আলী আব্দুল্লাহ সালেহ: ইয়েমেনের সাপুড়ে

আরব উপদ্বীপের দরিদ্রতম রাষ্ট্র ইয়েমেন। সেই সুদূর অতীতে, হাজার বছরব্যাপী সেবার সাম্রাজ্যের আমলে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও আধুনিক ইয়েমেনের চিত্রটা ভিন্ন। দরিদ্র, গোত্র সংঘাতে ভরপুর ইয়েমেন আদতে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, যার মূলে আছে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনের চরম শত্রুতা আর ধর্মীয় মৌলবাদ। এর সাথে যোগ করুন খাত নামের এক নেশাজাতীয় গাছের কথা, এর পাতা চিবোয় ওদেশের লোকেরা। দেশের ছেলে-বুড়ো বিকেল হতেই মজে যায় এই সর্বনাশা নেশায়। বর্তমানে ইয়েমেন নিয়ে জটিল ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মেতে আছে ইরান আর সৌদি আরব। আর এই সবকিছুর মূল্য দিয়ে চলেছে ইয়েমেনের জনগণ, যাদের দুর্ভোগ কমার কোনো আশা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

ইয়েমেনের সাপুড়ে; Image Source: Mirror

ইয়েমেনের কপালে আধুনিক আমলে যেসব শাসক পড়েছে, তারা মূলত বিভিন্ন গোত্রের মধ্যেকার শত্রুতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছেন। এমনই একজন ধুরন্ধর শাসক হলেন আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। ১৩ বছর শাসন করেছেন উত্তর ইয়েমেন, এরপরে ২২ বছর শাসন করেছেন সংযুক্ত ইয়েমেন, শেষমেষ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ২০১২ সালে, আরব বসন্তের জোয়ারে। সালেহ পরবর্তীতে জায়েদী গোত্রের হুথি যোদ্ধাদের সাহায্যে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়েছেন। ২০১৭ সালে পক্ষত্যাগ করে সৌদিদের সাথে হাত মেলাবার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে সানায় সালেহপন্থী সৈন্য এবং হুথিদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। মাথায় গুলি খেয়ে এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এ শাসকের মৃত্যু হয়।

সালেহ একবার বলেছিলেন, দেশ শাসন করা অনেকটা সাপের মাথায় পা দিয়ে নাচবার মতো কাজ। তা তিনি নাচছিলেনও বেশ।শিয়া-সুন্নী বিবাদ, গোত্রবিবাদ, সৌদি-ইরান বিবাদ কিংবা মিশর-সৌদি বিবাদ; সালেহ সব পক্ষকেই দক্ষ সাপুড়ের মতো সামলেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সাপুড়েরা সামান্য ভুলচুক করলে পরিণতি যে কী ভয়ানক হয়, সালেহ এর পতন তারই আরেকটি প্রমাণ। দেশি-বিদেশি নানা সাপ সামলে শেষমেষ সবথেকে পরিচিত সাপ, অর্থাৎ নিজের গোত্রের হাতেই তার মৃত্যু হয়।

উত্তর ইয়েমেনের ক্ষমতা দখল

দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলী আব্দুল্লাহ সালেহ সানা কেন্দ্রীক ইয়েমেন সাম্রাজ্যের সেনাদলে যোগ দেন। পড়াশোনা বিশেষ করেননি। ইয়েমেন সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল শিয়াপন্থী জায়েদী গোত্র, সালেহ নিজেও এদের একজন। ১৯৪৭ সালে জন্ম সালেহর, কয়েক বছরের মধ্যেই সেনাদলে উল্লেখযোগ্য পদে চলে আসেন। ১৯৬২ সালে এই উত্তর ইয়েমেনের সেনাবাহিনীর অফিসারেরা রাজশাসনের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে, তাদের সাথে ছিল মিশরের গামাল আব্দেল নাসেরের মদত। এদিকে সৌদি সমর্থন পেয়ে রাজপন্থীরা উত্তর ইয়েমেন এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মিশরের প্রায় ২৬ হাজার সৈন্য মারা পড়ে এই যুদ্ধে। শেষমেষ ১৯৭০ সালে রাজপন্থীরা সানা দখল করে নেয় এবং দুই পক্ষ ক্ষমতা ভাগাভাগির এক ছক করতে সক্ষম হয়। গঠিত হয় ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র। মিশর অবশ্য ১৯৬৬ এর তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের কারণে শেষদিকে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

উত্তর ইয়েমেনের শাসক সালেহ। সাল: ১৯৮৭; Image Source: The National

সালেহ নাসেরপন্থীদের পক্ষে লড়েছিলেন। শান্তিচুক্তির কারণে সেনাবাহিনীতে তার পদোন্নতি ছিল অব্যাহত। একের পর এক রাজনৈতিক হত্যার পালাবদলে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসেন আহমেদ আল ঘাসমি। আট মাসের মাথায় তিনি নিহত হলে কর্নেল সালেহ ক্ষমতা দখল করেন। তার বয়স তখন মাত্র তিরিশ কী একত্রিশ।

শাসক সালেহ এবং ইয়েমেন একত্রীকরণ

ইয়েমেনি সমাজে গোত্র ও ধর্মীয় পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সালেহ কোনো নামীদামী গোত্র থেকে আসেননি। কাজেই ক্ষমতা দখলের জন্য সালেহ সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের পরিবার বা নিজের গোত্রের ঘনিষ্ঠ লোকেদের বসাতে লাগলেন। দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে প্রশাসন আকন্ঠ ডুবে গেল। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশগুলো দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসনে ছিল। ১৯৬৭ সালে এরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। এর সোভিয়েতপন্থী নেতারা উত্তর ইয়েমেনের সাথে টুকটাক ঝামেলা বাঁধাতেন। ১৯৮৬ সালে ক্ষমতা দখল নিয়ে দক্ষিণ ইয়েমেন এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়ে যায়। পরে এর নেতারা ১৯৯০ সালে সালেহ এর উত্তর ইয়েমেনের সাথে দক্ষিণ ইয়েমেনকে সংযুক্ত করে একক ইয়েমেন রাষ্ট্র গঠন করেন। সালেহ হলেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী হলেন দক্ষিণ ইয়েমেনের নেতা সালিম আল বেইধ। ১৯৯৩ এর নির্বাচনে সালেহ এর জেনারেল পিপলস কংগ্রেস জিতলে সালিম যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। ১৯৯৪ এর এই গৃহযুদ্ধে সালেহ তাকে পরাস্ত ও দেশছাড়া করে গোটা ইয়েমেনের হর্তাকর্তা বনে গেলেন।

উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন; Image Source: Future Foreign Policy

সালেহর শাসনকাল কখনোই সুবিধার ছিল না। ইয়েমেনের মানুষের গড় আয় বা জীবনযাত্রার মানের উন্নতির তুলনায় সালেহর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অগ্রগতি ছিল রীতিমত বিস্ময়কর। আদেনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ইয়েমেনের জনগণ ততদিনে সালেহ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে একটু একটু করে। আবার পূর্বের পাহাড়ে বাসা বেধেছে আল কায়েদা। ধূর্ত সালেহ দেখলেন, ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলো আল কায়েদা। টুইন টাওয়ারে তারা হামলা চালালে প্রেসিডেন্ট সালেহ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাঁটছড়া বাধলেন।

মার্কিনীরা যেখানে নিজেদের মিত্র পাকিস্তানকেই ছেড়ে কথা বলে না, সেখানে ইয়েমেনের মতো নড়বড়ে দেশে যে তারা যথেচ্ছাচার চালাবে এতে আর অবাক কী! যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় জঙ্গীদের সাথে মরতে লাগলো সাধারণ মানুষ। গণ-অসন্তোষ বাড়তে লাগলো। মার্কিন অর্থসাহায্যে ভরপুর সালেহ শেষমেষ ২০১১ এর আরব বসন্তের জোয়ারে ভেসে গেলেন। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে গ্রেনেড লঞ্চারের শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হন তিনি। ২০১২ সালে তারই ডেপুটি আবদ্রাব্বাহ মনসুর এল হাদীকে ক্ষমতায় বসিয়ে সালেহ ইতি টানলেন ২২ বছরের কুশাসনের। সালেহ অবশ্য পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ এবং বিচার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুবিধার বিনিময়েই ক্ষমতা ছেড়েছিলেন।

আরব বসন্তের সময় ইয়েমেন; Image Source: Al Jazeera

হুথিদের সাথে সালেহ

ফিল্ড মার্শাল মনসুর আল হাদী সুন্নীপন্থী আল ইসলাহসহ বেশ কিছু দলের সাথে জোড়াতালির সরকার গড়লেন। তিনি নিজেও সুন্নী ছিলেন। ইয়েমেনের চল্লিশ শতাংশের বেশি মানুষ শিয়া ইসলামের অনুসারী, আর এদের বেশিরভাগই উত্তরের জায়েদী গোত্রভূক্ত। অথচ সৌদি সমর্থিত হাদী সরকারে জায়েদীদেরকে নেওয়া হলো না।

ইয়েমেনে আগে সরকার তেলখাতে প্রচুর ভর্তুকি দিত। ফলে অল্প দামে তেল কেনা যেত। হাদীর সরকার ২০১৩ সালে তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়। ইয়েমেনের মতো দরিদ্র দেশের অর্থনীতি একদম ভেঙ্গে পড়ে এর ফলে। সালেহর সমর্থক আর উত্তরের জায়েদী গোত্রের যোদ্ধারা অর্থাৎ হুথিরা তখন গাঁটছড়া বাঁধে এবং ২০১৫ সালে রাজধানী সানা দখল করে নেয়। সালেহর দল জেনারেল পিপলস পার্টির নেতারা মনসুর হাদীকে দল থেকে বিদায় করে দেয় এবং সালেহ ও হুথিদের সাথে যোগ দেয়। হাদী ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, তার সরকার ভেঙ্গে পড়ে। উত্তর ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইরান সমর্থিত হুথি এবং সালেহর হাতে।

হুথি যোদ্ধা এবং সমর্থকেরা; Image Source: IBTimes UK

আবার পক্ষবদল এবং মৃত্যু

২০১৫ সালে হাউথিরা সানা দখল করে নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনাদল আরো অনেকগুলো আরব ও আফ্রিকান রাষ্ট্র মিলে হুথিবিরোধী অভিযান শুরু করে। এ অভিযান এখনো চলছে, মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজারের বেশি নিরীহ ইয়েমেনীর, আর দুই পক্ষেই মরেছে শত শত সৈন্য। ফলে সৌদি জোটের বিরুদ্ধে জায়েদীসহ অন্যান্য গোত্রেও তীব্র অসন্তোষ বাড়ছে।

সৌদির বোমাবর্ষণ; Image Source: Youtube

রাজনীতিতে দক্ষ খেলোয়াড় হলেও আলী আব্দুল্লাহ সালেহ এবার হিসেবে ভুলচুক করে ফেললেন। তার অতীত রেকর্ডের কারণে হুথিরা সালেহর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতো। ২০১৭ এর নভেম্বরে হুথি নেতারা ঘোষণা দেন, সালেহ আবার সৌদিদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করছেন। সৌদিরা দীর্ঘদিন কাড়ি কাড়ি বোমা ফেলেও হুথিদের বিরুদ্ধে অসফল, কাজেই তারা চেষ্টা করছিল সালেহকে হাত করে কোনোভাবে হুথিদেরকে পরাস্ত করার।

কিন্তু আগেভাগে যোগাযোগের কথা ফাঁস হয়ে গেলে সানায় আবার যুদ্ধ বেধে গেল। সালেহপন্থী অনেক সৈন্য দক্ষিণ সানায় ছিল, আর উত্তরে ছিল হুথি এবং সালেহবিরোধীরা। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে সালেহ আনুষ্ঠানিকভাবে হুথিপক্ষ ত্যাগ করে সৌদিদের সাথে হাত মেলানোর কথা ঘোষণা করেন। সালেহ যাতে নিরাপদে পালাতে পারেন এজন্য এ সময় সৌদি জোট সানাতে তীব্র বোমাবর্ষণ শুরু করে। সালেহর গাড়িবহর এক হুথি অ্যাম্বুশের মুখে পড়লে সালেহ গাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকেন। এ সময় মাথায় স্নাইপারের গুলি খেয়ে তার মৃত্যু হয়। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া সালেহ এর মৃতদেহ নিয়ে উল্লাসরত হুথি যোদ্ধাদের দৃশ্য আক্ষরিক অর্থেই সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতিতে আরেকটি ব্যর্থতার পালক গুঁজে দিয়েছে।

সালেহ এবং বুশ; Image Source: Al Arabiya

পরিশেষে

আলী আব্দুল্লাহ সালেহর শাসন নিয়ে কবিত্ব করবার সুযোগ নেই। ইরান, মিশর, সৌদি আরবসহ নিজের দেশের হরেক গোত্রকে নিয়ে জটিল ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মাততে গিয়ে শেষমেষ প্রাণ হারান তিনি। গোটা শাসনামলে ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজের পকেটে ভরেছেন, ইয়েমেনের অবস্থারও বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি তার আমলে। যুদ্ধ আর সংঘর্ষে ভরপুর রাষ্ট্রটির দুর্বলতার সর্বোচ্চ সুযোগ নিয়ে আরো অনেক আরব একনায়কের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন তিনি। কথার বরখেলাপে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ২০০৬ এর নির্বাচনে না লড়ার ঘোষণা দিয়েও কয়েকদিন পরে আবার মত পাল্টান। এর আগেই প্রেসিডেন্টের মেয়াদও ৫ বছর থেকে ৭ বছর বাড়িয়ে নেন। পরে সুযোগ বুঝে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার আমলের নির্বাচন কোনোটিই স্বচ্ছ ছিল না। 

(বাম থেকে) সালেহ, গাদ্দাফী এবং হোসনি মুবারাক; Image Source: Business Insider

মিশর ও সোভিয়েতপক্ষ থেকে সৌদি ও মার্কিনপক্ষ, পরে সেখান থেকে ইরান ও হাউথিপক্ষ, পরে আবার সৌদি-মার্কিন পক্ষে যোগ দিয়েছেন ক্ষমতালোভী এই মানুষটি। সালেহর বার বার পক্ষবদলে বিরক্ত হয়ে জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের অনেক নেতা-কর্মী-মিলিশিয়া হুথি বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। ইয়েমেনের রাজনৈতিক চিত্রপট বর্তমানে সালেহ আমলের মতোই হতাশাজনক রয়ে গিয়েছে। সালাহর ছেলে সৌদি জোটের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।

ফিচার ইমেজ – Los Angeles Times

Related Articles

Exit mobile version