টেলিভিশন ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির আগে সীমিত সংখ্যক প্রিন্ট মিডিয়া বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজটি করতো। তারও আগে, যখন প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্বও ছিল না, বিজ্ঞাপন প্রচার হতো নানান জায়গায়- বাজারে, জনতার ভিড়ে কবিতা আবৃত্তি করে, গান গেয়ে শোনানোর মাধ্যমে, দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে কিংবা পাথর, কাঠ, স্টিলের পাতে খোদাই করে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, সেবা, ইভেন্টের প্রচার-প্রসার, এমনকি রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন, আসামী ধরার কাজেও বিজ্ঞাপনের ব্যবহার হতো সীমিত পরিসরে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি, ভোক্তা ও মিডিয়া বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার-প্রসারেও বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে রেডিও ও টেলিভিশনের মতো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে যুক্ত হয় নতুন মাইলফলক। এরপর ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এসে এই ধারাকে এত বেশি তরান্বিত করে যে, বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ে তাদের পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে পারছে।
বর্তমানে রেডিও-টেলিভিশন কমার্শিয়াল, বিলবোর্ড, অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের সময় হঠাৎ শুরু হওয়া ভিডিও, বিরক্তিকর পপ-আপ মেসেজে প্রত্যেকদিন প্রায় শত শত বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে। প্রাসঙ্গিক হোক বা অপ্রাসঙ্গিক; যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি বাইরে ঘুরতে যাওয়া, টেলিভিশন দেখা, রেডিও শোনা, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা পড়া, গেমিং, কিংবা ইন্টারনেট ব্রাউজ করা বন্ধ করে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলো এড়ানো প্রায় অসম্ভব। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন, বিজ্ঞাপনগুলো অসংখ্যবার আপনার চোখে পড়বেই।
কিন্তু বিজ্ঞাপনের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের শুরুটা হয় কখন?
প্রিন্টিং প্রেস শুরুর আগে
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য ও সেবার প্রচার-প্রসারের ইতিহাস প্রায় কয়েক হাজার বছরের পুরনো। কোন প্রতিষ্ঠান কবে, কখন এর প্রচলন করেছিল তা জানা না গেলেও বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া নানা তথ্য-চিত্র সাপেক্ষে সেসময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজে প্যাপিরাসের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাচীন মিশরে প্যাপিরাসে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের প্রচার হতো। হারিয়ে যাওয়া পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীন আরবের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্যাপিরাসে লেখা বাণিজ্যিক বার্তা এবং রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্যে তৈরি লিফলেট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিস, রোমে এসব কাজে লেখালেখির এই মাধ্যমটির বহু প্রচলন দেখা যায়।
তবে তারও আগে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় পাথরের দেয়ালে খোদাই করে কিংবা গ্রাফিতি এঁকেও বিজ্ঞাপন প্রচার হতো। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় চার হাজার বছর আগের পাথরে খোদাই করা নোটিশ আবিষ্কৃত হয়েছে।
চাইনিজ শিজিং বা ক্লাসিক অফ পয়েন্ট্রিতে উল্লেখ রয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব এগারো থেকে সপ্তম শতাব্দীর চীনে ক্যান্ডি বা মিঠাই জাতীয় খাবার বিক্রির উদ্দেশ্যে বাঁশি বাজিয়ে ক্রেতাদের আহ্বান করা হতো। সে সময় ক্যালিগ্রাফিক বিলবোর্ডের প্রচলনের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
পূর্ব চীনের জিনান শহর থেকে সং রাজবংশের সময়কার তৈরি তামার পাতে লেখা একটি বিজ্ঞাপন উদ্ধার করা হয়। বিজ্ঞাপনটির উপরের অংশে খরগোশের লোগো সহ ‘লিউসের সূক্ষ্ম সুঁইয়ের দোকান’ এবং নিচের অংশে ‘আমরা উচ্চমানের ইস্পাতের রড ক্রয় করে সেগুলো দিয়ে সূক্ষ্ম ও উৎকর্ষ সুঁই তৈরি করি, যেগুলো যেকোনো সময় বাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী’ লেখা রয়েছে। একেই এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত প্রাচীনতম বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের একমাত্র উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপের অধিকাংশ মানুষই পড়তে জানত না। তাই সেসময় পণ্য বা সেবার সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রতীক বা সেগুলোর ছবি কিংবা চিহ্ন ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজটি করা হতো। এছাড়াও স্ট্রিট কলাররা নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার গুণ বর্ণনা করে গীতিকবিতা গেয়ে বেড়াতো। এ ধরনের গীতিকবিতাগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রকাশিত কবিতার বই Les Crieries de Paris বা ‘স্ট্রিট ক্রাইস অফ প্যারিস’-এ উল্লেখ রয়েছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার আগমনের পর বিজ্ঞাপন
আধুনিক মুদ্রণের ইতিহাসের শুরুটা প্রায় ২২০ খ্রিষ্টাব্দের আগে, চীনের হান সাম্রাজ্যের সময়কালে। ‘ওড-ব্লক প্রিন্টিং’ নামে সর্বাধিক পরিচিত মুদ্রণের এই পদ্ধতিটির মাধ্যমে সেসময় রেশমের কাপড়ে বিভিন্ন রকমের লেখা, ছবি ও নকশা ছাপা হতো। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মুদ্রণের এই পদ্ধতিটির বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। কাপড়, স্ট্যাম্পসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহারের পাশাপাশি কাগজেও এর পুরোপুরি ব্যবহার শুরু হয়। সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মুদ্রিত ‘ডায়মন্ড সূত্র’ নামের বইটি প্রকাশিত হয় ৮৬৮ সালে।
কাগজে মুদ্রণের ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞাপনের ইতিহাসের সংযোগ তৈরি হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর। ধারণা করা হয়, ইংরেজ ব্যবসায়ী, কূটনীতিজ্ঞ ও লেখক উইলিয়াম ক্যাক্সটন কর্তৃক লেখা প্রথম ইংরেজি প্রিন্টেড বইয়ের প্রচারের লক্ষ্যে ১৪৭৭ সালের দিকে কাগজে মুদ্রিত বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। বিজ্ঞাপনের এই পদ্ধতিটি পরবর্তীতে হ্যান্ডবিল আকারে জনপ্রিয়তা পায়।
ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ভেনিসে সাপ্তাহিক সরকারি গ্যাজেট প্রকাশ হওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ধারণাটি ইতালি, জার্মানি, হল্যান্ড এবং ব্রিটেনেও বেশ দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের ধারণাটিও সে সময় থেকেই জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।
অন্যদিকে মুদ্রণের অগ্রগতি খুচরা বিক্রেতা এবং ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোকে হ্যান্ডবিল এবং ট্রেড কার্ড ছাপানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৬৭০ সালের লন্ডনের খুচরা ব্যবসায়ী জনাথন হোল্ডারের কথাই ধরা যাক। প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে তিনি তার দোকানে আসা প্রত্যেক ভোক্তাকে সব রকমের পণ্যের নাম ও দাম সম্বলিত একটি প্রিন্টেড ক্যাটালগ প্রদান করতেন। বর্তমানে এ ধরনের ক্যাটালগের ব্যবহার বেশ স্বাভাবিক হলেও সেসময় হোল্ডারের এই আবিষ্কার খুচরা বিক্রেতাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং খারাপ ব্যবসায়িক অনুশীলন হিসেবে ধরা হতো।
১৭০২ সালে ব্রিটেনে প্রকাশিত হয় প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি কোরান্ট’। তবে এর মাত্র দুই বছর পরেই, ১৭০৪ সালে ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়া আরেকটি পত্রিকা ‘দ্য বোস্টন নিউজ-লেটার’-এর মাধ্যমে ইতিহাসের প্রথম সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনটি ছাপানো হয়। এটি নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের অস্টার-বে’তে একটি জমি বিক্রয় সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ছিল। সে সময় থেকে দৈনিক পত্রিকা নির্ভর বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার প্রচলন বেশ ভালোভাবে শুরু হলেও বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে নতুন চমক আসতে প্রায় পঁচিশ বছর লেগেছিল।
১৭২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য পেনসিলভেনিয়া গ্যাজেট’-এ একটি আলাদা পৃষ্ঠাই রাখা হয় বিজ্ঞাপন প্রচারের লক্ষ্যে। এতে করে বেশ অনেকটা লভ্যাংশ বিজ্ঞাপন থেকে আসে বিধায় পত্রিকার দাম কমিয়ে ফেলা হয়। ফলে পত্রিকার কাটতিও বেশ বেড়ে যায়। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের এরূপ সুদূরপ্রসারী চিন্তা যে অন্যান্য সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকাগুলো দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল, তা বর্তমানের পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালেও বোঝা যায়।
বিজ্ঞাপনী সংস্থার আগমন
বর্তমানে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো মূলত ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবেই বেশি পরিচিত। এধরণের সংস্থাগুলো মূলত একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদানকৃত সেবা বা পণ্যগুলোর সৃজনশীল ব্র্যান্ডিং থেকে শুরু করে নানান প্লাটফর্মে প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যায়। সংস্থাগুলো কোনো প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিভাগ হতে পারে, কিংবা স্বাধীন ফার্ম হিসেবেও কাজ করে যেতে পারে। বর্তমানে এগুলো বেশ চোখে পড়লেও আজ থেকে প্রায় দু’শত বছর পূর্বে হাতেগোনা কয়েকটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার অস্তিত্ব ছিল।
ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থাটি শুরু হয় ১৭৮৬ সালের লন্ডনে, উইলিয়াম টেইলরের হাত ধরে। তাছাড়া প্রথম দিককার বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর প্রতিষ্ঠাটা হিসেবে ফ্ল্যাট স্ট্রিট, লন্ডনের জেমস ‘জেম’ হ্যোয়াইট, লন্ডন গ্যাজেটের অফিসার জর্ন রেয়নেল’য়ের নামও উঠে আসে। তবে ইউরোপের বাইরে, আমেরিকা, কানাডা এবং পুরো পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞাপনী সংস্থার অগ্রদূত হিসেবে ‘ভলনে বি. পালমার’কে স্মরণ করা হয়।
পালমার ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তার বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘ভলনে পালমার এজেন্সি’ শুরু করেন। ‘Adland: A Global History of Advertising’ বইয়ে পালমারকে আমেরিকা এবং কানাডার বিভিন্ন শহর এবং প্রাদেশিক অঞ্চলগুলোর সবচাইতে ভালো পত্রিকাগুলোর অনুমোদিত প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তিনি বিজ্ঞাপনদাতা এবং প্রকাশকগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা অবলম্বন করতেন।
তবে মাত্র দুই বছরের মধ্যে পালমারের বিজ্ঞাপনী সংস্থার মডেলে পরিবর্তন আসে। ১৮৪২ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় অফিস খুলে বসেন। সে সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় অল্প দামে বিজ্ঞাপনের পাতা ক্রয় করে সেগুলো বিজ্ঞাপনদাতাদের নিকট বেশি দামে বিক্রয় শুরু করে। ক্লায়েন্টের প্রয়োজন মোতাবেক বিভিন্ন লে-আউট, আর্টওয়ার্ক তৈরি করে দিলেও পালমার মূলত অ্যাড-স্পেস ব্রোকার হিসেবেই বেশি পরিচিতি পায়। পালমারের এই বিজ্ঞাপনী সংস্থার মডেলটি পরবর্তীতে বেশ জনপ্রিয় এবং অনুকরণীয় হয়ে উঠে। তবে বর্তমানে ক্রিয়েটিভ এজেন্সির ধারণাটি নিয়ে আসে ২১ বছর বয়েসি ‘ফ্রান্সিস ওয়েল্যান্ড আয়ার’।
১৮৬৯ সালে ফ্রান্সিস তার বাবার নামে নিউইয়র্কে ‘এন. ডব্লিউ. আয়ার এন্ড সন’ নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি রিলেজিয়াস উইকলির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করে। তবে তার বিচক্ষণতা এবং সৃজনশীলতাকে পুঁজি করে বেশ দ্রুতই তিনি ভলনে পালমার এজেন্সি সহ আরো কয়েকটি বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থা করায়ত্ত করে বসেন। ফ্রান্সিস পত্রিকার বিজ্ঞাপন পাতা ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও বিভিন্ন ক্লায়েন্টের জন্য ব্র্যান্ডিং করা সহ আকর্ষণীয়, সৃজনশীল বিজ্ঞাপন তৈরিতে লোকবল কাজে লাগান। মূলত বর্তমানে এজেন্সিগুলোর ‘ক্রিয়েটিভ টিম’য়ের ধারণাটি ফ্রান্সিসের এজেন্সি থেকেই এসেছে। De Beers, AT&T, ইউ. এস. আর্মি সহ আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের বিখ্যাত স্লোগান তৈরির কাজটিও এন. ডব্লিউ. আয়ার এন্ড সন’-এর।
বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপনের মূল কাজই যেহেতু কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য, ইভেন্ট বা সেবার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, সেহেতু উনিশ শতাব্দীর শেষের দিকে কোম্পানিগুলো নানানভাবে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারের পথ খুঁজতে লাগলো। সে সময় থেকেই মূলত বিজ্ঞাপন প্রচারে বিলবোর্ডের প্রচলন পুরোপুরিভাবে শুরু হয়। প্রথম নথিভুক্ত বড় আকারের বিলবোর্ডটি জারেড বেল কর্তৃক তৈরি। হাতে আঁকা ৯X৬ আঁকারের বড় বিলবোর্ডটি ১৮৩৫ সালের নিউইয়র্কে একটি সার্কাস শো’র জন্য তৈরি হয়েছিল।
বাংলায় বিজ্ঞাপন
বাংলায় বিজ্ঞাপনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয় কখন, তা না জানালে যেন পুরো লেখাটিই অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
বর্তমানে সংরক্ষিত বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয় ইংরেজি পত্রিকা ‘কলকাতা ক্রনিকল’য়ে, ১৭৭৮ সালে। পঞ্চানন কর্মকার কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি একটি বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক বইয়ের ছিল। সে সময়ে, বা তারো আগে অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলায় বিজ্ঞাপনের প্রচার-প্রসার চললেও তার কোনো প্রমাণ বর্তমানে সংরক্ষিত নেই। তবে এ দিকটায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে প্রায় শত বছর লেগে গিয়েছিল।
১৮৪০ সালের দিকে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। বছর দশেকের মধ্যে রফতানির লক্ষ্যে চা চাষে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। নতুন নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ শুরু করে সদ্য জন্ম নেওয়া এই সেক্টরে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া চা বাগানের হাত ধরেই শুরু হয় চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন। নতুন এই পানীয়কে জনসমাজে পরিচিত করতেও নেওয়া হয় নানান পদক্ষেপ। তার মধ্যে বিজ্ঞাপন যে অন্যতম প্রচার-প্রসারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল তার বলার অপেক্ষা রাখে না।
সে সময় লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন সহ নানান জনবহুল স্থানে চায়ের বিজ্ঞাপন ফলক দেখা যেত। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে ‘অসম চা কোম্পানি’। বিজ্ঞাপনগুলোতে চায়ের নানান ঔষধি গুণাবলি বর্ণনা সহ বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে চায়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝানো হতো। মানুষের মাঝে বিজ্ঞাপনগুলো কী পরিমাণ প্রভাব ফেলেছিল, তা আজকের চা নামক পানীয়টির কিংবদন্তি হয়ে ওঠাই প্রমাণ করে।
বিজ্ঞাপনের স্বর্ণযুগ
ইতিহাস ও সংস্কৃতির গতিপথ পালটে দিয়েছিল এমন আবিষ্কারগুলোর কথা আলোচনা হলে সন্দেহাতীতভাবে রেডিও এবং টেলিভিশনের নাম উঠে আসবে। বিজ্ঞাপনের স্বর্ণযুগের সূচনা যে এই দুই উদ্ভাবনের ফলেই শুরু হয়েছিল তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রেডিওর জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। দামে সস্তা হয়ে উঠায় মাত্র বিশ বছরের মধ্যে এই যন্ত্রটি প্রায় প্রত্যেক ঘরেই বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠে। সঙ্গীত, প্রাত্যহিক সংবাদ, অডিও নাটক, কী নেই এতে! ঘরোয়া বিনোদনের দুর্দান্ত উৎসটি খুব দ্রুতই মার্কেটারদের দৃষ্টি আকর্ষযন করে।
২৮ আগস্ট, ১৯২২। নিউ ইয়র্কের WEAF রেডিও স্টেশন। হোস্ট এইচ.এম. ব্লাকওয়েল ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পুরো দশ মিনিট কুইনের জ্যাকসন হাইটের হওথোর্ন কোর্ট অ্যাপার্টমেন্টে সব রকমের সুবিধাসহ ভাবনা-চিন্তাহীন কী ধরনের জীবন উপভোগ করা যাবে, তা বর্ণনা করেন। আর ঠিক এভাবেই পাবলিক রেডিওতে ইতিহাসের প্রথম রেডিও বিজ্ঞাপন সম্প্রচারিত হয়। সে সময় সরাসরি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার নিষেধ ছিল বিধায় বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্লাকওয়েল এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। আর দশ মিনিটের বিজ্ঞাপনটি প্রচার করতে কুইনস-বরো কর্পোরেশনের খরচ হয় পঞ্চাশ ডলার।
মাত্র দশ বছরের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটি রেডিও স্টেশনই বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে। এমনকি রেডিওর কিছু কিছু অনুষ্ঠান নানান ধরনের কোম্পানির স্পন্সরে সম্প্রচার করা হতো। বিশেষ করে নারীদের টার্গেট করে সোপ অপেরা, উইকলি রেডিও ড্রামা সে সময় বেশ প্রচলিত স্পন্সরড অনুষ্ঠান ছিল। সাবান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পণ্যগুলোর বিজ্ঞাপন এ ধরণের রেডিও আওয়ারগুলোতে প্রচার করা হতো।
টেলিভিশন বিজ্ঞাপন
আধুনিক সময়ের সংস্কৃতিতে টেলিভিশনের প্রভাব অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় কয়েক দশক ধরে মানুষের ঘরে ঘরে কেন্দ্রীয় বিনোদনের জায়গা দখল করে নিয়েছিল এই চারকোণার যাদুর বাক্সটি। বিনোদনের সাথে সাথে বিজ্ঞাপনের চেহারা পাল্টে দেওয়ার কাজেও টেলিভিশনের বড় ভূমিকা ছিল, তা ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথম দিকে টিভি কমার্শিয়াল প্রচারে আমেরিকা সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ১৯৩৯-এর দিকে NBC পরীক্ষামূলক-ভাবে প্রক্টর এন্ড গ্যাম্বল, জেনারেল মিল সহ আরো কয়েকটি কোম্পানির বিজ্ঞাপন বার্তা আকারে সম্প্রচার করে। যদিও একই ধরণের চর্চার জন্য ১৯৩০-এর দিকে ম্যাসাচুসেটস ভিত্তিক টিভি নেটওয়ার্ক W1XAV’কে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালের মে মাসে ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন থেকে WNBT সহ দশটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। শুরু হয় বিজ্ঞাপনের নতুন আরেকটি যুগ।
প্রথম বাণিজ্যিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপনটি সম্প্রচারিত হয় ১৯৪১ সালের পহেলা জুলাই, বর্তমানে WNBC নামে পরিচিত NBC’র মালিকানাধীন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক WNBT’তে। নিউ ইয়র্কের এবেটস মাঠে ব্রুকলিন ডজার্স এবং ফিলাডেলফিয়া ফিলিজের মধ্যকার বেসবল খেলা সম্প্রচার শুরুর ঠিক আগে।
ঘড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বুলোভা ওয়াচ’য়ের বিজ্ঞাপনটি মাত্র নয় সেকেন্ডের জন্য অন এয়ারে ছিল। আমেরিকার ম্যাপের মাঝে একটি বুলোভা ঘড়ি, তারো মাঝে লেখা ‘বুলোভা ওয়াচ টাইম’। ঘড়িতে তখন আটটা বাজে। বিজ্ঞাপনের শেষের চার সেকেন্ডের ভয়েস ওভারে বলা হয়েছিল, ‘আমেরিকা রানস অন বুলোভা টাইম’; অর্থাৎ, ‘বুলোভার সময়ে চলছে আমেরিকা।’ বিজ্ঞাপনটি প্রচারে বুলোভা ওয়াচের খরচ হয়েছিল নয় ডলার; সম্প্রচারের জন্য চার ডলার এবং স্টেশন চার্জ পাঁচ ডলার।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফলে বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রির সাথে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রায় থমকে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় সবগুলো কোম্পানিই তাদের বিজ্ঞাপনগুলোতে স্বদেশ প্রেমের চিত্র তুলে ধরতো। জাত্যভিমান তাদেরকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে, রফতানিযোগ্য পণ্যের বিজ্ঞাপনের থিমও হয়ে উঠেছিল জাতিবাদী ভাবধারা নির্ভর।
তবে পঞ্চাশের পরে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন আবার তার নিজস্ব ছন্দে ফিরে আসে। ছোট-বড় সব ধরনের পণ্য ও সেবা প্রচার-প্রসারে টেলিভিশন কমার্শিয়াল হয়ে উঠে নতুন এক ট্রেন্ড। স্পন্সর্ড প্রোগ্রামের পরিমাণও বাড়তে থাকে হুহু করে। নীতি নির্ধারকেরা বিজ্ঞাপনের মানদণ্ড বজায় রাখতে তৈরি করে নানা ধরণের নতুন নিয়ম-নীতি।
ঠিক এভাবেই বিংশ শতাব্দী শেষের সময়টা টেলিভিশনই বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজটিতে কর্তৃত্ব ফলিয়ে গেছে। যদিও তা ছিল ইন্টারনেট প্রযুক্তি মানুষের নাগালে পৌঁছনোর আগপর্যন্তই।
আর হ্যাঁ, ১৯৬৭ সালে প্রচারিত বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশন বিজ্ঞাপনটি ছিল ৭০৭ ডিটারজেন্ট সাবানের।
শুরুর শেষ
২০১৭ সালের PQ Media’য়ার হিসেব অনুযায়ী ঐ সময়ের বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিটির মূল্য ছিল প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার। দিন দিন এই মূল্য আরও দ্রুত গতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। বর্তমানে পার্সোনাল কম্পিউটার ভিত্তিক স্মার্টফোন, স্মার্ট টেলিভিশন, ইন্টারনেট ভিত্তিক নানান প্রযুক্তির বদৌলতে বিজ্ঞাপনগুলো আরও বেশি ব্যক্তি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।
দৈনিক সংবাদপত্র, বিলবোর্ড, রেডিও, টেলিভিশনের মতো প্রচারের ট্র্যাডিশনাল মাধ্যমগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, নয়তো বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রযুক্তিগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন স্ট্রিমিং, অনলাইন পত্রিকা সহ বিজ্ঞাপন প্রচারের হাজারটা মাধ্যম রয়েছে। তা অবশ্য অন্য আরেক সময়ের আলোচনা। তবে বিজ্ঞাপন যে মানুষের ব্যক্তিগত সত্ত্বার অংশ হয়ে উঠছে, শিল্প-সংস্কৃতিতে কৌশলে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/