Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিতর্কিত ৭ রানী: যারা পাল্টে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিপথ

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, পাতার পর পাতা জুড়ে কেবলমাত্র পুরুষদেরই কাহিনী। হোক সেটা বীরত্ব, কাপুরুষতা, বুদ্ধিদীপ্ততা কিংবা অন্য কিছু- পুরুষদের জয়জয়কার সব জায়গাতেই। অধিকাংশ জায়গায় নারীর ভূমিকা চিরাচরিত মা-বোন-স্ত্রীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবু কিছু কিছু নারী তাদের সেই কোমল রুপ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, চেয়েছিলেন আশেপাশের সমাজটাকে বদলে দিতে।

ইতিহাসের এমনই সাতজন রানীকে নিয়ে লেখা হয়েছে আজ; যাদের নানা কাজকর্ম, হোক সেটা মহান কিংবা কলঙ্কিত কিংবা নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ, পাল্টে দিয়েছিলো ইতিহাসের চলার পথকেই।

১) রানী ফ্রেডিগুণ্ড: মেরোভিঞ্জিয়ান ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্য

পঞ্চম শতকে মেরোভিঞ্জিয়ান রাজবংশে পরিবর্তনের জোর হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন রানী ফ্রেডিগুণ্ড। তবে এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, নামের শেষাংশের মতো রানীর স্বভাবও ছিলো বেশ ‘গুণ্ডা’ টাইপের!

রাজা চিলপারিকের সাথে বিয়ের পর থেকেই আস্তে আস্তে নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ়করণে মন দেন ফ্রেডিগুণ্ড। রানী গ্যালাসিন্থাকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। আবার রানী অডোভেরাকেও তিনিই মঠে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। একসময় গ্যালাসিন্থার বোন ব্রুনহাইল্ড আপন বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে ওঠেন। কালক্রমে ব্রুনহাইল্ড ও ফ্রেডিগুণ্ডের মাঝে মারাত্মক শত্রুতা তৈরি হয়। ব্রুনহাইল্ডকে শায়েস্তা করতে তার স্বামী ও অন্যান্য বোনদেরও হত্যা করান রানী। এর পাশাপাশি ফ্রেডিগুণ্ড রাজা চিলপারিকের অন্যান্য স্ত্রীদের সন্তানদেরও হত্যার ব্যবস্থা করেন, যেন রাজবংশে কেবলমাত্র তার রক্তের অস্তিত্বই টিকে থাকে!

Source: History Witch

রাজা চিলপারিক ৫৮৭ সালে যখন মারা যান, তখন তার ও ফ্রেডিগুণ্ডের ভালোবাসার ফসল হিসেবে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ক্লোটার একেবারেই শিশু। ফলে রাজপ্রতিভূ হিসেবে রাজ্যের শাসনভার পরিচালনার ভার বর্তায় তার উপরেই। যুদ্ধজয় ও বিদ্রোহীদের দমনের মাধ্যমে তার শাসনামলে মেরোভিঞ্জিয়ান রাজ্য ঠিকভাবে পরিচালনা করেন তিনি।

৫৯৭ সালে মারা যান ফ্রেডিগুণ্ড। তার ছেলে ক্লোটার তখন মায়ের হত্যাযজ্ঞের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়, হত্যা করে ব্রুনহাইল্ড ও তার বংশধরদের। আর এতসব রক্তপাতের মধ্য দিয়েই সেই এলাকায় প্রায় দু’দশকের মতো নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়।

২) ইসাবেলা অভ ফ্রান্স: ইংল্যান্ডের রানী

রানী ইসাবেলার স্বামী রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড ছিলেন একজন সমকামী। ফলে স্ত্রী হিসেবে নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু ইসাবেলা ঠিকমতো তো পেতেনই না, উল্টো রাজার সঙ্গীরা তাকে অপমানও করতো। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই ফুঁসছিলেন ইসাবেলা। এমন পরিস্থিতি পার করতে থাকাকালেই জন্ম নেয় ইসাবেলার সন্তানেরা, যাদের মাঝে ছিলো ভবিষ্যৎ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডও।

স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত হতে হতে একসময় পরকীয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন ইসাবেলা, সম্পর্ক গড়ে তোলেন নির্বাসিত ব্রিটিশ দেশদ্রোহী লর্ড রজার মরটাইমারের সাথে, ১৩২৫ সালে। আস্তে আস্তে ক্ষোভের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে তিনি আক্রমণ করে বসেন ইংল্যান্ডে, সিংহাসনচ্যুত করেন তার স্বামীকে। এরপর নিজেই রাজপ্রতিভূ হয়ে ছেলে তৃতীয় এডওয়ার্ডের পক্ষে রাজ্য চালাতে থাকেন। এমনকি নিজের স্বামীকে নৃশংসভাবে খুনও করান তিনি।

Spurce: ThoughtCo

অবশ্য ইসাবেলার এ শাসনকাল মাত্র চার বছরের মতো স্থায়ী হয়েছিলো। এডওয়ার্ড সাবালক হয়ে উঠলে সে তার মাকে সিংহাসনচ্যুত করে। এভাবেই শেষ হয় ফ্রান্সের বিখ্যাত এই নারীর রানী-অধ্যায়ের। অবশ্য তার প্রচেষ্টাকে একেবারে বৃথা বলা যাবে না। কারণ এরপর টানা পঞ্চাশ বছর ধরে ইংল্যান্ড শাসন করেছিলেন রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড।

৩) সম্রাজ্ঞী থিওডোরা: বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য

সম্রাজ্ঞী থিওডোরার উত্থানের গল্পটাকে বেশ অশ্লীলই বলা যায়। বেশ ছোটবেলা থেকেই তার মঞ্চ নাটকের অভ্যাস ছিলো। সেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছিলেন গ্রীক মিথোলজির লেডা এন্ড দ্য সোয়ান গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত নাটকে মাত্রাছাড়া অশ্লীলতা প্রদর্শনের কারণে। মঞ্চে শরীরে কাপড় একেবারে যতটুকু না রাখলেই না, তত কম পর্যন্ত রেখে তিনি বিভিন্ন দৃশ্যে অভিনয় করতেন সময়ে সময়ে। সে যা-ই হোক, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী প্রথম জাস্টিনিয়ানের সাথে বিয়ের পরই পাল্টে যায় থিওডোরার ভাগ্য।

Source: Lebrecht/Corbis

আস্তে আস্তে জাস্টিনিয়ানের ক্ষমতার এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে ওঠেন থিওডোরা। এমনকি রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের শপথে রানীর নামও নিতে হতো। আবার যারা তার বিরুদ্ধাচরণ করতো, তাদের শাস্তি প্রদানের উপযুক্ত ব্যবস্থাও তিনি করতেন। পাশাপাশি পতিতাদের জন্য গৃহ নির্মাণ, নারীদের বিয়ে ও যৌতুক বিষয়ক বিভিন্ন অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং রাজ্য থেকে পতিতালয় পরিচালকদের তাড়ানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করেন তিনি। আজকের ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চে তাকে একজন সেইন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৪) জুলিয়া এগ্রিপ্পিনা: রোম

জুলিও-ক্লডিয়ান সাম্রাজ্যের এই রানীর ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে তা সুসংহতকরণের কূটচাল দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তিনি কেবল একজন রাজার স্ত্রী কিংবা হবু রাজার মা হয়ে থাকতে চান নি, বরঞ্চ তিনিই চেয়েছিলেন ক্ষমতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে।

তৎকালীন সম্রাট ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনা পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন এবং একসময় তা প্রকাশও পেয়ে যায়। রাজা এমন স্ত্রীকে আর ঘরে রাখতে চান নি। এ পরিস্থিতিকে রানীর আসন পাকাপোক্ত করার উপযুক্ত সময় হিসেবে দেখেন এগ্রিপ্পিনা। নিজের আঙ্কেল ক্লডিয়াসকে শারীরিক সম্পর্কে প্রলুব্ধকরণের মাধ্যমে তার চতুর্থ স্ত্রী হবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এগ্রিপ্পিনা।

Source: Comic Vine

রানী হবার পর এবার তিনি জোর দেন ক্ষমতা সুসংহতকরণের দিকে। তার আগের ঘরের ছেলে নিরোকে তিনি রাজার উত্তরাধিকার বানান। সেই সাথে ক্লডিয়াস ও মেসালিনার মেয়ে অক্টাভিয়ার সাথে নিরোর বিয়ের ব্যবস্থাও তিনি করেন। ‘অগাস্টা’ নামধারণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন এগ্রিপ্পিনা।

একসময় বিষ মেশানো খাবার খেয়ে মারা যান সম্রাট ক্লডিয়াস, যার পেছনে এগ্রিপ্পিনার হাত আছে বলেই ধারণা করে অনেকে। এরপর রোমের সিংহাসনে বসেন নিরো, পাল্টে দেন রোমান সাম্রাজ্যের অনেক ইতিহাসই, যার কিনা এ সিংহাসনে আসার কথাই ছিলো না। রানীমা হয়ে এগ্রিপ্পিনার সারাক্ষণ শাসন একসময় অসহ্য ঠেকতে শুরু করে নিরোর কাছে। তাই একসময় আপন মাকেই খুন করায় নিরো!

এভাবেই অবসান ঘটে এগ্রিপ্পিনার ঘটনাবহুল জীবনের। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় তার ক্ষমতা ছিলো সত্যিই চমকে দেয়ার মতো। জুলিও-ক্লডিয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন বলে মনে করা হয় তাকে।

৫) নান্দি: জুলু সাম্রাজ্য

রানী নান্দির কাহিনীও কম রোমাঞ্চকর না। অন্যায়-অবিচার মুখ বুজে সহ্য না করে কীভাবে সময়মতো তার জবাব দেয়া যায়, এর চমৎকার এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তিনি। লাঙ্গেনী গোত্রের সদস্য নান্দি ও জুলু নেতা সেনজাংআখোনার সম্পর্কে ফল হিসেবে একসময় নান্দি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এরপরই গোত্রপতিরা তার নামে নানা অপবাদ দেয়া শুরু করে। একসময় জন্ম নেয় তার সন্তান শাকা। সন্তান জন্মের পর তিনি জুলু নেতার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান, তবে সেটাও তার জন্য তেমন কোনো মর্যাদা বয়ে আনতে পারে নি। বরঞ্চ সকলের বিদ্রুপ ও উপহাসের পাত্রী হতে থাকেন প্রতিনিয়ত।

আশেপাশের এত খোঁটা সত্ত্বেও দমে যান নি নান্দি, ছেলে শাকা যাতে ভবিষ্যতে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হয়ে গড়ে ওঠে, তার সব ব্যবস্থাই তিনি করেছিলেন। ১৮১৫ সালে অবশেষে শাকাই হয়ে ওঠে জুলুদের রাজা। এরপরই ভোজবাজির মতো সমাজে নান্দির মর্যাদা পাল্টে গেলো; তিনি হয়ে গেলেন রানীমা, সবাই তাকে ডাকতে লাগলো সম্মানসূচক ‘এন্দলরুকাজী (মহান হস্তিনী)’ নামে!

ক্ষমতায় গিয়ে এতদিন ধরে যারা তাকে ও শাকাকে এত কথা শুনিয়ে এসেছে, তাদের সবাইকে আচ্ছামতো শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করলেন নান্দি। চিরকুমার ছিলেন শাকা। তাই রানীমা হিসেবে ছেলের সাথে সাথে ক্ষমতার স্বাদ ঠিকমতোই ভোগ করেছিলেন তিনি।

৬) রানী দিদ্দা: কাশ্মীর

ক্ষমা ও নিষ্ঠুরতার সংমিশ্রণে তৈরি এক হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন কাশ্মীরের রানী দিদ্দা। তার শাসনকাল ছিলো দশম শতকে। স্বামী রাজা কসেমাগুপ্তের শাসনামলেই তিনি প্রশাসনিক ক্ষমতা বলতে গেলে নিজের কব্জায় নিয়ে আসেন। কিন্তু শুধু উপদেষ্টা হয়ে তার মন ভরছিলো না। তাই মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে তিনি খুন করান তার তিন নাতিকে। এরপর পুরো তেইশটি বছর ধরে তিনি সম্রাজ্ঞী হিসেবে সাম্রাজ্যের শাসনভার পরিচালনা করে যান। তৎকালের বিভিন্ন মুদ্রায় কসেমাগুপ্তের সাথে তার নাম খোঁদাই থাকার বিষয়টি তার ক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

Source: vcoins.com

উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারিণী হলেও নিজের রক্তের টিকে থাকার বিষয়টি তিনি ঠিকই নিশ্চিত করেছিলেন। ফলে কাশ্মীরের জনগণ আজও তাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা শাসক হিসেবে মনে রেখেছে।

৭) রানী নেফারতিতি

মিশরের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রানী নেফারতিতি। তিনি এবং তার স্বামী ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপ রাজ্যের ধর্মীয় কাঠামো পরিবর্তন করে মিশরের সংস্কৃতিকেই যেন অনেকটা বদলে দিয়েছিলেন।

Source: Pinterest

মিশরীয়রা বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু নেফারতিতি ও তার স্বামী ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে আমেন সহ সকল দেবদেবীর উপাসনা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র সৌরদেবতা আতেনের পূজা করতে হবে। অর্থাৎ বহুঈশ্বরে বিশ্বাসী একটি সমাজে তারা একেশ্বরবাদ চালু করেছিলেন। নিজেদের নাম পাল্টে তারা রেখেছিলেন আখেনাতেন এবং নেফারনেফারুয়াতেন। এছাড়া আতেনের সম্মানার্থে তারা একটি শহরও নির্মাণ করেছিলেন। মিশরের মানুষ নেফারতিতিকে যতটা না রানী হিসেবে দেখতো, তার চেয়েও বেশি দেখতো একজন দেবী হিসেবে। নিজের ফারাও স্বামীর মতোই ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি।

অবশ্য তাদের মৃত্যুর পর মিশরের জনগণ আবার তাদের আগের ধর্মীয় বিশ্বাসেই ফিরে যায়। তবুও মিশরের ধর্মীয় ব্যবস্থায় সংস্কার আনয়নের জন্য প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব হয়েই টিকে থাকবেন রানী নেফারতিতি।

ফিচার ইমেজ- ThoughtCo

Related Articles