পুরুষের ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এক নারীকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেয়। ষোল শতকের শেষভাগে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের এই ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। চার্চের ভাষ্যমতে, সেই নারী অসামাজিক ও অনারীসুলভ আচরণ প্রদর্শন করেছিলেন। যদিও সেই অভিযুক্ত নারী শুধুমাত্র পুরুষের পোশাক পরিধান করে সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে চেয়েছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর আমেরিকায় কোনো নারীর সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নিয়ম ছিল না। তাই সে সময় সেনাবাহিনীতে নারী হিসেবে অংশগ্রহণ করা আসলে একইসাথে অসম্ভব ও অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে নারীরা আমেরিকার রেভল্যুশনারি যুদ্ধে (১৭৭৫-৮৩) সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও সেবিকা ও রাঁধুনি হিসেবে বিভিন্ন সেনাক্যাম্পে অবস্থান করতেন। তাছাড়া কেউ কেউ সহযোদ্ধা হিসেবে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন।
তবে এর মধ্যে কিছু নারী শুধু সহযোদ্ধা নয়, যোদ্ধা হতে চেয়ে সবার অলক্ষ্যে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পুরুষের ছদ্মবেশে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম ডেবোরা স্যাম্পসন, যার সাহস ও বুদ্ধিমত্তা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছিল। যুদ্ধে যোগদান করার জন্য অবশ্য তাকে তার পোশাক ও নাম পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তিনি অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন। ক্ষণে ক্ষণে পরিচয় ফাঁস হওয়ার শঙ্কা থাকার পরও অবিচল ও অনড় এই নারী অত্যন্ত সফলতার সাথে তার পরিচয় গোপন রেখে যুদ্ধ করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে এমন বিরল সাহসী কাজের জন্য তৎকালীন কংগ্রেস ডেবোরা স্যাম্পসনের সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততার জন্য তাকে বীর যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
জন্ম ও শৈশব
ডেবোরা স্যাম্পসন ১৭৬০ সালের ১৭ ডিসেম্বর, ম্যাসাচুসেটসের ছোট্ট শহর প্লিম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন। স্যাম্পসন দম্পতির ছিল সাত সন্তান। তাদের সবার মধ্যে ডেবোরা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও ডানপিটে প্রকৃতির। ডেবোরার পূর্বপুরুষদের ম্যাসাচুসেটসে অনেক খ্যাতি ছিল। তারপরও স্যাম্পসন পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়, যখন ডেবোরার বাবা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার কোনো সন্ধান মেলে না।
ধরে নেওয়া হয়, সমুদ্রে জাহাজডুবিতে তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু পরে লোকমুখে জানা যায়, তিনি সে যাত্রায় মারা যাননি। বরং তিনি তার স্ত্রী-সন্তানকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে গিয়েছিলেন। তিনি নতুন করে বিয়ে করে মেইন শহরে বসবাস করা শুরু করেছিলেন। এ সময় ডেবোরার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
এ ঘটনার ফলে ডেবোরাদের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে একদম ভেঙে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে নিদারুণ অর্থাভাবে মিসেস স্যাম্পসন তার সন্তানদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রাখা শুরু করেন। আর এভাবে শেষ পর্যন্ত ডেবোরার স্থান হয়েছিল প্রাক্তন মন্ত্রী মেরি প্রিন্স থ্যাচারের বাড়িতে। তার বিধবা স্ত্রী ডেবোরাকে পড়তে শিখিয়েছিলেন। মূলত এ কারণেই ডেবোরার ভেতরে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আর এ আগ্রহ খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে সমবয়সী অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। নানা বাধা থাকা সত্ত্বেও মিসেস থ্যাচারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ডেবোরা স্যাম্পসন শেষ পর্যন্ত পড়তে শিখেছিলেন।
ডেবোরার বয়স যখন দশ, তখন মিসেস থ্যাচার মারা যান। তার পড়াশোনায় তখন সাময়িক বিচ্যুতি ঘটে। এরপর তার স্থান হয় ম্যাসাচুসেটসের মিডলবরোর এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। পরিবারের প্রধান জেরেমিয়াহ থমাস ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক কৃষক। অনুমান করা হয়, তিনিই মূলত ডেবোরার মধ্যে দেশপ্রেমের স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে তাকে ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীতে যোগদানে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু তিনি নারীশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে থমাসের এ অনীহাও ডেবোরাকে স্বশিক্ষিত হতে বাধা দিতে পারেনি। তিনি পড়াশোনার জন্য মিস্টার থমাসের ছেলেদের থেকে বই ধার নিয়ে গোপনে তার পড়াশোনা চালিয়ে যান।
১৭৭৮ সালের দিকে গৃহস্থালিতে সেবিকা হিসেবে কাজের মেয়াদ শেষ হয়। তখন ডেবোরা জীবিকার জন্য শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী গ্রীষ্মে তিনি শিক্ষকতা করেন এবং শীতে তাঁতি হিসেবে কাজ করেন। এ সময় তিনি নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানিয়ে ঘরে ঘরে বিক্রি করতেন। এভাবেই প্রাপ্ত সামান্য অর্থ দিয়ে তিনি নিজেই নিজের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেন।
সেনাবাহিনীতে ভর্তি
আমেরিকার রেভল্যুশনারি যুদ্ধ যখন শেষের দিকে ছিল, তখন ডেবোরা স্যাম্পসন হঠাৎই যুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় কোনো নারীর সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নিয়ম না থাকায় তিনি ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি প্রথমে পুরুষের ব্যবহার উপযোগী কিছু কাপড় কেনেন। সে সময় ডেবোরার বয়স ছিল ২২ বছর, আর উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির মতো। এ উচ্চতা সেসময়ের যেকোনো নারী অপেক্ষা যথেষ্ট বেশি ছিল তো বটেই, এমনকি তার কিছু সমসাময়িক পুরুষ যোদ্ধার থেকেও বেশি ছিল। এছাড়া স্ফীত কাঁধ ও সরু বুকের অধিকারী হওয়ায় ডেবোরার খুব সহজেই এক যুবকের ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম হন।
দুর্ভাগ্যবশত তার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রথম প্রচেষ্টায় তিনি টিমোথি থাইয়ার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সে যাত্রায় তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি মিডলবরো থেকে হাঁটতে হাঁটতে বোস্টন শহরের কাছে পৌঁছান। সেখানে তিনি রবার্ট শ্রুটলিফ নাম ধারণ করেন এবং ম্যাসাচুসেটসের চতুর্থ পদাতিক বাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর প্রাইভেট শ্রুটলিফ আরো ৫০ জন নতুন নিযুক্ত পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন।
পরিচয় ফাঁস
সম্মুখযুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করতে রবার্ট শ্রুটলিফকে অবশ্য বেশি দেরি করতে হয়নি। যুদ্ধে যোগদান করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করেন। তার দল বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। এর মধ্যেই আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনের জন্য রবার্ট শ্রুটলিফ ও তার দলকে নির্বাচিত করা হয়। সে মিশনে তার দল বেশি ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আশানুরূপ ফলাফল লাভ করে এবং বিপজ্জনক সে মিশনে তারা ১৫ জন ব্রিটিশ সৈন্য আটক করতে সক্ষম হন।
৩রা জুলাই, ১৭৮২ তারিখে, টেরিটাউন শহরের বাইরে ব্রিটিশদের সাথে রবার্ট শ্রুটলিফের দলের সরাসরি সংঘর্ষ বাঁধে। এ যাত্রায় শ্রুটলিফ মারাত্মকভাবে জখম হন। তার কপালে তলোয়ারের গভীর ক্ষত ছাড়াও উরুতে দুটি মাস্কেট বল বিদ্ধ হয়। কিন্তু তিনি নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে তার সহযোদ্ধারা খুব অবাক হন। আসলে চিকিৎসাকেন্দ্রে ডাক্তারের কাছে পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এ ভয়েই তিনি তাদের কাছে মিনতি করেন, তারা যেন তাকে যুদ্ধক্ষেত্রেই রেখে যান। এতে করে তিনি যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণের সুযোগ লাভ করতে পারবেন। কিন্তু তার অপারগ সহযোদ্ধারা তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়ার পর দায়িত্বরত ডাক্তার তার কপালের ক্ষতের চিকিৎসা করতে পারলেও উরুতে বিদ্ধ মাস্কেট বল বের করতে পারেননি। তার আগেই রবার্ট শ্রুটলিফ সেখান থেকে পালিয়ে যান। চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিজেই ছোট ছুরি দিয়ে উরু থেকে একটি মাস্কেট বল বের করতে সমর্থ হন। কিন্তু অপর বলটি উরুর বেশি গভীরে থাকায় সেটি আর তার পক্ষে বের করা সম্ভব হয় না। ফলে তিনি পরবর্তী সময়ে একপ্রকার পঙ্গু হয়ে যান এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শেষপর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে জেনারেল জন প্যাটারসনের সেবক দলে নিযুক্ত করা হয়। তবে যুদ্ধ একপ্রকার শেষ হলেও আমেরিকান সৈন্যরা মাঠেই অবস্থান করছিলেন।
১৭৮৩ সালের জুন মাসে, আমেরিকান সৈন্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর জন্য রবার্ট শ্রুটলিফের ইউনিটকে ফিলাডেলফিয়ায় প্রেরণ করা হয়। সেই সময় জ্বরসহ অন্যান্য রোগব্যাধি ফিলাডেলফিয়ায় মোটামুটি সাধারণ বিষয় ছিল। শ্রুটলিফ ফিলাডেলফিয়ায় গিয়েই জ্বরাক্রান্ত হন। অসুস্থ ও অচেতন অবস্থায় রবার্ট শ্রুটলিফকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তাকে ডাক্তার বারনাবাস বিনির তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। চিকিৎসার একপর্যায়ে ডাক্তার রবার্ট শ্রুটলিফের পরিচয় জানতে পারেন এবং তাকে নারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু তিনি তার কমান্ডারের কাছে বিষয়টি রিপোর্ট করার পরিবর্তে তথ্যটি গোপন রাখেন। তাছাড়া তিনি রবার্ট শ্রুটলিফকে সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য তাকে নিজ পরিবারে তার স্ত্রী ও মেয়ের কাছে নিয়ে যান। অতঃপর সেখানে একমাস সেবা শুশ্রুষার পর রবার্ট শ্রুটলিফ ওরফে ডেবোরা স্যাম্পসন সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং পুনরায় সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য ডাক্তারের অনুমতি চান। ডাক্তার তাকে অনুমতি দেন এবং যাওয়ার সময় তার হাতে একটি চিঠি দেন, তার কমান্ডার জেনারেল জন প্যাটারসনকে দেওয়ার জন্য।
জেনারেলকে পাঠানো ডাক্তারের চিঠিটি তার আসল পরিচয় বহন করছে, এটি ভেবে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। চিঠিটি কমান্ডারের কাছে দেওয়ার আগে চিন্তায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। পরে এ বিষয়ে তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন,
“পুনরায় দলে যোগদান করা, কামানের গোলাবর্ষণ মোকাবেলা করার চেয়েও কঠিন।”
কিন্তু বিস্ময়করভাবে চিঠিটি পড়ার পর জেনারেল প্যাটারসন রবার্ট শ্রুটলিফের সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততায় অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তাছাড়া সমসাময়িক কোনো পুরুষ যোদ্ধার প্রতি কোনোরূপ আপত্তিকর ব্যবহার না থাকার বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়। এরপর ২৫শে অক্টোবর, ১৭৮৩ তারিখে, জেনারেল তাকে কোনোরূপ শাস্তি না দিয়ে সসম্মানে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেন। এভাবেই একপ্রকার বাধ্য হয়েই ডেবোরা তার ছদ্মনাম ও পোশাক ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
বিবাহপরবর্তী জীবন
অব্যাহতি পাওয়ার পর ডেবোরা তার নিজ শহর ম্যাসাচুসেটসে ফিরে আসেন। ১৭৮৩ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি বেঞ্জামিন গ্যানেটের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং পরবর্তী সময়ে তার সাথে শ্যারন শহরে বসবাস শুরু করেন। এ দম্পতির ঘরে তিন সন্তান জন্ম নেয় এবং পরে তারা আরও একটি কন্যাসন্তান দত্তক নেন। ডেবোরা বিবাহপরবর্তী জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কৃষিকাজে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন কাজে তার স্বামীকে সাহায্য করতেন। ডেবোরা-গ্যানেট দম্পতি মাঠে যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করতেন, কিন্তু এত পরিশ্রম সত্ত্বেও তাদের সংসারে যথেষ্ট অভাব-অনটন ছিল।
সেই সময় রেভল্যুশনারি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক যোদ্ধা আর্থিক অনুদান পাওয়ার জন্য কংগ্রেস বরাবর আবেদন করেন। এর মধ্যে ডেবোরার পরিচিত বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধাও ছিলেন। তাই ডেবোরা তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য প্রাপ্য পেনশন ও অন্যান্য সুবিধার জন্য কংগ্রেস বরাবর দরখাস্ত করেন। কিন্তু তিনি তার সহযোদ্ধাদের মতো শুধুমাত্র কংগ্রেসে আবেদন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার আবেদন তার অন্য সহযোদ্ধাদের আবেদনের মতো একইভাবে বিবেচিত হবে না।
তাই তিনি তার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতা তিনি দেশের মানুষকে জানাবেন। এভাবে অনেক ভাবনা-চিন্তার পর অবশেষে তিনি একটি আত্মজীবনী লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি হারম্যান ম্যান নামক একজন স্থানীয় লেখকের সাথে যোগাযোগ করেন। এই লেখক তার জীবনী শুনে তার সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হন এবং তার আত্মজীবনী লিখতে রাজি হন।
আত্মজীবনীর লেখার পাশাপাশি তিনি নিজমুখে সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে তার অর্জন তুলে ধরার পরিকল্পনাও করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৮০২ সালে ম্যাসাচুসেটস থেকে নিউ ইয়র্কের পথে যাত্রা শুরু করেন। জনসাধারণের মাঝে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডেবোরা পথিমধ্যে প্রায় সব বড় বড় শহরে যাত্রাবিরতি করেন এবং তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জিত তার নানা রকম অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করতে শুরু করেন। কিছু কিছু সময় তিনি নারী পোশাকে মঞ্চে উঠতেন এবং মঞ্চ থেকে নামতেন সম্পূর্ণ যুদ্ধের পোশাক পরিহিত অবস্থায়। এছাড়া তিনি জনগণের বিশ্বাস ও সমর্থন অর্জনের জন্য যুদ্ধ চলাকালে শেখা নানারকম প্রশিক্ষণের কলাকৌশল প্রদর্শন করতেন।
ফলে নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর আগেই ডেবোরা সকলের মাঝে একজন বীর যোদ্ধার খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু এমন ভ্রমণ বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে তাকে খুব দ্রুতই নিজ শহরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই সম্পূর্ণ ভ্রমণ থেকে তিনি সামান্য কিছু অর্থ লাভ করতে সক্ষম হলেও তার মূল সাফল্য ছিল জনগণের সমর্থন আদায়। তিনি রেভল্যুশনারি যুদ্ধের বেশ কয়েকজন জাতীয় বীরের সমর্থন আদায় করতেও সক্ষম হন এবং যুদ্ধকালীন তার কমান্ডার জন প্যাটারসন তাকে সরাসরি সমর্থন করেছিলেন।
এর ফলে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ডেবোরাকে পেনশনসহ বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করতে মোটামুটি বাধ্যই হয়। তারপরও এই সামান্য অর্থ তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান ভালো করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কেননা, ইতোমধ্যেই তিনি বেশকিছু অর্থ ঋণ করেছিলেন আর এই ঋণ পরিশোধের জন্য তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ছিল না। এছাড়া যুদ্ধে প্রাপ্ত ক্ষতের কারণে শারীরিকভাবে তিনি তার বাকি জীবনে বেশ কষ্টে কাটান।
মৃত্যু
সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে চলা এই নারী শেষপর্যন্ত হার মানেন দারিদ্র্যের কাছে। ৬৬ বছর বয়সে পীতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাভাবে পরিবার তার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এমনকি মৃত্যুর পর তার কবরে হেডস্টোন দেওয়ার মতো অর্থও তাদের ছিল না। এ কারণেই তার কবর দীর্ঘদিন অযত্নে, অচিহ্নিত অবস্থায় লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার কবর চিহ্নিত করা হয় এবং তার কবরে উপযুক্ত সম্মানসূচক হেডস্টোন বসানো হয়।
মৃত্যুর চার বছর পর তার স্বামী কংগ্রেস বরাবর অর্থ সুবিধার জন্য একটি পিটিশন করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে সময়ে ডেবোরা বিবাহিত ছিলেন না। তাই কংগ্রেসের একটি কমিটি ডেবোরার স্বামীর আবেদন নাকচ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কয়েকটি যৌক্তিক কারণ বিবেচনা করে কংগ্রেস বিষয়টি পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের কথা ভাবে। কংগ্রেস ডেবোরার ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীতে যোগাদান করার বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। ফলে কংগ্রেসের একটি কমিটি ১৮৩৭ সালে তার স্বামীকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই অর্থ সাহায্য পাওয়ার আগেই তার স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন।