমকে উঠবে যে কেউই। তিনি বললেন, নুহাশ যে গন্ধটা টের পাচ্ছে, তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। নুহাশের এমন গন্ধ পাওয়ার মূল কারণ একধরনের স্মেল ডিসঅর্ডার, যার নাম ফ্যান্টোসমিয়া।
ফ্যান্টোসমিয়া কী?
ফ্যান্টোসমিয়া একটি স্মেইল ডিসঅর্ডার বা ঘ্রাণ বৈকল্য। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগীর অলফ্যাক্টরি স্নায়ু উল্টোপাল্টা সংকেত দিতে শুরু করে। যার ফলে রোগী বাতাসে এমন গন্ধ পেতে শুরু করেন, যার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। এই অস্তিত্ত্বহীন ঘ্রাণকে বলে ফ্যান্টম স্মেল। এটি জীবনের জন্য মারাত্মক কোনো ঝুঁকির কারণ হয়ে না দাঁড়ালেও দৈনন্দিন জীবনে যে নানা জটিলতা তৈরি করে বেড়ায় সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকেই ফ্যান্টোসমিয়াকে প্যারাসোমিয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। প্যারাসোমিয়াও একধরনের ঘ্রাণ বৈকল্য, তবে এর সঙ্গে ফ্যান্টোসমিয়ার কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
কোনো বস্তুর আসল ঘ্রাণ থেকে বিকৃত থেকে ঘ্রাণ অনুভব করলে, তাকে প্যারাসোমিয়া বলা হয়। অন্যদিকে ফ্যান্টোসমিয়ার মানে হলো এমন সব ঘ্রাণ অনুভব করে বেড়ানো, যার কোনো উপস্থিতিই নেই। যেমন: কোনো ময়লা না থাকলেও দূুর্গন্ধ অনুভব করা।
যেভাবে কাজ করে ফ্যান্টোসমিয়া
আমরা যখন কোনো বস্তুর ঘ্রাণ নিই, তখন আমাদের ন্যাসাল মেমব্রেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মূল ভূমিকা পালন করে। এই মেমব্রেনে অসংখ্য অলফ্যাক্টরি সংবেদী নিউরন কোষ রয়েছে যেগুলোকে ফ্রন্ট ডোর সেন্স নামেও অভিহিত করা হয়। ন্যাসাল মেমব্রেন হতে মস্তিষ্ক পর্যন্ত বিস্তৃত এই নিউরনগুলো বিভিন্ন ঘ্রাণবাহী অণু (Odor Molecules) বিশ্লেষণ করে মস্তিস্ককে ঘ্রাণের উপস্থিতির ব্যাপারে অবহিত করে।
নাক যখন ঘ্রাণ শনাক্ত করতে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন সেটি প্রভাব ফেলে আমাদের স্বাদেন্দ্রিয়ের ওপরে। এই প্রক্রিয়াকে আমাদের ব্যাক ডোর সেন্স দিয়ে ব্যাখা করা যায়। এই স্নায়ুটি ন্যাসাল ক্যাভিটি থেকে শুরু করে গলার শেষমাথা পর্যন্ত বিস্তৃত।
আমরা যখন খাবার খাই, তখন খাদ্যের ঘ্রাণবাহী অনুগুলো আমাদের ব্যাকডোর সেন্সের মাধ্যমে গলা থেকে পৌঁছে যায় ন্যাসাল ক্যাভিটিতে। এটি আমাদের গাস্টেটরি সিস্টেমকে প্রভাবিত করে, যা খাদ্যের স্বাদ গ্রহণের সাথে জড়িত। ফলে ব্যক্তি উল্টোপাল্টা গন্ধ অনুভব করতে শুরু করেন।
কেন হয় ফ্যান্টোসমিয়া?
নাকে ইনফেকশন: ফ্যান্টোসমিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো নাক ও শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন। কোনো কারণে নাসাপথ বা শ্বাসনালীর অভ্যন্তরে ইনফেকশন দেখা দিলে তা থেকে ফ্যান্টোসমিয়া দেখা দিতে পারে।
ন্যাসাল পলিপের সৃষ্টি: পলিপ হলো একধরনের টিস্যুকোষীয় প্রবৃদ্ধি, যা মাংসপিণ্ডের আকারের হয়ে থাকে। নাকে পলিপ জন্ম নিলে সেটির কারণে নাসাপথে বায়ু চলাচল ব্যাহত হতে পড়ে এবং একপর্যায়ে ধূলোবালি ও মিউকাস জমে গোটা নাসাপথ জমাট হয়ে যায়। তখন রোগী উল্টোপাল্টা ঘ্রাণ পেতে শুরু করেন।
মাথায় আঘাত: মস্তিষ্কের টেম্পোরারি লোবে সৃষ্ট ক্ষত ফ্যান্টোসমিয়ার অন্যতম কারণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের টিউমারের জন্য রোগী ফ্যান্টোসমিয়ায় ভুগতে পারেন। তবে এটি খুব কমই ঘটতে দেখা যায়।
নিউরোব্লাস্টোমা: যারা নিউরোব্লাস্টোমায় ভুগছেন, তাদের ফ্যান্টোসমিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। এটি একধরনের ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার, যা অলফ্যাক্টরি স্নায়ুর ওপরে কাজ করে। রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে নিউরোব্লাস্টোমার চিকিৎসা করে কিছুদিনের জন্য উপসর্গগুলো প্রশমিত রাখা যায় ঠিকই, তবে কিছুদিন বাদেই রোগটি আবার ফিরে আসতে পারে।
রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, যেমন- পার্কিনসন্স ডিজিজ, স্ট্রোক এর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। দেখা গেছে, যারা মৃগীরোগে আক্রান্ত, তাদের প্রায় সবারই খিঁচুনি হবার ঠিক পূর্বমূহুর্তে উল্টোপাল্টা ঘ্রাণ পাবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও এটি বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, বিষন্নতার মতো আবেগ বৈকল্যের সহ-উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
পরিবেশগত ফ্যাক্টর: বিভিন্ন পরিবেশগত ঝুঁকি, যেমন- সিগারেটের ধোঁয়া, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদির সংস্পর্শে আসলে ব্যক্তির ফ্যান্টোসমিয়া হতে পারে।
ফ্যান্টোসমিয়ার বিস্তৃতি
ফ্যান্টোসমিয়া হঠাৎ করে হয় না। রোগীর মধ্যে এই রোগের উপসর্গগুলো দানা বাঁধতে দিন, সপ্তাহ, মাসের পর মাস, এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে। তবে রোগের উপসর্গগুলো গড়ে উঠতে যত সময়ই লাগুক না কেন, শুরুতে শুরুতে সেগুলোর স্থায়িত্বকাল হয় খুবই কম। এই বড়জোর তিন-চার মিনিটের জন্য। কিন্তু দিন যতই গড়ায়, উপসর্গগুলোর স্থায়িত্বকাল এবং প্রকটতা বেড়েই চলে। দেখা গেছে, একটি নাসারন্ধ্র দিয়ে উল্টাপাল্টা ঘ্রাণ পেতে শুরু করার মাসখানেকের মধ্যেই অন্য নাসারন্ধ্রেেও একই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ফ্যান্টোসমিয়া নির্ণয়
উপসর্গগুলো একেক রোগীর জন্য একেকরকম এবং কিছুদিন পরপর সেগুলো উধাও হয়ে যেতে পারে। তাই কারো ফ্যান্টোসমিয়া হয়েছে কি না, সেটি শনাক্ত করা বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
কেউ কোনো ঘ্রাণজনিত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসলে আগে খতিয়ে দেখতে হবে সমস্যাটির কাছে অলফ্যাক্টরি সিস্টেম জড়িত কি না। অনেক সময় স্বাদেন্দ্রিয়ের সমস্যার কারণেও রোগী উল্টোপাল্টা ঘ্রাণ পেতে পারেন।
রোগীর সমস্যার সাথে অলফ্যাক্টরি সিস্টেমের সম্পর্ক খুঁজে পেলেই তার ফ্যান্টোসমিয়া হয়েছে এই সিদ্ধান্তে চলে আসাটাও উচিত নয়। কেননা আরো অনেক ব্যাধি রয়েছে যা অলফ্যাক্টরি সিস্টেমে সমস্যার কারণে দেখা দিয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে অ্যানোসমিয়া, ডাইসোমিয়া, হাইপারসোমিয়া, প্যারাসোমিয়া কিংবা ট্রপোসোমিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তাই রোগীর উপসর্গগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হবে, তার মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানতে হবে। তিনি কী ধরনের গন্ধ পান সেটি অনুধাবন করতে হবে।
সাধারণত কেউ ফ্যান্টোসমিয়ায় আক্রান্ত হলে তিনি নিম্নলিখিত গন্ধগুলো বেশি করে পেতে শুরু করেন
- সিগারেট পোড়ার গন্ধ।
- রাবার পোড়ার গন্ধ।
- বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- অ্যামোনিয়ার গন্ধ।
- কোনোকিছু পঁচে যাবার গন্ধ।
ফ্যান্টোসমিয়া নিরাময়
ফ্যান্টোসমিয়ার কারণ এবং রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর বৈচিত্র্যের কারণে এর চিকিৎসা করাটা বেশ জটিল হয়ে পড়ে। তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। তারা সাধারণ নিচের দুটো ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ন্যাসাল স্প্রে: ফ্যান্টোসমিয়ার নিরাময়ে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি ব্যবহার করা হয়, সেটি হলো ন্যাসাল স্যালাইন বা ন্যাসাল স্প্রে। এটি মূলত সাইনাস পরিষ্কারকের কাজ করে। স্যালাইন বা স্প্রের কারণে নাসাপথের মধ্যে জমে থাকা অবাঞ্ছিত পদার্থ, যেমন- ধূলো, ময়লা, মিউকাস অপসারিত হয় এবং তা বায়ু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে অলফ্যাক্টরি স্নায়ুর কাজ করতে সুবিধা হয়। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানটি হলো Oxymetazoline, যা দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল নিশ্চিত করে।
Venlafaxine: এটি মূলত একটি সেরোটোনিন-নরএপিনেফ্রিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SNRI), যা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবেও কাজ করে। এটি কেন্দ্রীয় এবং পার্শ্বীয় নিউরনগুলোর ওপর ক্রিয়া করে। দেখা গেছে, যারা ফ্যান্টোসমিয়ায় ভোগেন, তাদের অনেকেই Venlafaxine ব্যবহারে সুফল পেয়েছেন। ফ্যান্টোসমিয়া ছাড়াও খিঁচুনির উপসর্গকে প্রশমিত করতে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।