এক রোহিঙ্গা স্কুলশিক্ষক এবং তার গণহত্যার ডায়েরি (৮ম পর্ব)

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের অষ্টম পর্ব

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে ফুতুকে নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি; Image Source: Twitter

২৫ আগস্ট ভোরবেলায় সমগ্র রাখাইন রাজ্যজুড়ে চেকপোস্টগুলোতে আরসা একযোগে ৩০টি হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় সরকার জঙ্গিদের সাথে বেসামরিক জনগণের কোনো পার্থক্য করেনি। মনে হচ্ছিল কর্তৃপক্ষ যেন এরকম কোনো অজুহাতের অপেক্ষাতেই ছিল। কয়েক মাস ধরেই সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। কমপক্ষে ২৭টি আর্মি ব্যাটেলিয়নের সাথে বিজিপি এবং বেসামরিক রাখাইন মিলিশিয়ারা যোগ দিয়ে এলাকা থেকে সবাইকে উচ্ছেদ করতে শুরু করে।

সেনাবাহিনী মুসলিমবিদ্বেষী চরম উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরামর্শে ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিরোধী অপপ্রচার চালাতে শুরু করে। ফলে গণহত্যা ছড়িয়ে পড়তে থাকে তরঙ্গের মতো। কমপক্ষে ১০,০০০ নারী, পুরুষ এবং শিশুকে হত্যা করা হয় – ছুরিকাঘাতে, শিরশ্ছেদ করে, টুকরো টুকরো করে, আগুন ধরিয়ে দিয়ে, গুলি করে। বাচ্চাদেরকে তাদের মায়েদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আগুনে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক বাচ্চাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। মহিলাদেরকে অপহরণ করে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, তাদেরকে কামড়ে, গণধর্ষণ করে, তাদের স্তন কেটে ফেলা হয়, এরপর তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। (কোয়ে তান কাউক গ্রামের রাখাইন প্রশাসক ইউ তিন থিন সোয়ে এগুলো অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।)

কয়েকদিন পর্যন্ত পাহাড়ে বিভ্রান্তি এবং গুজব মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। পরিবারগুলো নিরাপদ মনে করে সেদিকে যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার পাশে ধ্বংসস্তূপ দেখে কিংবা নতুন কোনো চেকপোস্টের মুখোমুখি হয়ে তাদেরকে আবার উল্টোদিকে ফিরে আসতে হয়েছিল। সর্বত্র মানুষের শরীর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। কিছু জীবিত, কিছু মৃত। মানুষজনকে দেখা না গেলেও গাছের আড়াল থেকে তাদের কথোপকথনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

রাতের বেলা যুবকরা একত্রিত হলো পরিকল্পনা করার জন্য। তারা গ্রামে থেকে ঘুরে আসতে চায়। খাবার খুঁজে আনার জন্য, তাদের মৃতদেরকে কবরস্থ করে আসার জন্য। ফুতু চেয়েছিলেন তাদের সাথে যোগ দিতে এবং তার ডায়েরিগুলো খুঁজে বের করে আনতে, কিন্তু তার বাবা তাকে নিষেধ করলেন “আমাদেরকে যদি মরতে হয়, তাহলে আমরা এখানেই না খেয়ে মরব। মরার জন্য তোমার নিচে নামার দরকার নেই।”

নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে শরণার্থীরা; Image Source: K M Asad/LightRocket/Getty

পঞ্চম রাতে নতুন একটি গুঞ্জন শোনা গেল- শীঘ্রই সেনাবাহিনী পাহাড়ে অভিযান চালাবে। সাথে সাথে সবাই বাংলাদেশের দিকে পালাতে শুরু করল। ফুতু এবং তার পরিবার অন্যদের পেছন পেছন সারা রাত কাদামাটির উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পরের দিন সকালে ছোট একটা নদী পার হলো। শেষপর্যন্ত তারা যখন বিশাল নাফ নদীর সাদা বালুকাময় সৈকতে এসে পৌঁছাল, তখন সেখানে অগণিত মানুষ ভিড় করছিল। ফুতুর জীবনে দেখা বাজারের সবচেয়ে বড় ভিড়ও এর তুলনায় নগণ্য ছিল। মানুষ সমুদ্রতীরের বালিতে তেরপলের তাঁবু টানাচ্ছিল, তাদের সাথে যে অল্প কিছু জিনিসপত্র ছিল, সেগুলোই বালির উপর ছড়িয়ে রাখছিল।

মাঝিরা শরণার্থীদেরকে নিয়ে এপার থেকে ওপারে আসা-যাওয়া করছিল। ফুতু নিকটবর্তী বাংলাদেশি তীরে যেতে চাইছিলেন না। তার আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ সরকার হয়তো এখানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিতে পারে কারা প্রবেশ করতে পারবে, কারা পারবে না। ফলে তারা হয়তো পানির উপর আটকা পড়ে যেতে পারেন।

ফুতু চাইছিলেন বাংলাদেশের আরও গভীরে, কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্রবন্দর দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে। মাঝি যখন অতিরিক্ত ভাড়া চাইল, তিনি দরদামের ঝামেলায় না গিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। সেদিন রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হলো। ফুতু তার জীবনে কোনোদিন এরকম বৃষ্টিপাত দেখেননি। চৌদ্দ ঘণ্টা পর, তারা গ্রাম ছেড়ে পালানোর ১৩ দিনে পর, ২০১৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, তাদের নৌকাটি কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরের বুক সমান উঁচু পানিতে গিয়ে থামল। ফুতু তার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে নেমে এলেন।

ফুতুর পরিবার ছিল বাংলাদেশে পৌঁছা ৭০০,০০০ রোহিঙ্গার মধ্যে একটি পরিবার। এটি ছিল বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় স্রোত। তারা একটি প্রধান সড়কের ধারে তাদের তেরপলের টুকরোকে তাঁবুর মতো করে টানিয়ে সেখানে রাত কাটান। তৃতীয় দিন সকালে বাংলাদেশি সামরিক বাহিনী তাদের সবাইকে রাস্তা ছেড়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা গাছপালার ভেতর দিয়ে নিজেদের ক্লান্ত শরীরগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। সেখানে তারা এমনভাবে বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবির গড়ে তোলেন যে, মনে হচ্ছিল কেউ যেন রাতারাতি ঘন জঙ্গল সাফ করে ফেলেছে।

কর্দমাক্ত পাহাড়ের উপর বাঁশ এবং তেরপলের তৈরি খুপরির পর খুপরি গজিয়ে উঠতে থাকে। তাদের ওজনে পাহাড়ের মাটি ধ্বসে পড়ার উপক্রম হয়। বর্ষাকালে ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটে। নতুন আগত শরণার্থীরা পৃথিবীর বুকে ছোট এক টুকরো জায়গা খুঁজে পেতেও হিমশিম খাচ্ছিল। জঙ্গলের ভেতর গড়ে উঠা শরণার্থী শিবিরে বিপন্ন এশীয় হাতিদের চলাচলের রাস্তাগুলো বিপন্ন মানবজাতির দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হাতির আক্রমণে তাঁবুগুলো পদদলিত হয়ে ১৩ জন শরণার্থী নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়।

শরণার্থী শিবিরের জীবন; Image Source: Jonas Gratzer/LightRocket/Getty

সেই উত্তাল প্রথম সপ্তাহে এক রাতে ফুতু নতুন একটি ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। তিনি যতটা যত্নের সাথে সম্ভব, যা কিছু ঘটেছে তা লেখার চেষ্টা করেন- তাদের গ্রাম ছেড়ে পালানোর তারিখ, পাহাড়ের বুকে রাত কাটানোর ঘটনা- কিন্তু তিনি টের পান, তার স্বাভাবিক সুস্থির মস্তিষ্ক কাজ করছে না। তার চিন্তাভাবনাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে: এই ঘটনা কি অমুক তারিখে ঘটেছিল, নাকি অন্য কোনো তারিখে? মৃত্যু, অগ্নিশিখা এবং সহিংসতার দৃশ্যগুলো তার পরিষ্কার মনে পড়ছিল, কিন্তু ঘটনার বিস্তারিত এবং তারিখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল তার মস্তিষ্ক যেন স্মৃতিগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেনি। তিনি এক সপ্তাহ ধরে ঘটনাগুলোর খসড়া তৈরি করেন। একবার শুরু করে আবার থেমে যান, তারপর আবার শুরু করেন।

দুনসে পাড়ার সবাই যেহেতু প্রায় একই সময়ে পালিয়ে এসেছিল, তাই শিবিরের ভেতর তাদের সবার প্রায় একই অংশে স্থান হয়েছিল। বলা যায় পুরো একটি গ্রাম এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। কর্দমাক্ত পথে যতবারই ফুতুর সাথে পরিচিত কারো দেখা হতো, ততবারই তিনি তাদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, তাদের কতজন আত্মীয় আহত হয়েছে, কেউ মারা গেছে কি না। তাদের পরিবারের সবাই বেঁচে থাকলে এরপর তিনি তাদের প্রতিবেশীদের কথা জিজ্ঞেস করতেন।

একদিন ফুতু সিদ্ধান্ত নিলেন, তাকে নতুন একটি ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে। এর আগে একবার তিনি তার গ্রামের মানুষদের জীবনের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, এবার তিনি তাদের মৃত্যুর তালিকা লিপিবদ্ধ করতে শুরু করলেন। তিনি ইংরেজিতে লেখা শুরু করলেন, শিরোনাম দিলেন ‘মৃতদের তালিকা’। প্রতিটি নামের সাথে একটি করে মুখের ছবি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল।

শেষপর্যন্ত তার তালিকায় ১২টি নাম স্থান পেয়েছিল। ফুতুর মনে হলো তিনি ভাগ্যবান যে, তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি ভাগ্যবান যে, তাকে তার নিজের পরিবারের কোনো সদস্যের নাম লিখতে হয়নি। কিন্তু নিহতের সবাইকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন- মায়েদেরকে, তাদের সন্তানদেরকে, শিশুদেরকে। ফুতু ইতিহাস ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসের গতিপথ ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bangla language. It's a translation of the article "The Schoolteacher and the Genocide" by Sarah A. Topol, published in The New York Times Magazine.

Featured Image: New York Times

Related Articles

Exit mobile version