২৭ জুন, ২০০৭। দুপুর ১টা ৩০ মিনিট। লন্ডনের আকাশ জুড়ে প্রচন্ড শব্দে বিরতিহীনভাবে উড়ে চলছে বিশেষ নিরাপত্তাবাহনীর হেলিকপ্টারগুলো। নজরদারি করছে দুপুরের ব্যস্ত রাস্তাঘাটের উপর। কারণ দীর্ঘ ১০ বছর প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর সেদিন রানীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার জন্য ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবন থেকে বাকিংহাম প্যালেসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন টনি ব্লেয়ার।
ঠিক সে মুহূর্তে বাকিংহাম প্যালেস থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে লন্ডনের কার্লটন হাউজ টেরেস স্ট্রিটের একটি ভবনের তিন তলার অফিসে বসে ছিলেন ওষুধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ইউবিচেম পিএলসির চারজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তারা অপেক্ষা করছিলেন তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের জন্য, যিনি সংবাদ পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে জরুরী মিটিংয়ে বসতে চান। তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার কথা ছিল না, কারণ প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বাসা ঠিক এর পাশের ভবনটির পাঁচ তলায়, যার একপাশের বারান্দা এই অফিস থেকে পরিষ্কার দেখা যায়।
দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে চার কর্মকর্তার মধ্যে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকার শুনে বাকিরাও জানালা দিয়ে তাকালেন এবং অবাক হয়ে দেখতে পেলেন, তাদের কোম্পানীর ৬২ বছর বয়সী বৃদ্ধ মালিক তার পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছেন। বিস্ময়ে তারা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন। তাদের মধ্যে একজন সবার আগে সংবিত ফিরে পেয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু ততক্ষণে তাদের মালিকের শরীর আছড়ে পড়েছে নিচের কনক্রিটের ফুটপাতে।
কেউ একজন পুলিশের কাছে ফোন করল। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছল, ততক্ষণে পরলোকে পৌঁছে গেছেন কোম্পানীটির মালিক, লন্ডন প্রবাসী মিসরীয় কোটিপতি ব্যবসায়ী। উপরে থাকা বাকি তিন কর্মকর্তার একজন যখন ফুটপাথ থেকে চোখ সরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালেন, তখন দেখতে পেলেন আরব চেহারার দুজন ব্যক্তি আস্তে করে বারান্দা থেকে আড়ালে সরে যাচ্ছে।
রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করা এই কোটিপতি ব্যবসায়ী আর কেউ নন, তিনি ছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আশরাফ মারোয়ান, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের মেয়ে মুনা নাসেরের স্বামী এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সাবেক সিনিয়র উপদেষ্টা। তবে তার চেয়েও বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গুপ্তচর, এবং কারো মতে একই সাথে মিসরের ডাবল এজেন্ট! [আশরাফ মারোয়ান কেন এবং কীভাবে মোসাদে যোগ দিয়েছিলেন, তা জানতে ক্লিক করুন এখানে; আর কীভাবে তিনি কর্ণেল গাদ্দাফীর ইসরায়েল বিরোধী অপারেশন ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন, তা জানতে ক্লিক করুন এখানে।]
আশরাফ মারোয়ানের রহস্যজনক মৃত্যুকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা প্রথমে আত্মহত্যা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ তদন্ত শেষেও তারা আত্মহত্যার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। মারোয়ান কোনো সুইসাইড নোট রেখে যাননি, তিনি অবসাদে ভুগছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তিনি তার ব্যবসায়িক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। সময়ের আবর্তে তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেকেও এখন স্বীকার করে, মারোয়ান সম্ভবত আত্মহত্যা করেননি, তিনি হত্যাকান্ডেরই শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কারা তাকে হত্যা করেছিল, সে রহস্য এখনও অমীমাংসীত।
মৃত্যুর আগে কয়েক মাস ধরে মারোয়ান তার স্মৃতিকথা লিখছিলেন। তিনটি খন্ডে মোট ৬০০ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। এছাড়া লেখার সুবিধার জন্য টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে ক্যাসেটে বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ রেকর্ড করে রাখার অভ্যাসও ছিল তার। মারোয়ানের স্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর পর তার ডেস্ক থেকে পান্ডুলিপি এবং ক্যাসেটগুলো গায়েব হয়ে যায়। যারাই তাকে হত্যা করেছিল, তারা হয়তো চায়নি মারোয়ানের অতীত জীবনের কোনো স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ুক। কিন্তু কারা এই হত্যাকারী? ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, নাকি মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থা মুখাবারাত? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব সহজে পাওয়া যাবে না, তবে মারোয়ান তার গুপ্তচরবৃ্ত্তির জীবনে আসলে কাদের হয়ে কাজ করছিলেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করলে তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য বুঝতে কিছুটা সহজ হবে।
আশরাফ মারোয়ান সম্পর্কে এ পর্যন্ত অনেকগুলো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থই ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং গোপন নথিপত্রের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েলি সাংবাদিক এবং গবেষকদের দ্বারা লিখিত। সেগুলোর মধ্যে আছে ইউরি জোসেফ বার এর লেখা “The Angel“, হাওয়ার্ড ব্লামের লেখা “The Eve of Destruction” এবং অ্যারন বার্গম্যানের লেখা “The Spy Who Fell to Earth“। এসব বইয়ে অধিকাংশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাই মারোয়ানকে তাদের এজেন্ট হিসেবে স্বীকার করেছেন। অনেকে এমনকি তাকে ইসরায়েলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বিপরীত মতও যে নেই, এমন না। মিসরীয়রা তো বটেই, ইসরায়েলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা কর্মকর্তাও মারোয়ানকে মিসরের ডাবল এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
মারোয়ান তার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে মিসরের প্রচুর রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক গোপন তথ্য ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ তথা ইওম কিপুর যুদ্ধের ব্যাপারে ইসরায়েলকে অগ্রীম সতর্ক বার্তা দেওয়ার ঘটনাটিকে ইসরায়েলের প্রতি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, ঐ যুদ্ধের সংবাদ ১৫ ঘন্টা আগে ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কারণেই সে যাত্রা ইসরায়েল রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। তা না হলে হয়তো ইসরায়েলের অস্তিত্বই বিপন্ন হতো।
কিন্তু ইওম কিপুর যুদ্ধে মারোয়ানের তথ্য পাওয়ার পরেও ইসরায়েল প্রথম দিকে তেমন কোনো প্রতিরোধই তৈরি করতে পারেনি। যুদ্ধের প্রথম দিকে মিসর প্রায় বিনা বাধায় সুয়েজ খাল এবং সিনাই উপদ্বীপের বিশাল অংশ মুক্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ মারোয়ান ইসরায়েলকে সংবাদটা দিয়েছিলেন একেবারে শেষ সময়ে, যখন প্রস্তুতি নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় ছিল না। তাছাড়া মারোয়ান তাদেরকে জানিয়েছিলেন মিসরীয় বাহিনী আক্রমণ শুরু করবে সন্ধ্যা ছয়টার সময়। কিন্তু বাস্তবে মিসর আক্রমণ করেছিল এর চার ঘন্টা আগে, দুপুর দুটোর সময়। ফলে তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও অপ্রস্তুত ইসরায়েলি বাহিনীকে পরাজিত করতে মিসরের বেশি বেগ পেতে হয়নি।
তাছাড়া মারোয়ান যে সেবারই প্রথম মিসরের ইসরায়েল আক্রমণ করার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন, এমন নয়। এর আগেও ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে এবং ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে দু’বার তিনি ইসরায়েলকে জানিয়েছিলেন, মিসর ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে যখন তিনি মোসাদের প্রধান জাভি জামিরের কাছে সাংকেতিক ভাষায় ‘র্যাডিশ’ শব্দটি পাঠিয়েছিলেন, তখন জামির তেল আবিব থেকে ছুটে গিয়েছিলেন লন্ডন সেফ হাউজে। কারণ তাদের গোপন সাংকেতিক ভাষায় এই শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কথা যখন যুদ্ধ সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
সেবার মারোয়ান জামিরকে জানিয়েছিলেন, মে মাসের ১৫ তারিখে মিসর এবং সিরিয়া একযোগে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। মারোয়ানের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েল সেবার তাদের ১০,০০০ সৈন্যের বিশাল রিজার্ভ বাহিনীকে সীমান্তে মোতায়েন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিসর বা সিরিয়া কেউই ইসরায়েলে আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখায়নি। মাঝখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র সহ এত বড় বাহিনী স্থানান্তর এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি বাবদ ইসরায়েলের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!
এসব কারণে সে সময়ের ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আমানের প্রধান, জেনারেল এলি জেইরা মনে করেন, মারোয়ান শুরু থেকেই ছিলেন মিসরের ডাবল এজেন্ট। তার মতে, মারোয়ান ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে কাজ করার ভান করছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তার আনুগত্য ছিল মিসরের প্রতি। মারোয়ান প্রথমে অন্যান্য তথ্য দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। এরপর একাধিকবার মিসরের ইসরায়েল আক্রমণ সংক্রান্ত ভুল তথ্য দিয়ে তাদেরকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিলেন যে, ইওম কিপুর যুদ্ধের সময়ও সৈন্য মোতায়েন করা উচিৎ হবে কিনা, সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা দেরি করে ফেলেছিলেন। আর এ সুযোগেই মিসর সিনাই দখল করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
ইওম কিপুর যুদ্ধে ব্যর্থতার জন্য যুদ্ধ শেষে এলি জেইরাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। কারণ ওটা ছিল ইসরায়েলের জন্য বিশাল পরাজয়। ঐ যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলকে হারাতে হয়েছিল মিসরের সিনাই উপদ্বীপের দখল, যেটা তারা ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে মিসরের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল। জেইরা এই যুদ্ধের পরাজয়ের পেছনে নিজের দায় অস্বীকার করেন না। তবে তিনি এর জন্য দায়ী করেন মারোয়ানের গোয়েন্দা তৎপরতাকে। ইসরায়েলি ম্যাগাজিনের সাথে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে বলেন,
আমার সচেয়ে বড় ভুল ছিল, মারোয়ান যে একজন ডাবল এজেন্ট ছিল, সেটা আমি বুঝতে পারিনি।
স্বাভাবিকভাবেই মিসরীয় কর্তৃপক্ষও আশরাফ মারোয়ানকে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে দাবি করে। মারোয়ানের সাথে সবসময়ই মিসরের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুসম্পর্ক ছিল। মারোয়ানের এক পুত্রের বিয়ে হয়েছিল সাবেক মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসার মেয়ের সাথে। তার আরেক পুত্র ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারকের ছেলে জামাল মোবারকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
মারোয়ানের মৃত্যুর পর মিসর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করেছিল। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে মারোয়ানের জানাজা পড়িয়েছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ ইমাম শেখ মোহাম্মদ সাইয়্যেদ তানতাউই। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন হোসনে মোবারকের ছেলে জামাল মোবারক এবং মিসরের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ওমর সুলাইমান। জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারক মারোয়ানকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, মারোয়ানের উপর অর্পিত দায়িত্ব এবং তার অপারেশনগুলো সম্পর্কে তিনি জানতেন। মিসরের জাতীয় স্বার্থেই মারোয়ান এমন কিছু অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন, যা প্রকাশ করার সময় এখনও আসেনি।
কিন্তু তাহলে মারোয়ান যে বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলকে মিসরের সর্বাধিক গোপনীয় রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক তথ্য সরবরাহ করে এসেছিলেনন, সেগুলো কি সব ভুয়া তথ্য ছিল? মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল মুনায়েম সাঈদের মতে, সেগুলো ভুয়া তথ্য ছিল না। সেগুলো আসলেই সত্যিকার গোপনীয় তথ্য ছিল, যা মারোয়ানকে দেওয়া হতো ইসরায়েলিদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য। তার মতে, ইসরায়েলের চোখ এড়িয়ে মিসর এবং সিরিয়ার পক্ষে বিশাল বাহিনী নিয়ে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে যাওয়া সম্ভব হতো না। সেজন্যই তাদের দরকার ছিল এমন একজন ডাবল এজেন্ট, যে ঠিক দরকারের সময়ে ইসরায়েলকে বিলম্বিত এবং ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করবে। আশরাফ মারোয়ান ঠিক সে কাজটিই করেছিলেন।
তবে মিসরের এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান জেনারেল আহরন ফারকাশের মতে, ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে মারোয়ানের উপর তদন্ত করেছে, তার দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করেছে এবং তারপরেই কেবল তাকে বিশ্বাস করেছে।
ইউরি বার জোসেফ মারোয়ানকে নিয়ে লেখা তার ‘দ্য এঞ্জেল‘ গ্রন্থে মারোয়ানকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা হিসেবেই সাব্যস্ত করেছেন। তার মতে, আনোয়ার সাদাত দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই তথ্যও মারোয়ানের মাধ্যমে ইসরায়েল আগেই পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত আক্রমণের তারিখটি সাদাত কারও কাছে প্রকাশ করেননি। মারোয়ান শেষ মুহূর্তে ভাগ্যক্রমে তারিখটি জানতে পেরেছিলেন এবং সাথে সাথেই তিনি তা মোসাদকে জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
ইউরি বার জোসেফ মারোয়ানের ডাবল এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা পুরাই উড়িয়ে দেন। তার মতে আশরাফ মারোয়ানের মতো একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি, যিনি মিসরের প্রেসিডেন্টের জামাতা, তিনি নিজে থেকে মোসাদে যোগ দিতে চাইবেন, আর মোসাদও তাকে সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলবে- এটা সম্ভব না। তারা বিভিন্নভাবে মারোয়ানের বিশ্বাসযোগ্য যাচাই করেছে। তার দেওয়া তথ্যগুলো অন্য গোয়েন্দাদের দ্বারা সত্যায়িত করেছে, আবার তাকে পাল্টা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে, সে খবর মিসরের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে পৌঁছেছে কিনা। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরেই কেবল তারা মারোয়ানকে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।
ইউরি বার জোসেফ এটাও মনে করেন, ষাট এবং সত্তরের দশকে মোসাদ ছিল বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা বাহিনী। সে তুলনায় মিসরের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল অনেক নিম্নমানের। তার মতে, আশরাফ মারোয়ানের মতো একজন ব্যক্তিকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে পরিচালনা করে মোসাদকে ধোঁকা দেওয়ার মতো সক্ষমতা সে সময় মিসরের অনভিজ্ঞ গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আশরাফ মারোয়ান যে ইসরায়েলের গুপ্তচর ছিলেন, সে বিষয়ে ইসরায়েলের আদালতেরও একটি রায় আছে। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আমানের সাবেক প্রধান, জেনারেল এলি জেইরা সর্বপ্রথম তার “The Yom Kippur War: Myth vs. Reality” শিরোনামের একটি বইয়ে আশরাফ মারোয়ানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সে সময় অবশ্য তিনি সরাসরি মারোয়ানের পরিচয় প্রকাশ করেননি। মারোয়ানের ছদ্মনাম ‘দ্য এঞ্জেল’ ব্যবহার করে তিনি দাবি করেন, এই এঞ্জেল ছিল আসলে মিসরেরই ডাবল এজেন্ট।
পরবর্তীতে সাংবাদিক অ্যারন বার্গম্যানের তদন্তে যখন ‘দ্য এঞ্জেল’ এর প্রকৃত পরিচয় হিসেবে আশরাফ মারোয়ানের নাম বেরিয়ে আসে, তখন জেনারেল জেইরা তার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার বইয়ের নতুন এ সংস্করণে তিনি সরাসরি আশরাফ মারোয়ানের নাম উল্লেখ করেন এবং তাকে মিসরের ডাবল এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
জেইরার এ পদক্ষেপে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন তৎকালীন মোসাদের পরিচালক জাভি জামির। এক টিভি অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেন, ইসরায়েলের গোপন এজেন্টের পরিচয় প্রকাশ করে জেইরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের মূলনীতি ভঙ্গ করেছেন এবং এজন্য তার বিচার হওয়া উচিৎ। জেইরা তখন পাল্টা জামিরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।
দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাদের আইনী লড়াই চলার পর ২০০৭ সালে আদালত রায় দেয়, জেইরা মারোয়ানের নাম প্রকাশ করে আসলেই আইন ভঙ্গ করেছেন। এর আগে যা ছিল শুধুই সাংবাদিকদের গুঞ্জন, অবশেষে তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত পেল। প্রমাণিত হলো, আশরাফ মারোয়ানই সে রহস্যময় গুপ্তচর ‘দ্য এঞ্জেল’। আদালতের রায় জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালের ৭ জুন। আর এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই প্রাণ দিতে হয় আশরাফ মারোয়ানকে।
কিন্তু কে হত্যা করেছিল আশরাফ মারোয়ানকে? মোসাদ নাকি মুখাবারাত? যদি আমরা ধরে নেই মারোয়ান আসলেই ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে কাজ করছিলেন, তাহলে মোসাদের পক্ষে তাকে হত্যা করার যুক্তি কম। কারণ মোসাদ যদি নিজেদেরই একজন সাবেক এজেন্টকে হত্যা করে, সেটা তাদের হয়ে কাজ করা অন্য এজেন্টদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে নতুন এজেন্ট নিয়োগের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। বরং এক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা এবং অযোগ্যতা ঢাকার জন্য মুখাবারাতের পক্ষেই মারোয়ানকে হত্যা করা অধিকতর যৌক্তিক। কিন্তু যদি বিপরীতটা সত্য হয়? অর্থাৎ মারোয়ান যদি আসলে মিসরেরই ডাবল এজেন্ট হয়ে থাকেন? সেক্ষেত্রে হয়তো মোসাদই তাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু আসলে কী ঘটেছে, সেটা হয়তো আমরা কখনোই জানতে পারব না। মারোয়ানের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই রহস্যও হয়তো আজীবনের জন্য মাটি চাপা পড়ে গেছে। অথবা সেই রহস্য হয়তো বাক্সবন্দী আছে মোসাদের অথবা মুখাবারাতের হেডকোয়ার্টারের গোপন কোনো ভল্টে। ৫০ কিংবা ১০০ বছর পর, যখন এই ঘটনার তেমন কোনো মূল্য থাকবে না, হয়তো তখন কোনো একদিন কোনো আইনের বলে প্রকাশ করা হবে সেই তথ্য। নিছকই ইতিহাস হিসেবে সংরক্ষণের জন্য।
এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে পড়তে পারেন একই বিষয়ের উপর এই লেখকের লেখা বই “স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি“।
বইটি সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে: roar.cm/spy-stories