পুলিকাট: তামিলনাড়ুর ওলন্দাজ দাসবাণিজ্যের কেন্দ্র

চেন্নাই থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই চোখে পড়বে এক ছোট্ট শহর পুলিকাট। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নোনা পানির লেগুন পুলিকাট হ্রদের ধারে অবস্থিত। পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরটিতে বিরল অতিথি পাখি দেখার পাশাপাশি লেগুনে নৌকা ভ্রমণের সুযোগও রয়েছে। প্রতি ঘন্টায় বাসগুলো শহরের সরু রাস্তা দিয়ে দর্শনার্থীদেরকে নিয়ে যায়। জমজমাট মাছের বাজার আর লাউডস্পিকারের জোরালো শব্দঘেরা পুলিকাটকে অন্য উপকূলীয় শহর থেকে আলাদা করার উপায় নেই।  

কিন্তু এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক শহরটির এক অন্ধকার অতীত রয়েছে, যে সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। এই অন্ধকার ইতিহাস ঘেরা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সংঘর্ষ, সমৃদ্ধ হীরার ব্যবসা, চোরাকারবারিদের জাহাজ এবং দাস ব্যবসার সাথে।

ওলন্দাজ দুর্গ

পুলিকাট বাস স্ট্যান্ডের ঠিক পেছনেই লুকানো ছিল ৪০০ বছরের পুরানো দুর্গের ধ্বংসাশেষ, ক্যাসেল গেলড্রিয়া। ভেঙে পড়া ইটের কাঠামো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হবে না সহজে। সাপের ভয়ে কেউ ঝোপঝাড়ের কাছেও যায় না। স্থানীয় এক দোকানদারের মতে, “এটা এখন শুধুই জঙ্গল।

ঝোপঝাড় আর মাটির নিচে চাপা পড়া ক্যাসেল গেলড্রিয়া; Image Credit: Vinita Govindarajan

এই ধসে পড়া দুর্গ একসময় ছিল পরাক্রমশালী ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (ভিওসি) ক্ষমতার কেন্দ্র, যারা ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতে প্রথম পা রেখেছিল। ১৬০৫ সালে বর্তমান অন্ধ্র প্রদেশের মাসুলিপত্তনম, ১৬০৮ সালে তেগেনেপত্তনমের নিয়ন্ত্রণ লাভ করার পর ওলন্দাজরা ১৬১০ সালে পুলিকাটের দিকে নজর দেয়। পুলিকাট তখন কয়েক শতক ধরে পর্তুগিজদের অধীনে। ১৫০২ সালে ভারতের বুকে ট্রেডিং পোস্ট বানিয়ে এই অঞ্চলের বাণিজ্যের অনেকখানি প্রায় এক শতাব্দী ধরে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিশাল সশস্ত্র পালতোলা জাহাজের সাহায্য নিয়ে পর্তুগিজদের সেই আধিপত্যে ভাঙন ধরায় ওলন্দাজরা, তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয় পুলিকাটকে। পুলিকাটকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করোমান্ডেল উপকূলের (ভারতের দক্ষিণাংশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল) রাজধানী বানানো হয়।

ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্মিশন গ্রহণ করছেন হেনরি হাডসন; Image Source: Getty Images

প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পুলিকাট ছিল ওলন্দাজদের প্রশাসনিক ঘাঁটি। এ বন্দরকে কেন্দ্র করেই করোমন্ডেল উপকূল থেকে শত শত হীরা পশ্চিমে রপ্তানি করা হতো। ইন্দোনেশিয়া এবং সিলনের সেটেলমেন্ট থেকে হাজার হাজার ব্যারেলভর্তি জায়ফল, লবঙ্গের মতো মশলা পুলিকাটে ভিড়তো ওলন্দাজ বাণিজ্যরুটের বন্দর হিসেবে। দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে নীল, মরিচ আর মুক্তার বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে ওলন্দাজরা। এছাড়াও পূর্বে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে পুলিকাটে গানপাউডারের কারখানা স্থাপন করে তারা, যা ওলন্দাজদের অস্ত্র আর গোলাবারুদ সরবরাহ করতে থাকে সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে।

তামিলনাড়ুর সাদ্রাজের ওলন্দাজ দুর্গের কামান; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ওলন্দাজরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত পায় তাদের কুখ্যাত দাসবাণিজ্যের কারণেই। ডাচ ভাষায় লেখা কোম্পানির রেকর্ড ব্যতীত, এই দাসবাণিজ্য সম্পর্কে খুব কম তথ্য জানা যায়। উইল ও ডাইক নামের এক গবেষক তার পিএইচডির জন্য ভিওসি-র অনেকগুলো নথি অনুবাদ করেছিলেন। তার গবেষণাপত্রে ডাইক উল্লেখ করেছেন: “১৬২১ সালের জুন থেকে ১৬৬৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের ভিওসি জাহাজে পরিবহন করা ক্রীতদাসদের ‘মাস্টার লিস্ট’-এ মোট ২৬ হাজার ৮৮৫ জন পুরুষ-নারী-শিশু ক্রীতদাসের উল্লেখ রয়েছে, যাদের মধ্যে ১,৩৭৯ জন মারা গিয়েছিলেন।”

দাসবাণিজ্যের রাজধানী

ভারতীয় মহাসাগরজুড়ে ইউরোপীয়দের ক্রীতদাস বাণিজ্যের প্রমাণ খুবই অপ্রতুল। রিচার্ড বি অ্যালেনের ‘ইউরোপিয়ান স্লেভ ট্রডিং ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশান, ১৫০০-১৮৫০’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, “১৫০০-এর দশকে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই ইউরোপীয়দের দাসবাণিজ্য শুরু হয়। পর্তুগাল, ফিলিপিন্সের ম্যানিলা, এমনকি মেক্সিকো পর্যন্ত শত শত ক্রীতদাসকে বড় জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু ওলন্দাজরা পর্তুগিজদেরও ছাড়িয়ে যায়। ১৬২৪ সাল থেকে ১৬৬৫ সালের মধ্যে ওলন্দাজরা আরাকান থেকেই ১১ হাজারের বেশি ক্রীতদাসদেরকে ধরে আনে, যারা এর আগে স্বাধীন হিসেবেই বাস করতো। বাংলাসহ দক্ষিণ ভারতের তেগেনপত্তনম ও কারকালের ওলন্দাজ বসতি থেকেও ক্রীতদাসদেরকে পুলিকাটে এনে বিক্রি করা হতো। ওলন্দাজ মুদ্রায় প্রতি ক্রীতদাসের মালিক হতে খরচ করতে হতো ৪ থেকে ৪০ গিল্ডার। 

পুলিকাটের ওলন্দাজ গোরস্থান; Image Source: Tamilnadu Tourism

ডাইকের মতে, ধরে আনা ক্রীতদাসদেরকে প্রায়ই ৩ ভাগে ভাগ করা হতো: মুসলমান, হিন্দু, এবং ক্যাফার। মূলত কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদেরকেই ‘ক্যাফার’ হিসেবে উল্লেখ করা হতো।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ভারতের কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ কিংবা খাদ্যের ঘাটতি ওলন্দাজদের এই বাণিজ্য আরও বাড়িয়ে দেয়। যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম অত্যধিক বেড়ে যায় এবং দাসদের দামও অনেক সস্তা হয়ে যায়। ডাইক তার ‘সেভেন্টিন্থ সেঞ্চুরি বার্মা অ্যান্ড ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ১৬৩৪-১৬৮০’ বইয়ে লিখেছেন:

দক্ষিণ-পূর্ব করোমান্ডেল উপকূলে ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ডাচদের ক্রীতদাসের প্রতি অতৃপ্ত চাহিদা ভারতের বিভিন্ন অংশে পরিচিতি পায়। দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে মারা যাওয়ার বিকল্প হিসেবে দাসত্বের শিকলে বন্দী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় ওলন্দাজরা। তারা মাদ্রাজে স্থানীয় দালাল নিয়োগ করে, যারা বিপদে পড়া লোকজনদেরকে ক্রীতদাস হওয়ার সুবিধার কথা বলে ফুঁসলাতো। এই দাসবাণিজ্য ওলন্দাজরাই ব্যাপকহারে শুরু করে, যার কেন্দ্র ছিল পুলিকাট। দাসদেরকে পরিবহন করার জন্যেও মাদ্রাজ বন্দর ব্যবহার করা হতো।

ওলন্দাজ সার্জন ভুটার শ্যুটেনের জবানিতে উল্লেখ করা উড়িষ্যায় ওলন্দাজদের সাথে আরাকানিজদের দাসব্যবসা (১৬৬৩); Image Source: Wikimedia Commons

শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং বিদ্রোহও দাস বাণিজ্যের উত্থানে ভূমিকা রাখে। ১৬৪৫ সালে থাঞ্জাভুর, জিঞ্জি এবং মাদুরাইয়ের হিন্দু শাসকরা একত্র হয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। বিজয়নগর সেনাবাহিনীর আক্রমণে থাঞ্জাভুরের উর্বর কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যায়। শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, ফলে করোমান্ডেলেও ক্রীতদাসদের রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। পরের বছরই, প্রায় ২,১১৮ জনকে ক্রীতদাস হিসেবে বাটাভিয়ায় পাঠ্যে দেওয়া হয়, যা এখন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহর। এই ক্রীতদাসদের বেশিরভাগই ছিল করোমান্ডেলের দক্ষিণ উপকূলে থাকা বসতির লোকজন। ডাইক লিখেছেন, তামিলনাড়ু উপকূল বরাবর তোন্ডি, আদিরামপট্টিনম এবং কায়ালপতনম থেকে এসেছিল এই ক্রীতদাসরা।

ওলন্দাজদের জন্য করোমান্ডেলের দাসবাণিজ্যই ছিল তাদের উপনিবেশগুলোতে শ্রমিকের যোগান দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। করোমান্ডেল ক্রীতদাসরা খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল এবং তাদেরকে খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তারা বেশিরভাগই ছিল কৃষি শ্রমিক এবং তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিকের অনুপাতও ছিল যথেষ্ট।

অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ফরাসি এবং ইংরেজদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে ওলন্দাজদের দাসবাণিজ্য।

অ্যালেন তার বইয়ে লেখেন,

ক্রীতদাসদের এই বাণিজ্য এতটাই বেড়ে যায় যে স্থানীয় মোগল প্রতিনিধিদের নজর কাড়ে এটি। মোগলদের চাপে মাদ্রাজের ইংরেজ গভর্নর এলিহু ইয়েল এবং তার কাউন্সিল ১৬৮৮ সালের মে মাসে মাদ্রাজ এবং এর আশেপাশের বন্দরগুলো থেকে ক্রীতদাস কেনা ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করেন। অবৈধভাবে কেনা এবং রপ্তানি করা প্রতি অবৈধ ক্রীতদাসের জন্য ৫০ প্যাগোডা জরিমানার বিধান করা হয়।

পুলিকাটের ওলন্দাজ গোরস্থান; Image Source: Getty Images/Dinodia Photo

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ওলন্দাজদের দাস বাণিজ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে অব্যাহত ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে ভালোভাবে অবগত ছিলেন। অ্যালেনের বই অনুযায়ী, ১৭৯২ সালে, মাসুলিপত্তনমের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা জগারনাটপুরমে তাদের ওলন্দাজ সমকক্ষদের কাছে একটি নোট পাঠান। নোটে লেখা হয়, তারা (ইংরেজরা) তথ্য পেয়েছেন যে ক্রীতদাস বহনকারী জাহাজের ঠিকাদাররা কারখানায় খোলাখুলিভাবে বসবাস করছে, যারা সম্প্রতি ভারত থেকে ৫০০ জনকে ক্রীতদাস হিসেবে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমাদের জানানো হয়েছে যে, আপনাদের জন্য লিখিত পাস মঞ্জুর করা হয়েছে এই শর্তে যে, রপ্তানি করা প্রতিটি ক্রীতদাসের জন্য মাথাপিছু সাত রুপি প্রদান করা হবে।

১৭৮০ এবং ১৭৯০-এর দশকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্রীতদাসবিরোধী মনোভাব (অ্যাবোলিশনিস্ট) বৃদ্ধি পায়। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এবং পুলিকাটের ওলন্দাজদের চিঠিপত্রের চালালচালির পর ধীরে ধীরে দাসবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।

গুটিকয়েক গবেষকের কাজ ব্যতীত পুলিকাটের এই নোংরা অতীত সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ক্যাসেল গেলড্রিয়ার ধ্বংসাবশেষের মতো ভারতে ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক শাসনের ভুলে যাওয়া ইতিহাসের সাথে এটিও চাপা পড়েছে।

This article is in Bangla. It is about Pulicat, the Dutch colonial port on the Coromandel Coast.

References:
1. Slaver’s Bay: The little-known history of Dutch slave trade in a small town in Tamil Nadu - Vinita Govindaranjan - Scroll.in

Related Articles

Exit mobile version