বাস্তব যখন সিনেমাকেও হার মানায়
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসের ৭ তারিখ, সন্ধ্যাবেলায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে সতের বছর বয়সী এক তরুণ, নাম তার এলমার ওয়েইন হেনলি জুনিয়র। হেনলির মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যের যত চিন্তা। যে কোনো উপায়েই তাকে আবারো দুশো ডলার যোগাড় করতে হবে, দূর করতে হবে পরিবারের আর্থিক অনটন। এই দুর্দশা দূর করতে গিয়ে যদি কাছের কোনো মানুষের জীবন সংশয়ের মাঝেও পড়ে যায় তাতেও তার কিছু যায় আসে না। এসব ভাবতে ভাবতে যখন সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো, তখনই তার দেখা হয়ে যায় টিমোথি কর্ডেল কার্লির (১৯) সাথে। সাথে সাথেই হেনলির মাথায় অন্য চিন্তা এসে ভর করে। সে তাকে ডিন কর্লের বাসায় এক পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায়। কার্লি সানন্দে সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়। তারপর দুজনে কর্লের বাসায় এসে ডুবে যায় অ্যালকোহলের জগতে।
এভাবে চলে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। মাঝরাতে ক্ষুধা লাগায় স্যান্ডউইচ কিনতে বের হয় তারা। গাড়িতে করে দু’জনে আসে হিউস্টন হাইটসে। সেখানে হেনলির বাড়ির কাছে গাড়ি থামায় কার্লি। গাড়ি থেকে নেমে হেনলি সামনেই তার বান্ধবী রোন্ডা উইলিয়ামস (১৫) এর বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। সেদিন সন্ধ্যায় মদ্যপ অবস্থায় রোন্ডার বাবা তাকে মারধর করেছিলো। তাই বাবার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার আগপর্যন্ত সাময়িকভাবে বাসা থেকে দূরে অন্য কোথাও থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সে। হেনলি রোন্ডাকে কর্লের বাসায় পার্টিতে আমন্ত্রণ জানালে রোন্ডা প্রস্তাবটি লুফে নেয়। তারপর গাড়িতে করে তিনজনই কর্লের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
রাত প্রায় তিনটার দিকে (৮ই আগস্ট) তারা তিনজন কর্লের বাসায় এসে পৌঁছায়। রোন্ডাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যান ডিন কর্ল। হেনলিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেন, “তুমি আমার সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছো”। হেনলি কর্লকে সব বুঝিয়ে বললে তিনি ঠান্ডা হন। এরপর তিনি তাদের তিনজনকে বিয়ার এবং মারিজুয়ানা পরিবেশন করেন। আবার শুরু হয় তাদের পার্টি। প্রায় দু’ঘন্টা পর তিনজনই অজ্ঞান হয়ে যায়। তখনই শুরু হয় কর্লের খেলা…
বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পায় হেনলি। টের পায় তাকে উপুড় করে শুইয়ে দু’হাতে হাতকড়া পড়িয়ে রাখা হয়েছে। তার মুখে স্কচটেপ লাগানো ছিলো এবং দু’পা ছিলো বাঁধা। কার্লি আর রোন্ডাকেও একই অবস্থায় রাখা হয়েছিলো। তবে তাদের জ্ঞান তখনও ফিরে আসেনি। হেনলি প্রতিবাদ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন কর্ল, জানান হেনলি সাথে করে একটি মেয়ে নিয়ে আসায় তিনি খুবই রেগে গেছেন। তাই কার্লিকে নির্যাতন করার পর তাদের তিনজনকেই আজ তিনি খুন করবেন। তারপর হেনলিকে টেনেহিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে যান তিনি। তার বুকের দিকে .২২ ক্যালিবারের পিস্তলটি তাক করে খুন করার ভয় দেখান। হেনলি তখন একেবারেই চুপ হয়ে যায়। শুধু ঠান্ডা মাথায় সে কর্লের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় যে কর্ল যদি তাকে ছেড়ে দেয় তাহলে এই নির্যাতন আর খুনের কাজে সে নিজেও অংশ নেবে। এই কথা শুনে এতদিনের সঙ্গীর প্রতি বুঝি দয়া হলো কর্লের। তাই তাকে ছেড়ে দিলো সে। দু’জনে মিলে কার্লি আর রোন্ডার অচেতন দেহ টেনে নিলো কর্লের শোবার ঘরে। সেখানে দু’জনকেই টর্চার বোর্ডের সাথে বাঁধা হলো- কার্লিকে উপুড় করে আর রোন্ডাকে চিত করে।
এবার কর্ল হেনলির হাতে একটি ছুরি দিয়ে রোন্ডার জামা কাটতে বললেন। এরপর তিনি কার্লির সাথে মিলিত হতে উদ্যত হলেন এবং হেনলিকেও রোন্ডার সাথে একই কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। হেনলি রোন্ডার জামা কাটতে আরম্ভ করলো, কর্ল নিজের জামা খুলে ফেললেন এবং কার্লিকে নির্যাতন করতে শুরু করলেন। এতক্ষণে কার্লি এবং রোন্ডা দুজনই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলো। রোন্ডা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সে কোনোমতে মাথা তুলে হেনলিকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি আসলেই ঘটছে?” হেনলি সম্মতিসূচক উত্তর দিলো। কার্লিও যন্ত্রণায় আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছিলো।
হেনলি রোন্ডাকে অন্য রুমে নিয়ে যেতে কর্লের কাছে অনুমতি চাইলো। কিন্তু কর্ল তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কুকীর্তিতে ডুবে রইলো। হঠাৎ করে হেনলি কর্লের পিস্তলটি কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “তুমি অনেক বেড়ে গিয়েছো ডিন”। কর্ল তার জায়গা থেকে উঠে ধীরে ধীরে হেনলির দিকে এগোতে থাকলে হেনলি আবার পিস্তল উঁচিয়ে বলে উঠলো, “আমি আর এসবের সাথে থাকতে পারবো না। আমার আর কোনো বন্ধুকেই আমি তোমার হাতে খুন হতে দেবো না”। “আমাকে খুন করো ওয়েইন”, বলে ঠান্ডা মাথায় হেনলির দিকে এগোতে থাকলেন ডিন কর্ল। হেনলি নিজেও বুঝতে পারছিলো না কীভাবে সে এই মানুষরুপী দানবের মোকাবেলা করবে। তাই সে কিছুটা পিছু হটলো। এটা দেখে কর্ল চিৎকার উঠলো, “তুমি এটা করতে পারবে না”। কিন্তু কর্লের অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে হেনলি ঠিকই গুলি চালিয়ে বসলো, গুলিটি গিয়ে বিঁধলো কর্লের কপালে। টলে উঠলেন ডিন কর্ল, তারপরও কোনোমতে এগোতে থাকলেন তারই এককালীন সহকর্মীর দিকে। হেনলি থামলো না, সে আবারো পরপর দু’রাউন্ড গুলি ছুঁড়লো। দুটো গুলিই কর্লের বাম কাঁধে আঘাত হানলো। এবার আর তিনি পারলেন না। মাথা ঘুরে রুমের বাইরে গিয়ে পড়লেন। কর্লের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হেনলি তার কাঁধে এবং কোমরের নিচে আরো তিন রাউন্ড গুলি খরচ করলো। রুমের বাইরের হলওয়েতে পড়ে রইলো ডিন কর্লের নিথর দেহ, নগ্ন এবং দেয়ালের দিকে মুখ ঘোরানো অবস্থায়…
বন্ধুদের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো হেনলি। সবাই ঠিকমতো কাপড়চোপড় পড়ে নিলো। সকাল আটটা বেজে চব্বিশ মিনিটে পাসাডেনা পুলিশ অফিসে ফোন দিলো করলো হেনলি। ফোনটি ধরলেন ভেলমা লাইন্স নামে একজন। হেনলি কাঁপা কাঁপা গলায় বোকার মতো বলে বসলো, “আপনারা তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসুন। আমি এইমাত্র একজনকে খুন করেছি।” তারপর পুলিশকে বাসার ঠিকানা দিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগলো তিনজন।
বেশ কয়েক মিনিট পর ২০২০ লামার ড্রাইভে এসে থামলো পুলিশের গাড়ি। তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে কর্লের মৃতদেহ দেখতে পেলো। সেই সাথে উদ্ধার করলো হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা পিস্তলটি। হেনলি নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো যে, কলটি সে-ই করেছিলো। একইসাথে নিজের এবং বন্ধুদের জীবন বাঁচাতে সে যে ছয় রাউন্ড গুলি চালিয়েছে এই কথাটিও সে স্বীকার করে নিলো।
এরপর পুলিশের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলো হেনলি। সে পুলিশকে জানালো যে সে এবং ডেভিড ওয়েন ব্রুকস নামের আরেকটি ছেলে কর্লের সহকারী হিসেবে কাজ করতো। তারা শিকারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। যখন উপযুক্ত কারো সন্ধান পেতো তখন তাকে কর্লের বাসায় পার্টির দাওয়াত দিতো। অপরপক্ষ রাজি হলে গাড়িতে করে তাকে কর্লের বাসায় নিয়ে যেতো তারা। সেখানে গিয়ে মারিজুয়ানা আর বিয়ারের আসর জমিয়ে তুলতো তারা। একসময় শিকার অজ্ঞান হয়ে পড়তো। তখন কাজ শেষ হয়ে যেতো হেনলি আর ব্রুকসের। তারা পেয়ে যেতো তাদের শিকারের জন্য ২০০ ডলার মজুরি (মাথাপিছু)। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন শিকার জ্ঞান ফিরে পেতো, তখন সে নিজেকে কাঠের বোর্ডের সাথে আটকানো অবস্থায় দেখতে পেতো। তার হাত-পা বাঁধা থাকতো, মুখে লাগানো থাকতো স্কচটেপ অথবা ঢোকানো থাকতো কোনো কাপড়ের টুকরা যাতে কোনো শব্দ বের হতে না পারে। কর্ল উচ্চশব্দে তার রেডিওটা চালিয়ে দিতেন যাতে বন্দীর চিৎকারের কোনো শব্দ বাইরে যেতে না পারে। এরপরই শুরু হয়ে যেতো তার পাশবিক নির্যাতন। বন্দীর শারীরিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিলো কর্লের। তাই বোর্ডের নিচে একটা প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে রাখতেন তিনি যাতে বন্দীর বমি, বর্জ্যপদার্থ এবং রক্ত সেই শিটের উপরে গিয়ে পড়ে। অন্যদিকে চলতে থাকতো কর্লের পাশবিক আনন্দ। নির্যাতনের পালা শেষ হলে গলা টিপে অথবা সরাসরি গুলি করে কর্ল তার শিকারদের খুন করতেন।
এতক্ষণ ধরে হেনলির কাহিনী শোনার পর পুলিশ জানতে চাইলো কর্লের প্রকৃত শিকারের সংখ্যা কত সেই সম্পর্কে। ‘ত্রিশ’ কেবল এই শব্দটুকুই উচ্চারণ করেছিলো হেনলি। এতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সেখানে অবস্থিত পুলিশ সদস্যগণ।
এরপর হেনলি আর ব্রুকসকে নিয়ে চলতে থাকে পুলিশের মৃতদেহ উদ্ধারের অভিযান। ব্রুকস আর হেনলি তাদের শিকারকে একটি Ford Econoline অথবা Plymouth GTX গাড়িতে করে কর্লের বাড়িতে নিয়ে আসতো। আর খুন করার পর কর্ল দেহগুলোকে প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে একটি ভাড়া নেওয়া নৌকা রাখার জায়গা, বলিভার পেনিনসুলার একটি সৈকত, স্যাম রেবার্ন লেকের কাছাকাছি একটি বনভূমি অথবা জেফারসন কাউন্টির একটি সৈকতে পুঁতে রাখতেন। খনন কার্য শুরু হলো। একে একে বেরিয়ে আসতে লাগলো মানুষের হাড়গোড়, হাত, পা ইত্যাদি নানা অঙ্গ। দুর্গন্ধে সেখানে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। যারা খনন করছিলো তাদের মাঝে একজন আর মানসিক চাপ সইতে না পেরে ডুকরে কান্না শুরু করে দেন। আরেকজন অনবরত বমি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সাতাশটি মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এদের সবাই ছিলো ছেলে, যাদের বয়স ছিলো ১৩-২০ বছরের মাঝে। সবাইকেই যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করেছিলেন সমকামী সিরিয়াল কিলার ডিন কর্ল।
বন্দী করা হয় হেনলি আর ব্রুকসকে। হেনলিকে সর্বমোট ৫৯৪ বছর কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়! ব্রুকসকেও আজীবন কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়।
ডিন কর্লের হাতে নিহতদের তালিকা
১৯৭০– জেফরি কোনেন, জেমস গ্লাস, ড্যানি ইয়েট্স।
১৯৭১– ডোনাল্ড ওয়ালড্রপ, জেরি ওয়ালড্রপ, র্যান্ডেল হার্ভি, ডেভিড হিলিগিয়েস্ট, গ্রেগরি ম্যালি উইঙ্ক্ল, রুবেন ওয়াট্সন হ্যানে।
১৯৭২– উইলার্ড ব্রাঞ্চ জুনিয়র, ফ্রাঙ্ক অ্যাগুইরে, মার্ক স্কট, জনি ডেলোম, বিলি বাউলচ জুনিয়র, স্টিভেন সিকম্যান, রয় বান্টন, ওয়ালি জে সিমোনাক্স, রিচার্ড হেমব্রি, রিচার্ড কেপ্নার।
১৯৭৩– জোসেফ লাইলস, উইলিয়াম রে লরেন্স, রেমন্ড ব্ল্যাকবার্ন, হোমার গার্সিয়া, জন সেলার, মাইকেল বাউলচ, মার্টি জোন্স, চার্লস ক্যারি কোবল, জেমস স্ট্যান্টন।
পরিশিষ্ট
মজার ব্যাপার হলো- খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ার আগে ডিন কর্ল কিন্তু তার এলাকায় ছোটদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন একটি গুণের কারণে। কর্লের পরিবারের ছিলো চকলেটের ব্যবসা। কর্ল স্থানীয় শিশুদের, বিশেষত কিশোরদের মাঝেমাঝেই বিনামূল্যে চকলেট খেতে দিতেন। এজন্য তারা তাকে ডাকতো The Candy Man এবং The Pied Piper নামে। আর এই জনপ্রিয় মানুষটিই শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়লেন এমন ঘৃণ্য কাজে যা তাকে আমেরিকার অন্যতম কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত করে তুলেছে।