পরিবারের কোনো সদস্য যখন জীবনের চিরন্তন সত্য তথা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়, তখন সবার একমাত্র চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেই মানুষটির শেষকৃত্যানুষ্ঠান কীভাবে সম্পন্ন করা যায় সেটা। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করে; কোথাও মৃতদেহ পোড়ানো হয়, কোথাও মাটির নিচে কবর দেয়া হয়, এমনকি কিছু কিছু সংস্কৃতিতে মৃতদেহকে শবভূক পাখির খাদ্যে পরিণত করার রেওয়াজ পর্যন্ত চালু আছে।
কবর দেয়া মৃতদেহগুলোকে বিভিন্ন সময়ই কবর-চোরদের নিকৃষ্ট লালসার শিকার হতে হয়েছে। ইতিহাসে এমন অনেক নজিরই খুঁজে পাওয়া যাবে, যখন মৃতদেহ বিক্রি করে কিছু পয়সা লাভের আশায় কিংবা মৃতদেহের সাথে দেয়া বিভিন্ন ধনসম্পদ হাতিয়ে নেয়ার লোভে কবর-চোরেরা কবরস্থানে হামলা চালিয়েছে। এমনকি আজকের দিনেও এমন ঘটনার কথা কখনো কখনো শোনা যায়।
এই কবর-চোরদের হাত থেকে মৃতদেহকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময়ই বিভিন্ন রকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হয়েছিল মৃতব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা। আজ আমরা তেমনই কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।
১. গোরস্থানের বন্দুক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ড্রেক্সেল হিলে একটি জাদুঘর আছে, নাম তার ‘মিউজিয়াম অফ মৌর্নিং আর্ট’। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে সংগৃহীত জিনিসগুলো মৃতদেহের সাথে সম্পর্কিত কোনোকিছুই হবে। আসলেও তা-ই।
এ জাদুঘরেই একটি বন্দুকের দেখা মেলে, যা এককালে মৃতব্যক্তির কাছের মানুষেরা ব্যবহার করতো। কেন? কারণ তৎকালে সেখানে কবর-চোরের উৎপাত ছিল অনেক বেশি। আর এই চোরেদের হাতে নিজেদের প্রিয়জনদের শবদেহটা যাতে খোয়াতে না হয়, সেজন্যই বন্দুকেই ব্যবস্থা করেছিল তারা। আঠারো শতকে উদ্ভাবিত এ বন্দুকগুলো পরিচিত ছিল ‘দ্য সিমেট্রি গান’ তথা ‘গোরস্থানের বন্দুক’ হিসেবে।
কবরের নিম্নভাগে আটকানো এ বন্দুকটি ৩৬০ ডিগ্রি কোণে, অর্থাৎ চারদিকেই ঘুরতে পারতো। এর সাথে লাগানো থাকতো চিকন তার। রাতের বেলা কবরের প্রহরী যখন তার দায়িত্ব থেকে অবসর নিত, তখনই মূলত খেল দেখাত এ বন্দুকটি। কোনো কবর-চোর অসতর্কভাবে বন্দুকটির সাথে লাগানো তারে পা দিলেই কাজ হয়ে যেত। এরপর সেদিক লক্ষ্য করেই অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকতো বন্দুকটি।
অবশ্য বন্দুকটির কলাকৌশল বুঝতে খুব বেশিদিন লাগেনি কবর-চোরদের। একবার বুঝে যাবার পর তারা বেছে নিয়েছিল অন্য কৌশল। দিনের বেলায় তারা নারী সঙ্গীদের কবরস্থানে পাঠাতো সেখানে কোন কোন কবরে এমন বন্দুক লাগানো আছে সেটা দেখে আসতে। এরপর রাতে তারা সেসব জায়গা এড়িয়ে চলতো যাতে করে আর গোরস্থানের বন্দুকের শিকার হওয়া না লাগে।
এ বন্দুকগুলো সাধারণত সপ্তাহের চুক্তিতে ভাড়ায় নেয়া হতো। সেই ভাড়াও ছিল বেশ চড়া। তাই ধনীরা ছাড়া অন্যদের পক্ষে এর ব্যয়ভার বহন করাটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। ফলে কবরস্থান থেকে মৃতদেহ চুরির শিকার হতো সাধারণত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলো।
২. তিন স্তরের কফিন
উনিশ শতকে কবর-চোরেরা পুরো যুক্তরাজ্য জুড়েই ছিল আতঙ্কের প্রতিশব্দ। বিশেষ করে সেই সময়ের কুখ্যাত দুই সিরিয়াল কিলার উইলিয়াম বার্ক ও উইলিয়াম হেয়ারের কথা বলা লাগে। তারা প্রায় ১৭ জনকে খুন করেছিল ১৮২৮ সালেই। এরপর তারা মৃতদেহগুলো নিয়ে যেত ডাক্তার রবার্ট নক্সের কাছে, যিনি তাজা মৃতদেহ নিয়ে গবেষণা করতে খুব ভালোবাসতেন। এছাড়া বিভিন্ন মেডিকেল স্কুলগুলোতেও মৃতদেহের চাহিদা থাকায় কবর-চোরদের উৎপাত বাড়ছিল বৈ কমছিল না।
সেই ১৮২৮ সালেরই কথা। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ডাউলিং নামক এক লোকের স্ত্রী ও সন্তান দুজনই মারা যায়। ভালোবাসার মানুষ এবং নবজাতক সন্তানকে হারিয়ে ডাউলিংয়ের অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। তারপর যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, এ মৃতদেহ দুটো চোরদের হস্তগত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তখন তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরো বেড়ে গেল। অবশেষে এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তিনি। প্রথমে মৃতদেহ দুটো তার বাড়ির পাশেই সপ্তাহখানেক কবর দিয়ে রাখলেন, যতদিন না সেগুলো অনেকটাই পচে যায়।
এরপর সেই দেহাবশেষগুলো তিনি সীসা নির্মিত অন্য দুটি কফিনে স্থানান্তর করেন। সীসার কফিনগুলো এবার ঢোকান কাঠের তৈরি আরো দুটি কফিনে। সবার শেষে এই কফিন দুটোকে আরো বড় দুটো কাঠের তৈরি শবাধারে ভরে কবর দেয়ার পরেই শান্ত হন ডাউলিং।
৩. শেক্সপিয়ারের অভিশাপ
ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারের হলি ট্রিনিটি চার্চেই খুঁজে পাওয়া যাবে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কবর। অবশ্য শেক্সপিয়ার বুঝতে পেরেছিলেন যে, মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের প্রতি কবর-চোরদের নজর পড়তে বেশি সময় লাগবে না। ফলে এক অজানা আশঙ্কা সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াত।
মৃত্যুর আগে তাই নিজের কবর ফলকের জন্য এ কথাগুলো লিখে গিয়েছিলেন তিনি, যেখানে রয়েছে কবর চোরদের প্রতি অভিশাপ-বার্তা!
Good frend for Jesus sake forebeare,
To digg the dust encloased heare;
Bleste be the man that spares thes stones,
And curst be he that moves my bones.
শেক্সপিয়ারের এই অভিশাপবাণী কিন্তু কাজে এসেছিল। কারণ তার কবরের দিকে আজপর্যন্ত কেউ হাত বাড়ানোর দুঃসাহস করেনি!
৪. কফিন টর্পেডো
১৮৭৮ সালে কফিনের সাথে ব্যবহারের জন্য ‘কফিন টর্পেডো’ নামক এক বিষ্ফোরকের উদ্ভাবন পর্যন্ত করা হয়েছিল। আর এর পেছনে ছিলেন ফিলিপ কে. ক্লোভার নামক এক ব্যক্তি। ফিলিপের মতে, তার উদ্ভাবিত এ কৌশলের সাহায্যে সহজেই একজন কবর-চোরকে ঠেকানো সম্ভব। এজন্য একটি বিষ্ফোরক কফিনের সাথে লাগানো থাকবে। দাফনের পর কেউ যদি কফিনটিকে পুনরায় তুলে নিতে চায়, তাহলে সাথে সাথেই এমন বিষ্ফোরণ ঘটবে, যার ফলশ্রুতিতে চোর নিহত কিংবা গুরুতর আহত হবে।
১৮৮১ সালে এ কফিন টর্পেডোর কার্যকারিতার খবরও জানা যায়। সেই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘দ্য স্টার্ক কাউন্টি ডেমোক্র্যাট’ নামক সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে তিন কবর-চোরের একটি দল ঢুকেছিল এক কবরস্থানে, উদ্দেশ্য ছিল কোনো মৃতদেহ তুলে নিয়ে পয়সা কামানো। সাধারণত যখন তারা কাজে যেত, তখন দুজন কবর খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত থাকতো আর অন্যজন আশেপাশে সতর্ক নজর রাখতো কেউ আসছে কিনা তা দেখতে। সেদিনও সবকিছু পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছিল। একজন সামনে চলে গেল চারপাশে নজর রাখতে। অন্য দুজন কোদাল নিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করে দিল। একটু খোঁড়ার পরই হঠাৎ করে বিকট এক বিষ্ফোরণ হলো মাটির নিচ থেকে। আসলে তাদের কোদালের আঘাতে কফিন টর্পেডো সক্রিয় হয়েই ঘটেছিল সেই বিষ্ফোরণ।
বিষ্ফোরণের আঘাতে একজন প্রাণ হারায়, অন্যজন হারায় তার একটি পা। তৃতীয় যে চোর দূরে নজর রাখতে গিয়েছিল, সে তখন মৃতদেহ বহনের উদ্দেশ্যে আনা গাড়িতে করে তার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যায়।
৫. পিরামিডের কৌশল
প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ফারাওদেরকে কবর দেয়ার সময় সাথে দিয়ে দিত মূল্যবান সব ধনসম্পদ, যাতে করে পরকালে তাদের জীবনযাপনে কোনো কষ্ট না হয়। আর সেগুলো যেন চোরেরা সহজে হস্তগত করতে না পারে সেজন্য তারা ডিজাইন করতো জটিল সব নকশাযুক্ত ভবনের।
এমনই একটি কৌশল ছিল ঢালু পথের সাথে সংশ্লিষ্ট। এজন্য প্রবেশপথটা প্রথমে ঢালু করে বানানো হতো। এরপর এর সম্মুখভাগে রেখে দেয়া হতো ভারী, উঁচু কোনো পাথর, যাতে করে চোর সেটা কোনোভাবেই ধাক্কা দিয়ে সরাতে না পারে। আর যদি কোনোভাবে পারতোও, তবে একটু পরেই ছিল লোহার শিক দিয়ে তৈরি দরজা। ফলে সেদিক দিয়ে ঢোকা চোরদের জন্য প্রায় অসম্ভবই হয়ে দাঁড়াত।
তা-ই বলে চোরেরাও কিন্তু হাল ছেড়ে দিত না। তারা এমন সুড়ঙ্গ খুঁড়তো, যা গিয়ে শেষ হতো একেবারে মূল চেম্বারে, অর্থাৎ ফারাওয়ের কবর যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে। এভাবেই স্থপতির কৌশল আর চোরের ধূর্ততার মাঝে চলতো লুকোচুরি খেলা।
৬. মর্টসেফ
কবর-চোরদের হাত থেকে রেহাই পেতে এখন যে পদ্ধতিটির কথা বলতে যাচ্ছি, সেটা অনেকের কাছেই বেশ বিচিত্র ঠেকবে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে স্কটল্যান্ডে দেখা যেত লোহার তৈরি এ খাঁচাগুলো। এগুলো তখন পরিচিত ছিল ‘মর্টসেফ’ নামে। কফিনাকৃতির এ খাঁচাগুলোর একাংশ থাকতো মাটির নিচে থাকা কফিনকে ঘিরে। এগুলো এতই বড় হতো যে অপর অংশ বেরিয়ে আসতো মাটির বাইরে।
এক-দুজন মানুষের পক্ষে মর্টসেফকে সরানো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। এজন্য একদল লোক দিয়ে ভারী এ লোহার খাঁচাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টেনে নেয়া হতো। এটা তুলতে বিশেষ যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো, তা পরিচিত ছিল ‘মর্টসেফ ট্যাকল’ নামে।
তৎকালে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন কবরস্থান কর্তৃপক্ষই কয়েকটি মর্টসেফের ব্যবস্থা রাখতো। দৈনিক এক শিলিং খরচে সেগুলো ভাড়া করা যেত। মর্টসেফ ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য ছিল মাটির নিচে থাকা মৃতদেহটি যাতে কবর-চোরদের নেয়ার অযোগ্য অবস্থায় চলে যায় সেটা নিশ্চিত করা। অবশ্য ধনী পরিবারগুলো স্থানীয় কামারদের সহায়তায় নিজেরাই এমন মর্টসেফ বানিয়ে নিত। এডিনবার্গের গ্রেফায়ার্স কার্কইয়ার্ডে আজও এমন বেশ কিছু মর্টসেফ খুঁজে পাওয়া যাবে।
ফিচার ইমেজ: graveyardsofscotland.com