করম্যান্টিন
আদজা তো হাতে এলো, কিন্তু করম্যান্টিনে ব্রিটিশ প্রতিরোধ তখনো শক্তিশালী। তাদের কমান্ড করছেন সেলউইন নামে এক অভিজ্ঞ অফিসার। তিনি দুর্গের প্রাচীর ছাড়াও বাম পাশে এক পাহাড়ের উপর কামান মোতায়েন করেছেন। উঁচু স্থানে থাকার ফলে সেই কামান অগ্রগামি যেকোনো সেনাদলের নাগাল পেয়ে যাচ্ছিল দুর্গের কাছে পৌঁছানোর আগেই।
ডাচ সেনাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কাউন্ট ভন হর্ন। ডি রুইটারের তরফ থেকে সেলউইনের কাছে তিনি আত্মসমর্পণের আহবান জানান। কিন্তু ব্রিটিশরা তা প্রত্যাখ্যান করল। ফলে লড়াই নিশ্চিত হয়ে যায়। আদজা দখলের পরদিনই জাহাজ থেকে ডি রুইটার অনেক সেনা তীরে নামিয়ে দেন। ডাচরা দুর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে ব্রিটিশরা কামান ব্যবহার শুরু করে। বিশেষ করে পাহাড়ে থাকা কামানের আঘাতে ডাচরা কিছুটা দিশেহারা হয়ে যায়।
ভন হর্ন দ্রুত দলে থাকা স্থানীয় এক লোকের সহায়তা নেন। ঘুরপথে সেই লোক তাকে পাহাড়ের উপরের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ভন হর্ন কিছু সেনা নিয়ে এরপর সেখানে হামলা চালিয়ে কামান নিষ্ক্রিয় করে দিলেন।
পাহাড়ের ঘাঁটি ধ্বংস করে ভন হর্ন এবার দুর্গে পুরোদস্তুর হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। কামানের গর্জনের ভেতর দিয়েই ডাচ এবং তাদের স্থানীয় সাহায্যকারীরা বিপুল বিক্রমে করম্যান্টিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গোলাবর্ষণ উপেক্ষা করে প্রাচীরের গাঁয়ে মই ঠেকানো হলো, এরপর তরতর করে মই বেয়ে উঠতে শুরু করল সৈনিকেরা। মইয়ের মাথা থেকে দুর্গের ভেতরে নিক্ষেপ করা হলো গ্রেনেড। বেশ কয়েক জায়গাতেই এরপর প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়লে ডাচরা দুর্গে প্রবেশ করে। লড়াই চালিয়ে যাওয়া অনর্থক বুঝে সেলউইন ও তার সহযোগীরা আত্মসমর্পণ করলেন।
করম্যান্টিন বিজয়ের পর ডি রুইটার ডেল মিনাতে ফিরে যান। এখানে তার কাছে খবর এলো যে যুবরাজ রুপার্ট এবং নেদারল্যান্ডসের সেনা সহায়তা কিছুই আসছে না। তবে মন্দের ভাল হিসেবে রসদপত্র নিয়ে কয়েকটি জাহাজ এসে পৌঁছে।
গিনি উপকূল ত্যাগ
ভ্যাল্কেনবার্গের সাথে আলোচনা করে ডি রুইটার ঠিক করলেন নতুন করে ইংল্যান্ডের আর কোনো ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো ঠিক হবে না। ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৫ সালে নিজ বহর নিয়ে তিনি সাগরে বেরিয়ে এলেন। এস্টেট জেনারেলদের নির্দেশ ছিল যেকোনো জায়গায় ব্রিটিশ জাহাজ পেলেই ছিনিয়ে নিতে।
এদিকে ১৬৬৪ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস দুই পক্ষই বাণিজ্য বহর নিজ নিজ জলসীমা ছেড়ে বের হবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। নৌবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছিল যুদ্ধের জন্য। ১৬৬৪ সালের শেষদিকে কাদিজে আসা ডাচ জাহাজগুলো ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন থমাস অ্যালেন ছিনিয়ে নিতে থাকেন। সংঘাত শুরু হয়ে গেলেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি ছিল। তবে তার আগেই ঊর্ধ্বতন কমান্ডের নির্দেশে রয়্যাল নেভি ১৬৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের ভেতরেই শতাধিক ডাচ বাণিজ্য জাহাজ দখল করে নিয়েছিল।
অবশেষে ১৬৬৫ সালের ১৪ মার্চ ঘটা করে দ্বিতীয় চার্লস সেভেন ইউনাইটেড প্রভিন্সেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। ডাচ যুদ্ধজাহাজ থেকে শুরু করে যেকোন বাণিজ্যিক জাহাজ দেখতে পেলেই আক্রমণের নির্দেশ দিলেন রাজা।
ফিরতি পথে ডি রুইটার
১৬৬৫ সালের ২৩ এপ্রিল বার্বাডোসের কাছে এসে পড়ল ডি রুইটারের বহর। সেখানকার বন্দরের কাছে দুটি দুর্গ থেকে ব্রিটিশরা নজর রাখছিল। ৩০ তারিখ ডি রুইটারের নেতৃত্বে রসদপত্র সংগ্রহের জন্য ডাচরা বন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু দুর্গে আর নোঙর করে থাকা ব্রিটিশ জাহাজের গোলাবর্ষণ তাদের থামিয়ে দেয়।
নিরুপায় হয়ে ডি রুইটার মার্টিনিক চলে গেলেন। এখানে ফরাসিদের গভর্নরের থেকে মালামাল সংগ্রহ করলেন। ৬ মে ডাচরা ব্রিটিশদের অধীনস্থ দ্বীপ মন্টেফেরাতের উদ্দেশ্যে পাল তোলে। সেখানে পাঁচজন ব্রিটিশ বণিক তাদের হাতে বন্দি হলো। এরপর নেভিস দ্বীপে বন্দি হলো আরো চারজন। আরো কয়েকজন বণিক আর বাণিজ্যের মালামাল বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আটক করে ডাচরা। ১৭ মে ডি রুইটার নাক ঘোরালেন নিউফাউন্ডল্যান্ডের দিকে। তার কানে ততদিনে চার্লসের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার খবর পৌঁছে গেছে।
২২ জুলাই ডাচ বহর নরওয়ের উপকূলে এসে পড়ল। এখানে ডি রুইটার আরেকটি ডাচ জাহাজের থেকে উত্তর সাগরে ব্রিটিশদের হাতে ডাচ নৌবহরের পরাস্ত হবার কথা জানতে পারলেন। তার অনুমান ছিল ব্রিটিশরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফলে অত্যন্ত সাবধানে চলতে থাকলেন তিনি। অগাস্টের ৬ তারিখে তার নৌবহর নেদারল্যান্ডসের এমস নদীর পশ্চিম তীরে ডেলফিজেল শহরের কাছে এসে অবস্থান নেয়।
ব্রিটিশ পরিকল্পনা
চার্লস ফ্রান্সের রাজা লুইকে নিজের দলে টানতে চাইছিলেন। চতুর্দশ লুইয়ের চোখ ছিল মূলত অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসের উপর, যা কিনা হাবসবুর্গদের শাসনাধীন। নেদারল্যান্ডসে ফরাসী ঘাঁটি করতে পারলে সেখান থেকে হাবসবুর্গ অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করা সহজ হয়। তবে নেদারল্যান্ডসের সাথে সামরিক সহায়তার চুক্তি থাকায় চার্লসের সাথে প্রকাশ্যে যোগ দেয়া আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। সবদিক বিবেচনা করে লুই ব্রিটিশদের সাথে জোট করার খুব একটা লাভ দেখতে পেলেন না।
ওদিকে ব্রিটিশদের মোকাবেলায় ডাচরা ৪৮টি নতুন জাহাজ বানাচ্ছিল। তাদের মূল ফ্লিট অবস্থান করছিল টেক্সেল দ্বীপের সাগরে, অপেক্ষা করছিল সর্বাধিনায়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি রুইটারের আগমনে। তার অনুপস্থিতিতে ওয়াসেনার (Jacob van Wassenaer Obdam) নামে অভিজাত বংশীয় এক অফিসার কমান্ডে ছিলেন। তার অধীনস্থ লেফটেন্যান্ট অ্যাডমিরাল স্টেলিংওর্ফ, কর্টেনার এবং অ্যাডমিরাল ট্রম্প, যিনি প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের নৌবাহিনীর অধিনায়ক ট্রম্পের ছেলে।
ব্রিটিশরা ডাচদের টেক্সেলেই অবরোধ করতে চাইল। ১০৯টি রণতরী আর ২৮টি ফায়ারশিপ নিয়ে ডিউক অফ ইয়র্ক টেক্সেলের বাইরে হাজির হলেন। তার সহকারী অফিসার ছিলেন যুবরাজ রুপার্ট, ডিউক মঙ্ক আর আর্ল অফ স্যান্ডউইচ। তাদের মূল উদ্দেশ্য জিল্যান্ডের বাহিনীর সাথে টেক্সেলের ফ্লিটের সম্মিলন ঠেকানো এবং আমস্টারডাম বরাবর বাণিজ্য কাফেলা বন্ধ করে দেয়া।
অভিযানের সফলতা নির্ভর করছিল কত দিন ব্রিটিশরা সাগরে থাকতে পারে তার উপরে। ডিউক অফ ইয়র্কের বিশ্বাস ছিল বাণিজ্য বন্ধ করে দ্রুত ডাচদের খোলা সাগরে যুদ্ধে বাধ্য করতে তিনি সক্ষম হবেন, তাই লম্বা সময় সাগরে থাকার মতো রসদপত্র তিনি জাহাজে জমা করেননি। রুপার্ট আর মঙ্ক টেক্সেলের বাইরে কয়েকটি ডাচ বাণিজ্য জাহাজ কব্জা করতে পারলেও রসদ ফুরিয়ে আসায় তিন-চার সপ্তাহ পরেই ব্রিটিশরা অবরোধ সাময়িকভাবে তুলে নেয়।
এই অবসরে জিল্যান্ডের বহর এসে টেক্সেলের মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিল। ওয়াসেনার এবার খোলা সাগরে বেরিয়ে এসে ডিউক অফ ইয়র্ককে ধাওয়া করলেন। পথিমধ্যে তিনি নয়টি ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ছিনিয়ে নেন।
ব্যাটল অফ লোয়েস্টোফ্ট
জুন ১২, ১৬৬৫। উত্তর সাগরে নরফোকের উপকূলে লোয়েস্টোফ্ট শহর।
ডাচ আর ব্রিটিশ বহর একে অপরের দেখা পেয়ে যুদ্ধসাজে সজ্জিত। বাতাস বইছে ব্রিটিশদের পক্ষে, তারপরেও ওয়াসেনার আক্রমণের ফয়সালা করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ডিউক অফ ইয়র্কের জাহাজ কোনোভাবে ঘায়েল করতে পারলেই কেল্লা ফতে। সেই কাজ করতে তিনি নিজের অন্যান্য জাহাজের থেকে বেশ এগিয়ে ছিলেন। তার দলের অন্য চারটি জাহাজও তাকে অনুসরণ করলে ডাচ সারি কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
ডিউক অফ ইয়র্ক দেখতে পেলেন- তিনি ডাচ জাহাজ দিয়ে অনেকটা ঘেরাও হয়ে গেছেন। দুই পক্ষের মধ্যে গোলা বিনিময় চলতে লাগল। কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার নিহত হন। অন্যদিকে স্টেলিংওর্ফ যুদ্ধের শুরুতেই নিহত হয়েছিলেন, কর্টেনার হন আহত। কর্টেনারের অফিসারেরা ভীত হয়ে ওয়াসেনারের আদেশের অপেক্ষায় না থেকেই জাহাজ সরিয়ে নিতে থাকে। অন্যান্য ডাচ জাহাজ তাদের দেখে মনে করল ওয়াসেনার বোধহয় পিছিয়ে আসার আদেশ জারি করেছেন, ফলে ১২-১৩টি জাহাজ তাদের অনুগামী হয়। এই সুযোগে আর্ল অফ স্যান্ডউইচ ডাচ মধ্যভাগে আঘাত করে তাদের দু’টুকরো করে দেন।
দুপুর একটার সময় দেখা গেল ডাচ সারি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। ওয়াসেনার পশ্চাদপসরণকারী জাহাজগুলো ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে সরাসরি ডিউক অফ ইয়র্কের রণতরীর দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু চারদিক থেকে ব্রিটিশ জাহাজ তার দিকে নিশানা করে কামান দাগতে থাকলে প্রচণ্ড শব্দে ওয়াসেনারের জাহাজ বিস্ফোরিত হয়, ৫০০ লোকের মধ্যে বেঁচে যায় মাত্র পাঁচজন।
ওয়াসেনার বেঁচে যাওয়াদের তালিকায় ছিলেন না। এদিকে দুটি ফায়ারশিপের আঘাতে ডাচ সম্মুখসারির বেশ কয়েকটি জাহাজেও আগুন জ্বলে ওঠে। পরাজয় আসন্ন বুঝে অ্যাডমিরাল ট্রম্প ডাচদের সরিয়ে নেন। ব্রিটিশদের জাহাজও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ডাচদের পিছু ধাওয়া করল না।
এই সংঘর্ষে ডাচদের ১৬টি জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়, তিনজন কমান্ডারসহ মারা গেল ২,০০০ সৈনিক। ব্রিটিশদের মাত্র একটি জাহাজ ডুবে যায়, হতাহতের সংখ্যাও নগণ্য।
এই যুদ্ধের পর ডিউক অফ ইয়র্ক আর যুবরাজ রুপার্ট কিছুদিনের জন্য তীরে চলে গেলে আর্ল অফ স্যান্ডউইচ নৌবহরের দায়িত্বে থাকেন। তার সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল ফিরতি পথে থাকা ডি রুইটারকে ধ্বংস করে দেবার, কিন্তু হেলায় সেই সুযোগ হারান তিনি। ডি রুইটারকে না খুঁজে মনোযোগ দেন ডাচ বাণিজ্য জাহাজ দখল করার কাজে।
ডাচ প্রতিক্রিয়া
লোয়েস্টোফ্টের পর ডাচরা দ্রুত বিধ্বস্ত জাহাজ মেরামতের কাজে হাত দিল। ডি রুইটার তখনও এসে পৌঁছেননি, এমনকি তিনি ফিরে আসতে পারবেন কিনা তা নিয়েও এস্টেট জেনারেলরা সন্দিহান। তারা তাই ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিলেন ট্রম্পকে।
সাইত্রিশ বছর বয়স্ক ট্রম্প তার বাবার মতোই সুদক্ষ অফিসার, কিন্তু তিনি কিছুটা উদ্ধত স্বভাবের। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ মানতে তার গড়িমসি খুব দুর্লভ নয়। নিজের আভিজাত্যের অহমিকায় ডি রুইটারের মতো সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া কারো অধীনে থাকা তার কাছে সুখকর নয়। রিপাবলিকান হওয়ায় ডি উইটকেও তিনি দেখতে পারতেন না, কারণ মনে-প্রাণে ট্রম্প ছিলেন অরেঞ্জিস্ট।
ড্যানিশ সমর্থন
বার্যেন তৎকালীন ডেনমার্কের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ শুরু হলে মাল বোঝাই ডাচ বাণিজ্য বহর নিরপেক্ষ ডেনমার্কের বার্যেনে আশ্রয় নেয়। ড্যানিশ রাজা গোপনে ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ করলেন। প্রস্তাব দিলেন ডাচ জাহাজ থেকে প্রাপ্ত মালামালের একাংশের বিনিময়ে তিনি ব্রিটিশদের বার্যেনে ঢুকতে দিতে রাজি আছেন।
রফা হয়ে গেলে আর্ল অফ স্যান্ডউইচ বার্যেনে প্রবেশ করতে গেলেন, কিন্তু কোনো একটা ভুল বোঝাবুঝির সূত্র ধরে বন্দর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ড্যানিশ কামান ব্রিটিশদের উপর গোলাবর্ষণ আরম্ভ করল। ৬ জন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৪০০ নাবিক হতাহত হয়। ড্যানিশ রাজা প্রমাদ গুনলেন, ব্রিটিশরা প্রতিশোধ নিতে কী না কী করে বসে। তিনি এবার নেদারল্যান্ডসের পক্ষাবলম্বন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন।
আর্ল অফ স্যান্ডউইচের পতন
তৎকালীন নৌ কমান্ডারদের মধ্যে আর্ল অফ স্যান্ডউইচ ছিলেন সুনামের অধিকারী। তার তড়িৎ আক্রমণই কিন্তু লোয়েস্টোফ্টে ব্রিটিশ জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল। বার্যেনের ব্যর্থতার পর তিনি কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নয়টি জাহাজ দখল করে নেন, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় দুই লাখ পাউন্ড। কিন্তু এখানে তিনি তার জীবনের অন্যতম একটি ভুল করে বসেন। সর্বাধিনায়ক ডিউক অফ ইয়র্কের অনুমতি না নিয়েই লুণ্ঠিত মালামাল ভাগ করে দেন অফিসারদের মাঝে।
মঙ্ক ও ব্রিটিশ অফিসার কভেন্ট্রি আগে থেকেই স্যান্ডউইচের বিরোধী ছিলেন। তারা এই কাজের সূত্র ধরে তাকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেন। স্যান্ডউইচ কোনোক্রমে সামরিক আদালতে দাঁড়ানো থেকে বেঁচে যান। আপাতত সাগরে থাকলেও সমরকৌশল নির্ধারণে তার কোনো ভূমিকা আর থাকল না।
ডি রুইটারের প্রত্যাবর্তন এবং ডাচ পুনর্গঠন
স্কটল্যান্ডের উপকূল ঘেঁষে এমস নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন ডি রুইটার। সময় তখন আগস্ট, ১৬৬৫। ১৯টি রণতরী এবং বাজেয়াপ্ত করা সাতটি মালবোঝাই ব্রিটিশ জাহাজ নিয়ে ডি রুইটার টেক্সেলে প্রবেশ করলেন।
ট্রম্পের গাইগুই সত্ত্বেও তার হাত থেকে কমান্ড নিয়ে ডি রুইটারকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। তার পদবী হলো লেফটেন্যান্ট অ্যাডমিরাল অফ হল্যান্ড এবং পশ্চিম ফ্রাইজিল্যান্ড। শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযানে তার পরামর্শদাতা হিসেবে এস্টেট জেনারেলদের প্রতিনিধি হিসেবে ডি উইটসহ তিনজন কমিশনার তার কাছে গছিয়ে দেয়া হয়।
ডাচ ফ্লিটে সেই সময় ৯৩টি রণতরী, ১২টি ফায়ারশিপ আর ২০টির মতো অন্যান্য জাহাজ। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার কামান আর ২০,০০০ সেনা প্রস্তুত আছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামত আর নতুন রণতরী নির্মাণে হাত লাগাল। ৬০০ মেরিন সেনা নিয়ে একটি বহর ১৬৬৬ সালের জুন মাসে সাগরে চলে গেল ব্রিটিশ বাহিনীর খোঁজে।
১৬৬৬ সালের অগাস্টে নিজের বহর চার ভাগে ভাগ করলেন ডি রুইটার। এরপর তিনি ডেলফল্যান্ড (Delfland) জাহাজে চেপে রওনা হলেন।তবে সেই বছর দুই পক্ষের নৌবাহিনী মুখোমুখি হয়নি। তবে উভয়েই পরস্পরের বাণিজ্য কাফেলার উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শীত কাটাতে ব্রিটিশ বহর ইংল্যান্ডের বন্দরে ফিরে গেল। লন্ডনে তখন চলছে প্লেগের প্রাদুর্ভাব, ফলে ব্রিটিশরা কিছুটা পর্যুদস্ত ছিল।
ডি রুইটার ঘোরাফেরা করছিলেন ব্রিটিশ উপকূলের উত্তরদিক ঘেঁষে। রওনা দেবার আগে এস্টেট জেনারেলরা ৩০ জুলাইয়ের এক আদেশে তাকে ইংলিশ চ্যানেল আর স্কটল্যান্ড দিয়ে চলাচলকারী ডাচ বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছিলেন। ডি রুইটার তার পাশাপাশি নাবিক ও সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। যুদ্ধের মহড়া করে ফেলেন কয়েকবার। নভেম্বরের শুরুতে এরপর তিনি শীত পার করতে নেদারল্যান্ডস ফিরে যান।