আজকের যুগে কোনো ক্ষমতাশীল নারী দৃষ্টিগোচরে আসবে না, সে কথা কল্পনাই করা যায় না! বছরের পর বছর সারা বিশ্বের নানা খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন, যেমন- ফোর্বস, নিউজউইক, এন্ট্রাপ্রিনিউর, টাইম, দ্য টেলিগ্রাফ প্রভৃতি ক্ষমতাশীল এবং জনপ্রিয় নারীদের অবদান ও স্বীকৃতি তুলে ধরে। এই নারীরা তাদের বিচক্ষণতা প্রমাণ করেন নানা ক্ষেত্রে। তবে তাদের মতো পূর্বে নারীরা তাদের ক্ষমতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিলেও পুরুষেরা তাদের দমিয়ে রেখেছে। সবদিক থেকেই এগিয়ে থাকা সেসব নারীরা আজকের ক্ষমতাশীল নারীদের মতোই রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, আর্থিক সংস্থান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্য সব বিষয়েই নিজেদের সার্থকতা তুলে ধরেছেন। বৈশ্বিক নীতিমালায় নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েও তারা পৃথিবীতে রেখে গিয়েছেন তাদের অবদান। যদিও প্রাচীনকালে বেশ ভালো সংখ্যক নারীরই অবদান ছিলো, তবুও তাদের মধ্যে খুব কম নারীকেই মনে রাখা হয়েছে আজ পর্যন্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের নারীর অর্জনই তাদের সমকক্ষ পুরুষদের অর্জনের তুলনায় পিছিয়ে আছে। আজকে কথা হবে ইতিহাসের সেরকম দশজন ক্ষমতাশীল নারীদের নিয়ে, যাদের নাম ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে গেলেও তাদের রয়েছে স্মরণীয় ও বরণীয় সব অবদান।
কসেম সুলতান
তাঁর আসল নাম ছিলো অ্যানাস্তাসিয়া। গ্রিক বংশোদ্ভূত এই নারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন বসনিয়ায়। তিনি ইস্তানবুলে গিয়ে পৌঁছান একজন দাসী হিসেবে এবং সেখানে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয় অন্তঃপুরে। শীঘ্রই তিনি প্রথম সুলতান আহমেদের কাছে স্ত্রী হিসেবে খুব প্রিয় হয়ে যান এবং অ্যানাস্তাসিয়ার নাম রাখেন কসেম। সুলতান আহমেদের ঘরে জন্ম নেয়া তার ছেলেরা অবশেষে উত্তরাধিকারসূত্রে সাম্রাজ্যের দায়ভার পেয়ে যায়। আর তাই সে সময়টাতে পাক্কা ত্রিশ বছর তার খেতাব থাকে ‘রানী-মাতা’। বেশিরভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বিচার-বিবেচনায় তার ছেলেদের চাইতে তার অবদান বেশি ছিলো। দু’বার তিনি এই সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন এবং এভাবেই তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের সবচাইতে সমৃদ্ধিশালী নারীতে পরিণত হন। তিনি খুবই জটিল প্রকৃতির নারী ছিলেন, যিনি রাজনৈতিক শত্রুদের প্রতি কোনো করুণা বা দয়া-মায়া দেখাতেন না। তবে দরিদ্রদের প্রতি তিনি অবলীলায় বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত!
তুরহান
তুরহান ছিলেন কসেমের পুত্রবধূ এবং প্রধান শত্রু। দু’জনেরই ছিলো ক্ষমতাশীল পুত্র এবং দু’জনেরই ইচ্ছা ছিলো শাসকের স্থানটি নেয়া! তবে তুরহান তার কাজকর্মে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ছিলেন নিতান্তই ধূর্ত ও নির্দয়। তিনি কসেম ও তার বাহিনীকে কসেমের নিজগৃহে হত্যার পরিকল্পনা করেন। শেষমেশ তার পরিকল্পনা সফল হয় ও রাজপ্রতিনিধিত্বের সুযোগটা তিনি পান এবং রাজত্ব করেন অটোম্যান সাম্রাজ্যে।
মারোযিয়া
মধ্যযুগে গোটা ইউরোপকে একত্র করে রাখতে পেরেছিলো শুধুমাত্র ক্যাথলিক গির্জা। এটা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছিলো একজন নারীর নেতৃত্বের কারণে। আর তিনি সিনেটর মারোযিয়া। তিনি ছিলেন কাউন্ট টিওফিল্যাক্ট (ডিকনদের অব্যবহিত ঊর্ধ্বতন যাজক), রোমের সবচাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার পিতার মৃত্যুর পর ক্ষমতার ভিত্তিটা চলে আসে তার আওতায়, যদিও পোপ বা পাদ্রি তখনও গির্জার প্রধান শাসক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। মারোযিয়ার ঋষি পিটারের সিংহাসনের পেছনের মূলশক্তি ছিলেন এবং মারোযিয়াই নির্ধারণ করতেন কে হবেন পরবর্তী পোপ। তবে ইতালির রাজার সাথে বিয়ের কারণেই তার জীবনে নেমে আসে ধস। মারোযিয়ার ছেলে আলবেরিকই তার স্বামীর বিরুদ্ধে সব দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূলে ছিলো। ফলস্বরূপ মারোযযিয়ার স্বামীকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় এবং মারোযিয়া হয়ে যান কারারুদ্ধ! আর এভাবেই কৌশলে আলবেরিক রোমের সম্রাট হয়ে যায়।
তোরেগেন খাতুন
তোরেগেন খাতুন চেঙ্গিস খানের তৃতীয় ছেলে ওগেদেই-এর স্ত্রী ছিলেন। আর ওগেদেই ছিলেন মঙ্গোল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গ্রেট খান। কিন্তু তিনি একজন মদ্যপায়ী ছিলেন, যাকে সাম্রাজ্যের দায়ভার দেয়ার কারণ এই ছিলো যে, তার অন্যান্য ভাইয়েরা একে অন্যকে ঘৃণা করতেন। তাই তাদের কারো কাছে সাম্রাজ্যের দায়ভার দিলে যুদ্ধ-বিগ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। ওগেদেই তার কাজের বেশিরভাগ অংশের দায়িত্বই দিয়ে দিতেন তার স্ত্রী তোরেগেন খাতুনের কাছে। তাই ওগেদেই এর মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকভাবে তার ক্ষমতা চলে যায় তার স্ত্রীর কাছে। তোরেগেন খাতুন মঙ্গোল সাম্রাজ্য শাসন করেন যতদিন পর্যন্ত তার ছেলে গ্রেট খান না হয়ে যান।
সোরঘাঘতানি বেকি
চেঙ্গিস খানের ছোট ছেলে তোলুই এর স্ত্রী ছিলেন সোরঘাঘতানি। তোলুই এর মৃত্যুর পর তিনি শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। যদিও ইতোমধ্যে তার পুত্রের বয়স হয়ে যায় ২৩ বছর। মঙ্গোল সাম্রাজ্যে তিনি বেশ ক্ষমতাশীল শাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি তোরেগেনের পুত্রের মৃত্যুর পর তার পুত্রকে সিংহাসনে দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের ঐক্যজোট গড়ে তোলেন। তার ছেলে যেন ‘গ্রেট খান’ উপাধি পান, সেজন্য তিনি বেশ বড়সড় ঘুষ অভিযান চালনা করেছেন। আর তার বহু বছরের পরিকল্পনা এবং ধূর্ততা সার্থক হয়, যখন তার ছেলে লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হয়। পারস্যের কাহিনীকার রশিদ-আল-দ্বীন মঙ্গোলদের ‘গ্রেট এমিরস অ্যান্ড ট্রুপস’-এ লিখেছেন “তিনি তাঁর হুকুম পালনের ক্ষেত্রে এক চুলও ছাড় দিতেন না”।
আহোতেপ
স্বামীর মৃত্যুর পর সতেরোতম রাজবংশের শাসক, ফেরাউন সেকুইনেনার তাও, আহোতেপ তার কনিষ্ঠ পুত্র আহ্মোসের বদলে শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিশরের শাসক হওয়ার দরুন তিনি হেকসোস আগ্রাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তার স্বামীর বাহিনী ও মিশরের বিদ্রোহীদের পাঠিয়েছিলেন। সে যাত্রায় বিজয়ের পর থেকে তিনি একধরনের সম্মানসূচক পদক বা অলঙ্কার পরিধান শুরু করেন, যার নাম ছিলো ‘গোল্ডেন ফ্লাইস অব ভ্যালর’, যা মিশরের সেনানায়কদেরও পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হতো।
আরসিনোই
আরসিনোই ছিলেন প্রথম টলেমির কন্যা। প্রথমে তিনি বিয়ে করেছিলেন পশ্চিম-পূর্ব ইউরোপের ঐতিহাসিক এলাকা থ্রেসের শাসক লাইসিসমাচুসকে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২৭৯ সালে যখন আরসিনোইয়ের ভাই দ্বিতীয় টলেমি উত্তরাধিকার সূত্রে মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তিনি মিশরে পালিয়ে যান। আর তার ভাইয়ের স্ত্রীকে মিথ্যা অভিযোগে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন এবং নিজের ভাইকে বিয়ে করেন। আর তার এই ভাইকে বিয়ে করার বিষয়টি গ্রীক সমাজে এক মহা কলঙ্কের ছাপ ফেলে দেয়। শীঘ্রই আরসিনোই তার ভাই অর্থাৎ স্বামীর শাসন ক্ষমতাকে ম্লান করে দেন এবং নিজেকে মিশরের কার্যকরী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সরকারি নথিতে তিনি নিজেকে ফেরাউন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার নামে মুদ্রাও প্রচলন করেন।
যোই
তিনি ছিলেন অষ্টম কন্সট্যান্টাইন (১০২৮ সাল পর্যন্ত বাইজান্টাইনের সম্রাট ছিলেন) এর কন্যা। জীবনে বহুবার বিয়ে করা সত্ত্বেও তিনি সবসময়ই ছিলেন বাইজান্টাইনের সম্রাজ্ঞী। তার একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিলো তার বোন থিওডোরা। যদিও ঘটনাক্রমে থিওডোরা যোইয়ের পাশাপাশি সহ-সম্রাজ্ঞী হিসেবে শাসন করে যান, যতদিন না পর্যন্ত তার বিয়ে হয়ে যায় নবম কন্সট্যান্টাইন মনোমাচুস এর সাথে। থিওডোরার বিয়ের পর যোইয়ের পাশাপাশি সহ-সম্রাট হিসেবে শাসন করেন মনোমাচুস।
ওয়েই
ওয়েই ছিলেন সম্রাট যংযংয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী, যিনি আঠারো শতাব্দীতে চীনের ট্যাং রাজবংশ শাসন করেন। ওয়েই এর স্বামী ছিলেন ঔ জেতিয়ান এর উত্তরাধিকারী। জেতিয়ানের ক্ষমতা ও নির্মমতার প্রশংসার জের ধরেই ওয়েই নতুন সদস্যদের নিয়ে এক শক্তিশালী আদালত গঠনে সফলকাম হন, যারা ছিলো জেতিয়ানের সাবেক মন্ত্রী। যংযং ছিলেন কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির, যার কারণে ক্ষমতার সিংহভাগই দিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েইকে। ওয়েই বেশ দক্ষতার সাথে শাসন করেন এবং তার বিপক্ষে যারাই যেত, তাদের প্রতি ওয়েই কোনো রকম করুণা করতেন না।
নূর জাহান
মুঘল সাম্রাজ্ঞের শাসক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ছিলেন নূর জাহান। জাহাঙ্গীর সরকারিভাবে শাসক থাকলেও তিনি ছিলেন মদ ও আফিমের প্রতি ঘোর আসক্ত। পুরো সাম্রাজ্য এই বিষয়ে অবহিত ছিলো যে, নূর জাহানই ছিলেন মূল শাসক, যিনি সব ধরনের ঘোষণা জারি করতেন এবং মুদ্রাগুলোতেও প্রচলিত ছিলো ছবি। সরকারি সব কাজের নথিপত্রের জন্য তার ছিলো রাজকীয় সীল।