খাবার নিয়ে মানুষের পাগলামি থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সেটা কতটুকু? ‘পিকা’ নামক একটি রোগের কারণে মানুষের উদ্ভট উদ্ভট সব খাবারের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়। এতে করে অনেকে সাবানের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। খেতে শুরু করে সাবান। অনেকে আবার খাবারের জন্য বেছে নেয় ইট, পোড়া মাটি, টুথপেস্ট- এমন অনেক কিছু। পিকায় আক্রান্ত মানুষের রোগের নাম আবার নিজেদের খাবারের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। যেমন প্যাগোফেজিয়া।
অদ্ভুত রোগ প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত বরফের প্রতি বেশি আসক্ত হয়। কারণে অকারণে বরফ খেতে পছন্দ করে তারা। পিকার মধ্যেই একটি ভাগে প্যাগোফেজিয়াকে রাখেন চিকিৎসকেরা। অনেকে মনে করেন, প্যাগোফেজিয়ার সাথে রক্তশূন্যতায় ভোগার ব্যাপারটি জড়িত। তবে তাই বলে এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেন না। অতিরিক্ত বরফ খাওয়ার পেছনে রক্তশূন্যতার প্রভাব থাকতে পারে বটে, তবে সেটাই যে প্রধান কারণ এবং প্যাগোফেজিয়া যে সেই কারণেই হয় সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কারণ কেবল শারীরিক সমস্যাই নয়, পিকায় আক্রান্ত রোগীরা মানসিক অবসাদ এবং অন্যান্য কারণেও নানারকম উদ্ভট খাবার গ্রহণ করে থাকেন।
প্যাগোফেজিয়ার লক্ষণ
বারবার বরফ চিবুতে ইচ্ছা করা বা বরফ দেওয়া পানীয় পান করাকেই প্যাগোফেজিয়ার মূল লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। এই ইচ্ছা যদি আপনার মধ্যে হঠাৎ করে হয় কিংবা কিছুদিনের জন্য হয় তাহলে সেটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, আপনি প্রায় এক মাস যাবত এমন বরফ ও বরফজাতীয় খাবারের প্রতি আসক্তি অনুভব করছেন তাহলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনি পিকা’য় আক্রান্ত কিনা সেটা জেনে আসাটা প্রয়োজন।
প্রথমেই বলেছি যে, প্যাগোফেজিয়ার সাথে এ্যানিমিয়া বা রক্তশুন্যতার বেশ ভালো একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্ত হলে বেশকিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে-
- অবসাদ এবং দূর্বলতা
- ত্বক সাদাটে হয়ে যাওয়া
- বুক ব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- মাথা ঘোরা
- ঘনঘন পিপাসা পাওয়া এবং অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া
- ক্ষুধা না পাওয়া
- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
প্যাগোফেজিয়ার কারণ
প্যাগোফেজিয়া সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, এটি বড়দের হবে না। প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্তদের অনেকে বেশ বয়স্ক। অনেকে আবার গর্ভধারণের কারণে প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্ত হন। একটি গবেষণায় গবেষকেরা লৌহস্বল্পতা আছে এমন এ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত ৮১ জন মানুষের সাথে কথা বলেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে চান। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোট ১৩ জনের প্যাগোফেজিয়ার সমস্যা ধরা পড়ে। এদের মধ্যে অনেকে আয়রন সাপ্লিমেন্ট নিয়ে থাকেন। তবে তার পাশাপাশি বরফ খাওয়ার ব্যাপারটিও চলতে থাকে। অন্য এক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্তরা না জেনে হলেও বরফ বেশি পছন্দ করেন এবং গ্রহণ করেন। বেশি বরফ খাচ্ছেন এমন মানুষদের পরীক্ষা করে তাদের এ্যানিমিয়ার সমস্যা আছে বলে জানা যায়। ফলে তাদের মতে, এটি খুব পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, এ্যানিমিয়া এবং প্যাগোফেজিয়ার মধ্যে খুব দৃঢ় সম্পর্ক আছে।
তবে এ্যানিমিয়াকে প্রধান কারণ বলে মনে করলেও মানসিক অবসাদকেও অনেকে এগিয়ে রেখেছেন কারণ হিসেবে। অসম্ভব মানসিক চাপে থাকলে বরফ খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় বলে মনে করেন অনেকে। এটি তখন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। তবে কারণ যেটাই হোক, প্যাগোফেজিয়া একটি রোগ। আর এই রোগের কোনোরকম ছাপ যদি আপনি নিজের খাদ্যাভ্যাসে দেখতে পান তাহলে এই প্রশ্নগুলো করুন নিজেকে। এতে আপনি এবং আপনি যে চিকিৎসকের কাছে যাবেন দুজনেরই সমস্যা ও সমাধান নির্ধারণ করা সহজ হবে।
১। আপনি প্রতিদিন কতখানি বরফ খান?
২। কতদিন ধরে বরফের প্রতি আসক্ত আপনি?
৩। বরফ ছাড়া আর কোনো আসক্তিতে ভুগছেন?
৪। রোগের আর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে আপনার শরীরে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেই ভালো করে জেনে নিন। তারপর চিকিৎসকের কাছে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে যে, আপনার আসলে প্যাগোফেজিয়া আছে কিনা।
কী করবেন এবং কী করবেন না
প্যাগোফেজিয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনার যেটা করা উচিত সেটা হল ভালো করে নিজেকে জানা। রক্তশূন্যতার কারণেই আপনার বরফে আসক্তি হচ্ছে কিনা সেটা জানা দরকার। হতে পারে যে, এমন কিছু হলে আপনি কেবল আপনার রক্তশূন্যতার সমস্যার সমাধান করেই প্যাগোফেজিয়ার সমস্যা দূর করতে পারেন। তবে চিকিৎসক না বলা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াই ভালো। অনেকসময় অনেকে বরফের প্রতি নিজের আসক্তি দেখে নিজেকে প্যাগোফেজিয়ার রোগী ভেবে বসেন। আর এর কারণ এ্যানিমিয়া ভেবে নিয়ে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। কারণ আমাদের শরীর অতিরিক্ত পরিমাণ আয়রন গ্রহণ করতে পারে না। এতে শরীরে আয়রন জমে কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্যান্সার বা মারাত্মক কোনো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
এ্যানিমিয়া ছাড়াও যদি মানসিক চাপ থেকে প্যাগোফেজিয়ার সমস্যা তৈরি হয় তাহলে সিবিটি বা কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মানসিক কোনো সমস্যা থেকে বরফ গ্রহণের সমস্যা তৈরি হলে সেটা দ্রুত চলে যাবে। তবে এ তো গেল প্যাগোফেজিয়ার ক্ষেত্রে কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেসব কথা। তবে তার আগে আপনার জানা উচিত কেন আপনি এই পদক্ষেপ নিবেন। প্যাগোফেজিয়া কি এতই গুরুতর কোনো সমস্যা?
হ্যাঁ, সেভাবে বলতে গেলে ছোটোখাটো থেকে শুরু করে বেশ বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে প্যাগোফেজিয়া। যেমন- প্যাগোফেজিয়া আপনার দাঁতের বেশ বড় রকমের ক্ষতিসাধন করতে পারে। প্যাগোফেজিয়ায় আক্রান্তরা যেহেতু অধিক পরিমাণে বরফ গ্রহণ করেন, ফলে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যায়। এতে দাঁত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। খুব দ্রুত দাঁত নষ্ট হওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো ঘটে।
আর আপনার প্যাগোফেজিয়ার কারণ যদি হয় এ্যানিমিয়া, সেক্ষেত্রে বেশ সমস্যায় পড়ে যেতে পারেন আপনি। আপনার হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। আপনার হৃদপিণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে সেটা কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।
আপনি যদি গর্ভবতী হন এবং আপনার যদি প্যাগোফেজিয়ার সমস্যা দেখা দেয় তাহলে এর প্রভাব পড়তে পারে আপনার শিশুর উপরেও। আপনার শিশু অনেক আগেই জন্ম নিতে পারে কিংবা তার ওজনে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আর এই প্যাগোফেজিয়া যদি শিশুদের ক্ষেত্রে হয় তাহলে শিশুর অসুস্থতার মাত্রা বাড়তে পারে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনো শিশু যদি অতিরিক্ত পরিমাণ বরফ কিংবা বরফজাতীয় খাবার গ্রহণ করে তাহলে তার দাঁত, শরীর এবং সবকিছুতে এর প্রভাব পড়বে। সে অসুস্থ হবে খুব দ্রুত।
এই পুরো সমস্যা থেকে দূরে থাকতে বেশি করে আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। সেইসাথে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকুন। কোনো সমস্যা দেখা দিলেই মানসিক সেবা নিন এবং চিকিৎসকের কাছে যান। বরফ খাওয়া চোখে পড়ার মতো বিষয় নয়, বলা যায় মজার ব্যাপার। তবে তাই বলে এই মজার ব্যাপার রোগে পরিণত হতে শুরু করলে সেটাকে গুরুত্ব দিন। সঠিক পদক্ষেপ নিন।