বিবাদী বাগ ও তিন বিপ্লবী বীর
কলকাতা শহরের লালদীঘি সংলগ্ন যে এলাকাটি ‘অফিসপাড়া’ নামে পরিচিত, অনেকে সেটিকে ‘কলকাতার হৃদয়’ বলেও অভিহিত করে। কেননা এখানেই যে রয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং, রিজার্ভ ব্যাংক, জিপিওসহ রয়্যাল এক্সচেঞ্জ, টেলিফোন ভবন এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও ব্যাংক। ব্রিটিশ আমলে কাগজে-কলমে কলকাতার এই প্রশাসনিক কেন্দ্রের নাম ছিল ডালহৌসি স্কোয়ার। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর লালদীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এলাকাটির নতুন নাম হয় বিবাদী বাগ।
না, কোনো ঐতিহাসিক বিবাদ থেকে এলাকাটির নাম বিবাদী বাগ হয়নি। তবে এর নামকরণের সাথে জড়িয়ে আছে বিবাদের চেয়েও বড় একটি বিষয়: ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের তিন বীর সেনানী— বিনয়, বাদল ও দীনেশের নামের আদ্যক্ষর অনুসারে এলাকাটি পেয়েছে তার বর্তমান নাম। এবং মজার ব্যাপার হলো, এই তিনজনের জন্মস্থানই অধুনা বাংলাদেশের অধীনে।
কী করেছিলেন তারা? কেনই বা তারা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন? সেসব প্রশ্নের উত্তরই আমরা জানব এই লেখায়।
মূল ঘটনাটি যেদিন ঘটে, সেদিনের তারিখ ছিল ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের রাজধানী কলকাতার প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং আর সবদিনের মতো সেদিনও গমগম করছিল নিত্যকার কর্মতৎপরতায়। ব্রিটিশ কর্মকর্তা, ভদ্রলোক, বাঙালি বাবু, কেরানি সকলেই ব্যস্ত ছিলেন নিজ নিজ কাজে। কিন্তু এসব সরকারি আমলাদের ভিড়ে হঠাৎ করেই আবির্ভাব ঘটে তিন বিশেষ ব্যক্তির। তারা এক গগনবিদারী গর্জনের মাধ্যমে ছারখার করে দেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দৈনন্দিন অভ্যস্ততা। সেদিন এই অকুতোভয় ত্রয়ী যা করে দেখান, প্রায় ৯০ বছর বাদেও তা বারবার ঘুরেফিরে আসে বাঙালির মুখে মুখে।
বিনয়-বাদল-দীনেশ
সেই তিন বিশেষ ব্যক্তিই হলেন বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। তারা ছিলেন বিপ্লবী। ব্রিটিশ শোষকদের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিতে চাননি তারা। তাই প্রভাবিত হয়েছিলেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে, এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার।
বিনয় জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। তার বাবা রেবতীমোহন বসু ছিলেন একজন প্রকৌশলী। কিন্তু বিনয় হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। তাই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি ভর্তি হন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে, যেটি বর্তমানের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। এ সময়ই তিনি সংস্পর্শে আসেন ঢাকা-কেন্দ্রিক বৈপ্লবিক হেমচন্দ্র ঘোষের। এরপর ভিড়ে যান যুগান্তর পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট মুক্তি সঙ্ঘে। পরে তিনি যোগ দেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গড়ে তোলা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে। এভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে ডুবে যাওয়ার ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন শেষ করতে পারেননি তিনি।
এদিকে দীনেশের জন্ম ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর, মুন্সিগঞ্জ জেলার যশোলঙ গ্রামে। তার বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত এবং মা বিনোদিনী দেবী। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনিও যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে। শুরুতে গেণ্ডারিয়ায় দাদুর বাসায় বাস করলেও, পরে তিনি চলে এসেছিলেন ওয়ারীতে, পৈত্রিক বাসভবনে।
বাদলের জন্মনাম সুধীর গুপ্ত। ১৯১২ সালে ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।ছেলেবেলায় যখন তিনি বিক্রমপুরের বানারিপাড়া স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন, তখন থেকেই শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ফলে একপর্যায়ে তিনিও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স
ইতিমধ্যেই যেহেতু একাধিকবার বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নাম চলে এসেছে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদের এই কাহিনীতে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই এবার এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির ব্যাপারে কিছু বলা যাক।
এই সংগঠনটির জন্ম ইতিহাস কিছুটা বিচিত্র। ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের সভায় এসেছিলেন মতিলাল নেহরু। আপাতদৃষ্টিতে তাকে সামরিক কায়দায় অভিনন্দন জানাবার নাম করে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অনুপ্রেরণায় সুভাষচন্দ্র বসু গঠন করেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। এর জিওসি ছিলেন নেতাজি নিজেই, এবং সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় মেজর সত্য গুপ্তের কাঁধে।
আদতে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া। তাই কংগ্রেস সভা শেষ হওয়ার পর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে আরো সংগঠিত করে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়। সত্য গুপ্ত সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে তেজোদ্দীপ্ত ও উদ্যমী, দেশপ্রেমী তরুণদের একাট্টা করতে থাকেন। এবং সেই সূত্র ধরেই এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন বিনয়, বাদল, দীনেশরা।
বিনয়ের প্রথম অভিযান
পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনে বাংলার সাধারণ মানুষ তখন অতিষ্ঠ। তাই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অভিযানের লক্ষ্য ছিল বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যান এবং ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ ই হাডসনকে আক্রমণ।
১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিউ স্টিফেনসনের স্ত্রীর আসার কথা ছিল মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শনে। সে উপলক্ষ্যে হাসপাতাল তদারকির কাজে সকালবেলা উপস্থিত হন লোম্যান ও হাডসন। তাদেরকে মারার লক্ষ্যে বিনয় বসুর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা আগে থেকেই রোগী সেজে অবস্থান করছিলেন হাসপাতালে। হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে যে-ই না বের হয়েছেন লোম্যান ও হাডসন, তাদের দিকে অব্যর্থ নিশানায় গুলি ছুঁড়ে দেন বিনয়। কলকাতা থেকে বিমানযোগে চিকিৎসক দল এসেও বাঁচাতে পারেননি লোম্যানকে। গুরুতর আহত হন হাডসনও।
এ ঘটনার পর ঢাকায় সর্বত্র পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার শুরু হয়। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে আততায়ী বিনয়কে। বিনয়কে ধরতে না পারলেও, তারা ঠিকুজি কুষ্ঠি জোগাড় করে ফেলে বিনয়ের। সারা বাংলায় বিনয়ের ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানো হয়। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা, পাঁচ হাজার কিংবা মতান্তরে দশ হাজার, পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও বিনয়কে পাওয়া যায় না। কেননা বিনয় তখন ঢাকা থেকে পালিয়ে চলে গেছেন কলকাতায়, যেখানে তিনি পরিচালনা করবেন তার পরবর্তী অভিযান।
এবার কাণ্ড কলকাতায়
দিনে দিনে ইংরেজদের অন্যায়-অত্যাচার বেড়েই চলছিল। ব্রিটিশ পুলিশরা শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটকে রাখতে থাকে, এবং তাদের উপর চালাতে থাকে নির্মম নির্যাতন। সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বক্সীর মতো নেতাদেরও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয়। এভাবে ক্রমশই সেখানকার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডগুলো রাজনৈতিক বন্দিদের ভিড়ে উপচে পড়ছিল। ফলে সৃষ্টি হয় এক চরম অসহনীয় অবস্থা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে রাজবন্দিদের মাঝে। তাই তারা জেলকোড মেনেই কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
রাজবন্দিদের এই আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখেনি ব্রিটিশ পুলিশ। তারা আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে বেদম লাঠিচার্জ করতে থাকে রাজবন্দিদের উপর। সুভাস বসু, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বক্সীরাও রেহাই পাননি তাদের হাত থেকে। এমন খবর কি আর চাপা থাকে! তাই কিছুকালের মধ্যেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল রাজবন্দিদের উপর অত্যাচারের খবর। জানা গেল, এই অত্যাচারের নেপথ্যের খলনায়ক ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন।
তাই জেলের বাইরে থাকা বিপ্লবীদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন কর্নেল সিম্পসন, যিনি বসতেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। সুতরাং এবার হামলা হবে সরাসরি মহাকরণে। কিন্তু এখানে ঢোকা মানে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে ফেলা। একবার এখানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঢুকলে বাঁচার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই বিপ্লবী নেতারা অনেক ভাবনা-চিন্তা করতে লাগলেন, কাদের পাঠানো যায় এই অভিযানে।
অনেক ভাবনার পর অবশেষে নেতারা আস্থা রাখলেন বিনয়ের উপর। বিনয়ই নেতৃত্ব দেবেন এই অভিযানে। কিন্তু সাথে তো প্রয়োজন আরো অন্তত দুজনকে। তারা কারা? বেছে নেয়া হলো বাদল ও দীনেশকে। কারণ একই অঞ্চলে জন্মলাভের সূত্র ধরে কিশোর বয়স থেকেই পরস্পরকে চিনতেন বিনয়, বাদল ও দীনেশ। তাই অন্য কারো চেয়ে এই ত্রয়ীই ঠিকঠাক কাজটি করতে পারবে বলে বিশ্বাস ছিল নেতাদের।
মিশন মহাকরণ
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। মহাকরণ তথা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একটি কামরায় বসে নিজের কাজকর্ম পরিচালনা করছেন কর্নেল সিম্পসন। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞানগুহ। বেলা বারোটা নাগাদ জানা গেল, তিনজন বিলাতি পোশাক পরিহিত বাঙালি যুবক আগ্রহী কর্নেল সিম্পসনের সাক্ষাৎ পেতে।
কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানগুহকে ঠেলে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন সেই তিন বাঙালি যুবক। মুখ তুলে চাইলেন কর্নেল। এবং যা তিনি দেখতে পেলেন, তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। তিন বাঙালি যুবক দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে, তারই দিকে রিভলবার তাক করে। তাদের মধ্যে একজন (বিনয়) ইংরেজিতে বললেন, “Pray to God, Colonel. Your last hour has come!”
কথাগুলোর মর্মার্থ বোঝার জন্যও তো কিছুটা সময় প্রয়োজন। কিন্তু বেচারা সিম্পসন! আজীবন নিরীহ-নিরপরাধের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এসেছেন যে মানুষটি, তিনি নিজের শেষ সময়ে বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশই পেলেন না। আচমকাই তিনটি রিভলবার থেকে বের হওয়া ছয়টি বুলেট এসে তার শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখের নিথর দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কর্নেল।
অলিন্দ যুদ্ধ
পূরণ হয়ে গেছে বিনয়-বাদল-বিকাশ ত্রয়ীর প্রাথমিক লক্ষ্য। এবার তাদের প্রাণ নিয়ে পালানোর পালা। কিন্তু সে সুযোগ কি তারা পেলেন? না, পেলেন না। কারণ রিভলবারের শব্দে মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে এলো পুলিশ বাহিনী। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দে তাদের সাথে বিনয়দের শুরু হলো আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের লড়াই। একদিনে মাত্র তিনজন যুবক, অন্যদিকে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট ও ডেপুটি কমিশনার গার্ডনের নেতৃত্বে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত পুলিশ। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ পরিচিত ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে। তাছাড়া স্টেটসম্যান পত্রিকা মারফত ইংরেজিতে এই যুদ্ধের নাম হয়েছিল ‘Veranda Battle’।
পরাজয় নিশ্চিত জেনেও এত সহজে হাল ছেড়ে দিলেন না বিনয়-বাদল-দীনেশ। নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে, প্রাণপণে লড়াই করে যেতে লাগলেন তারা। একপর্যায়ে আহত হলেন জুডিসিয়াল সেক্রেটারি নেলসন। তখন আগমন ঘটল গুর্খা বাহিনীর। এদিকে পিঠে গুলিবিদ্ধ হলেন দীনেশ। তারপরেও গুলিবর্ষণ অব্যহত রাখলেন তিনি। কিন্তু তাদের হাতে তো বুলেটের সংখ্যা সীমিত। ফলে ক্ষণকালের মধ্যেই প্রায় ফুরিয়ে আসতে লাগল তাদের শেষ সম্বল। অথচ ও-প্রান্ত থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে গুর্খা বাহিনী।
শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে একটি শূন্য কামরায় প্রবেশ করলেন বিপ্লবী ত্রয়ী। বাঁচার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই তাদের সামনে। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দিতেও তারা নারাজ। বাদলের পকেটে ছিল পটাশিয়াম সায়ানাইড। সেটি গলধঃকরণ করলেন তিনি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আর বিনয় ও দীনেশ তাদের রিভলবারের শেষ দুটি বুলেট চালিয়ে দিলেন নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে। গুরুতর আহত হলেন তারা। কিন্তু এত সহজে ধরা দিল না কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। পুলিশবাহিনী তাদের বন্দি করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঠিয়ে দিল পুলিশ মেডিকেল কলেজে।
অতঃপর…
অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রদান করা হতে লাগল বিনয় ও দীনেশকে। কারণ ব্রিটিশরা তো এত সহজে শেষ করে দিতে চায় না তাদের শত্রুপক্ষকে। চূড়ান্ত যন্ত্রণা নিয়ে শত্রুনিধনই তাদের পছন্দ। তাই ডাক্তার ও নার্সরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে লাগলেন দুই বিপ্লবীকে সুস্থ করে তোলার।
কিন্তু বিনয় যে ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর তাই তার ছিল ভালোই দখল। সবার অলক্ষ্যে নিজের ক্ষতস্থানে আঙুল চালাতে চালাতে সেপটিক করে ফেলেন তিনি। ফলে চিকিৎসকদের পক্ষেও আর সম্ভব হয়নি তার প্রাণ বাঁচানো। ১৯৩০ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি আলিঙ্গন করে নেন মৃত্যুকে।
তবে এতটা সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন না দীনেশ। ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কনডেমনড সেলে। শুরু হয় তার বিচারকার্য। এরপর ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর আগে তবু তার ছিল একটি অনন্য অর্জন, আর তা হলো জেলবন্দি অবস্থায় সুভাষ বসুর চরণ স্পর্শের সৌভাগ্য।
শেষ কথা
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই অবগত নয় এই তিন বিপ্লবী বীর সম্পর্কে। কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের বীরত্ব। তবে আশার বিষয় এই যে, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে বড় পর্দায় চিত্রায়নের। অবশ্য সেটি নিয়েও বিতর্ক কম হচ্ছে না। কেননা একাধারে চারজন নির্মাতা বিনয়-বাদল-দীনেশকে নিয়ে অন্তত তিনটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন!
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সকল বিতর্ক পেছনে ফেলে সবগুলো ছবিই একে একে আলোর মুখ দেখবে, যাতে করে নতুন প্রজন্ম নতুন করে জানতে পারে এমন তিন বীরের সম্পর্কে, স্বাধীন ভারত লাভে যাদের অবদান অন্য কারো চেয়ে কম নয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নিতে হবে যেন বিনয়-বাদল-দীনেশদের মতো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যোদ্ধাদের সাথে পরিচয় ঘটে তরুণ প্রজন্মের।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/