মানসিক চাপে ভুগছেন? ফোনে মায়ের সাথে কথা বলুন!

আপনি কি স্ট্রেস বা মানসিক চাপে ভুগছেন? প্রচন্ড অস্থির লাগছে? একাকিত্ব অনুভব করছেন? পানিতে তলিয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে? চারপাশের সবকিছু অর্থহীন লাগছে? জীবনটা একেবারেই মূল্যহীন মনে হচ্ছে? সামাজিক বিজ্ঞানীরা এসব সমস্যার এক অসাধারণ নিরাময় আবিষ্কার করেছেন। সেটির সত্যতা যাচাই করতে আপনাকে মিনিট পাঁচেকের বেশি ব্যয় করতে হবে না। স্রেফ আপনার মায়ের সাথে কথা বলুন। কিংবা মা যদি ধারেকাছে না থাকেন, তবে তাকে ফোনে একটি কল দিন। এতে করে আপনার স্ট্রেস কমা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে

যাবতীয় মানসিক সমস্যায় ফোন করতে পারেন মাকে; Image Source: mmctsu.com

মায়ের ভালোবাসার ক্ষমতা

সম্পর্ক-বিজ্ঞানে মায়ের ভালোবাসার মতো ক্ষমতাশালী বস্তু খুব কমই আছে। গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই জানতেন যে একজন সন্তান যদি তার মাকে জড়িয়ে ধরে, তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই তার মস্তিষ্কে ভালো লাগার অনুভূতিসম্পন্ন হরমোন অক্সিটোসিনের স্রোত বয়ে যায়, যা মা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কের বন্ধনকে আরো জোরালো করে, মানসিক চাপ কমায়, এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের খুঁটিকে আরো মজবুত করে। এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন নিশ্চয়ই অনেকেই হয়েছেন যে, আপনি হয়তো মানসিকভাবে সেরা অবস্থায় ছিলেন না, কিন্তু মায়ের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটানোর পরই আপনার মেজাজ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, মায়ের ভালোবাসার শক্তি কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। একজন মায়ের পক্ষে হাজার মাইল দূরে থেকেও সন্তানের মন ভালো করে দেয়া সম্ভব, যেটি রীতিমতো একটি গবেষণা থেকেই প্রমাণিত। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের চাইল্ড ইমোশন ল্যাব থেকে করা গবেষণাটির ফল বলছে, মায়ের আলিঙ্গন সন্তানের মানসিক স্ট্রেস কমাতে যে প্রভাব ফেলে, ফোনের মাধ্যমে শোনা যাওয়া মায়ের কণ্ঠস্বরেও ঠিক সেরকমই প্রভাব বিদ্যমান।

গবেষণাটি হয়েছে  ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনে; Image Source:  University of Wisconsin-Madison

যেভাবে পরিচালিত হয়েছে গবেষণাটি

৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৬১ জন মেয়েকে এই গবেষণার জন্য বেছে নেয়া হয়। তাদের মানসিক স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে অজানা অচেনা দর্শকদের সামনে তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলী গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দেয়া হয়। তাদের মনে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্ট্রেস ঢুকিয়ে দেয়ার পর, তাদেরকে তিনটি পৃথক দলে বিভক্ত করা হয়। এরপর:

  • প্রথম দলকে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যাতে করে মায়ের সাথে তাদের শারীরিক সংযোগ ঘটে;
  • দ্বিতীয় দলকে ফোন দেয়া হয়, যাতে তারা তাদের মায়ের সাথে ১৫ মিনিট করে কথা বলতে পারে;
  • তৃতীয় দলকে একটি আবেগ-নিরপেক্ষ ভিডিও দেখতে দেয়া হয়।

এরপর গবেষকরা প্রতিটি মেয়ের শরীর থেকে তরল নমুনা সংগ্রহ করেন, যাতে করে তাদের শরীরের অক্সিটোসিন ও স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসলের মাত্রা পরিমাপ করা যায়।

ফলাফল

গবেষকরা কিছু বিস্ময়কর ফলাফল পান। তারা দেখেন, যারা মায়ের সাথে শারীরিক বা ফোনের মাধ্যমে সংযোগের সুযোগ পায়নি, তাদের মানসিক স্ট্রেসের সবচেয়ে কম নিঃসরণ ঘটেছে। কিন্তু যারা মায়ের শারীরিক সংস্পর্শ পেয়েছে, আর যারা ফোনে মায়ের সাথে কথা বলেছে, তাদের সকলেরই প্রায় সমান মাত্রায় মানসিক স্ট্রেসের নিঃসরণ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে গবেষণাপত্রের প্রধান রচয়িতা লেসলি সেলৎজার বলেন,

যেসব বাচ্চারা মায়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে, হোক তা ফোনে কথা বলে কিংবা সশরীরে উপস্থিত হয়ে, তাদের সকলেরই প্রায় সমান মাত্রার হরমোনাল প্রতিক্রিয়া ছিল। এতদিন আমরা জানতাম সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে অক্সিটোসিন বৃদ্ধির জন্য শারীরিক স্পর্শের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের প্রাপ্ত ফলাফলের মাধ্যমে এটি এখন পরিষ্কার যে মায়ের কণ্ঠস্বর আলিঙ্গনের সমতুল্য প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।

মায়ের সংস্পর্শে এলে শিশু সবচেয়ে আনন্দে থাকে; Image Source: 

প্রতিক্রিয়া

ড. লেন স্ত্রাথার্ন, বর্তমানে বেইলর কলেজ অব মেডিসিন এবং টেক্সাস চিলড্রেন্স হসপিটালে পিডিয়াট্রিকসের একজন অধ্যাপক, এ গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলকে ‘খুবই শক্তিশালী’ হিসেবে অভিহিত করেন।

স্ত্রাথার্ন, যিনি নিজে উপরোক্ত গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না, বলেন যে, এটিই প্রথম কোনো গবেষণা যেখানে দেখানো হয়েছে যে মায়ের স্পর্শই শুধু নয়, এমনকি কণ্ঠস্বরও সন্তানের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। এর আগে তিনি নিজেও একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, শিশুদের অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়, যখন তারা তাদের মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং আয়নায় তাদেরকে দেখতে পায়। তবে পরিসংখ্যানগতভাবে সেই বৃদ্ধি খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না।

অক্সিটোসিনের মাত্রা বৃদ্ধি

মানব মস্তিষ্কে বুকের দুধ খাওয়ানো, আলিঙ্গন ও অর্গাজমের সময় অক্সিটোসিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে কায়িক পরিশ্রমকে গতিশীল করতেও এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। বস্তুতঃ, পিটোসিন নামে একটি ড্রাগ রয়েছে, যেটি অক্সিটোসিনের কৃত্রিম সংস্করণ; কায়িক পরিশ্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই ড্রাগটি ব্যবহৃত হয়।

মস্তিষ্ককে সতেজ ও প্রাণবন্ত রাখতে অক্সিটোসিন খুবই দরকারি; Image Source: SlidePlayer

এছাড়াও অক্সিটোসিন মানুষের যা যা উপকার করে:

  • সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি করে;
  • শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা লাঘব করে;
  • মানসিক স্ট্রেস ও উদ্বিগ্নতা কমায়;
  • ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা দূর করে।

জীবজন্তুর উপর চালানো গবেষণা থেকে দেখা গেছে, অক্সিটোসিন একজন নারীর মস্তিষ্ককে মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। ড. স্ত্রাথার্ন ও অন্যরা মস্তিষ্ক স্ক্যানিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মস্তিষ্কের যে অংশগুলো অক্সিটোসিন উৎপাদন করে, একজন মা তার সন্তানকে দেখামাত্রই সেই অংশগুলো জ্বলে ওঠে। এটি রক্তপ্রবাহে উচ্চমাত্রার অক্সিটোসিনের উপস্থিতির সাথেও সম্পর্কিত।

যদি মাকে ফোন দেয়া সম্ভব না হয়?

ফিরে যাওয়া যাক আমাদের প্রাথমিক আলাপে; অর্থাৎ মানসিক স্ট্রেস কমাতে মাকে ফোন করার উপকারিতা বিষয়ে। এই বিষয়টি অনেকের জন্যই স্পর্শকাতর হতে পারে, বিশেষত যাদের মা নেই, কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, যাদের পক্ষে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলা সম্ভব নয়। মানসিক স্ট্রেস কমাতে তাদের কী করণীয়? বাবার সাথে কথা বলা কি কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে? সম্ভবত না।

জার্নাল অব পারসোনাল অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি বলছে, আপনি নিজে যে লিঙ্গেরই হোন না কেন, একজন পুরুষের চেয়ে যেকোনো নারীর সাথে (তার সাথে আপনার সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন) কথা বললে আপনার একাকিত্ব দূর হওয়া ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। টানা দুই সপ্তাহ যাবত ৯৬ জন কলেজ শিক্ষার্থীকে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।

কোনো নারীর সাথে কথা বললে একাকিত্ব দূর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি; Image Source: Healthista

এক্ষেত্রে মনিটরিংয়ের জন্য ৯৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী তাদের সকল সামাজিক মিথস্ক্রিয়া রেকর্ড করেছেন, এবং প্রতিটি মিথস্ক্রিয়ার পর সেটিকে রেট করেছেন। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ সকলেই একজন নারীর সাথে আলাপচারিতার পর অপেক্ষাকৃত কম একাকিত্ব অনুভব করেছেন। এর একটি কারণ সম্ভবত এই যে, নারীরা প্রাকৃতিকভাবেই বেশি দক্ষ কারো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে, আবেগিক জায়গাগুলোতে যথোপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে।

সাইকোলজি টুডে‘র কিরা আসাট্রায়ান বলেন, “নারীদের মস্তিষ্ক সামাজিক দক্ষতা ও স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী। এর ফলে তারা অন্য একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সহজেই মনে রাখতে পারে।”

এ কারণেই মনে করা হয়, আপনি যদি কারো সাথে কথা বলে নিজের মানসিক চাপ ও একাকিত্ব দূর করতে চান এবং আপনার কথার বিপরীতে উপযুক্ত সাড়াও পেতে চান, তাহলে একজন নারীর সাথে কথা বলাই আপনার জন্য সবচেয়ে ফলদায়ক হবে।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about how talking to mother over phone can reduce one's mental stress. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © ABC

Related Articles

Exit mobile version