চৌসার প্রান্তরে শের শাহ বনাম হুমায়ুন: যুদ্ধের মহড়া

১৫৩৮ সালের জুলাই মাস নাগাদ মুঘল সম্রাট হুমায়ুন আফগান নেতা শের খানকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করে বাংলা অধিকার করে নেন। বাংলার আবহাওয়া শুরু থেকেই সম্রাটের কাছে খুব চমৎকার লাগায় তিনি প্রায় ৯ মাস বাংলায় অবস্থান করেন। এদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রায় সম্রাটের এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতা ডেকে আনে। এসময় সম্রাটেরই সৎ ছোট ভাই মির্জা হিন্দাল সম্রাটের অনুপস্থিতির সুযোগে রাজধানী আগ্রা অধিকার করে নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন।

আপাতত সেই যাত্রায় সম্রাটেরই আরেক সৎ ছোট ভাই মির্জা কামরান মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী রক্ষা করেন। হিন্দালের বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি পাঞ্জাব থেকে ছুটে এসে হিন্দালকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন।

পরিণত বয়সে যুবরাজ মির্জা হিন্দাল। তবে ছবিটি আসলেই মির্জা হিন্দালের কিনা, তা নিশ্চিত নয়। এমনকি উইকিমিডিয়া কমন্সে ছবিটির শিরোনামেও একটি প্রশ্নবোধক (?) চিহ্ন দেয়া আছে; Image Source: Wikimedia Commons

রাজধানীর এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সম্রাট গৌড় অধিকারের ৯ মাস পর তার রাজধানী আগ্রা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। রসদ স্বল্পতা, পথের দুর্গমতাসহ নানা প্রতিকূলতার মাঝেও রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী তাদের মার্চ অব্যহত রাখে। তবে সম্রাটের যাত্রাপথে বাঁধ সাধল শের খানের অনুগত আফগান সেনাবাহিনী।

বাংলা থেকে বিহারের প্রবেশপথ তেলিয়াগড়িতে তারা মুঘল সেনাবাহিনীর পথ রোধ করে। ছোটখাট সংঘর্ষের মাঝে দিয়েই মুঘল সেনাবাহিনী আগ্রার দিকে এগুতে থাকে। যাত্রার কিছুদিন পরেই সম্রাট চৌসারে গিয়ে উপস্থিত হন। চৌসা হচ্ছে আধুনিক ভারতের বিহার রাজ্যের বক্সার জেলার একটি স্থান। ১৫৩৯ সালের এপ্রিলের দিকে এই চৌসারেই মুখোমুখি হয়েছিল সম্রাট হুমায়ুনের নেতৃত্বে পরাক্রমশালী রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী আর শের খানের নেতৃত্বাধীন অপেক্ষাকৃত দুর্বল আফগান সেনাবাহিনী।

সম্রাট হুমায়ুনের উদ্দেশ্য তার অন্তর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত মুঘল সেনাবাহিনীকে নিয়ে কোনো মতে আগ্রা পৌঁছানো। আর শের খানের উদ্দেশ্য হুমায়ুনের এই করুণ অবস্থায় তাকে জাপটে ধরে মুঘল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা। দুই বাহিনীই গঙ্গা আর কর্মনাশা নদীর মিলনস্থলে গঙ্গার দক্ষিণ দিকে মারমুখি ভঙ্গিতে অবস্থান নিল। দুই বাহিনীকে আলাদা করে রেখেছে ছোট্ট নদী কর্মনাশা।

যুদ্ধের পূর্বে দুই বাহিনীর অবস্থান; ছবিসূত্র: মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫ Edited by: Ahmad Abdullah Rifat

দুই সেনাবাহিনীর অবস্থানের এ চিত্র দেখে স্পষ্টই বলা যায়, এই যুদ্ধে আফগানরা মুঘলদের চেয়ে কিছুটা খারাপ অবস্থায় ছিল। গঙ্গা আর কর্মনাশার মিলনস্থলের সংকীর্ণ ত্রিকোণাকার স্থলভূমিতে আফগানরা পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে মুঘলদের অবস্থান তুলনামূলক ভালো ছিল। মুঘল সেনাবাহিনী কর্মনাশার যে দিকে অবস্থান নিয়েছিল, সেই জায়গাটা বেশ বিস্তৃত ছিল।

সম্রাট হুমায়ুন চাইলেই নিজের এই অবস্থাগত সুযোগ কাজে লাগিয়ে আফগানদের চেপে ধরে একটি শিক্ষা দিতে পারতেন। মুঘলরা এই অবস্থানগত সুযোগ কাজে লাগিয়ে আফাগানদের অবরোধ করলে তারা দুইদিক থেকে নদী, আর অন্য দিক দিয়ে মুঘলদের দ্বারা ঘেড়াও-এর মাঝে পড়ে যেত। মুঘলরা এটা করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে নিজেরেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আফগানদের অন্য কোনো গতি ছিল না। কিন্তু বিচিত্র হুমায়ুন তা করলেন না। তার সেনাবাহিনী নিয়ে এপ্রিল থেকে জুন মাস নাগাদ মোট ৩ মাস অপেক্ষা করলেন। কীসের অপেক্ষা করলেন কে জানে!

সম্রাটের অপেক্ষার একটি কারণ হতে পারে আগ্রা থেকে সাহায্য পাওয়া। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তা পেলেন না। আগ্রায় ইতোমধ্যেই হিন্দাল মির্জার দ্বারা একটি বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছিল। কাজেই রাজধানী আগ্রার নিরাপত্তা বিধান করা সবচেয়ে জরুরী ছিল। এদিকে সম্রাটের আরেক ভাই কামরান মির্জা এই বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করলেও বিপদ যে একেবারে কেটে গিয়েছিল, তা কিন্তু না। বরং কামরান মির্জা স্বয়ং আগ্রার উপর চেপে বসলেন। বিদ্রোহ দমনের পর তিনি নিজের প্রদেশে ফেরত না গিয়ে আগ্রায় অবস্থান করলেন। আগ্রায় তার অবস্থান ঝুকিপূর্ণ ছিল, কারণ তার নজরও মুঘল মসনদের উপর ছিল।

কাজেই আগ্রা নিরাপত্তা রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল এ সময়। কামরান মির্জা তার ভাইয়ের এই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বটে, তবে নিজের আমিরদের কুপরামর্শে তিনি তা থেকে সরে আসলেন। চৌসায় হুমায়ুন পরাজিত হলে নিজের ভাগ্য খুলে যাওয়ার একটা সূক্ষ্ম সম্ভাবনা দেখতে পেলেন তিনি।

এদিকে চৌসায় ৩ মাস বসে থেকে থেকে হুমায়ুন পড়লেন আরেক সমস্যায়। তার সেনাবাহিনীতে রসদের খাটতি। এমনকি পশুখাদ্যের অভাবে যুদ্ধের মূল্যবান পশুগুলোও মারা যেতে লাগল। অন্যদিকে, চুনার আর জৈনপুর থেকে মুঘল আমিররা তাদের বাহিনীসহ চৌসায় সম্রাটের বাহিনীর সাথে এসে যোগ দিল। তাদের নিজেদেরও যথেষ্ট রসদ ছিল না। কারণ পূর্বেই আফগানদের চালানো অভিযানে ভয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছিল।

সম্রাটের বাহিনীতে এসে যোগ দেয়ায় সম্রাটের শক্তিবৃদ্ধি হল সত্যি, কিন্তু রসদ ঘাটতি আরো প্রকট আকারে দেখা দিল। বিভিন্ন সমস্যায় শক্তির দিক থেকে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা মুঘল সেনাবাহিনীর মানসিক শক্তি আসলে তলানীতে ছিল। আর যুদ্ধের জন্য সামরিক শক্তি কিংবা শারীরিক শক্তির পাশাপাশি যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল মানসিক শক্তি। এই শক্তিটাই মুঘলদের একেবারে কম ছিল।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে, অপেক্ষা করছিলেন শের খানও। তার অপেক্ষা ছিল মুসাহিব খান আর বৃষ্টির জন্য। শের খানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল মুসাহিব খান বা ছোট খাওয়াস খান তখনো তার সাথে এসে যোগ দিতে পারেনি। তিনি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শের খান আরো অপেক্ষা করছিলেন বৃষ্টির জন্য। তিনি জানেন এই বৃষ্টির হাতেই বাংলা অভিযানে মুঘল সেনাবাহিনী বারবার পর্যদুস্ত হচ্ছিল। প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির প্রতি তাই মুঘল সেনাবাহিনীর একটা সূক্ষ্ম বিরক্তি ছিল।

শের খান অন্য আরেকটি কারণে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি জানতেন বর্ষার সময় রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী তাদের অন্যতম একটি শক্তিস্তম্ভ কামান ব্যাবহার করতে পারবে না। মুঘল সেনাবাহিনীকে কামান ব্যাবহার করা থেকে বিরত রাখতে পারলে আগে থেকেই তিনি অর্ধেক যুদ্ধ জিতে যাবেন। এদিকে শের খান যে শুধু অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন তা না। তিনি এই ৩ মাসের অপেক্ষার প্রহর কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নিজের শক্তি বাড়াচ্ছিলেন। যেখানে হুমায়ুন বসে থাকা ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই আর তেমন কিছু করেননি।

হুমায়ুন যখন গৌড় থেকে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন, তার কিছুদিন পরেই শের খানও সম্রাট হুমায়ুনকে বাঁধা দিতে রোহতাস দুর্গ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। যাত্রা শুরু করে শের খান হুমায়ুনকে আবারও সন্ধি বার্তা পাঠালেন।

রোহতাস দুর্গের একাংশ; Image Source: Wikimedia Commons

তিনি লিখলেন,

সম্রাট যদি আমাকে বাংলা ফিরিয়ে দিতে রাজি হন, তাহলে সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে নিতে আমি প্রস্তুত। বাংলায় আমি সম্রাটের নামেই খুতবা পাঠ করাব এবং সম্রাটের নামেই মুদ্রা প্রচলন করাব।

শের খান এ কথা বলেছিলেন বটে, তবে তার কার্যক্রম দেখলে মনে হয় এসব আসলে হুমায়ুনকে মন ভোলানোর জন্য পাঠানো বার্তা। তিনি জানতেন এসব ভূয়া বার্তার ফলে হুমায়ুনের মাঝে যুদ্ধ স্পৃহা কমে যাবে। হলোও তাই। সম্রাট শের খানের এই বার্তার তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দেননি। তবে চৌসার পৌঁছানোর পর তিনি এই বার্তার জবাব দিয়েছিলেন।

সম্রাটের বার্তা নিয়ে শের খানের কাছে গিয়েছিলেন শেখ খলীল। তিনি শের খানের কাছে সম্রাটের শর্ত পেশ করলেন। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর শের খান সম্রাটের শর্ত মেনে নিতে রাজি হলেন।

সন্ধির শর্তানুযায়ী সম্রাট হুমায়ুন শের খানকে বাংলা ও বিহার দিতে রাজি হয়েছিলেন। এমনকি শের খানের অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ চুনারও তাকে ফিরিয়ে দিতে তিনি সম্মত হয়েছিলেন।

শের খান; Image Source: thefamouspeople.com

বিনিময়ে শের খান সম্রাট হুমায়ুনের আনুগত্য স্বীকার করে নেবে এবং সম্রাটের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করবে। তবে নিজের আত্মসম্মানের ব্যপারে হুমায়ুন বেশ সতর্ক ছিলেন। শের খান ইতোমধ্যেই মুঘল সীমান্ত অতিক্রম করে বেশ কিছু মুঘল ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। মুঘল এলাকায় শের খান ব্যাপক প্রাণহানী চালিয়েছে এবং বেশ কিছু মুঘল যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। এসব ঘটনা নিশ্চিতভাবেই মুঘল সাম্রাজ্যের মর্যাদাকে ছোট করেছে। তাই সন্ধিতে সম্রাট হুমায়ুন একটি বিশেষ শর্ত জুড়ে দিলেন।

কেউ যেন না ভাবে যে মুঘল সম্রাট চাপে পড়ে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন, তাই তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন, আফগান সৈন্যদের অবশ্যই কর্মনাশা নদীতে তাদের অবস্থা ছেড়ে পিছু হটতে হবে। যাতে মুঘল সেনাবাহিনী বিনা বাঁধায় নদী পাড় হতে পারে। এবং সেই সাথে, নদী পার হয়ে মুঘল সৈন্যরা আফগান সেনাবাহিনীকে কিছু দূর পর্যন্ত ধাওয়া করবে। আর অবশ্যই এ সময় আফগানদের পিছু হটতে হবে। 

আফগানদের ধূর্ত শেয়াল শের খান এই অপমানজনক শর্তও মেনে নিতে রাজি হলেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, শের খান আর সম্রাট হুমায়ুনের মাঝে সন্ধি প্রায় নিশ্চিতভাবেই হতে যাচ্ছে। তবে শের খানের পরবর্তী কার্যকলাপ দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়, এসব দূত চালাচালির ঘটনা শের খান করেছিলেন সময় নষ্ট করার জন্য। সন্ধির এসব শর্ত মেনে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার ছিল না। তিনি মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রীতিমত বোকা বানিয়ে যাচ্ছিলেন এসময়।

অবশ্য শের খান যে লোক দেখানো ভালোমানুষি দেখাননি তা না। তিনি হুমায়ুনের আস্থা অর্জনের জন্য হুমায়ুনের জন্য রসদ সরবরাহের একটি পথ থেকে আফগান বাঁধা তুলে নিলেন।

১৫৩৯ সালের ৩০ মে মুসাহিব খান শের খানের সাথে চৌসায় মিলিত হলেন। মুসাহিব খান চৌসায় পৌঁছানোর পর শের খান আরেক ফন্দী আঁটলেন। তিনি ব্যপক উৎসাহের সাথে প্রচার করলেন ঝাড়খন্ডের চেরুহ জমিদাররা তাকে আক্রমণ করতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এই তথ্য প্রচার করে তিনি তার বাহিনীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে ঝাড়খন্ডের প্রায় ১২ কিলোমিটার গভীরে ঢুকে আবারও বেড়িয়ে আসলেন। এসে আবার প্রচার করলেন চেরুহ জমিদাররা এখনো অনেক দূরে।

পরের দিন আবারও বেশ ঢাকঢোল মিটিয়ে তিনি ঝাড়খন্ডের গভীরে প্রবেশ করলেন, আবারও বেড়িয়ে এলেন। দিনরাত এভাবে প্রায় ৬/৭ দিন শের খানের ঝাড়খন্ড অভিযান চলল। কিন্তু কোনো সংঘর্ষের খবরই পাওয়া গেল না। 

হুমায়ুন তখন বেশ ফুরফুরে মনে আনন্দে দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত চৌসা থেকে তিনি বিনাযুদ্ধে নিরাপদে বেড়িয়ে যেতে পারবেন। এ সময় শের খানের এই ঝাড়খন্ড অভিযানের কথা শুনে তিনি তার প্রতি বেশ সহানূভূতিশীল হলেন। 

সম্রাট হুমায়ুন কি তখন ঘুণাক্ষরে টের পেয়েছিলেন শের খানের এই অভিযান আসলে অন্য কিছু না, হুমায়ুনের উপরে আক্রমণের মহড়া মাত্র! শের খান রাতেও তার এই মহড়া চালিয়েছিলেন কোনো প্রকার সন্দেহের উদ্রেক না করেই, যাতে খুব সহজেই রাতের অন্ধকারে হুমায়ুনকে চেপে ধরা যায়।

৭ দিন শের খান তার এই গোপন মহড়া চালালেন। এরপর ১৫৩৯ সালের ২৫ জুন সকাল নাগাদ তিনি মুসাহিব খানকে চেরুহ জমিদারদের দমনের জন্য ঝাড়খন্ডের দিকে প্রেরণ করলেন। ইতোমধ্যেই মুঘল গোয়েন্দারা বিপদ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু যে সাম্রাজ্যের সম্রাট যুদ্ধপরিস্থিতিতে স্বয়ং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন, সে সাম্রাজ্যে যত চৌকস লোকই থাকুক না কেনো, তাদের অধঃপতন একপ্রকার নিশ্চিতই।

যা-ই হোক, মুসাহিব খান অভিযানের জন্য বের হওয়ার পর মুঘল গোয়েন্দাদের থেকে সম্রাট একটি বার্তা পেলেন। বার্তায় সম্রাটকে মুসাহিব খানের অভিযান সম্পর্কে জানিয়ে সম্রাটকে সতর্ক থাকতে বলা হল। বার্তায় এটাও উল্লেখ করা হল, মুসাহিব খান হঠাৎ ঘুরে মুঘলদের বিরুদ্ধে চড়াও হতে পারে। এমন আশঙ্কাজনক বার্তা পেয়েও হুমায়ুন সতর্ক হলেন না। সেই রাতে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলেন। এমনকি শিবিরে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার দিকটিও দেখলেন না। 

রাতের বেলা শের খান স্বয়ং তার আফগান বাহিনী নিয়ে শিবির ত্যাগ করলেন। মুঘল অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা দূরে তিনি তার বাহিনীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইউনিটগুলোকে একত্রিত করলেন। এ সময় শের খানের সাথে এসে যোগ দিলেন মুসাহিব খান। তিনি সারাদিন এমনিতেই তার বাহিনী নিয়ে ঝাড়খন্ডের দিক থেকে ঘুড়ে এলেন।

শের খান শেষবারের মতো তার ওয়ার কাউন্সিল ডাকলেন। যুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিকঠাক আছে কি না তা জেনারেলদের নিয়ে যাচাই করলেন। কোনো ভুল পাওয়া গেল না। শের খান নিশ্চিন্ত হলেন। শের খান এরপর তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর দিকে এগুতে লাগলেন।

শের খান যখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসছিলেন, মুঘল যোদ্ধারা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। আফগানদের এই আক্রমণ পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র অবহিত ছিল না। যে কারণে, মুঘল শিবিরে ন্যূনতম কোনো নিরাপত্তা ছিল না। যারাও বা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, তারাও বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিল। 

মুঘল সৈন্যরা ধরেই নিয়েছিল সন্ধি হয়ে গেছে। সুতরাং সাবধানতার কোনো বালাই তাদের মাঝে ছিল না। এদিকে ধীর পায়ে তাদের দিকে মৃত্যুদূত ধেয়ে আসছে। [পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেখুন লেখার পরবর্তী পর্বে।]

তথ্যসূত্র

১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫

২। তারিখ-ই-শের শাহ; মূল: আব্বাস সারওয়ানী, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: শের শাহ, অনুবাদক: সাদিয়া আফরোজ, সমতট প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৫

৩। রিয়াজ-উস-সালাতীন, মূল লেখক: গোলাম হোসায়ন সলীম, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: বাংলার ইতিহাস, অনুবাদক: আকবরউদ্দীন, অবসর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০০৮

 

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল ||  ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন || ২৫। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান ও গুজরাটের পতন || ২৬। গুজরাট থেকে মুঘলদের পলায়ন: মুঘল সাম্রাজ্যের চরম লজ্জাজনক একটি পরিণতি || ২৭। শের খান: হিন্দুস্তানের এক নতুন বাঘের উত্থানের গল্প || ২৮। শের খানের বাংলা অভিযান || ২৯। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ হত্যাকাণ্ড: সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগীজদের বিশ্বাসঘাতকতার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ || ৩০। শের খানের বাংলা বিজয় || ৩১। সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা বিজয়: বাংলা থেকে শের খানের পশ্চাদপসরণ || ৩২। মির্জা হিন্দালের বিদ্রোহ: মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আগ্রা যাত্রা

ফিচার ইমেজ: Pinterest

Related Articles

Exit mobile version