এখন সবার হাতে হাতে মুঠোফোন রয়েছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যোগাযোগ করা যায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। কিন্তু একশো বছর আগে যোগাযোগ এতটা সহজ ছিল না। চিঠি ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কাউকে চিঠি লিখলে তা ডাক মারফত প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে অনেক দিন সময় লাগতো। যথাসময়ে চিঠি না পৌঁছানোর কারণে অনেক অসুবিধা হতো। তখনই কবুতর দিয়ে চিঠি পাঠানোর এক অভিনব পদ্ধতির উদ্ভব হয়। এতে চিঠি পৌঁছাতে যেমন সময় কম লাগতো, তেমনি রাষ্ট্রের শাসকগণের পাঠানো গোপন চিঠি ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যেত। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়া যোগাযোগের এই কৌশল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
কবুতরের পথ চেনার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এরা অনেক দূর উড়ে চলে গেলেও ঠিকই নিজ বাসায় ফিরে আসতে পারে। এদের স্মরণশক্তির এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হয় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। কোনো চিঠি এদের পায়ে বেঁধে দিলে, এরা তা সঠিক ঠিকানায় তা পৌঁছে দিতে পারতো। আবার ফিরতি চিঠি নিয়ে প্রেরকের কাছে ফিরেও আসতে পারে। যদিও দূরপাল্লার যোগাযোগের জন্য এটি তেমন প্রচলিত ছিল না, তবে মোটামুটি দূরত্বের জন্য এটি একটি ভালো পদ্ধতি ছিল।
১৯০৭ সালের ঘটনা। একজন জার্মান ওষুধ বিক্রেতা কবুতর ব্যবহার করেই রোগীদের কাছে ওষুধের প্রেসক্রিপশন পৌঁছে দিতে শুরু করলেন। একদিন তার মাথায় পোষা কবুতরগুলো নিয়ে এক চমকপ্রদ বুদ্ধির উদয় হয়। কবুতরগুলোকে তিনি বার্তাবাহক থেকে বানিয়ে ফেলেন আলোকচিত্রী বা ফটোগ্রাফার।
যেভাবে উড়ে গেল ফটোগ্রাফার কবুতর
সেই জার্মান ওষুধ বিক্রেতার নাম জুলিয়াস নিউব্রোনার। তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের ক্রোনবার্গ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। বাবার দেখানো পথ ধরে তিনিও ওষুধ বিক্রি করতেন। অনেকগুলো পোষা কবুতর ছিল তার। রোগীদের কাছে দ্রুত ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি কবুতরের সাহায্য নিতেন। এই কবুতরগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় অল্প পরিমাণে ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিতেন। এই পদ্ধতি তার সময় ও যাতায়াত খরচ দুটোই বাঁচিয়ে দিতো।
একদিন ওষুধ পাঠাতে গিয়ে একটি কবুতর কুয়াশার কারণে রাস্তা হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ চার সপ্তাহ সেই কবুতরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। চার সপ্তাহ পর হুট করে সেই কবুতর মালিকের কাছে হাজির হয়। নিউব্রোনার তার ফিরে আসা কবুতরের স্বাস্থ্যের কোনো পরিবর্তন দেখেননি। দীর্ঘ সময় মালিকের কাছ থেকে দূরে থাকলেও তার খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা হয়েছিল বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারটি নিউব্রোনারকে কৌতূহলী করে তোলে। কবুতরগুলো ওড়ার সময় কোথায় কোথায় যায় সেটা দেখার সাধ জাগে তার মনে।
একদিন ভাবলেন, কবুতরদের সাথে একটি ছোট ক্যামেরা সেট করে দিলে কেমন হতো? যে-ই ভাবা সেই কাজ। কিছু কবুতরের বুকে তিনি অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পাতলা দেহবর্ম লাগিয়ে দেন। এর সাথে একটি হালকা ও ছোট ক্যামেরা সেট করে প্রথম পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। ক্যামেরাগুলোতে একটি টাইমার লাগানো ছিল। নিউব্রোনার নিজেও একজন শখের ফটোগ্রাফার হওয়ায় ক্যামেরাগুলোর টাইমার ও শাটার স্পিড নিয়ে তিনি যত্ন সহকারে কাজ করেছিলেন। কাঠের ফ্রেমের তৈরি এই ক্যামেরাগুলোর ওজন ছিল মাত্র ৩০-৭৫ গ্রাম।
ফটোগ্রাফার কবুতর নিয়ে পরীক্ষা করতে জুলিয়াস নিউব্রোনার তার বাসা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি ৫০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত তার এই নতুন ফটোগ্রাফির কৌশল পরীক্ষা করেন। এভাবে কবুতরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও যন্ত্রের ছোটখাট পরিবর্তন করে তিনি আকাশ থেকে দৃষ্টিনন্দন ছবি তোলার কৌশল বের করে ফেলেন।
ঔষধ বিক্রেতা থেকে উদ্ভাবক হওয়ার গল্প
এমন নয় যে, আকাশ থেকে ছবি তোলার জন্য এটিই একমাত্র পদ্ধতি ছিল। বেলুন, ঘুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে আগে থেকেই আকাশ থেকে ছবি তোলার বিভিন্ন পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু এদের গতিবিধি ছিল সীমাবদ্ধ। কবুতর দিয়ে তোলা ছবিগুলো ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ছবিগুলো দেখতে অনেকটা এখনকার গো প্রো ক্যামেরার মতো ছিল। বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তোলা যেতো। লেগো খেলনার মতো ছোট ছোট বিল্ডিং আর পিঁপড়ার মতো হাঁটাচলা করা মানুষের ছবি সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক কৌতূহল সৃষ্টি করে।
জুলিয়াস নিউব্রোনার তার এই নতুন উদ্ভাবনকে পেটেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জার্মানির ইম্পেরিয়াল পেটেন্ট অফিসে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেন। ক্যামেরার যে নকশাটি তিনি পাঠান তাতে দুটো লেন্স এবং একটি অটোমেটিক শাটার ছিল। কিন্তু পেটেন্ট অফিস কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ ছাড়া তার পেটেন্ট অনুমোদন দিতে রাজি হয়নি। অবশেষে ১৯০৮ সালে নিজের তোলা ছবি প্রমাণ হিসেবে দেখিয়ে তিনি তার যন্ত্রের কার্যক্ষমতা প্রমাণ করেন এবং পেটেন্টের খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে নেন।
কবুতর দিয়ে ছবি তোলার বিষয়টি দ্রুত চারদিকে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। কবুতর দিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে শুনেই মানুষ তা দেখতে অনেক উৎসুক হয়ে ওঠে। নিউব্রোনার সাধারণ মানুষের এই কৌতূহলকে ব্যবসার একটি উপায় হিসেবে লুফে নেন। তিনি ইতোমধ্যে ইউরোপের নানা আলোকচিত্র প্রদর্শনী কেন্দ্রে তার কবুতরের তোলা ছবিগুলো প্রদর্শন করেন।
ছবিগুলো একেবারে নির্ভুল ছিল না। কবুতরের ডানার কারণে ছবির অনেকাংশে ঢেকে যেত। কিন্তু এই ছবিগুলো যে কবুতর দিয়ে তোলা এবং এটিই যে আক্ষরিক অর্থে বার্ডস আই ভিউ – এর উদাহরণ সেই ব্যাপারটিই মানুষকে বেশি মুগ্ধ করে। নিউব্রোনার তার তোলা ছবিগুলো পোস্টকার্ড হিসেবে মানুষের কাছে বিক্রি করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তার এই উদ্ভাবন যুদ্ধক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার কবুতরের ব্যবহার
প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকেই চিঠির আদান-প্রদানে কবুতর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যুদ্ধের ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ রসদ সরবরাহ, ময়দানের পরিস্থিতি বর্ণনা ইত্যাদি কাজে কবুতর দিয়ে খবর পাঠানো হতো। কবুতরের সাথে ক্যামেরা যুক্ত হওয়ার পর তা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ সময় ক্যামেরা বহনকারী কবুতরদের গুপ্তচর হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কবুতরের ঝাঁক প্রতিপক্ষের ঘাঁটির গুরুত্বপূর্ণ ছবি তুলে নিয়ে আসতো। উড়ন্ত এই কবুতরের দল মাটি থেকে ১৫০ থেকে ৩০০ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যেতো। তাই এদের সহজে শনাক্ত করা এবং গুলি করা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই কবুতরগুলো ছিল বর্তমান আধুনিক ড্রোনের জীবন্ত সংস্করণ।
যুদ্ধে এদের ব্যবহার বেশিদিন টেকেনি
জুলিয়াস নিউব্রোনারের এই উদ্ভাবন খুব বেশিদিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে টেকেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ফটোগ্রাফার কবুতরের ব্যবহার কমে আসতে থাকে। এর মূল কারণ হলো মানুষ ইতিমধ্যেই আকাশ জয় করে ফেলেছিল। ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উড়োজাহাজ প্রথম সফলভাবে আকাশে উড়তে সক্ষম হন। এরপর থেকে ব্যবহারের সুবিধার্থে নিয়মিত উড়োজাহাজ হালনাগাদ হতে শুরু করে।
যুদ্ধের জন্য আলাদা নকশার উড়োজাহজ তৈরি শুরু হলো। বড় উড়োজাহাজের মডেল থেকে ছোট ছোট উড়ন্ত মেশিন তৈরি করা হতো। এমনটি দেখে নিউব্রোনারও তার গবেষণা বন্ধ করে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজের আবিষ্কার ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়েছিল, এটি ভেবেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফটোগ্রাফার কবুতরের প্রচলন একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি। স্যাটেলাইট ক্যামেরা, ড্রোন ক্যামেরা ইত্যাদি আসা সত্ত্বেও ১৯৩০ সালে জার্মান এবং ফরাসি সেনাবাহিনী এদের ব্যবহার বহাল রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এদের বেশ কয়েকবার কাজে লাগানো হয়। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) গুপ্তচর হিসেবে এই কবুতরদের কাজে লাগায়।
সিআইএ কবুতরের সাথে দুই লেন্স বিশিষ্ট ব্যাটারিচালিত এক বিশেষ ক্যামেরা ব্যবহার করেছিল। মেশিন দিয়ে তৈরি ড্রোনের তুলনায় এই জীবন্ত ড্রোনগুলো সহজে মানুষের চোখে ধোঁকা দিতে পারতো। ছবি তোলা ছাড়াও অন্যান্য নানা কাজে কবুতর ছিল যুদ্ধের এক অপরিহার্য অংশ। তাই এখন বিভিন্ন গোপন গবেষণাগার কিংবা যুদ্ধের বেইজ ক্যাম্পে কোনো প্রকার পাখি ত্রিসীমানায় আসলেই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
শেষ কথা
কবুতর পোষা একসময় একটি ব্যাপক প্রচলিত শখ ছিল। আগে প্রায়ই নানা বসতবাড়িতে কবুতরের খোপ পাওয়া যেত। এসবের সংখ্যা এখন তুলনামূলক কম। যদিও এখনো কিছু শৌখিন মানুষদের কারণে গ্রামেগঞ্জে ও শহরের কিছু কিছু এলাকায় এই শখটি টিকে আছে। জিনগতভাবে দিক নির্ণয়ের ক্ষমতাসম্পন্ন পাখিটি একসময় মানুষের অনেক কাজে আসতো। আধুনিক যন্ত্রপাতি আসার পর এদের আর আগের মতো বিচরণ করতে দেখা যায় না।