১
বঙ্গদেশের বাদশাহ দাউদ শাহ মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষে জড়ানোর উদ্দেশ্যে মুঘল সীমান্তে উষ্কানীমূলক আচরণ করতে লাগলেন এবং জামানিয়া দুর্গটি দখল করে নিলেন। মুঘল সম্রাট আকবর তখন গুজরাটে ব্যস্ত ছিলেন। দাউদ শাহকে ঠেকিয়ে বাংলা সীমান্তের ভেতরে ঠেলে দেওয়ার জন্য আকবর তাই জৈনপুরের মুঘল গভর্নর খান-ই-খানান মুনিম খানকে প্রেরণ করলেন।
দাউদ শাহকে দমনের দায়িত্ব পেয়ে মুনিম খান প্রথমে একটি ছোট অগ্রগামী সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। দাউদ শাহও এই বাহিনীটিকে প্রতিরোধ করতে তার দুর্ধর্ষ জেনারেল ও বঙ্গের প্রধান আমির লোদি খান আফগানকে প্রেরণ করলেন। ছোট ছোট বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হলো। কিন্তু কোনো পক্ষই তেমন সুবিধা করতে পারলো না। এদিকে একসময়ের জাঁদরেল জেনারেল মুনিম খান ততদিনে বয়সে ভারাক্রান্ত একজন মানুষ, তিনি হাল ছেড়ে দিলেন এবং বঙ্গের সাথে চুক্তি করে মুঘল সীমান্তে সড়ে আসলেন।
কিন্তু এ চুক্তি মুঘল সম্রাট আকবর বা বঙ্গের বাদশাহ দাউদ শাহ কেউই মেনে নিলেন না। মুনিম খানের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার বিষয়টি উপলব্ধি করে আকবর বাংলা আর বিহার ফ্রন্টের দায়িত্ব দিলেন রাজা টোডর মলকে। এদিকে বাংলার দরবারে তখন ঘটছিলো অন্য ঘটনা। কোনো একটি ব্যাপারে দাউদ শাহের সাথে লোদি খানের মনোমালিন্য হওয়ায় লোদি খান মুনিম খানের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের আনুগত্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই বিষয়টি জেনে যান কতলু খান নামক অন্য একজন আফগান। তিনি বিষয়টি বাদশাহ দাউদ শাহকে জানিয়ে দিলেন। দাউদ শাহ লোদি খানকে ডেকে এনে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে হত্যা করলেন। দাউদ শাহ বঞ্চিত হলেন বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, দুর্দান্ত আর দুর্ধর্ষ সাহসী একজন মানুষের থেকে। এদিকে মুনিম খান ব্যর্থ হওয়ায় আকবর স্বয়ং নিজেই উপস্থিত হলেন বাংলা সীমান্তে।
বাদশাহ দাউদ শাহও তার সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। বিহার ও অযোধ্যা সীমান্তে সন, স্রন আর গঙ্গা নদীর মিলনস্থলে এই দুই বাহিনী এক তীব্র নৌ সংঘর্ষে জড়িয়ে পরলো। এই নৌ যুদ্ধে মুঘলরা বিজয়ী হলো। বাদশাহ দাউদ শাহ পরাজিত হয়ে পাটনার দিকে পিছু হটলেন। আকবর দ্রুত মুনিম খানকে নির্দেশ দিলেন পাটনা দখলের।
২
বাংলা সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে বৃদ্ধ মুনিম খান পাটনা দখল করতেও ব্যর্থ হলেন। আকবর বাধ্য হলেন মুনিম খানকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে। যেহেতু তৎকালীন সময়ে গোটা হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের পর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যটি ছিলো বঙ্গ, আর মুঘল সাম্রাজ্য এবার সেই বঙ্গের সাথেই লড়তে যাচ্ছে, কাজেই রাজধানী ত্যাগের পূর্বে রাজধানীর নিরাপত্তায় আকবর বিশেষ দৃষ্টি দিলেন। বঙ্গ নিয়ে ইতোমধ্যেই মুঘলদের একটি বাজে অভিজ্ঞতা আছে। এই বঙ্গের মায়াতেই আটকে গিয়ে নিজের রাজধানী খুইয়ে বসেছিলেন মরহুম সম্রাট হুমায়ুন। আকবর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চান না।
যা-ই হোক, আকবর রাজধানী ত্যাগ করলেন ১৫৭৪ সালের ১৫ জুন। নৌপথের এ যাত্রায় আকবরের সাথে ছিলেন মানসিংহ, ভগবন্দ দাস, শাহবাজ খান, বীরবল আর মীর বহর কাসিম খানসহ সাম্রাজ্যের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আকবর বেনারস হয়ে গঙ্গা আর গোমতী নদীর মিলনস্থল সৈয়দপুরে নোঙ্গর করেন। ইতোমধ্যে মূল সেনাবাহিনীও স্থলপথে আকবরের সাথে মিলিত হয়। এদিকে বঙ্গে তখন ভরা বর্ষা, মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য এমন আবহাওয়া প্রচন্ড প্রতিকূলের। তারপরেও আকবর অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে নিরাপত্তার জন্য মহিলা আর শিশুদের জৈনপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এরপর আকবর অগ্রসর হলেন সেই বিখ্যাত চৌসা ফেরিঘাট বরাবর।
১৫৭৪ সাল, ৩ আগস্ট। আকবর পাটনার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন। মুনিম খান তখনও পাটনা অবরোধ করে বসে ছিলেন। পাটনা দুর্গে এ সময় অবস্থান করছিলেন বাদশাহ দাউদ শাহ ও তার বিশ্বস্ত জেনারেল আয়েশ খান নিয়াজী। আয়েশ খান নিয়াজী বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন। তাই এই অবরোধ ভেঙে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালালেন। তবে তার এই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করলেন।
অবরোধ ভাংতে ব্যর্থ হয়ে দাউদ শাহের অবশিষ্ট সৈন্যরা দুর্গ আরও শক্ত করে আগলে ধরলেন। দুর্গের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করা হলো। তবে রসদ সরবরাহ ছাড়া অবরোধের সময় বেশিদিন দুর্গ ধরে রাখা যাবে না। তাই গঙ্গার বিপরীতে থাকা হাজীপুর (বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের ত্রিহুত বিভাগের একটি শহর) থেকে গোপন রসদের চালানের ব্যবস্থা করা হলো।
এভাবে একটা মাত্র দুর্গ নিয়ে পড়ে থাকতে আকবর মোটেও রাজি ছিলেন না। তাই তিনি শুরুতে হাজীপুরকেই দখলের সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য বাধা ছিলো মূলত দুটি। প্রথমটি বর্ষা, আর দ্বিতীয়টি বঙ্গ বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা।
৩
হাজীপুর দখলের দায়িত্ব দেয়া হলো চালমাহ বেগকে। সাথে দেয়া হলো তিন হাজার দক্ষ অশ্বারোহী। চালমাহ বেগ হাজীপুর দুর্গ আক্রমণ করলেন। দুর্গের দায়িত্বে ছিলেন ফতেহ খান বারহা। মুঘল আক্রমণের মুখে তিনি পরাজিত হলেন। হাজীপুর মুঘল নিয়ন্ত্রণে চলে আসলো।
হাজীপুর দখলের পর আকবর পূর্ণ মনোযোগ দিলেন পাটনার প্রতি। পাটনায় মোতায়েন থাকা বঙ্গের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ২০ হাজারের কাছাকাছি, সাথে ছিলো বিপুল পরিমাণ রণহস্তি আর কামান। তবে কী মনে করে কে জানে, বাদশাহ দাউদ শাহ খানিকটা ভড়কে গিয়ে ইতোমধ্যেই এই দুই সাম্রাজ্যের ভেতরে যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে দূত পাঠালেন আকবরের কাছে।
আকবর এর জবাবে বাদশাহকে চারটি বিকল্প থেকে যেকোনো একটি বেছে নিতে বললেন। এক, বাদশাহ নিজে আকবরের সামনে এসে ক্ষমা চাইবেন। দুই, বাদশাহ এবং আকবর একটি একক দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লড়বেন। তিন, বাদশাহ চাইলে নিজে না এসে তার কোনো আমিরকে পাঠাতে পারেন। সেক্ষেত্রে আকবরও তার কোন একজন আমিরকে দিয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ লড়বেন। চার, বাদশাহের যেকোনো একটি রণহস্তি এবং মুঘল সেনাবাহিনীর একটি রণহস্তি লড়াই করবে। প্রতি ক্ষেত্রেই যে পক্ষ জিতবে, মূল যুদ্ধের ফলাফল তার পক্ষে যাবে।
কিন্তু বাদশাহ দাউদ শাহ কোনোটিই বেছে না নিয়ে রাতে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন। পাটনা ত্যাগ করে সোজা বঙ্গের মূল ভূখন্ডের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি। পাটনা অরক্ষিত হয়ে পড়লো। মুঘল সেনাবাহিনী প্রায় বিনা বাধাতেই পাটনা বুঝে নিলো। রাত হয়ে যাওয়ায় আকবর আর এই বাহিনীটিকে ধাওয়া করেননি। ভোর হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন, এরপর শুরু করলেন ধাওয়া। বঙ্গের মূল সেনাবাহিনীর নাগাল না পেলেও বিপুল পরিমাণ গনিমত আর প্রায় ৪০০টি রণহস্তী তার দখলে চলে আসলো।
বর্ষাকালে বঙ্গে ঢুকে বঙ্গের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেওয়া এককথায় অসম্ভবেরও কাছাকাছি। মুঘল সেনাবাহিনী সেই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছে। তবে এখন যে প্রশ্নটি আকবরের কাছে পেশ করা হলো তা হলো, বর্ষার মাঝেই কি অভিযানের বাকি অংশ পরিচালিত হবে নাকি শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে?
দুই ধরনেরই মত আসলো, তবে আকবর অভিযান চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন। মুনিম খানের ব্যক্তিগত কমান্ডে অতিরিক্ত ১০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী মোতায়েন করা হয়। একই সাথে রাজা টোডর মলসহ মুঘল সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটগুলোকেও তার অধীনে মোতায়েন রাখা হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আকবর দিল্লিতে ফেরত গেলেন।
৪
প্রথমদিকে সম্রাটকে আশাহত করলেও এবার মুনিম খান আশার তুলনায়ও অনেক বেশি সফলতা পাচ্ছিলেন। মুঘল অভিযানে মুঙ্গের, ভাগলপুর, কোলগাঁও আর তেলিয়াগড়ের পতন ঘটে। দুর্ভেদ্য এই তেলিয়াগড়কেই মূলত বঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হতো। তেলিয়াগড় দখল করেই মুঘল সৈন্যরা দ্রুত বঙ্গের রাজধানী তাণ্ডা (বর্তমান মালদা জেলায়) অভিমুখে যাত্রা করলেন। বাদশাহ দাউদ শাহ সাতগাঁও হয়ে উড়িষ্যার দিকে সড়ে গেলেন। তান্ডার পতন ঘটলো। তান্ডা থেকে বিপুল পরিমাণ আফগান বঙ্গের আরও গভীরে প্রবেশ করে। মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প্রশ্নে এই আফগানরা সত্যিই হুমকি ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে তারা মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিলো। কাজেই মুঘল সেনাবাহিনী আফগানদের ধাওয়া করার সিদ্ধান্ত নিলো। তান্ডার উত্তরে ঘোড়াঘাট, পূর্বে সোনারগাঁও, দক্ষিণ পূর্বে ফাতেহাবাদ (বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর) আর দক্ষিণে সাতগাঁও বরাবর মুঘল সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়লো।
এদিকে বাদশাহ দাউদ শাহ পালিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে করতে উড়িষ্যার দিকে সরে যাচ্ছিলেন। তাকে ধাওয়া করার দায়িত্ব এসে পরলো রাজা টোডর মলের উপর। বনের দুর্গম রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এমন পরিবেশে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাস্তা দুর্গম ও অপরিচিত হওয়ায় অ্যামবুশের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো অনেক। সেক্ষেত্রে বঙ্গ বাহিনীর হাতে কচুকাটা হওয়া ছাড়া করার আর কিছুই থাকবে না। তারপরও এই পথেই সেনাবাহিনী যাত্রা অব্যহত রাখলো।
ঝুকিপূর্ণ এই পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার খেসারতও দিতে হলো হাতে হাতে। বাদশাহ দাউদ শাহের পুত্র জুনায়েদ খান পথে দুবার মুঘল সেনাবাহিনীর পথ অবরোধ করে দাঁড়ালেন। দুবারই মুঘলরা পরাজিত হলো। টানা দুটি পরাজয়ে সেনাবাহিনী এবার বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। তারা সরাসরি আকবরের নির্দেশ ছাড়া এই ঝুকিপূর্ণ পথ ধরে এগোবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে এবার মুনিম খানকে হস্তক্ষেপ করতে তান্ডা থেকে এগিয়ে আসতে হলো। মুনিম খান নিজে উড়িষ্যায় এসে সেনাবাহিনীকে আশ্বস্ত করলেন। এরপর তুলনামূলক সহজ রাস্তা ধরে মুঘল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। শেষ পর্যন্ত সব বাঁধা পেড়িয়ে মুঘল বাহিনী উড়িষ্যা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।
১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ সুবর্ণরেখা নদীর তীরের তুকারোই গ্রামে হিন্দুস্তানের পরাশক্তি এই দুই সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী মুখোমুখি হলো।
৫
মুখোমুখি হয়েই দুই বাহিনী সেনাবিন্যাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। খান-ই-খানান মুনিম খান মূল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করলেন কিয়া খানকে, মূল বাহিনীর ডানপাশে থাকলেন শাহাম খান জলাইর, পাইন্দা মুহাম্মদ খান মুঘল, মুহাম্মদ আলী খান তুকবাই। বামপাশে থাকলেন রাজা টোডর মল, আশরাফ খান মীর মুন্সি, মুজাফফর খান মুঘল, লস্কর খান। সম্মুখ বাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন চালমাহ বেগ। মুনিম খান মূল সেনাবাহিনীর পেছনে রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ড নিজের হাতে রাখলেন।
অন্যদিকে বাদশাহ দাউদ শাহের বাহিনীর বিন্যাসও অনেকটা একই রকম ছিলো। সামনে গুজরা খানকে রেখে মূল বাহিনী নিয়ে তিনি কিছুটা পেছনে অবস্থান করছিলেন। অন্যদিকে ডান বাহিনীর কমান্ড ছিলো উড়িষ্যার গভর্নর খান জামানের কাছে। আর বামবাহুর নেতৃত্ব দিলেন ইসমাইল খান আবদার।
যুদ্ধ শুরু হলো। আফগান সৈন্যরা, তথা বাংলার সেনাবাহিনী সামনে এগোতে শুরু করলেই মুঘল সেনাবাহিনীর সামনে রাখা হালকা কামানগুলো গোলাবর্ষণ শুরু করলো। তবে তাতে খুব একটা কাজ হলো না। বঙ্গ সৈন্যদের অগ্রযাত্রা অব্যহত থাকলো। এরপর দুই বাহিনীই সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো। গুজরা খান তীব্র আক্রমণ চালালেন চালমাহ বেগের উপর। তার এই তীব্র আক্রমণে মুঘল সৈন্যদের দিশেহারা হওয়ার অবস্থা হলো। প্রচন্ড সংঘর্ষের পর এই বাহিনীর মুঘল সৈন্যরা হাল ছেড়ে দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। এই সংঘর্ষে স্বয়ং চালমাহ বেগ নিহত হলেন।
এদিকে সিকান্দার খান আক্রমণ করলেন রাজা টোডর মলকে, আর ইসমাইল খান আক্রমণ করলেন শাহাম খানকে। দুই জায়গাতেই তীব্র লড়াই চললো। অন্যদিকে, স্বয়ং বাদশাহ দাউদ শাহ বাংলার মূল সেনাবাহিনী নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর কেন্দ্রকে আক্রমণ করে নড়বড়ে করে দিলেন। যুদ্ধ এবার এগিয়ে গেলো মুনিম খানের দিকে। মুনিম খানের ডানপাশ চেপে ধরলেন দাউদ শাহ, অন্যদিকে গুজার খান চেপে ধরলেন বামপাশকে। মুনিম খানের অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে গেলো যে মনে হচ্ছিলো মুঘল সেনাবাহিনীর পরাজয় এখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। গুজার খান একাই পাহাড়ের মতো দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে মুঘলদের উপর ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে লাগলেন।
কিন্তু, হঠাৎ ছুটে আসা একটি তীর সব হিসেব এলোমেলো করে দিলো। তীরটি এসে সোজা বিদ্ধ হলো গুজার খানের চোখে। মারা গেলেন বাংলার দুর্ধর্ষ এই জেনারেল। গুজার খান নিহত হলে তার অনুপস্থিতিতে তার বাহিনী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অন্যদিকে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে মুঘলরাও এতক্ষণে নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছে। এরপর মুঘল সেনাবাহিনীর কেন্দ্র আর রিজার্ভ ফোর্স একযোগে আক্রমণ চালালো বাদশাহ দাউদ শাহের উপরে। মুঘলদের এই তীব্র আক্রমণ এবার আর সামলাতে পারলেন না তিনি। পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটলেন বাংলার বাদশাহ দাউদ শাহ।
৬
এদিকে যুদ্ধ শেষে বাদশাহ দাউদ শাহকে ধাওয়ার উপরে রাখা হলো। তিনিও কিছুদিন এদিক সেদিক পালিয়ে বেড়ালেন। তবে শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের আনুগত্য করার সীদ্ধান্ত নিলেন। একই সালের ১২ এপ্রিল তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে আসেন। খান-ই-খানা মুনিম খান দাউদ শাহকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। দাউদ শাহ তার তরবারি মুনিম খানের কাছে অর্পণ করলেন, অর্থাৎ তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে নতি স্বীকার করলেন। মুনিম খান দাউদ শাহকে একটি মুঘল তরবারি ও রাজকীয় খিলাত উপহার দিলেন। এরপর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করা হলো।
এই চুক্তির আওতায় উড়িষ্যা দাউদ শাহের কাছে ছেড়ে দেওয়া হলো। আর দাউদ শাহ বাংলা, বিহার মুঘল সাম্রাজ্যের হাতে ছেড়ে দিলেন। একইসাথে আমৃত্যু মুঘল সাম্রাজ্যের আনুগত্য করার প্রতিজ্ঞা করলেন। বাংলায় মুঘলদের আপাত জয় হলো। কিন্তু কথায় আছে, বেশিরভাগ প্রতিজ্ঞা করাই হয় তা ভাঙার জন্য। তবে দাউদ শাহ ছাড়াও মুঘলদের জন্য আরেকটি বড় বিপর্যয় সামনেই অপেক্ষা করছিল।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/