আবেগ-অনুভূতি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাসি-আনন্দ, ভালোলাগা-ভালোবাসার মতো আবেগ যেমন আমাদের জীবনকে বর্ণিল রঙের ছটায় রাঙিয়ে দেয়, তেমনি দুঃখ-কষ্ট, রাগ, দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতির মতো আবেগ জীবনকে তিক্ততায় ভরিয়ে দেয়। এই ভালো বা খারাপ আবেগগুলোর ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানের ফলে আমাদের জীবনের ভারসাম্য বজায় থাকে, আমরা জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু কখনো কখনো একটি বা একাধিক আবেগের আধিক্যের কারণে জীবন সাম্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, আনন্দের প্রাচুর্য মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করছে এমনটা সাধারণত দেখা যায় না। তবে দুঃখ-কষ্ট বা রাগের আধিক্য জীবনকে একনিমিষে নরক বানিয়ে দিতে পারে।
ফলে আচরণ, বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনায় আসে নেতিবাচক পরিবর্তন, যার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে জীবন দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্টি হওয়া নেতিবাচক আবেগ ও আচরণ আমাদের সবাইকে একরকম নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়ে দেয়। এভাবে আমরা প্রতিটি সংগ্রামী জীবনযোদ্ধা একটা না একটা সময় জীবনে হোঁচট খাই। কখনো আবার উঠে দাঁড়াই, কখনো পারি না। তখন মনে হয়, “না, আমি আর পারছি না, আমাকে দিয়ে আর সম্ভব না।”
আপনি যদি এমন দিশেহারা অবস্থায় পড়ে থাকেন, তাহলে মোটেও ঘাবড়ে যাবেন না। কারণ আপনি একা নন। সাইকোথেরাপি নিয়ে সাইকোথেরাপিস্টরা আছেন আপনার পাশে।
সাইকোথেরাপির প্রাথমিক ধারণা
আমরা যখন কোনো দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের মতো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় পড়ি, তখন কী করি? বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের লোকজনের সাথে সমস্যাগুলো শেয়ার করি। এতে কখনো সমাধান হয়, কখনো হয় না। অন্তত হালকা লাগে, দুশ্চিন্তা কমে। কখনো কখনো আমরা এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যা পরিবার বা বন্ধুবান্ধবকেও বলা যায় না। বললেও দুশ্চিন্তা বা কষ্টবোধ কমে না। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে, আপনার সাইকোথেরাপি নেয়ার সময় হয়েছে। সাইকোথেরাপির গুরুত্ব বুঝতে হলে জানতে হবে সাইকোথেরাপি কী।
সাইকোথেরাপি হচ্ছে একটি চিকিৎসাপদ্ধতি, যেখানে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইকোথেরাপিস্ট আপনার সাথে আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলে সেটি চিহ্নিত করবেন এবং বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও জ্ঞানের আলোকে তা সমাধান করবেন।
বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের থেকে একজন সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য নেয়া অনেক বেশি কার্যকরী। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা আছে, প্রশিক্ষণ আছে, আপনার সাথে আবেগীয় দূরত্ব আছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তিনি আপনার প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং আপনার সমস্যা যত উদ্ভটই হোক আপনাকে কটাক্ষ করবেন না। তিনি আপনার ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না, বরং আপনার নিজেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন। এছাড়া আরেকটি বিশেষ সুবিধা আপনি পাবেন। তা হচ্ছে খুবই গোপনীয় পরিবেশে মনের সবটুকু কথা নির্ভয়ে খুলে বলতে পারবেন। কারণ সাইকোথেরাপিস্টরা গোপনীয়তাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সুতরাং, সাইকোথেরাপি মূলত ব্যক্তি ও সাইকোথেরাপিস্টের অংশগ্রহণে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানের একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি, যা ব্যক্তিকে আরো সুস্থ ও সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারে।
কখন সাইকোথেরাপি নেয়া জরুরি?
যখন কারো দিনের পর দিন অনেক বেশি মন খারাপ থাকে, যখন কেউ দীর্ঘসময় ধরে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগে, যখন অতিরিক্ত রাগ জীবনকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চায় কিংবা কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সাইকোথেরাপি নিতে হয়। এছাড়া আরো যেসব কারণে সাইকোথেরাপি নেয়া যায়:
- দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে প্রচন্ড অসহায় অনুভব করলে
- মানসিক সমস্যা সমাধানের প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও সমাধান না হলে
- প্রতিদিনের কাজকর্মে মনোযোগ দিতে না পারলে
- অতিরিক্ত মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে
- সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি হলে (দাম্পত্য কলহ, ডিভোর্স)
সাইকোথেরাপির যত প্রকার
সাইকোথেরাপির নানা রকমফের আছে। প্রত্যেক প্রকার সাইকোথেরাপিই একেকটি আলাদা পথ দেখায়, যে পথে সাইকোথেরাপিস্ট ক্লায়েন্টের সমস্যার সমাধান করবেন। তবে সাইকোথেরাপিস্টরা সাধারণত একাধিক ধরনের সাইকোথেরাপির সমন্বয়ে সমাধান করে থাকেন। আপনাকে কোন ধরনের সাইকোথেরাপি দেয়া হবে তা নির্ভর করবে আপনার সমস্যার ধরন ও গভীরতা এবং আপনার সাইকোথেরাপিস্টের মনোবিজ্ঞানের উপর দখল কতটুকু তার ওপর। বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপি নিয়ে চলুন সংক্ষেপে জানা যাক।
কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি
এই সাইকোথেরাপি মানুষের সমস্যা চিহ্নিত করে এবং তার চিন্তা ও আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে। ক্ষতিকর ও বাজে আচরণ ও চিন্তাকে বদলে দেয় যৌক্তিক ও ইতিবাচক আচরণ দিয়ে। মানুষকে সঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখায়। ডিপ্রেসন, ওসিডি, এংজাইটি, ট্রমা ও ইটিং ডিসঅর্ডারের মতো রোগবালাইয়ের আদর্শ দাওয়াই হিসেবে কাজ করে এই থেরাপি।
ইন্টারপারসোনাল থেরাপি
এটি একটি স্বল্পমেয়াদী সাইকোথেরাপি। এই থেরাপি গভীর শোক, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বড়সড় ঝামেলার মতো সমস্যা সংক্রান্ত ব্যাপারে তার ও অন্যদের ভূমিকা ঠিক কেমন হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এটি মানুষকে সুস্থভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ ও যোগাযোগের দক্ষতার উন্নতি ঘটাতে শেখায়।
ডায়ালেক্টিক্যাল থেরাপি
এটি একধরনের কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি, যা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা লোকজন, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ও পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের রোগীদের সমস্যা সমাধানের পথ দেখায়। এটি ব্যক্তির দায়িত্ববোধে পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং সুস্থ আচরণ করতে শেখায়।
সাপোর্টিভ থেরাপি
এই থেরাপিতে রোগীকে আত্মোন্নয়নের জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। এটি শেখায় কীভাবে আত্মসম্মানবোধ বাড়ানো যায়, দুশ্চিন্তা কমানো যায়, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো যায় এবং সামাজিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যায়।
সাইকোডায়নামিক থেরাপি
শৈশবের দুঃসহ কোনো স্মৃতির কারণে আমাদের অবচেতন মনে বিরক্তিকর চিন্তাভাবনা ঘোরাফেরা করে, যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই থেরাপির লক্ষ্য হচ্ছে এই চিন্তাগুলো দূর করে মানসিক ও আচরণগত সুস্থতা নিশ্চিত করা।
সাইকোঅ্যানালাইসিস
এটি সাইকোডায়নামিক থেরাপির আরো বিস্তারিত রুপ। এক্ষেত্রে এক সপ্তাহে তিনটি বা তার বেশি সেশন নেয়া হয়।
কারা সাইকোথেরাপি দিয়ে থাকেন?
সাইকোথেরাপি সেবা দিয়ে থাকেন সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলর, সাইকিয়াট্রিক নার্সের মতো পেশাজীবীরা।
কাউন্সেলিং বনাম সাইকোথেরাপি
কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি মোটামুটি একইরকম ব্যাপার, কখনো কখনো শব্দ দুটি সমার্থক। যারা কাউন্সেলিং করেন, তারাই সাইকোথেরাপি দেন। তবে কিছু পার্থক্য তো রয়েছেই। কাউন্সেলিং স্বল্পমেয়াদী একটি সেবা।
কাউন্সেলিং মূলত ক্লায়েন্টের বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। যেমন- দাম্পত্য জীবনে অশান্তি। এক্ষেত্রে কাউন্সেলর মাত্র কয়েকটি সেশনে ক্লায়েন্টের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সমাধান বাতলে দেন। আর সাইকোথেরাপি দীর্ঘসময় নিয়ে চলা একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। এতে সমস্যার একদম গভীরে গিয়ে সমস্যার শিকড়কে উপড়ে ফেলা হয়। এতে ব্যক্তির অতীত ও অতীতের সমস্যাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় যেন এর প্রভাবে বর্তমান জীবন সুন্দর হয়।
কীভাবে সাইকোথেরাপি শুরু করবেন
প্রথমে আপনাকে একজন সাইকোথেরাপিস্ট খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য আপনার পরিচিত লোকজনকে জিজ্ঞেস জরুন, আপনার পারিবারিক ডাক্তারকে বলুন, আশেপাশের মেডিকেল কলেজগুলোতে খোঁজ নিন, কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ থাকলে সেখানে খোঁজ নিন।
তারপর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন ও সাইকোথেরাপি শুরু করুন। সাইকোথেরাপি মোটামুটি এরকম হবে- আপনি ও আপনার থেরাপিস্ট প্রথমে আপনার সমস্যাকে খুঁজে বের করবেন। এতে আপনার থেরাপিস্ট বিভিন্ন স্কেলের ভিত্তিতে আপনার ডিপ্রেসন বা এংজাইটির তীব্রতা পরিমাপ করবেন। এরপর সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবেন। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে বলতে আপনার গুরুত্বপূর্ণ আচরণগত ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করবেন এবং তা শোধরানোর কৌশল শেখাবেন। থেরাপিস্ট আপনাকে কিছু হোমওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন এবং আপনি তা ঠিকঠাকমতো করছেন কি না তার খবর নেবেন। তারপর আপনার থেরাপিস্ট ও আপনি সময়ের সাথে আপনার কতটুকু উন্নতি হচ্ছে তা নিরীক্ষণ করবেন। আশা করা যায়, এভাবে একসময় আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
বর্তমানে মানসিক যেকোনো জটিলতা বা মানসিক রোগের নির্ভরযোগ্য ও কার্যকরী সমাধান হচ্ছে সাইকোথেরাপি। আপনি যদি কোনো মানসিক সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে দেরি করবেন না। আজই অভিজ্ঞ কোনো সাইকোথেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ করুন।