Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চিপকো আন্দোলন: গাছকে জড়িয়ে ধরে পরিবেশ বাঁচানোর এক অহিংস লড়াই

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে পরিবেশ আন্দোলন এখন গোটা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। তবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এ যাত্রার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চিপকো আন্দোলন। গাছ ও বন রক্ষার জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে যে অহিংস আন্দোলন হয়েছিলো ৭০ এর দশকে, তা-ই চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত। আন্দোলনটি হয়েছিলো ভারতের উত্তরাখণ্ডে।

সিনেমায় হরহামেশাই দেখা যায়, ভিলেন মারতে আসলে নায়িকা নায়ককে বাঁচানোর জন্য জড়িয়ে ধরে রাখছে। এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য অনেকটাই যেন সেরকম, গাছ কাটা বন্ধের জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গ্রামবাসীরা।

ভালোবাসার আলিঙ্গন; Image Source: StudiousGuy

হিন্দিতে ‘চিপকো’ শব্দটির অর্থ ‘জড়িয়ে ধরো’ বা ‘আটকে থাকো’। আর গাছকে জড়িয়ে ধরার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম ‘চিপকো আন্দোলন’। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন ভারতের উত্তরাখণ্ডে এই আন্দোলনটি শুরু হয়। কারখানা স্থাপনের জন্য তৎকালীন আমলারা ১০০ গাছ কাটতে উদ্যোগী হয়। এবং এ কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ান গ্রামের দুই যুবক- সুন্দরলাল বহুগুনা ও চণ্ডীপ্রসাদ ভট্ট। গাছকে জড়িয়ে ধরে তারা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের একটাই লক্ষ্য; যেভাবে হোক গাছ ও বন নিধন বন্ধ করে পরিবেশকে রক্ষা করা।

পটভূমি

এ আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয় আরো দুই শতাব্দী আগেই। তখন ১৭৩০ সাল। রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চল খেজারিলি গ্রামে একটি রাজপ্রাসাদ গড়ার পরিকল্পনা করলেন তৎকালীন মেওয়ারের রাজা। রাজার নাম অভয় সিং। রাজার নেতৃত্বেই শুরু হয় গাছ কাটা কর্মসূচী। আর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিন সন্তানের মা অমৃতা দেবী। সে সময় তার সাথে যোগ দেন গ্রামের বিষ্ণোয়ই সম্প্রদায়ের লোকেরাও। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, যে করেই হোক গ্রামের খেজরি গাছগুলোকে বাঁচাতে হবে। আর সেজন্য গাছের সাথে নিজেকে আটকে রেখে শুরু হয় এ আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ। আর এভাবেই গাছকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই রাজার সৈন্যদের হাতে তাদের প্রাণ দিতে হয়েছিল।

আন্দোলনের সম্মানার্থে গুগল ডুডল; Image Source: Deccan Chronicle

এরপর ১৯৬৩ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর ভারতের উত্তরাখণ্ডে এ আন্দোলন আবার শুরু হয়। তখন উত্তরাঞ্চলের, বিশেষত গ্রামীন অঞ্চলগুলো ব্যাপক উন্নয়ন লাভ করে। বিশেষ করে যুদ্ধের জন্য নির্মিত রাস্তাগুলো বিদেশি সংস্থাদের বেশ নজর কাড়ছিল। সংস্থাগুলো চেয়েছিল ঐ অঞ্চলের বনজ সম্পদ দখল করতে। সরকারের অনুমতি পেলে শুরু হয়ে যায় বৃক্ষনিধন। অথচ জীবনধারণের জন্য বনজ সম্পদের ১০ শতাংশও ভোগ করতে দেয়া হতো না অঞ্চলের আদিবাসীদের। বাণিজ্যিক কারণে এভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে কৃষির ফলন কমে যাচ্ছিল, মাটি ক্ষয়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিল সমগ্র অঞ্চলটির ওপর। যার ফলাফল ছিল গ্রামবাসীর জন্য শেষপর্যন্ত হুমকিস্বরূপ ।

পরবর্তী ইতিহাস

আন্দোলনটির প্রথম সূত্রপাত হয় উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলায়, পরে তা দ্রুত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গান্ধীবাদী সমাজকর্মী চণ্ডী প্রসাদ ভট্ট ১৯৬৪ সালে স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য দশোলী গ্রাম্য স্বরাজ্য সংঘ (ডিজিএসএম) নামে একটি ক্ষুদ্র সমবায় সংস্থা গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালে উত্তরপ্রদেশ থেকে এই আন্দোলন কঠোর রূপ ধারণ করে। ১৯৭৪ সালে সরকার কর্তৃক ২,০০০ গাছ কাটা হলে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সুন্দরলাল বহুগুনা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারী, পুরুষ, ছাত্রদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। ১৯৭২-৭৯ সালের মধ্যে দেড় শতাধিক গ্রাম চিপকো আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। উত্তরাখণ্ডে ১২টি বড় ও ছোটখাটো অনেক বিক্ষোভ হয়ে থাকে। ১৯৮০ সালে সুন্দরলাল বহুগুনাসহ আরও কয়েকজন নেতা ভাগীরথী নদীর তীরে বাঁধটি নির্মাণের বিরোধিতা করেন; যা পরবর্তীকালে ‘বীজ বাঁচাও আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এ আন্দোলন আজও অব্যাহত রয়েছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত একটি কর্মসূচীর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, চিপকো কর্মীরা আমলাতন্ত্রের হাত থেকে তাদের বনজ সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছিল এবং পরে ১৯৮৩ সালে কর্ণাটক রাজ্যে এপিকো আন্দোলনকেও (একইরকম পরিবেশবাদী আন্দোলন) অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। চিপকো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নারী গ্রামবাসীর ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ অঞ্চলের কৃষির সাথে নারীরা যুক্ত থাকায় তারা এই বিক্ষোভে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন গৌড়া দেবী, সুদেশা দেবী, বাচ্চনি দেবী, চণ্ডী প্রসাদ ভট্ট, ধুম সিং নেজি, শমসের সিং, গোবিন্দ সিং রাওয়াত প্রমুখ।

আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ

প্রথম এ আন্দোলন যার হাত ধরে হয়েছিল, তিনি অমৃতা দেবী। উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে সরকার থেকে করাতকল মালিকদের ওপর গাছ কাটার আদেশ আসার পর সে অঞ্চলের আদিবাসী গৌড়া দেবী তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিবাদ করেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এ আন্দোলনের সাথে শামিল হন।

গৌড়া দেবী; Image Source: markshep.com

আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা সুন্দরলাল বহুগুণা। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের একজন অনুসারী। ১৯৮১-৮৩ সালে তিনি চিপকো আন্দোলনের খবর পৌঁছে দিতে প্রায় ৫,০০০ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হন। ভারতের অসামরিক সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েও তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সুন্দরলাল। তার যুক্তি ছিল, যতদিন না ভারতে সবার মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততদিন তিনি এ পুরস্কার নিতে পারবেন না। তিনি এবং তার স্ত্রী- দু’জনে মিলে প্রথম এ পদক্ষেপ নেন এবং সারা দেশের কাছে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিতে মানুষের দ্বারে দ্বারে যান।

সুন্দরলাল বহুগুনা এবং তার স্ত্রী; Image Source: Right Livelihood Award

ফলাফল

উত্তরাঞ্চলের এ প্রতিবাদের খবর রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছালে তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হেম্বতি নন্দন বহুগুনা একটি কমিটি গঠন করেন, যা শেষপর্যন্ত গ্রামবাসীর পক্ষে রায় দেয়। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসলে তিনি ১৫ বছর হিমালয় অঞ্চলে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। হিমালয় প্রদেশ , কর্ণাটক, রাজস্থান, পশ্চিমঘাটেও পরে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং এক দশকের মধ্যে হিমালয় জুড়ে সবুজের জন্য এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

নারীদের অবদান

ভারতের মতো পিতৃতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা; যেখানে ঘরের বাইরে বাকি সব কাজই প্রধানত পুরুষই করে থাকে, সেখানে এ আন্দোলন অভাবনীয় অবদান রাখে নারীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। নারীরা যে কোনো অংশে কম নয় এবং প্রয়োজনে তারা সকল কাজই করতে পারে, এটি আবারও প্রমাণ করেছে চিপকো আন্দোলন। সর্বপ্রথম এ আন্দোলন শুরু হয় একজন নারী; অমৃতা দেবীর হাত ধরেই। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে এই নারীরা তাদের স্থানীয় বন রক্ষার্থে সমবায় সংগঠন গড়ে তোলেন। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীও শুরু করেন তারা।

নারীদের অবদান ছিল সর্বাগ্রে; Image Source: World Rainforest Movement

সবুজকে বাঁচাতে গাছের সাথে নিজেকে আটকে রেখে যারা রক্ত ঝরিয়েছেন, তাদের মনে রাখবে সকল পরিবেশবিদ। তাদের এই আত্মত্যাগ সাহস ও প্রেরণা যোগাবে ভবিষ্যৎ আন্দোলনকারীদের। ভারতীয় অঞ্চল ও বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ উন্নয়নের এই চিপকো আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতের আন্দোলনের জন্য হয়ে থাকবে পাথেয়স্বরূপ।

Related Articles