যখন আমরা কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পাই, তখন সাধারণত ‘পোস্টমর্টেম’ শব্দটির সাথেও পরিচিত হয়ে উঠি, কেননা আমাদের দেশে অস্বাভাবিকভাবে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা হয়। ‘পোস্টমর্টেম’ শব্দের বাংলা পরিভাষা ‘ময়নাতদন্ত’। চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাধারণত হলা হয় ‘অটোপসি’। অর্থাৎ ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেম বা অটোপসি মানে হলো মৃতদেহ থেকে আহরিত বিদ্যা, যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কোনো ব্যক্তির মৃত্যুরহস্য বা জীবিত থাকা অবস্থায় তার সাথে ঘটে যাওয়া নানা অপরাধের ধরণ ও বিবরণ।
প্রাচীনকাল থেকেই পোস্টমর্টেমের সঙ্গে ধর্ম, রাজনীতি, যৌক্তিক মতবাদ, অতিভৌতিক জাদুবিদ্যাসহ নানা পৌরাণিক কাহিনী নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। যুগে যুগে পোস্টমর্টেম নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক কিংবদন্তী। মৃতদেহ ফিরে আসা, আত্মা ফিরে আসা, স্বপ্নে ভয় দেখানো, আমাবস্যার রাতে ডাকাডাকি করা, পিশাচ আকারে মানুষের ক্ষতি করাসহ তৈরি হয়েছে নানা অশরীরী গল্প কিংবা উপন্যাসও।
কিন্তু সেসব আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়; আমরা আজকে ময়নাতদন্তের ঐতিহাসিক ময়নাতদন্ত জানার চেষ্টা করবো। ময়নাতদন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের দীর্ঘ সাধনা ও গবেষণার ফসল। ফলে ময়নাতদন্তের ইতিহাসও ছোট নয়। প্রাচীনকালের তথ্য-উপাত্তেই পাওয়া যায় এর উৎস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে মিসরীয়রা মমি তৈরি করার জন্য মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করতো। তবে তারা সেসব পোস্টমর্টেম করতো মূলত ধর্মীয় বিবেচনায় ও পদ্ধতিতে। অর্থাৎ আমরা এখন সেসকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে দেখে থাকি তা থেকে মিসরীয়দের পোস্টমর্টেম ছিল কিছুটা ভিন্নতর।
মূলত মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পোস্টমর্টেম করার কথা জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে গ্রিসে। রোমান সাম্রাজ্যে এটি চালু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে। ঐতিহাসিকদের সূত্রানুসারে, জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর তার অফিসিয়াল পোস্টমর্টেম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে। এছাড়া প্রাচীনকালে আরবদের মধ্যে আন নাফিসের মৃতদেহের পোস্টমর্টেমের কথাও জানা যায়।
আধুনিক পোস্টমর্টেম ব্যবস্থা চালু করেন ইভোননি মরগাগনি, যাকে পোস্টমর্টেম ব্যবস্থার জনক বলা হয়।। পোস্টমর্টেম ব্যবস্থার উপর রচিত ঐতিহাসিক কিছু বইয়ের নামও জানা যায়, যা ছিল প্রাচীন যুগে রচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৬৫ গ্রিসের হিপোক্রেট, ১১৭-১৩৮ খ্রিস্টাব্দে মিসরীয় চিকিৎসক হেব্রিয়ন, ১২০০-১২৫০ খ্রিস্টাব্দে চীন এবং ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে ইতালির চিকিৎসক ফরচ্যুনিতো ফেদেলে পোস্টমর্টেমের উপর বই রচনা করেছিলেন।
মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণ, মৃত্যুর ধরণ, মৃত্যুকাল, মৃত্যু সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, কোনো বহিঃবস্তুর উপস্থিতি যেমন বুলেট, বোমার স্প্রিন্টার ইত্যাদি থাকলে তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হলে তা কী বিষ, কীভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, কখন প্রয়োগ করা হয়েছে তা নির্ধারণ এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের মৃতদেহ হলে ভবিষ্যতে শনাক্তকরণের জন্য তার মোটিভ সংরক্ষণ ইত্যাদি পোস্টমর্টেমের উদ্দেশ্য। আতশকাচের সাহায্যে গবেষণা করে, লাশের প্রয়োজনীয় প্যাথোলজিক্যাল, কেমিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল, সেরোলজিক্যাল প্রভৃতিসহ সব জৈবাঙ্গে পরীক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করাই এর কাজ। ফলে আধুনিক সময়ে এই কাজ করে থাকেন পেশাদার চিকিৎসকগণ; আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকগণ।
‘পোস্টমর্টেম’ এর বাংলা পরিভাষা ‘ময়নাতদন্ত’ কেন?
ইতিমধ্যেই আমরা জানতে পারলাম যে, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করতে পোস্টমর্টেম করা হয়ে থাকে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে চিকিৎসক তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভরসাও এই পোস্টমর্টেম রিপোর্টের উপর। কেননা অপরাধের তদন্ত ও বিচারিক কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে এই পোস্টমর্টেম থেকে পাওয়া নানা তথ্য-উপাত্ত। এককথায়, সাধারণভাবে আমরা যা জানতে পারি না তা জানার জন্যই পোস্টমর্টেম করা হয়।
কিন্তু ‘পোস্টমর্টেমের’ বাংলা অনুবাদ বা পরিভাষা কেন ‘ময়নাতদন্ত’ করা হল? খেয়াল করলে সহজেই দেখা যাবে ‘ময়নাতদন্ত’ শব্দটিতে দুটি ভাগ রয়েছে, তথা ‘ময়না’ ও ‘তদন্ত’। আমরা জানি ‘ময়না’ একটি পাখির নাম আর ‘তদন্ত’ মানে যাচাই-বাছাই। সেদিক বিবেচনায় ‘পোস্টমর্টেম’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ ‘মৃতদেহ তদন্ত’ বা এ জাতীয় কিছু হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সেটা না করে পোস্টমর্টেমের বাংলা অনুবাদ করা হলো ময়না পাখির নামের সাথে মিল রেখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি ‘ময়নাতদন্ত’ পরিভাষাটির সাথে ময়না পাখির কোনো সম্পর্ক রয়েছে?
শুনলে হয়তো অনেকে অবাক হবেন, সত্যিকার অর্থেই ময়না পাখির সঙ্গে পোস্টমর্টেমের একটি সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। ময়না পাখির গায়ের রঙ কালো ধরনের এবং ঠোঁটের রঙ হলুদ হয়ে থাকে। ময়না প্রায় ৩ থেকে ১৩টি স্বরে ডাকতে পারে। গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে অন্ধকারে ময়না পাখির দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অন্ধকারের মাঝে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তবে অভিজ্ঞ মানুষেরা ময়নার ডাক শুনেই বুঝতে পারেন, ওটা ময়না পাখির ডাক।
অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ময়না পাখিকে যেমন শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর শুনেই আবিষ্কার করা সম্ভব হয়, ঠিক তেমনি পোস্টমর্টেমের মাধ্যমেও কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর অজানা রহস্য বা অন্ধকারে থাকা কারণসমূহ সূত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। সামান্য সূত্র প্রয়োগ করে শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করা যায় নানা ধরনের অজানা রহস্য। অনেক সময়ে সেই তথ্যসূত্র ধরেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় প্রকৃত অপরাধীদের। অর্থাৎ ময়না পাখির মতো পোস্টমর্টেমও অন্ধকারের নানা রহস্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। আর এই রহস্যকে কেন্দ্র করেই পোস্টমর্টেম পরিভাষাটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ময়নাতদন্ত।
পোস্টমর্টেমের ধরণ
আমরা শুধুমাত্র অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পোস্টমর্টেমের কথা জানলেও বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের পোস্টমর্টেম চালু আছে।
মেডিকেল: কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার মৃতদেহের মেডিকেল পোস্টমর্টেম করা হয়, যা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ও পরিচিত।
ক্লিনিক্যাল: কোনো ব্যক্তি অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করলে তার মৃতদেহের ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম করা হয়। শুধুমাত্র কারো মৃত্যু নিয়ে যদি বিতর্ক ওঠে সেক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম করতে দেখা যায়।
একাডেমিক : মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের অধ্যয়নের জন্য মৃতদেহ পোস্টমর্টেম করা হয়। অর্থাৎ মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন।
ময়নাতদন্ত করার কারণ
ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়ে গেলেও, সুনির্দিষ্টভাবে বললে নিম্নলিখিত কারণসমূহকে সামনে রেখে সাধারণত পোস্টমর্টেম করা হয়ে থাকে।
১) স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা।
২) কিভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো তার বর্ণনা।
৩) মৃত্যু কিভাবে হলো; অর্থাৎ আত্মহত্যা, খুন, দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো কারণে মৃত্যু হয়েছে তা নির্ণয়।
৪) মৃত্যুর সময় নির্ণয়।
৫) মৃতদেহ যদি অজানা হয় তাহলে তা শনাক্তকরণের জন্য চিহ্ন সংরক্ষণ করা।
বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ
পোস্টমর্টেমের পূর্বে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাহ্যিক পর্যবেক্ষণপর্ব সম্পন্ন করে। এ সময়ে প্রাথমিকভাবে যাচাই করতে হয় মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ, অর্থাৎ বাহ্যিক দৃষ্টিতে মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে তার অনুসন্ধান। যেমন- দুর্ঘটনা, উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, পানিতে ডুবে যাওয়া, শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি।
মৃতদেহের পরনে থাকা কাপড় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে হবে লোকটি কিভাবে আক্রান্ত হয়েছিল; কাপড়ের কোনো অংশ ছেড়া বা জামার বোতাম ছেড়া, বুলেট বা ছুরির দাগ, রক্ত বা অন্য কোনো তরলের উপস্থিতি থাকা, যেমন তেল, পানি, ফেনা, বিষ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নখের উপরের এনামেলের অংশ ১০টি ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেটে নেয়ার পর ধীরে ধীরে চুল থেকে শুরু করে মৃতদেহের প্রতিটি অঙ্গ, যেমন- ত্বক, চোখ, নাক, মুখ, কান, রন্ধ্র, হাত, পা, বুক, পেট, পিঠ, লোম ইত্যদির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি পর্যবেক্ষণ।
এরপর গভীরভাবে অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ বা তার অংশ বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও ভিসেরা রিপোর্টের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। পাকস্থলী, লিভারের অংশবিশেষ, উভয় কিডনির অংশবিশেষ, ফুসফুস, হার্ট, অন্ত্র ও মূত্রনালির অংশবিশেষ সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো বিষক্রিয়ায় বা দুর্ঘটনায় বা পানিতে পড়ে মারা যাওয়া ব্যাক্তির ক্ষেত্রে পাকস্থলী সংরক্ষণ করতে হবে। গ্যাসজনিত কারণে, পানিতে পড়ে বা পুড়ে গিয়ে মারা গেলে ফুসফুস ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এবার মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে কী কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে মনে হয় তা লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। যেমন- হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি।
ময়নাতদন্তের নিয়ম
১) মৃতদেহ মর্গে আসার সাথে সাথে দেহের সাথে একটি লেবেল বা ট্যাগ লাগানো হয়।
২) পোস্টমর্টেম অবশ্যই মর্গে করতে হবে, অন্য কোনো জায়গায় নয়। তবে যদি মৃতদেহ গলিত অবস্থায় থাকে এবং মৃতদেহ সরানো হলে আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে এই নিয়ম শিথিলযোগ্য।
৩) পোস্টমর্টেমের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসিয়াল অর্ডার থাকতে হবে। এছাড়া পোস্টমর্টেম করা যাবে না।
৪) কোনো প্রকারের দেরি করা যাবে না। অফিসিয়াল অর্ডার পাওয়ামাত্রই ময়নাতদন্তের কাজ শুরু করতে হবে।
৫) দিনের আলোয় পোস্টমর্টেম করতে হবে, কারণ রাতের কৃত্রিম আলোতে কোনো সূত্র চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারে।
৬) মৃতদেহ অবশ্যই পুলিশ দ্বারা প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ করতে হবে। তারপর পোস্টমর্টেমের জন্য প্রেরণ করতে হবে।
৭) পোস্টমর্টেমের সময়ে চিকিৎসক ব্যতীত অহেতুক কোনো ব্যক্তি বা মিডিয়ার উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হবে না।
এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ময়নাতদন্ত। সংগ্রহ করা হয় মৃতদেহ থেকে বিভিন্ন ধরনের আলামত এবং তার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, যা আমাদের সাহায্য করে বিচারিক ফয়সালার। ময়নাতদন্তের পর মরদেহ নিঁখুতভাবে সেলাই করে দেয়া হয়।
আমাদের দেশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থাপনা এখনো ষাটের দশকে পড়ে আছে। ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত অভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা ফরেনসিক বিভাগে পড়ালেখাও করতে চান না। অনেক মেডিকেল কলেজের এ বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষকই নেই। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ময়নাতদন্তও হয়ে উঠুক যুগোপযোগী ও প্রযুক্তিনির্ভর- এটাই সবার কামনা।
ফিচার ইমেজ: উইকিমিডিয়া কমন্স