‘প্রিজন গ্যাং’ ধারণাটির সূত্রপাত ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। শত্রুপক্ষের কয়েদীদের হাত থেকে নিজের দলের কয়েদীদের রক্ষা করতে চৌদ্দ শিকের ভেতরে নিজেদের একেকটি দল গড়ে তোলে আসামীরা। আত্মপক্ষ সমর্থনের ধারণা থেকে উদ্ভূত এই টার্মটি এখন অবশ্য কালের বিবর্তনে বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। প্রিজন গ্যাং বলতে এখন দুর্ধর্ষ সেই দলগুলোকে বোঝায়, যারা জেলের ভেতরে থেকেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে এবং পতিতাবৃত্তি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মতো সব অপরাধ কর্মের সাথে যোগসাজশ বজিয়ে রাখছে। অনেক সময় দেখা যায়, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা দীর্ঘদিন যাবত বাইরের দুনিয়ার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকায় তাদের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো পরিস্ফুটিত হতে শুরু করে। একঘেয়ে জীবনে কিঞ্চিৎ বিনোদনের ছোঁয়া পেতে তারা গড়ে তোলে নতুন দল, যেখানে সদস্য হয় তাদেরই মতো সুবিধাবঞ্চিত কয়েদীরা। মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা তাদেরকে পরিণত করে রীতিমতো দানবে। আজ তেমনই পাঁচ দুর্ধর্ষ প্রিজন গ্যাংয়ের কাহিনী জেনে নেয়া যাক।
১. দ্য নাম্বারস গ্যাং- দক্ষিণ আফ্রিকা
ধারণা করা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার জেলগুলোর বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করে দ্য নাম্বারস গ্যাং। ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই গ্যাং তিনটি চক্রে বিভক্ত- ২৬ তম, ২৭ তম এবং ২৮ তম। প্রতিটি দলের কাজ আলাদা। ২৬ তম গ্যাংয়ের কাজ নগদ অর্থ সংগ্রহ করা, ২৭ তম গ্যাং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকদের সামলায় আর ২৮ তম দল পুরোপুরি যোদ্ধা। সংখ্যাভিত্তিক এই গ্যাংগুলো বেশি ভয়ানক, কেননা এরা জেলখানার পুরো সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। নিজেদের চাহিদামতো টাকা বা অস্ত্রের সরবরাহ না পেলে কারাগারের নিরাপত্তারক্ষী বা প্রহরীদের খুন করাও তাদের জন্য খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার পলসমোর জেলখানার শতকরা ৫০ ভাগ প্রহরীর শরীরে ছুরিকাঘাত বা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জেলখানায় নতুন কয়েদী এলে তাদের সামনে নিজেদের ক্ষমতার প্রদর্শনী করতে তারা এমন কাজ করে। অনেক সময় নাম্বারস গ্যাংয়ের নতুন সদস্যদের আনুগত্য যাচাই করতেও প্রহরীদের আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। দলীয় এই বিনোদনের বলির শিকার হয় নিরীহ নিরাপত্তাকর্মীরা।
পলসমোর জেলখানার ২৮ তম দলের বর্তমান নেতা জন মংগ্রেল। মংগ্রেল কমপক্ষে ১,০০০ খুনের সাথে জড়িত বলে লোকমুখে প্রচলিত আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই গ্যাংটি মারাত্মক সংগঠিত। দলের কেউ নিয়মভঙ্গ করলে সাথে সাথে তদন্ত করে ‘ট্রায়াল’ এর ব্যবস্থা করা হয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে শ্বাসরোধ করে অথবা গলা কেটে সেই সদস্যের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অপরাধ খুব বেশি গুরুতর না হলে, সেই কয়েদীর পায়ুপথ ছুরি দিয়ে কেটে রক্তক্ষরণ নিশ্চিত করা হয়। এরপর গ্যাংয়ের এইচআইভি পজিটিভ কোনো সদস্যকে দিয়ে ঐ অপরাধীকে ধর্ষণ করানো হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার জেলগুলোর মাধ্যমে তাই এইডসের বিচরণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
২. প্রিমেইরো কমান্দো দা ক্যাপিটাল- ব্রাজিল
‘প্রিমেইরো কমান্দো দা ক্যাপিটাল’, পর্তুগিজ এই কথাটির মানে রাজধানীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান আজ্ঞাদানকারী দল। ব্রাজিলের এই প্রিজন গ্যাংটি সাও পাওলোতে তাদের আস্তানা গেড়েছে। ১৯৯৩ সালের ৩১ আগস্ট যাত্রা শুরু করে তারা। একটি সকার ম্যাচে অংশগ্রহণ করা আটজন কয়েদী মিলে শুরু করে তাদের দল। তখন থেকে প্রিমেইরো কমান্দো দা ক্যাপিটাল বা পিসিসি সাও পাওলোর সবচেয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে। এমনকি ব্রাজিলের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও তারা প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের ক্ষমতা ও অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসা। জেলখানার ভেতরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন, এমনকি আসামীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার রেকর্ডও আছে পিসিসির।
২০০৬ সালের মে মাসে পিসিসির সাথে কারা কর্তৃপক্ষের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। সাও পাওলোর পুলিশ এখনো পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেনি প্রায় ৪০ জন পুলিশ অফিসার নিহত হওয়া সেই যুদ্ধের পেছনে কে বা কারা দায়ী ছিল। এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন কিছু গণ্ডগোলের কারণে আরও প্রায় ১৫০ কয়েদী ও প্রহরী নিহত হয়। সাও পাওলো ও ব্রাজিলের কারাগার ইতিহাসে এটি এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে জঘন্য সহিংসতা হিসেবে বিবেচিত হয়। পিসিসির সদস্যরা জেলখানার ভেতরে সেলফোন ব্যবহার করে পূর্ব পরিকল্পিত এসব আক্রমণ চালায় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৩. ট্রিনিটারিও গ্যাং- যুক্তরাষ্ট্র এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র
১৯৮৯ সালে নিউ ইয়র্কের জেলহাজতে প্রতিষ্ঠিত হয় ট্রিনিটারিও গ্যাং। বস্তুত এই দলটি গঠন করা হয়েছিল নিউ ইয়র্ক কারাগারে আটককৃত স্প্যানিশ বন্দীদের সুরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশে। ট্রিনিটারিও শব্দটি এসেছে ‘ট্রিনিটি ব্রাদারহুড’ থেকে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই হিস্পেনিক বা স্পেনদেশীয়, মূলত ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের রক্ত তাদের ধমনীতে বইছে। ট্রিনিটারিও নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে দ্রুত ডালপালা ছড়ান গ্যাং হিসেবে পরিগণিত হয়। এমনকি সমুদ্র পেরিয়ে আশপাশের এলাকাতেও এরা প্রভাব বিস্তার করছে বলে শোনা যায়। যুক্তরাষ্ট্র আর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে এদের প্রায় ৩০,০০০ সদস্য আছে বলে ধারণা করা হয়।
মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, সাক্ষীকে ভয় দেখানো, ডাকাতি-লুটপাট, হত্যা, রাহাজানি এসবই তাদের অর্থ উপার্জনের প্রধান উৎস। তাদের প্রধান অস্ত্র রামদা। দ্রুত বর্ধনশীল সদস্যদের হাতে ভয়ঙ্কর এই অস্ত্রটি তুলে দিয়ে ট্রিনিটারিওরা কারাগারে নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে।
৪. ব্ল্যাক গেরিলা ফ্যামিলি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক ব্ল্যাক প্যান্থার গ্যাংয়ের সদস্য জর্জ জ্যাকসনের উদ্যোগে গঠিত হয় ব্ল্যাক গেরিলা ফ্যামিলি। ১৯৬৬ সালে স্যান কোয়েন্টিন জাতীয় কারাগারে এই গ্যাং তৈরিতে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে ডব্লিউ. এল. নোলেন। বেশ কিছু লক্ষ্য সামনে রেখে দলটি গঠন করে তারা যার মধ্যে ছিল বর্ণবাদ দূর করা এবং আমেরিকান সরকারকে টক্কর দেয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিজন গ্যাংগুলোর মধ্যে এরা রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী। বিজিএফ বা ব্ল্যাক গেরিলা ফ্যামিলির কর্তৃপক্ষ বিদ্বেষী মনোভাব কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদেরকে বেশ বড় রকমের একটি হুমকিতে পরিণত করেছে। সরকারকে এক হাত দেখে নেয়ার উদ্দেশে এই অফিসারদের নিধন করা তাদের দলগত নীতির অন্তর্ভুক্ত।
রাস্তা থেকে জেলখানায় ধরে আনা কৃষ্ণাঙ্গদের দলে নিয়োগ দেয় বিজিএফ। জেলের বাইরেও তাদের শক্তিশালী যে ক’টি সংগঠন রয়েছে, সবার মধ্যে দারুণ একটি সংহতি দেখা যায়। জরিপে দেখা গেছে, জেলের ভেতরে যদি বিজিএফের ৩০০ সদস্য থাকে, তবে জেলের বাইরে তাদের সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা কম করে হলেও ৫০ হাজার! গাড়ি চুরি, মাদক ব্যবসা, খুন ও অপহরণ তাদের প্রধান পেশা।
৫. দ্য নেতা অ্যাসোসিয়েশন- পুয়ের্তো রিকো
দ্য নেতা অ্যাসোসিয়েশন, যাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নেতা হিসেবেই ডাকা হয়, ১৯৭০ সালে পুয়ের্তো রিকোয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পুয়ের্তো রিকোর মাদক ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রক ও হর্তাকর্তা নেতারাই। আদর্শগত দিক থেকে নেতারা নিজেদের পুয়ের্তো রিকোর স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে দাবি করে। দলের সদস্যরা অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক নিপীড়িত ও বঞ্চিত বিধায় তাদের মধ্যে একটি পারস্পারিক সহানুভূতির জায়গা গড়ে উঠেছে। নেতারা এতোটাই শক্তিশালী গ্যাং যে, পুয়ের্তো রিকোয় তাদের ৪০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ হাজার এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রায় ৩০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে জানা যায়।
জি২৭ নামক বিরোধী এক গ্যাংয়ের দলনেতার সাথে পাশবিক এক যুদ্ধের মাধ্যমে নেতারা কুখ্যাত হয়ে ওঠে। হাত এবং চামচ ব্যবহার করে মাটি খুঁড়ে তার সেলে প্রবেশ করে নেতার সদস্যরা, কাঁটা চামচ দিয়ে তাকে আঘাত করে ১৫০ বারেরও বেশি এবং তার মৃতদেহ কুচি কুচি করে প্রায় ৮৪ টুকরো করে তারা। অভিযোগ রয়েছে, তার শরীরের খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠানো হয় যার মধ্যে ঐ দলপতির মা-ও রয়েছে। জি২৭ এর দ্বিতীয় প্রধানের কাছেও পৌঁছে যায় একটি টুকরো। নিজেদের পরিচয় গোপন করতে বেশ সিদ্ধহস্ত নেতারা, এমনকি নিজেদের সদস্যপদও অন্যদের সামনে স্বীকার করতে চায় না। এ কারণে কে যে এই গ্যাংয়ের সদস্য তা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য এবং বিপজ্জনক।
ফিচার ইমেজ- brookings.edu