অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজপরিবারগুলোতে বিয়ে হবে পূর্বনির্ধারিত জুটির মধ্যে- এটা অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব বিবাহিত দম্পতির মধ্যে কারো কারো ঘটে মধুরেন সমাপয়েত অর্থাৎ মধুর সমাপ্তি, কেউ বা মাঝপথেই আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হয়, আবার কারো কপালে জোটে খুনের দায়ে তিন দশক কারাগারে পার করার নির্মম অভিজ্ঞতা। ঠিক শেষেরটাই ঘটেছিল জার্মানির সেলে নগরীর রাজকন্যা সোফিয়া ডরোথিয়ার সাথে। প্রিন্স হ্যারির সাথে মেগান মার্কেলের বিয়ে নিয়ে মিডিয়া যখন সরগরম, তখন জেনে নেয়া যাক রাজপরিবারের সদস্য হয়েও প্রেমে পড়ার ‘দুঃসাহস’ দেখানো সোফিয়ার সেই দুঃখগাথা।
গ্রেট ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজা প্রথম জর্জ ১৬৮২ সালে তার কাজিন জার্মানির সেলে নগরীর সোফিয়া ডরোথিয়াকে বিয়ে করেন। না, এই বিয়ের সাথে প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরো ব্যাপারটাই ছিল আসলে দায়িত্ব পালন। রাজত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি, হাউজ অফ হ্যানওভারের ভবিষ্যৎ সব কিছুই নির্ভর করছিল বর-কনের উপরে, এখানে ভালোবাসার জায়গাটাই বা কোথায়? বিয়ের পরের বছরই নবদম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় জর্জ অগাস্টাস। ১৬৮৭ সালে পরিবারে যুক্ত হয় আরেক নতুন সদস্য। মায়ের নামানুসারে মেয়ের নামও রাখা হয় সোফিয়া ডরোথিয়া। পুত্র, কন্যা দুজনই বেশ দাপটের সাথে ধরণী মাতিয়ে রাখে। ছেলেটি বড় হয়ে রাজা দ্বিতীয় জর্জের পদমর্যাদা অর্জন করে, আর মেয়েটি হয় প্রুশিয়ার রানী।
পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রাজা প্রথম জর্জ ভাবতে থাকেন, সংসারের প্রতি তার দায়িত্ব তো তাহলে শেষ। কাজেই স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে প্রাসাদে অবস্থানরত উপপত্নী আর রক্ষিতাদের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন তিনি। নির্বাসিত, অপমানিত, বাইরের দুনিয়া থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন সোফিয়া তার তথাকথিত স্বামীর রাজপ্রাসাদের প্রাচুর্যে থেকে কতটা একাকিত্ব বোধ করতেন, তা আলাদা করে বলাই বাহুল্য। রাজা জর্জ যখন ইন্দ্রিয় তৃপ্তির মোহে এক রক্ষিতার কাছ থেকে আরেক রক্ষিতার কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন বলতে গেলে বাধ্য হয়েই রানীকেও খুঁজে নিতে হয় নিজের সুখের ঠিকানা। সত্যিই যখন সুখের সন্ধান করতে গিয়ে সোফিয়ার জীবনে কেউ আসে, তার ফলাফল হয় বিধ্বংসী।
১৬৮৮ সালে সুদর্শন, সুপুরুষ আর ধনী সুইডিশ এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী কাউন্ট ফিলিপ ক্রিস্টোফ ভন কনিগসার্কের বেশে হ্যানওভারে প্রবেশ করে ট্র্যাজেডি। সোফিয়ার সাথে শৈশবেই পরিচয় ছিল কাউন্ট ফিলিপের। নিঃসঙ্গ এক রাজকীয় নারীকে কীভাবে বিনোদিত করতে হয়, তার ছলা-কলা বেশ ভালোই জানা ছিল ফিলিপের। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং বেশ ধূর্ত ফিলিপ চাতুর্যের সাথে সোফিয়ার মনে জায়গা করে নেয়। মাস্ক পরিহিত অবস্থায় দুজন যখন বলরুমে নাচতে থাকে, তখন তাদের পুরনো বন্ধুত্বের সম্পর্কই শুধু পুনরুজ্জীবিত হয় না, বরং সে সম্পর্ক নতুন এক বাঁক নেওয়ার পথেও অগ্রসর হয়।
আগে থেকে নির্বাচিত রাজকুমারী সোফিয়া আর ফিলিপ নিজেদের মধ্যে অল্প অল্প করে গড়ে ওঠা এই রসায়ন খুব একটা আমলে নিতে চাইলো না। তাছাড়া অবিবাহিত ফিলিপের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর মতো মানুষেরও অভাব ছিল না। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কাউন্টেস ক্লারা ভন প্ল্যাটেন, উচ্চাভিলাষী এই নারী রাজা প্রথম জর্জের জন্যও অপেক্ষা করেছিলেন দীর্ঘদিন। ফিলিপকে নিজের বশীভূত করতে শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী ও যথেষ্ট সুন্দরী ক্লারার খুব বেশি কসরত করতে হয়নি। খুব শীঘ্রই তারা একে অপরের ছায়ায় পরিণত হয়ে গেলেন যেন। তাদের দুজনকে নিয়ে যেসব গুজব প্রচলিত ছিল, ক্লারার দিকে অন্য নারীরা যেভাবে ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতো, সবই খুব উপভোগ করতেন ক্লারা। বিবাহিতা নারীর, তা-ও আবার রাজা প্রথম জর্জের স্ত্রীর, সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে লোকের তিক্ত কথা শোনার চেয়ে ক্লারার সঙ্গই বরং আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে ফিলিপের কাছেও। কাজেই হ্যানওভারের রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব দুজন একসাথেই লুফে নেন।
একে অপরের কাছ থেকে দূরে গিয়েই ফিলিপ আর সোফিয়া টের পান তাদের মধ্যকার অনুভূতিগুলো শুধু বন্ধুত্বের নয়, তারচেয়েও ঢের বেশি কিছু। ক্লারা ফিলিপকে চাইতেন শুধুমাত্র বাকিদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে। কিন্তু সোফিয়ার ভালোবাসায় যে কোনো খাদ ছিল না, তা প্রাসাদ থেকে বেরিয়েই অনুধাবন করেন ফিলিপ। এদিকে রাজপ্রাসাদে বসে একাকী রাজকুমারী সারাদিন কেবল ফিলিপের কথাই ভাবতে থাকে। একদিকে স্বামীর প্রতারণা, অন্যদিকে ভালোবাসার নতুন আশ্রয়েরও এভাবে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না তিনি। দুজনের মধ্যে শুরু হয় চিঠি আদান-প্রদান।
খুব জটিল ভাষায় গোপন সংকেতের মাধ্যমে পারস্পরিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন ফিলিপ আর সোফিয়া। দিন দিন চিঠিগুলোতে প্যাশন আর একে অপরকে চাওয়ার বাসনা আরও বেড়ে উঠতে থাকে। প্রেমে উন্মত্ত সোফিয়া আর ফিলিপ অবশ্য নিজেদের প্রেমকাহিনীকে অদৃশ্য মনে করেই সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিলেন। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের বিষয়টি একদিন নজরে পড়ে ক্লারার। তাকে রেখে ফিলিপ অন্য কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, এই ঈর্ষায় কাতর হয়ে সে প্রতিশোধ নেয়ার ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। সোজা রাজা প্রথম জর্জকে গিয়ে এই কাহিনী জানায় সে।
সোফিয়া আর ফিলিপের জীবনে এরপরে আর কখনো শুভদিন আসেনি। প্রতারণার দায়ে স্ত্রীকে আদালতে হাজির করেন জর্জ। রাজকুমারী হয়ে এত বড় অপরাধ করায় সাধারণ জনগণও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সোফিয়ার উপরে। তার স্বামী যে এতদিন ধরে তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে চলেছে, সেটি যেন কোনো আমলে নেয়ার মতো বিষয়ই না। সোফিয়া যেদিন আদালতে হাজির হয়, তার গলায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ছিল রাজা জর্জের আঙুলের ছাপ। সোফিয়া বুঝতে পারছিলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো প্রেমিকের হাত ধরে চিরদিনের জন্য হ্যানওভার ছেড়ে চলে যাওয়া। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে গোপনে দেখা করে সোফিয়া আর ফিলিপ। দুজন মিলে পরিকল্পনা করে কবে, কীভাবে এই নরক থেকে পালানো যায়। এখান থেকে বের হয়ে গেলে তারা সুখে-শান্তিতে বাকি জীবন কাটাতে পারবে, এমনটাই ছিল তাদের ধারণা। সে যা-ই হোক, ১৬৯৪ সালের জুলাই মাসের সে রাতে সন্তুষ্টচিত্তে প্রেমিকাকে শুভরাত্রি জানিয়ে সে-ই যে উধাও হয়ে গেল ফিলিপ, পৃথিবীর বুকে কেউ আর কখনো তার চেহারা দেখেনি।
একজন কাউন্টের এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে জলঘোলা করা শুরু করে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কিন্তু রাজপরিবারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মতো যথেষ্ট সাহস বা সুযোগ তাদের ছিল না। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে রাজা জর্জ বা তার পরিবারের সদস্যরাই ফিলিপকে খুন করেছে। সে সময় রাজপরিবার বিষয়ক কোনো বিচারকার্যের ফলাফল সাধারণ মানুষের জানার নিয়ম ছিল না। তাই আদালতেই কোনো গোপন ষড়যন্ত্র করে ফিলিপকে শাস্তি দেয়া হলো কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সঠিক কোনো প্রমাণ বা সাক্ষী না থাকায় কাউকেই সেই অর্থে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি। কেউ কেউ আবার ক্লারার দিকেও আঙুল তোলে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বঞ্চিত, ক্রোধে উন্মত্ত এই নারীই হয়তো বা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে খুন করেছে ফিলিপকে। অথবা ক্লারা নিজেও হয়তো রাজপরিবারের এই গুজব-চক্রান্তের একজন বলি ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজপরিবারগুলো তাদের অসীম ক্ষমতা প্রদর্শন করতে মাঝে মাঝেই এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। কাজেই সোফিয়ার আর কখনোই জানা হলো না, শেষপর্যন্ত কী হয়েছিল তার প্রেমিকের সাথে।
প্রকৃতপক্ষেই যে তাকে ভালোবেসেছিল, তাকে হারানোর দুঃখ বরণ করে নিতেই যেন রাজকীয় আদালতে তিন দশকের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় সোফিয়াকে। বাবা, স্বামী আর শ্বশুরের হাতেই নির্ধারিত হয় তার ভাগ্য। খুব তাড়াহুড়া করে নেয়া এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করা হয় অস্বাভাবিক দ্রুত সময়ের মধ্যে। রাজপরিবারের আর কোনো নারী যেন ভালোবাসার স্বপ্ন না দেখে, তার জন্য সোফিয়ার এই ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটুও পিছপা হয় না তার তথাকথিত আপনজনরা। ১৬৯৪ সালের ডিসেম্বরে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় সোফিয়া আর রাজা জর্জের। জার্মানির সেলে নগরীতে অ্যালডেন হাউজে কারাজীবন শুরু হয় সোফিয়ার। শুধু ৩০ বছরই নয়, জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি এখানেই কাটিয়েছেন।
অ্যালডেন হাউজে সবার সাথে ভালো আচরণ করে দিন কাটছিল রাজকন্যার। এদিকে রাজা প্রথম জর্জের রাজপ্রাসাদে সোফিয়ার নাম উচ্চারণ করার উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, এমনকি বাচ্চাদেরও অনুমতি ছিল না মায়ের কথা জিজ্ঞেস করার। এ কারণেই রাজা প্রথম জর্জের সাথে শিশুপুত্র দ্বিতীয় জর্জের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কন্যা সোফিয়া মাকে দেখতে গেছে, এ কথা কানে যাওয়ার পরে মেয়ের মুখ দেখা বন্ধ করে দেন জর্জ। অভিমানী কন্যা বিয়ের পরে আর কখনো বাবার সাথে দেখাও করেনি। এমনকি জীবনের শেষ দিনগুলোতে অসুস্থ রাজা জর্জ যখন মেয়ে সোফিয়ার সাথে দেখা করতে চান, তখন ভাগ্যচক্রে প্রকৃতি যেন আগের দিনগুলোর প্রতিশোধ নিয়ে বাবা-মেয়েকে এক হতে দেয়নি। রাজপরিবারের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা মা সোফিয়া ডরোথিয়াকে খুব মিস করত তার সন্তানেরা। বাবার অবহেলার কথা তাদের অজানা ছিল না। কাজেই মায়ের এই প্রণয়ে পূর্ণ সম্মতি ছিল তাদের দুই ভাই-বোনের। রাজপরিবারের সদস্যদের লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যেত জর্জও। হ্যানওভারের দেয়ালে দেয়ালে গুমরে মরত তাদের দুই ভাই-বোনের কান্না। আর বন্দিনী রাজকন্যা সোফিয়ার জীবনের শেষাঙ্কের খোঁজ পায়নি কেউ কখনো।
ফিচার ইমেজ- historyanswers.co