কর্মব্যস্ত একটি দিনের শেষে যে জিনিসটি আমরা মনে-প্রাণে কামনা করে থাকি, তা হলো রাত থেকে সকাল পর্যন্ত বিরতিহীন একটি ঘুম। এর সাথে যদি চমৎকার একটি স্বপ্ন বোনাস হিসেবে চলে আসে, তাহলে যে পরের সারাটি দিনই মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকবে, তা তো না বললেও চলে।
সুন্দর একটি কর্মব্যস্ত দিনের প্রধান পূর্বশর্ত হলো ঘুম। কিন্তু সবার ভাগ্যে নিরুপদ্রব, নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম জোটে না। অনেকের তো ঘুমই হয় না ঠিকমতো, যার ফলে উদ্ভব ঘটেছে ইনসমনিয়া, তথা নিদ্রাহীনতার মতো শব্দটিরও। যারা এতে ভোগেন, তারাই কেবল বোঝেন এর যন্ত্রণা কতটুকু। আর নিদ্রাহীনতা নামক এই অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে আজকের দিনে আমরা শরণাপন্ন হই চিকিৎসকের, সেবন করি তাদের পরামর্শ মোতাবেক নানা ওষুধ, মেনে চলি তাদের দেয়া উপদেশ। অনেকে আবার চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে শুরুতে ইন্টারনেটে গুগল বা ইউটিউবে ঘাঁটাঘাঁটি করে সমস্যাটির সমাধান বের করার চেষ্টা করেন।
স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা তো আরো একধাপ এগিয়ে। তারা ঘুমের সময় বিভিন্ন সাউন্ড ইফেক্ট সম্বলিত অ্যাপের মাধ্যমে কানে ইয়ারফোন গুঁজে পুকুর/নদীর বুকে বৃষ্টি, সমুদ্রের গর্জন, শোঁ শোঁ বাতাস কিংবা বজ্রপাতের সাথে বৃষ্টি, টিনের চালে বৃষ্টির সুমধুর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান। অর্থাৎ, যে পথেই যাওয়া হোক না কেন, সবারই লক্ষ্য থাকে কীভাবে সুন্দর একটি ঘুমের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
এগুলো তো গেলো আধুনিক যুগে ঘুমপাড়ানী মাসি-পিসিকে ডেকে আনার নানা উপায়। কিন্তু কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, কয়েক শতাব্দী আগে মানুষেরা এই অতি আরাধ্য ঘুমের সন্ধান পেতে কী করতেন? নিদ্রাহীনতা যখন তাদেরকেও চেপে ধরতো, তখন এর থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা কী কী করতেন? তাদের ঘুমের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করতেই আজকের এই লেখার অবতারণা।
১) নির্ধারিত রুটিন
আদিকালে মানুষেরা প্রথমেই যে কাজটি করতেন, তা হলো প্রতিদিন ঘুমের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রাখা, এবং সেই রুটিনের যেন কোনোক্রমেই ব্যত্যয় না ঘটে সেটা নিশ্চিত করা। আমাদের অভিভাবকদের মাঝে এটা এখনও বেশ ভালোভাবেই দেখা গেলেও তরুণ প্রজন্মের মাঝে এই অভ্যাসের যে বেশ অভাব রয়েছে, তা তো না বললেও চলে।
আমাদের পূর্বসূরীগণ মনে করতেন, কেবলমাত্র শান্তির একটি ঘুমই পারে একইসাথে দেহ-মন-আত্মাকে সুন্দর একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখতে। আবার যারা বেশি রাত করে ঘুমোতে যেত, কিংবা একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠতো, তাদেরকেও শিকার হতে হতো বিভিন্ন অপমানের, ঠিক যেমন আজকের দিনে আমাদেরকেও কথা শুনতে হয় আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে!
২) সঠিক খাদ্য সুন্দর ঘুমের নিশ্চায়ক
চা-কফির মতো পানীয় সবসময়ই মানুষের ঘুম নষ্টের কারণ হয়ে এসেছে। এ কারণে আজকের দিনের মতো আগেকার দিনের মানুষেরাও কিছু খাদ্য ও পানীয় যেমন ঘুমের ক্ষতিকারক হিসেবে এড়িয়ে চলতেন, তেমনই আবার কিছু খাবার খেতেন যেন ঘুম ভালো হয়।
একসময় ইউরোপীয়রা রাতে ভালো ঘুমের জন্য লেটুস পাতার স্যুপকে খাদ্য তালিকায় রাখতেন। সেই সাথে থাকতো পসেট নামক একপ্রকার পানীয়, যা বানানো হতো ঈষদুষ্ণ দুধের সাথে বিয়ার ও মশলা মিশিয়ে। সাধারণত শোবার আগে এই পসেট পান করা হতো।
তখন ভালো পরিপাকক্রিয়া ও ভালো ঘুম যে পরস্পর সম্পর্কিত তা বিশ্বাস করা হতো। ১৫৩৪ সালে স্যার থমাস এলিয়ট তার ‘Castel of Helth’ বইতে সেজন্য লিখেছিলেন, “Digestion is made better, or more perfite by slepe, the body fatter, the mynde more quiete and clere, the humours temperate”।
শোয়ার সময় দেহের ভঙ্গিটাও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তখন মনে করা হতো, সঠিক ভঙ্গিমায় ঘুম পরিপাকক্রিয়ায় সহায়তা করে।
৩) সঠিক তাপমাত্রা
আধুনিক ঘুম বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ঘরের তাপমাত্রা যদি ১৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, কেবলমাত্র তাহলেই তা চমৎকার একটি ঘুমের নিশ্চয়তা দিতে পারবে। আগেকার দিনের মানুষজন হয়তো এত নিখুঁতভাবে হিসেব করে বলতে পারতেন না, তবে তাপমাত্রা বেশি থাকা যে ভালো ঘুমের জন্য মোটেও ভালো না সেটা তারা ঠিকই জানতেন। কিন্তু তাহলে তাপমাত্রা কমানোর জন্য তারা কী ব্যবস্থা নিতেন?
বেশি কিছু না, তারা কেবল তাদের দরজা-জানালাগুলো খুলে দিতেন। এতেই বাতাসের প্রবাহ পরিবেশ ঠাণ্ডা করে দিতো। তাদের তো আর আজকের দিনের মতো এয়ার ফ্রেশনার ছিলো না। তাই বাতাসে সুঘ্রাণ আনতে তারা ব্যবহার করতেন গোলাপ ও মার্জোরাম (একধরনের সুগন্ধী গুল্মবিশেষ)। এছাড়া লিনেনের চাদরও তারা বিছানায় ব্যবহার করতেন, কারণ এটি বেশ শীতল ও আরামদায়ক। সেই সাথে এই চাদরের অন্য আরেকটি গুণও ছিলো। এটি ছাড়পোকা থেকে এর উপর ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিকে সুরক্ষা দিতো। আর ছাড়পোকার কামড় কে-ই বা খেতে চায়?
তবে যদি লিনেনের চাদরও ব্যর্থ হতো, তবে সেই চাদর পরিষ্কারের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হতো। ১৭৬০ সালে প্রকাশিত ‘Housekeeper’s Companion’ বইতে লেখিকা হান্নাহ গ্লাসে পরামর্শ দিয়েছেন, যারা জলাভূমিপূর্ণ এলাকায় থাকেন, তারা যেন খাটের পায়ের কাছে গরুর গোবর রেখে ঘুমান, কারণ এটা পোকামাকড় দূরীকরণে সহায়ক!
৪) ঘুমের ওষুধ
আজকের দিনে ঘুম না হলে আমাদের ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিয়ে ঘুম আনয়নের ব্যবস্থাটি সেরে নেন। তবে এ সমস্যা তো কেবল আজকের দিনে নয়, আরো অনেক আগে থেকেই ছিলো। তাহলে তখনকার মানুষেরা কী করতো, একবার কি ভেবেছেন এ বিষয়টি নিয়ে?
আগেকার দিনের মানুষেরা ঘুমানোর জন্য ঘরে তৈরি ওষুধের দ্বারস্থ হতেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা সেসব রেসিপি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও উন্নত হয়ে তাদের হাতে পৌঁছাতো, আবার তাদের হাত থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত হতো। ১৬৫৪ সালে প্রকাশিত এলিজাবেথ জ্যাকবসের স্বাক্ষরিত এক রেসিপি বইয়ে পুরুষদের দ্রুত ঘুমানোর জন্য চারটি রেসিপির কথা বলা হয়েছিলো। এর মাঝে একটি ছিলো পপি বীজের সাথে বিয়ার, হোয়াইট ওয়াইন বা ফর্টিফায়েড ওয়াইন মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত।
এছাড়াও ক্যামোমিল ফুলের নির্যাস, গোলাপের পাপড়ি, ল্যাভেন্ডার, শসা অথবা লেটুস পাতার রস থেকে পাতন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত মিশ্রণও এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো বলে জানা যায়। এটা যেমন পান করা হতো, তেমনই মাথা ঠাণ্ডা করার কাজেও ব্যবহার করা হতো। ১৭১০ সালে প্রকাশিত আরেকটি রেসিপিতে লাল গোলাপের পাতা, দুধ ও জায়ফল একত্রে মিশিয়ে সেটি একটি কাপড়ে বেঁধে এরপর কপালের দুই পাশে একে একে প্রয়োগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। বালিশ কিংবা জাজিমের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হতো গোলাপ গাছের শুকনো পাতা। কখনো সেগুলো ছড়িয়ে রাখা হতো বিছানার ওপরই। এর উদ্দেশ্য ছিলো বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয়া।
৫) প্রার্থনা
শেষটা করা যাক প্রার্থনার কথা দিয়েই। বিভিন্ন ধর্মেই ঘুমানোর আগে বিভিন্ন রকম প্রার্থনার কথা বলা আছে, যাতে ঘুমোনোর সময় কোনোপ্রকার অনিষ্ট না হয়।
আদিকালে ইউরোপীয়দের এই ‘অনিষ্ট’ নিয়ে বিশ্বাস অবশ্য এতটাই অদ্ভুত ছিলো যে, সেটা দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। তারা মনে করতো, রাতের বেলায় সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে শয়তান বেরোয় মানুষের ক্ষতি করতে, যখন তার ক্ষমতা তাকে বর্ণনাতীত। এমনকি, সে পুরুষদের জননাঙ্গের ক্ষতি করে তাকে পুরুষত্বহীন করে দেয়ার ক্ষমতাও রাখতো বলে বিশ্বাস করতো অনেকে।
শয়তানের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে তাই কেবল প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত হতো না তারা, নিতো আরো বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থাও। বিছানার পাশে রেখে দিতো বিভিন্ন রকম মন্ত্রপূত তাবিজ, যাতে শয়তান তাদের ঘরে আসতে না পারে। শিশুদের গলায় নেকড়ের দাঁতের মালা পর্যন্ত পরিয়ে রাখা হতো এই উদ্দেশ্যে।