ইফতেখার একদিন কোথা থেকে একটি ছোট্ট বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে এলো। এমনিতে সে ছাত্র, তার উপর থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। তার এমন কান্ডে সবাই অবাক হলো! কয়েকদিনের মাঝেই বিড়ালটি ইফতেখারের অবসরের সঙ্গী হয়ে গেল। বিড়ালটিও তার খুব ন্যাওটা। সারাক্ষণই ওর সাথে সাথে থাকে। কিন্তু ওর একটা ভারী বদভ্যাস আছে, যা কিছু সামনে পাবে হয় কামড় দিয়ে তার স্বাদ পরীক্ষা করে দেখবে, না হয় আঁচড় দিয়ে নখে ধার দেওয়া শুরু করবে। এভাবে চলছিলো দুজনের দিনগুলো।
সমস্যা বাঁধল কিছুদিন পর! কয়েকদিন ধরে ইফতেখারের শরীর ভালো যাচ্ছিলো না। সারাক্ষণ গা ম্যাজম্যাজ করে। ক্লান্তি যেন ঘিরে রেখেছে সারাক্ষণ, সেই সাথে জ্বরজ্বর ভাব লেগেই আছে। নিয়মিত শরীরচর্চা করে সে। তাই এসব হালকা জ্বর নিয়ে মাথা ঘামায়নি একদমই! কিন্তু এবার সতর্ক হতে হলো। কোথাও একটা গোলমাল তো হয়েছেই। কারণ ইতোমধ্যেই শরীরে ব্যথার সাথে যুক্ত হয়েছে মাথাধরা। সেদিন গোসল করতে গিয়ে বগলের কাছে হাত দিতেই চমকে উঠলো সে, মারবেল বলের মতো ছোট ছোট গুটি উঠেছে বগলের নিচে। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এই সমস্যাগুলো নিয়ে শেষমেশ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
ডাক্তার সবকিছু শুনলেন! তারপর হেসে বললেন, তার বিড়ালই এ সবের মূল। বিড়ালের আঁচড় থেকেই এই সমস্ত কিছুর শুরু হয়েছে! আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ক্যাট স্ক্রাচ ডিজিজ হয়েছে তার। বলা বাহুল্য, অদ্ভুত এই রোগের নাম এই সর্বপ্রথম শুনলো- ‘বিড়ালের আঁচড় রোগ!’ ক্যাট স্ক্রাচ ডিজিজ একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ, যার উৎপত্তি বিড়ালের আঁচড় থেকে! এর পেছনে কাজ করে একটি বিশেষ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া নাম বারটোনেলা হেনসেলি (Bartonella henselae )।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, শতকরা ৪০ ভাগ বিড়াল কোনো না কোনো পর্যায়ে তাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া বহন করে, যদিও এতে তাদের নিজেদের শরীরে কোনোরকম সমস্যা হয় না! কিন্তু তা আপনার শরীরে ঢুকে পড়লে গণ্ডগোল বাঁধতে পারে। বিড়ালপ্রেমী মানুষদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি মন্দ খবর!
১৮৮৯ সালে এই রোগটিকে সর্বপ্রথম সবার সামনে নিয়ে আসেন হেনরি পেরিনুড। ক্লিনিক্যাল লক্ষণগুলো সম্পর্কে প্রথম তুলে ধরেন আরো ৬০ বছর পরে ১৯৫০ সালে রবার্ট ডেব্রি। প্রথম দিকে ধারণা করা হতো এই রোগের জন্য যে ব্যাকটেরিয়া দায়ী তার নাম Afipia felis, কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, ক্যাট স্ক্রাচ রোগের পেছনে সত্যিকার অর্থে দায়ী যে ব্যাকটেরিয়া তার নাম Bartonella henselae.
আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্রের মতে, প্রতি বছর আমেরিকায় ১২,০০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫০০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জানুয়ারি এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এই রোগে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেড়ে যায়। কেননা এই সময়েই মানুষ নতুন করে পশুপাখি পোষা শুরু করে। আমাদের দেশে গৃহপালিত প্রাণীর জনপ্রিয়তা কম থাকায় এ রোগের হার বেশ কম। তবে একেবারে যে হয় না, তা-ও নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তথ্যের অভাবে তা জানা সম্ভব হয় না।
সাধারণত বিড়ালের আঁচড়-কামড় থেকেই সমস্যার উদ্ভব, তবে কোনো উন্মুক্ত ক্ষততে যদি বিড়ালের লালারস লাগে সেক্ষেত্র ক্যাট স্ক্রাচ ডিজিজ হতে পারে। বিড়াল ছাড়াও মাছি কিংবা এটুল থেকেও ক্যাট স্ক্রাচ রোগের সংক্রামণ হয়েছে- এমন ঘটনা ঘটেছে! তবে একজন আক্রান্ত মানুষ থেকে কখনো অন্য একজনের দেহে এ রোগ সংক্রামিত হয় না। বয়স্ক বিড়ালদের চেয়ে কম বয়সী বিড়ালের এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বেশি সংক্রমিত হয়। এমনকি তাদের লোমেও ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। তাই আপনার পোষা বিড়ালটির সাথে খুব খেলাধুলা করে যদি হাত না ধুয়ে আপনার চোখ চুলকে নেন- হয়তো সেই ফাঁকেই আপনার দেহে ঢুকে পড়তে পারে ব্যাকটেরিয়া।
৫-৯ বছর বয়সী শিশুরা, যারা বিড়াল এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের প্রতি খুব অনুরক্ত, তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন! অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ খুব বেশি মারাত্মক হয় না। শুধুমাত্র যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে ক্যাট স্ক্রাচ রোগ বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এইডস কিংবা যাদের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে থাকে।
ক্যাট স্ক্রাচ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে পূর্বেই একবার ধারণা দেওয়া হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে এখানে লক্ষণগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো। ক্যাট স্ক্রাচ রোগে যে সমস্ত লক্ষণ সবচেয়ে বেশী দেখা যায়, সেগুলো হলো-
- বিড়াল যেখানে আঁচড় কাটে কিংবা কামড় বসায়, তার আশেপাশে ফোসকা দেখা দেয়। সাধারণত ৩-১০ দিনের মধ্যে ফোসকা পড়তে দেখা যায়।
- নিকটবর্তী লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে। লসিকা গ্রন্থি অপেক্ষাকৃত দেরিতে ফুলে ওঠে। মোটামুটি কয়েক সপ্তাহ পরে। অবসন্নতা ঘিরে ধরে হঠাত করে।
- মাথাব্যথা।
- হালকা জ্বর যা ৯৮.৬ ডিগ্রি থেকে ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে ওঠানামা করে।
- শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়।
এছাড়া আরো কিছু সমস্যা মাঝেমাঝে দেখা যেতে পারে। যেমন-
- ক্ষুধামান্দ্য।
- ওজন কমে যাওয়া।
- ঠোঁটে সংক্রমণ।
- শরীরের পশ্চাৎ অংশে ব্যথা।
- হঠাৎ হঠাৎ শরীরের কোনো অংশ ঠাণ্ডা অনুভব হওয়া।
- পেটে ব্যথা।
- অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
- র্যাশ।
- দীর্ঘমেয়াদী জ্বর।
ক্যাট স্ক্রাচ নির্ণয় মূলত ক্লিনিক্যাল। অর্থাৎ ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে এবং রোগের বিবরণ শুনে রোগ নির্ণয় করেন। তবে পলিমারেজ চেইন রিয়াকশনের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ শনাক্ত করে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই রোগ খুব বেশি মারাত্মক না হলেও, কোনো কোনো সময় তার ব্যতিক্রম হতে পারে। এ থেকে যে সমস্ত জটিলতার সৃষ্টি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- এনসেফালোপ্যাথি: যদি কোনোভাবে ব্যাকটেরিয়া মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়, সেক্ষেত্রে এনসেফালোপ্যাথির মতো মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মস্তিষ্কের অংশবিশেষ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
- নিউরোরেনাইটিস: আমাদের চোখের রেটিনা থেকে যে স্নায়ু সমস্ত দৃশ্যানুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়, তাকে অপটিক স্নায়ু বলে। বারটোনেলা হেনসেলি ব্যাকটেরিয়া চোখের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায়। অবশ্য এটি স্থায়ী নয়। রোগমুক্তির পরে দৃষ্টিও স্বাভাবিক হয়ে আসে।
- পেরিনুড অকুলোগ্লান্ডুলার সিন্ড্রোম: এটিও একপ্রকার চোখের জটিলতা। এতে চোখ লাল হয়ে যায়। হঠাৎ চোখ লাল হয়ে যাওয়া (Pink Eye Syndrome) অন্যতম কারণ ক্যাট স্ক্রাচ ডিজিজ। যে সমস্ত ক্ষেত্রে সরাসরি চোখের মাধ্যমে বারটোনেলা হেনসেলি মানবদেহে সংক্রামিত হয় সেসব ক্ষেত্রে পিংক আই সিনড্রোম বেশি হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে।
স্বাস্থ্যবান মানুষেরা সাধারণত কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই এমনিতেই সেরে ওঠেন। তবে ৪-১৫ ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া যকৃৎ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং যকৃৎ, প্লীহা, চোখ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগের চিকিৎসা মতোই এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়।
লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থির ফোলা কমাতে এরিথ্রোমাইসিন গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য যে সমস্ত ওষুধ ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে রয়েছে-
- সিপ্রোফ্লক্সাসিন (ciprofloxacin)
- রিফামপিসিন (rifampin )
- টেট্রাসাইক্লিন (tetracycline)
- ট্রাইমেথোপ্রিম-সালফামেথাজ্যাজোল (trimethoprim-sulfamethoxazole)
ক্যাট স্ক্রাচ ডিজিজের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিড়ালের স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। আপনার যদি পোষা বিড়াল থাকে- তাহলে আমার উপদেশ আপনার ভালো না লাগারই কথা! সেক্ষেত্রে কী আর করা? আপনার দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপরে ভরসা রাখুন!
Feature Image: Youtube