কফি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবসায়িক পণ্য বলে পরিগণিত। পেট্রোলিয়ামের পরেই এর অবস্থান। আর আধুনিক ডায়েটের মূলভিত্তিতেও আছে কালো বা বাদামী রঙের এই পানীয়টি। বিশ্বাস করা হয়, কফির উৎপত্তি হয়েছে ইথিওপিয়ায়। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মতও প্রচলিত আছে; আবার এটাও প্রচলিত আছে যে, সত্যিকার অর্থে কফি উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস কেউই হয়তো জানে না। মধ্যপ্রাচ্যে ষোড়শ শতাব্দীতে লোকজনকে সাহায্য দানের জন্যে একত্রিত করার কাজে কফি ব্যবহার করা হতো।
কিন্তু আপনি জানেন কি, এই সাধারণ পানীয়টি সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিল! এই সামাজিক বিপ্লব ছড়ানো পানীয়কেই প্রাচীনকালে ‘শয়তানের পানীয়’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। আবার, আধ্যাত্মিক নেশা থেকে শুরু করে যৌন উত্তেজক বড়ি হিসেবে ইতিহাসে কফির ব্যাপক প্রচলন ছিল।
কফির ইতিহাস নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি বইটি লিখেছেন পল ক্রিস্টাল। বইটির নাম “কফি: অ্যা ড্রিঙ্ক ফর দ্য ডেভিল”। পলের বইয়ের বিবৃতি মোতাবেক কফির ইতিহাস ঘিরে থাকা ৮টি চমকপ্রদ তথ্য নিয়েই আজকের আয়োজন।
১. ইথিওপিয়ান আর ইয়েমেনীয় মিথ
ইথিওপিয়ান মিথ
সংস্কৃতিগত দিক থেকে, ইথিওপিয়ান এবং ইয়েমেনীয় ইতিহাসে কফি একটি প্রধান আর বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। এই সাংস্কৃতিক তাৎপর্যটি চতুর্দশ শতাব্দীরও আগে থেকে, যখন ইয়েমেনে কফি আবিষ্কারও হয়নি। ইথিওপিয়া নাকি ইয়েমেন? কোথায় সর্বপ্রথম কফি উৎপন্ন বা ব্যবহৃত হয়েছিল তা আদতে বিতর্কের বিষয়। কেননা, প্রতিটা দেশেরই তাদের পানীয়ের উৎস সম্পর্কে নিজস্ব পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি এবং এমনকি প্রচলিত সত্যকথাও আছে। ইথিওপিয়ায় কফির সর্বাধিক জনপ্রিয় আর প্রচলিত কিংবদন্তি অনেকটা এরকম –
অনেককাল আগে একদিন, আবিসিনিয়ার মঠের নিকটবর্তী এক পার্বত্যাঞ্চলে কাফফা শহরের ক্যালডি নামক এক পশুপালক তার ছাগলগুলোকে চরাচ্ছিল। আচমকাই ছাগলগুলো লাফাতে শুরু করে, অনেকটা নাচসদৃশ, আর জোরে জোরে ম্যা ম্যা শব্দে ডাকতে থাকে। ক্যালডির কাছে এই ব্যাপারটা অদ্ভুত আর বেখাপ্পা লাগে।
ক্যালডি বেশ মনোযোগের সহিত দেখতে পেল, একটা ছোট্ট গুল্মের ঝোপঝাড় ( বা অনেক কিংবদন্তি অনুসারে ঝোপঝাড়ের কয়েকটি গুচ্ছ) হচ্ছে এই অদ্ভুত উত্তেজনার উৎস। অনেক ভাবনার পর, উজ্জ্বল সেই ছোট ছোট ফলগুলোর স্বাদ নিজেকে নিতে রাজি করায় ক্যালডি। আর ঠিক একইরকমের উত্তেজনা আর চাঙ্গা ভাবটা তার নিজেরও অনুভূত হয়।
নিজের আবিষ্কারে নিজেই মুগ্ধ হয়ে ক্যালডি তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছুটে আসে স্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানাতে। ক্যালডির সহধর্মিনী এই আবিষ্কারকে “স্বর্গ প্রেরিত” আখ্যা দেয়। আর তাকে মঠের সন্ন্যাসীদের কাছে বিষয়টি খোলাসা করতে পাঠায়। কিন্তু, স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া সেই উচ্ছ্বাসটা এক নিমেষেই ধূলিস্মাৎ হয় মঠের সন্ন্যাসীর কাছে এসে।
কেননা, মঠের একজন সন্ন্যাসী সেই লাল রঙের ফলগুলোকে “শয়তানের কর্মকান্ড” বলে আখ্যায়িত করে। এবং তৎক্ষণাৎ আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সেই অদ্ভুত বীজগুলোকে। সেই ছোট্ট লাল ফলগুলো ঝলসে যায় আগুনের তাপে। তবে ফলগুলো থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ায় অদ্ভুত এক সুগন্ধি চারদিকে ছড়াতে থাকে, যা সেই সন্ন্যাসীর নজর কাড়ে। দ্রুতই সন্ন্যাসীর আদেশে সেই ফলগুলোকে জ্বলন্ত আগুন থেকে উঠিয়ে আনা হয় এবং সেগুলোকে গরম জলের একটা কলসিতে সংরক্ষণ করা হয়।
এই নতুন পানীয়ের সুবাস মঠের সকল সন্ন্যাসীকেই আকৃষ্ট করে। সবাই মিলে এই নতুন ফলের থেকে উদ্ভূত পানীয়ের স্বাদ গ্রহন করে। আর সবাই-ই নিজেদের উচ্ছ্বসিত অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারে। পরবর্তীতে সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত মতে, সারারাত জেগে প্রার্থনা করার জন্য তারা প্রতিনিয়ত এই পানীয় পান করা শুরু করে।
তবে উক্ত কিংবদন্তি, ১৬৭১ সালের আগ অবধি কোথাও লেখা হয়নি। আর ক্যালডির যে সময়কালের গল্প বলা হয়, সেটাকে ধরা হয় ৮৫০ সালের দিককার কথা। তাই ইতিহাসবিদরা এটাই বিশ্বাস করে যে, নবম শতাব্দী থেকেই ইথিওপিয়াতে কফির চাষাবাদ শুরু হয়। এছাড়াও অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, কফির বীজের সাথে ঘি (মাখন) বা পশুর চর্বি মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে ছোট ছোট বল বানান হতো। দীর্ঘ আর দুঃসাধ্য ভ্রমণের জন্য বেশ দরকারি আর কার্যকরী ছিল এগুলো।
ইয়েমেনীয় মিথ:
ইথিওপিয়ার মতোই ইয়েমেনেরও একটি (মতান্তরে দুটি) প্রচলিত মিথ আছে যা কফির ইতিহাসকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ইথিওপিয়ার ক্যালডি মিথের চাইতে ইয়েমেনীয় মিথ অনেক বেশি মৌলিক। ইয়েমেনীয় কিংবদন্তিটা অনেকটাই এরকম –
একবার আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে ইথিওপিয়া ভ্রমণে যান ইয়েমেনের আধ্যাত্মিক সুফি ঘোথুল আকবর নুরুউদ্দিন আবু-হাসান আল-শাধিলি। যাত্রাপথে তিনি কিছু পাখিকে গুল্মের ঝাড় থেকে একধরনের ফল/বীজ খেতে দেখেন। এবং ফলগুলো খাওয়ামাত্রই পাখিদের মধ্যে একধরনের চাঙ্গা আর উদ্যমী ভাব দেখেন তিনি।
তাই, গুটিকতক ফল/বীজ তিনি নিজের জন্য নিয়ে নেন। যাত্রাবিরতিতে বা যাত্রাশেষে তিনি ফল/বীজগুলোর স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, নিমেষেই তার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।
২. মকা সৃষ্টির পেছনে আছে একজন সাধুসন্তেরও নাম
উৎকৃষ্ট মানের এক জাতের কফিকে মকা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও, বর্তমানে চকলেটের স্বাদযুক্ত কফি পানীয়গুলোর মধ্যে মকা ল্যাটে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু এই মকা নামটি এসেছে ইয়েমেনের লোহিত সাগরের উপকূলঘেষা শহর মকা থেকে।
ইয়েমেনের আধ্যাত্মিক সুফির চাইতে এই সাধুসন্তের মিথটিকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। আর এই মিথের বলেই বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ বা লোকজনই এটাই দাবী করে যে, ইথিওপিয়ার ক্যালডি নয়, বরং ইয়েমেনের এই মিথের মাধ্যমেই কফি সৃষ্টির ঘটনাটা ঘটেছিল। মিথটা অনেকটা এরকম –
কাহিনীটা আসলে শেখ ওমরকে কেন্দ্র করে। ইয়েমেনের একজন বিখ্যাত ডাক্তার এবং পুরোহিত ছিলেন তিনি। কথিত আছে, ইবাদতের মাধ্যমে ইশ্বরের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করে তিনি চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহন করতেন। এছাড়া, তিনি ইয়েমেনের মকা শহরের শেখ আবুল’আল হাসান শাধেলির অনুসারী ছিলেন। তাকে ওসাব পাহাড়ের নিকটে এক পরিত্যক্ত গুহায় নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।
এক বর্ণনায় জানা গেছে, তার নির্বাসনের কারণ ছিল নৈতিক সীমালঙ্ঘনের জন্য। আবার অন্য এক বর্ণনায় জানা গেছে, তিনি রাজার (যিনি তখন শয্যাশায়ী ছিলেন) পরিবর্তে রাজকন্যার উপর ওষুধের অনুশীলন করেছিলেন। তাকে সুস্থ করার পর, নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেজন্য রাজা তাকে শাস্তি হিসেবে নির্বাসনে পাঠান।
নির্বাসিত জীবনযাপনে কয়েকদিন পার করার পর, অনাহারে ক্লান্ত হয়ে এক গুল্মের ঝাড়ে লাল রঙের ফল আবিষ্কার করে শেখ ওমর। ক্ষুধার জ্বালার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েই ফলগুলো তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে। যদিও অন্য আরেক বর্ণনা বলা হয়েছে, তিনি অনাহারে ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে হতাশায় চিৎকার করে কাঁদছিলেন; তখন শাধেলির নির্দেশে একটি পাখি কফি গাছের একটা ডাল এনে তার কাছে ফেলে যায়।
সেগুলো কাঁচা খেতে বেশ তেঁতো স্বাদের লেগেছিল ওমরের। তেঁতো ভাবটাকে তাড়াতে ফলগুলোকে সে আগুনের মধ্যে ছেড়ে দেয়। তবে তার এই প্রাথমিক “ঝলসানো” পদ্ধতিটি আসলে ফলগুলোকে আরো বেশি শক্ত করে তোলে এবং চিবোনোর অনুপযুক্তও করে তোলে। তাই ওমর সেগুলোকে নরম করার চেষ্টা করে।
ফলগুলোকে সেদ্ধ দেয়া হলে সেখান থেকে অদ্ভুত সুন্দর এক সুবাস ভেসে আসে আর সেদ্ধ ফুটন্ত সেই পানি বাদামী রঙ ধারণ করে। তাই ওমর সিদ্ধান্ত নেয় চাবানোর বদলে পানীয়টা পান করার। তিনি পানীয়টি খেয়ে উপলব্ধি করেন, এটি তাকে চাঙ্গা করে তুলেছে। আবার অন্য এক বিবরণে পাওয়া গেছে, ওমর চিবোনোর অযোগ্য বলে সেই ফলের স্যুপ খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ফলগুলোকে সরিয়ে স্যুপটা খেতে আসলে আজকের দিনের কফির মতোই লেগেছিল।
ওমরের এই বলবর্ধক পানীয়টির কথা খুব দ্রুতই তার শহর মকা অবধি পৌঁছে যায়। তাই তাকে নির্বাসন থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং তার আবিষ্কৃত ফলগুলোকে নিয়ে শহরে ফিরে আসার আদেশ দেয়া হয়। তিনি মকায় ফিরে আসেন কফি বিন নিয়ে এবং কফির সেই পানীয়টি সবার সাথে ভাগ করে নেন।
অনেকে আবার একে অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের উপায় বলেও ভেবে নিয়েছিল। খুব বেশি একটা সময় লাগেনি কফিকে একটি অলৌকিক ওষুধ হিসেবে এবং শেখ ওমরকে সাধুসন্ত রূপে প্রশংসিত করতে। এমনকি ওমরের সম্মানে মকা শহরে একটা মঠও নির্মাণ করা হয়েছিল।
অন্তত এমনটাই ছিল ইয়েমেনের মিথ। এরপর দ্রুততার সাথে এই অবিশ্বাস্য পানীয়ের নাম আরব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তখনকার সময়ে আরবের দাসদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হতো। আরবের দাসদের অতিরিক্ত কর্মঠ করে তুলতে কফি পান করানো হতো। এভাবেই ব্যাপারটি বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করে।
৩. কফি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছিল
আরবরাই সর্বপ্রথম কফি চাষ করেছিল ব্যবসায়ের জন্যে, এবং ইয়েমেন বা ইথিওপিয়া যেটাই হোক না কেন, সেখান থেকে তা ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে কফি রেস্তোরাঁর কথা জানা যায় চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতকের দিকে, তা-ও ইস্তানবুলের নিকটবর্তী শহরসমূহে। সে সময়গুলোতে কফি ‘কাবেহ খানাহ’ বা ‘কিভা হান’ নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল।
আর অনতিবিলম্বে শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকা এই রেস্তোরাঁগুলো ধীরে ধীরে মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কেননা, সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে লোকেরা এই রেস্তোরাঁগুলো ব্যবহার করতো। সক্রিয় কথোকপথনে যোগ দিত সবাই। গল্পগুজবে উঠে আসতো রাজনীতি বা অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো; গুজব বা তথ্য কিংবা এমনকি সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলাও খেলে থাকতো তারা।
কফি রেস্তোরাঁগুলো এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, সেগুলোকে “স্কুলস অফ দ্য ওয়াইজ” বা “জ্ঞানী/বিজ্ঞদের পাঠশালা” বলে আখ্যায়িত করা হতো। এই মিথস্ক্রিয়া এবং তথ্য আদান-প্রদানের ব্যাপারটা এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, শোনা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মক্কায় সব ধরনের কফি রেস্তোরাঁ এবং মুসলমানদের জন্য কফি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
তবে শত বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও কফি রেস্তোরাঁগুলো আবারো চালু হয়েছিল এবং তা ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যায়। সেই সময়গুলোতে অবশ্য আরবরা “আরব-দেশীয় শরাব” তৈরি করে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টাও করেছিল।
ইউরোপ থেকে ভ্রমণকারী এবং ব্যবসায়ী যারা প্রাচ্যের কাছাকাছি গিয়েছিল, তারা তাদের সাথে করে “কাবেহ খানাহ” এবং আরব দেশের কালো রঙের গরম শরাবের গল্প সাথে করে নিয়ে ফিরতো। এভাবেই কফি ইউরোপে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে।
আরবী নাম কাহুয়া রূপান্তরিত হয়ে কাওয়ে হয়, যার অর্থ শক্তি। এবং যুগের বিবর্তনে কাওয়ে কফিতে পরিণত হয়। আর ১৬৫০ এর দশকে কফি রেস্তোরাঁর সংস্কৃতি ইউরোপে প্রবেশ করে অক্সফোর্ডে প্রথম কফি হাউজ খোলার মধ্য দিয়ে। জনশ্রুতি আছে যে, অক্সফোর্ডের যে স্থানে তখন কফি হাউজ খোলা হয়েছিল সেখানে এখন ‘দ্য গ্র্যান্ড কফি’ নামে একটি কফি হাউজ আছে। এমনকি, ১৬৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অক্সফোর্ডের কুইন’স লেন ক্যাফেটি এখনও অক্ষত আছে।
৪. কফি পান করা আর পাপ করা – দুটোকেই সমতুল্য গণ্য করা হতো
অ্যালকোহলের মতোই কফিরও নিষেঘাজ্ঞার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ধর্মীয় উদ্বেগ, পাপের আশঙ্কা এবং আরো নানা ধরনের বাঁধা বিপত্তির ইতিহাস। যদি ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা নিজেদের গোঁড়ামি ধরে রাখতে সক্ষম হতো তাহলে আজকের দিনে এত কফি রেস্তোরাঁর দেখা মিলতো না।
১৫১১ সালের দিকে আইনজ্ঞ এবং পণ্ডিতগণ মিলে এক বৈঠকের মাধ্যমে কফি পান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই বিরোধিতার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং মক্কার গর্ভনর খায়ের বেগ। কেননা, তার মনে হয়েছিল, কফি হয়তো লোকেদের একত্রিত করবে, তার শাসনের বিরোধিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে এবং এমনকি তার শাসনের ব্যর্থতা নিয়েও বেশ কথা উঠবে।
এভাবেই গণবিক্ষোভ আর গণবিপ্লবের হাতিয়ার রূপে জন্ম হয়েছিল কফির। তাই, একে পাপ (হারাম) বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ১৫২৪ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্কি সুলতান প্রথম সেলিমের আদেশে প্রধান মুফতি মেহমেত ইবাসসুদ এল-ইবাদী একটি ফতোয়া জারি করে কফি পান করার অনুমতি দেয়ার আগ অবধি দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে এই বিতর্ক প্রচলিত ছিল যে কফি আসলে মাদকদ্রব্য কি না।
এমনকি গর্ভনর বেগের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল প্রথম সেলিমের আদেশেই। অবশ্য পরবর্তীতে তিনিই একে পবিত্র পানীয় বলে ঘোষণা করেছিলেন। ১৫৩২ সালে কায়রোতেও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল কফির ব্যাপারে। কায়রোতে অবশ্য কফি হাউজ এবং কফির গুদামঘরগুলো জব্দ করা হয়েছিল।
৫. ‘শয়তানের পেয়ালা’ খ্যাত কফি
ষোড়শ শতাব্দীর দিকে অটোমান সাম্রাজ্যে কফি অত্যধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেটা এতটাই ছিল যে, সুলতান চতুর্থ মুরাদ একে অবৈধ ঘোষণা এবং এই পানীয় পান করা অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার শিরচ্ছেদের নির্দেশ দিতেও বাধ্য হয়েছিলেন। তবে শিরচ্ছেদের ভয়ও কফি পানকারীকে তার অভ্যাস থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
আরব বিশ্ব থেকে ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ভেনিস দিয়ে ইউরোপে যাত্রা শুরু করেছিল কফি। ভেনিস এবং রোমের রাস্তায় রাস্তায় কফির প্রচলন বাড়ে এবং এর জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। ঠিক তখনই একদল লোক গিয়ে ক্যাথলিক পোপের কানে এর সাথে মুসলমানদের সংযুক্ততা এবং এর প্রতি আসক্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার পরামর্শ দেন। এমনকি সেই পরামর্শদাতারা কফিকে “শয়তানের নির্মম আবিষ্কার” বলেও অভিহিত করেছিলেন।
পোপ পরামর্শদাতাদের কথা শুনেই এবং ঝোঁকের বশে বিচার করতে চাননি, অন্তত নিজে সেটা সম্পর্কে ভালোমন্দ না জেনে। তাই তারই নির্দেশে এই বিভ্রান্তিকর পানীয় নিয়ে আসা হয় এবং তাকে একটি পাত্রে দেয়া হয় পান করার জন্য, তা-ও জনসম্মুখে। পান করা শেষে তার বক্তব্য ছিল,
“শয়তানের এই পানীয়টি এতটাই সুস্বাদু যে কাফের বা নাস্তিক লোকদের একে একচেটিয়া ব্যবহার করতে দেয়া অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে। এবং এই সুস্বাদু পানীয়টিকে নিজেরা নিজেদের ব্যবহার উপযোগী করে তুলে শয়তানকে ঠকানো উচিত হবে আমাদের।”
পরবর্তীতে পোপ অষ্টম ক্লিমেন্ট কফি বিনকে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং সবাইকে পরামর্শ দিয়েছিলে অ্যালকোহল ত্যাগ করে এই পানীয়টিকে গ্রহণ করতে। তার আশীর্বাদে কফি বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। এই গল্পটি সম্ভাব্য কিংবদন্তি হিসেবে বিতর্কিত হয়েই রয়ে গেছে। তবে এটি এখনো পোপেদের নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর একটি হিসেবেই গণ্য হয়।
৬. সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কফি ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে
স্যামুয়েল পেপিসের মতে, ইংল্যান্ডের প্রথম কফি হাউজটি ১৬৫০ সালে অক্সফোর্ডের পূর্ব পর্বতের সেইন্ট পিটারের পার্শ্বস্থ যাজকপল্লীতে একজন ইহুদী ভদ্রলোক নির্মাণ করেছিলেন; যা এখন দ্য গ্র্যান্ড ক্যাফে নামে পরিচিত। আর লন্ডনের প্রথম কফি হাউজ খোলা হয়েছিল ১৬৫২ সালে কর্নহিল গির্জার প্রাঙ্গনে সেইন্ট মাইকেল সড়কে।
প্যাস্কোয়া রোজে নামের এক গ্রীক ভদ্রলোক এটি চালাতেন। পরবর্তীতে তিনি ১৬৭২ সালে প্যারিসেও একটি কফি হাউজ দিয়েছিলেন।
৭. কফি হাউজগুলো ছিল সময়ের প্রথম ইন্টারনেট ব্যবস্থা
পেপিস এবং তার মতো বিদ্বান মানুষদের জন্য সেই সময়গুলোতে কফি হাউসগুলোই ছিল একমাত্র সংবাদপত্র কিংবা ইন্টারনেটের ব্যবস্থা। তার ডায়রিতে তিনি ডাচদের সাথে সংঘর্ষের খবর ছাড়াও ধুমকেতু দেখা যাওয়ার সংবাদ (১৫ ডিসেম্বর ১৬৬৪) এবং প্লেগ রোগের মহামারী হুমকির (২৪ মে ১৬৬৫) কথাও উল্লেখ করেছেন। সেই সময়গুলোতে এক কফি রেস্তোরাঁয় বসেই তারা এসব জানতে পারতেন।
বিশেষ করে তাদের কোনো কিছু অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়তো না। কেননা, লোকেদের কাছে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এমন গল্পগুজব করার চাইতে অনেক বেশি ভালো লাগা কাজ করতো কফির গন্ধে পূর্ণ এক পরিবেশে বসে আড্ডা দিতে। ১৬৭৫ সালের মধ্যে কেবল ইংল্যান্ডেই কফি রেস্তোরাঁর সংখ্যা হাজার তিনেক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় তো আবার অতিথিদের রাতে শোবার ব্যবস্থা এবং প্রাতঃরাশের ব্যবস্থাও করা ছিল।
৮. সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে কফিকে ‘ভায়াগ্রা’ বলে দাবী করা হতো
এখনকার সময়ে কফি সেবনকে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বলেই ধরা হয়। এছাড়াও, কিছুদিন আগের এক গবেষণায়ও জানা গেছে, কফি সেবনে আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাস পায়। কিন্তু কয়েক শতাব্দী আগেও কফি সেবনের সাথে আরো অন্যান্য অনেক কিছু সংযোগ ঘটিয়েছিল তখনকার মানুষজনরা। যেমনটা সপ্তদশ শতাব্দীর কথাই বলা যায়, যখন কফিকে ‘ভায়াগ্রা’ বলে দাবী করা হতো।
দেহব্যবসায়ী না এমন সব নারীদেরকে কফি রেস্তোরাঁ থেকে বের করে দেয়া হতো। ১৬৯৬ সালে ডিফেন্স অফ দ্য ফিমেল সেক্স নামে এক প্রবন্ধে মেরি অ্যাস্টল লিখেছেন,
“কফি হাউজে অভ্যস্ত একজন যার কি না নিজের বাড়ি আছে অথচ তিনি থাকেন কফি হাউজে। তিনি তার দোকানের বইয়ের চেয়ে খবরের কাগজ, সাহিত্য-সাময়িকী এবং ভোটের সাথেই বেশি কথোকপথন করেন। এবং জনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ তাকে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর তিনি সর্বদাই জাতির সেবায় প্রস্তুত অথচ তিনি কোনোভাবেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে প্রস্তুত নন।”
১৬৭৪ সালে নারীরা বিধ্বংসী এক পিটিশন করেছিল কফির বিরুদ্ধে। সেখানে সমস্ত স্ত্রীরা অভিযোগ করেছিল যে, তাদের স্বামীরা নিজেদের বাড়িতে একেবারেই অনুপস্থিত এবং তারা তাদের গৃহকর্মকে একেবারেই অবহেলা করে। তাদের কাছে কফি ছিল একধরনের ভায়াগ্রা যা তাদেরকে উৎসাহ আর উত্তেজনা দিত সব কিছু ভুলে নতুন উদ্যমে জাতির সংকট নিয়ে আলোচনা করতে।
যুগে যুগে প্রচলিত এমন অনেক তথ্যই প্রচার হয়েছে কফিকে ঘিরে। সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো হয়তো বিশ্বাসযোগ্য; আবার অনেকগুলো কেবল কল্পকাহিনীর বিস্তার মাত্র। তবে যত যা-ই ঘটুক না কেন, আজকের দিনে কফি তার নিজের জায়গা অটল রেখেছে শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এসেও। সকালে এক কাপ কফি না পান করলে দিনটাই শুরু হয় না- এমন লোকের অভাব নেই অন্তত আজকের দুনিয়ায়।