১
শাহজাদা মির্জা মুহাম্মদ হাকিম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৫৩ সালের এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে, কাবুলে। মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন মির্জার দ্বিতীয় এই পুত্রের মা ছিলেন মাহ চুচক বেগম। শাহজাদা মির্জা মুহাম্মদ হাকিম ছাড়াও সম্রাটের আরও এক পুত্র আর তিন কন্যার জননী ছিলেন মাহ চুচক বেগম।
জন্মের পর মাত্র ৩ বছর বয়সে সম্রাট হুমায়ুন মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে কাবুলের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। ৩ বছর বয়সের শিশু তো আর শাসনকাজ চালাতে পারবে না, কাজেই সম্রাট হুমায়ুন তার বিশ্বস্ত জেনারেল মুনিম খানকে মির্জা হাকিমের অভিভাবক হিসেবে কাবুলে রেখে আসলেন।
এরপর ১৫৫৫ সালে তিনি পুনরায় দিল্লি আর আগ্রা বিজয় করে মুঘল সাম্রাজ্যকে একটা স্থায়ী ভিত্তি দিলেন। ১৫৫৬ সালে সম্রাটের মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদে বসলেন। মসনদে বসার সময়ে আকবর নিজেও সামান্য ১৩ বছর বয়সের একজন বালক ছিলেন। আকবরের পক্ষে মূলত মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন বৈরাম খান।
১৫৬১ সালের শুরু দিকে বৈরাম খানের দুঃখজনক পতনের পরও আকবর নিজের হাতে শাসনক্ষমতা বুঝে পেলেন না। পরের দুই বছর মুঘল সাম্রাজ্য শাসিত হলো আকবরের দুধ মা আগার নেতৃত্বাধীন একটি অভিজাত দলের সাহায্যে। এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিন্ন করতে আকবরকে অপেক্ষা করতে হয় ১৫৬২ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত। এরপর আকবর নিজ হাতে পুরো সাম্রাজ্যের দায়িত্ব বুঝে নেন।
এই সুদীর্ঘ সময় কাবুল মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের নামে মুনিম খানের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছিল। কাবুলের গভর্নর মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের বয়স তখনও ১০-এ পৌঁছেনি। বিপত্তি তখনই বাধলো যখন ১৫৬১ সালে মুনিম খান তার পুত্রকে কাবুলের দায়িত্বে রেখে রাজধানীতে আসেন আকবরের সাথে দেখা করতে।
২
কাবুলে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের মা মাহ চুচক বেগম তার পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন। তিনি জানতেন, এভাবে চলতে দিলে হয়তো আজীবন তার পুত্রকে আকবরের অধIনস্থ হিসেবেই কাটাতে হবে। তাই তিনি মুনিম খানের অনুপস্থিতির এই সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করলেন না। নিজের দুই পরামর্শদাতা ফজলে বেগ আর তার পুত্রের পরামর্শে মুনিম খানের পুত্রকে কাবুল থেকে বিতারিত করে তিনি কাবুল দখল করে নিলেন। আকবর কাবুল থেকে এই দুঃসংবাদ পেয়ে মুনিম খানকে কাবুল দখল করতে প্রেরণ করলেন। কিন্তু, জালালাবাদের কাছাকাছি মুনিম খান পরাজিত হয়ে আগ্রা ফিরে এলেন।
এদিকে ততদিনে সম্রাট হুমায়ুনের সময়কার একজন আমির, শাহ আবুল মালি মক্কা থেকে ফিরে কাবুলে মাহ চুচক বেগমের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন। সম্রাট হুমায়ুনের হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সময় গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখায় তিনি পাঞ্জাবের গভর্নর পদটি পেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের প্রধান উজির হওয়ার প্রশ্নে বৈরাম খানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি।
যা-ই হোক, মাহ চুচক বেগম তাকে আশ্রয় দিলেন। শাহ আবুল মালির চোখও ছিলো কাবুলের দিকে। তিনি মাহ চুচক বেগমের মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বিয়ে হয়ে গেলো। এই বিয়ের মাধ্যমে তিনি মাহ চুচক বেগমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু দেখা গেল যত সহজে মাহ চুচক বেগমের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন, ব্যাপারটা তত সহজ না। বরং, মাহ চুচক বেগম রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে শাহ আবুল মালির উপরেই চেপে বসছেন। ১৫৬৪ সালে তাই তিনি নির্মমভাবে মাহ চুচক বেগমকে হত্যা করলেন। কাবুল থেকে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের প্রভাব পুরোপুরিই মিটে যেত, কিন্তু বাদাখশানের তাইমুরি সুলতান সোলায়মান মির্জা মির্জা হাকিমকে পতনের হাত থেকে বাঁচালেন। তড়িৎগতিতে এসে তিনি শাহ আবুল মালিকে পরাজিত করে হত্যা করলেন।
মির্জা মুহাম্মদ হাকিম আবারও কাবুলের ক্ষমতা বুঝে পেলেন। ক্ষমতা পেয়ে এবার তিনি নিজের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে নিজের নামে খুতবা পাঠ করালেন। কাবুলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে আকবর ১৫৬৬ সালে কাবুলে অভিযান চালাতে মনস্থির করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে তিনি আর বেশিদূর অগ্রসর হননি। তবে সম্ভবত ভাইকে উৎখাত করার তেমন কোনো আগ্রহ তার ছিলো না, তিনি মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের একরকম স্বায়ত্বশাসন মেনেই নিয়েছিলেন।
৩
তবে এর ১৪ বছর পর সম্রাট আকবর এবার বাধ্য হলেন কাবুলে যেতে।
আকবর বুঝতে পেরেছিলেন ১৫৭৯ সালে শুরু হওয়া বাংলা-বিহারের এই মুঘল বিদ্রোহ মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে বিরল একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। কোনো মানুষের জীবনে এরকম সুযোগ খুব কমই আসে। বাংলার বিদ্রোহীরা আকবরের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে আকবরের স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছে। মির্জা হাকিম সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত আর বিদ্রোহীরা পূর্ব সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ করে রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করবেন। তারা শুধু একবার রাজধানী দখল করতে পারলেই হলো, আকবরের এতদিনের রাজনৈতিক অর্জন মুহূর্তেই ধসে পড়বে। সম্রাট আকবর এই ঝুঁকি নিতে পারেন না। বাংলার বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কাবুলে থাকা মির্জা মুহাম্মদ হাকিম। তাকে ধ্বংস করতে পারলে বিদ্রোহ এমনিতেই মুখ থুবড়ে পরবে।
এদিকে ইতোমধ্যেই মির্জা মুহাম্মদ হাকিম নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছে। তিনি শাদমান নামে তার এক কমান্ডারকে পাঞ্জাব দখল করতে পাঠালেন। রাজা ভগবান দাসের পুত্র মানসিংহকে এগিয়ে এলেন এই আক্রমন প্রতিহত করতে। দুই পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ন হলে শাদমান পরাজিত ও নিহত হন। শাদমানের কাছ থেকে মানসিংহ মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের ৩টি বার্তা হস্তগত করেন। বার্তা তিনটি দরবারের গুরুত্বপূর্ণ ৩ জনের উদ্দেশ্যে লেখা। মানসিংহ বুঝে গেলেন ভূত আসলে সর্ষের ভেতরেই। মির্জা মুহাম্মদ হাকিম দরবারের ভেতর থেকেই সমর্থন পাচ্ছেন।
ওদিকে শাদমানকে পাঞ্জাব দখল করতে পাঠিয়ে মির্জা মুহাম্মদ হাকিম কাবুলে প্রস্তুতি নিয়েই অপেক্ষা করছিলেন। শাদমানের হাতে পাঞ্জাব পতন হলে তিনি দ্রুত ধেয়ে এসে এগিয়ে যেতেন। শাদমান ব্যর্থ হওয়ায় এখন পাঞ্জাব দখলের দায়িত্ব তার উপরেই বর্তালো। মির্জা হাকিম দ্রুতগামী ১৫,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে পাঞ্জাব বরাবর এগিয়ে আসলেন।
পাঞ্জাবের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজ হাতে তুলে নিতে তাকে রোহতাস দুর্গ দখল করতে হবে। কিন্তু তিনি এজন্য শক্তি ব্যয় করতে চাচ্ছিলেন না। রোহতাস দুর্গের অধিপতিকে তিনি আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানালেন। দুর্গের অধিপতি ইউসুফ খান তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। নিজের মামা ফরিদ উদ্দিনের পরামর্শে মির্জা হাকিম এবার লাহোর অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। তিনি আশা করছিলেন লাহোরের অধিবাসীরা তার সমর্থনে এগিয়ে এসে লাহোর তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু তিনি এখানেও ব্যর্থ হলেন। ভগবান দাস, মানসিংহ আর সাইদ খানের উপস্থিতিতে লাহোর আত্মসমর্পণ করলো না।
৪
মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের সিন্ধু পাড়ি দেওয়ার খবর শুনেই আকবর কাবুলে যাওয়ার ব্যপারে মনস্থির করে ফেললেন। মূল হুমকিটা কাবুল থেকেই। বাংলার দিকে তিনি রাজা টোডর মল, তরসুন খানসহ অন্যান্য অভিজ্ঞ সেনাপতিদের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। বাংলা সীমান্ত তারাই সামলে নিতে পারবেন।
সম্রাট আকবর প্রায় ৫০,০০০ অশ্বারোহী যোদ্ধা আর ৫০০ রণহস্তির শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করলেন, ১৫৮১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে। শাহজাদা দানিয়েলকে রেখে গেলেন রাজধানীর সুরক্ষার জন্য।
সম্রাট আকবর যখন পাঞ্জাবের কাছাকাছি গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন তার কাছে কিছু গোপন চিঠি নিয়ে আসা হলো। চিঠিগুলো যাত্রা পথে যেকোনোভাবেই হোক, মালিক আলী নামের এক মুঘল অফিসারের হস্তগত হয়েছিল। চিঠিগুলো দিউয়ান খাজা শাহ মনসুরের সাথে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের যোগাযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ইতোপূর্বে শাদমানের নিকট থেকেও মানসিংহ কিছু বার্তা উদ্ধার করেছিলেন, যাতে খাজা শাহ মনসুরসহ আরও দুজন মুঘল অভিজাত মির্জা হাকিমের সাথে যোগ দিয়েছেন, এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত এই চিঠিগুলোর জন্য দিউয়ান খাজা শাহ মনসুরকে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়ার জন্য বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এর একদিন পরেই কোট কাচওয়াহারের কাছে একটি গাছের ডালে খাজা শাহ মনসুরের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেক পরে সম্রাট আকবর জানতে পারেন, দিউয়ান খাজা শাহ মনসুরের সাথে জড়িত সবগুলো পত্রই জাল ছিলো। এর অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন শাহবাজ খানের ভাই করম উল্লাহ। করম উল্লাহ আবার অনুগত ছিলেন রাজা টোডর মলের। শেষপর্যন্ত খাজা শাহ মনসুর হত্যাকান্ডের কোনো বিচার হয়েছিলো কি না, তা জানা যায়নি। তবে আকবর পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার খাজা শাহ মনসুরের এই পরিণতির জন্য অনুতাপ করেছিলেন।
৫
মির্জা মুহাম্মদ হাকিম যখন সম্রাট আকবরের পাঞ্জাব আগমনের কথা শুনলেন, তখন তিনি সিন্ধু পাড়ি দিয়ে সোজা কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সম্রাটের মুকাবিলা করার মতো শক্তি আর সাহস কোনোটাই তার ছিল না।
সম্রাট আকবর যে মির্জা হাকিমের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে চাচ্ছিলেন, বিষয়টা এমনও না। এমন হলে দীর্ঘদিন কাবুলে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের আধা স্বায়ত্বশাসন মেনে নিতেন না। কিন্তু মির্জা হাকিম এবার স্বয়ং আকবরকে উৎখাত করে হিন্দুস্তান দখল করে নিতে অগ্রসর হয়েছিলেন। এটা অমার্জনীয় অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমা করা হলে মির্জা হাকিম আবারও একই চেষ্টা চালাবেন। কাজেই তিনি অভিযান চালিয়ে যেতে মনস্থির করলেন।
আকবর দ্রুত পাঞ্জাবের সিরহিন্দ থেকে শতদ্রু আর বিপাশা নদী পাড়ি দিয়ে কালানৌরে গিয়ে ঘাটি গাড়লেন। এরপর কালানৌর থেকে রাভি আর চেনাব অতিক্রম করে রোহতাস দুর্গে গিয়ে পৌঁছালেন। রোহতাস থেকে পরবর্তী গন্তব্য হলো সিন্ধু বরাবর। বর্ষা চলে আসায় সিন্ধুর তীরে আটকে (Attock)-এ প্রায় ৫০ দিন অপেক্ষা করেন তিনি। এই ভেতরেই সম্রাটের ফিরতি যাত্রার সময় সিন্ধুর তীর যেনো শত্রুমুক্ত থাকে, সেজন্য এখানে নির্মাণ করান শক্তিশালী একটি দুর্গ।
পরিস্থিতি অনুকূলে আসলে সম্রাট আকবর শাহজাদা মুরাদের নেতৃত্বে একটি অগ্রগামী বাহিনী পাঠিয়ে দেন। এই বাহিনীতে আরও ছিলেন মানসিংহ, মাধোসিং, শেখ জামাল বখতিয়ার, মখসুস খান ও নৌরঙ্গ খানসহ অনেক বিখ্যাত জেনারেল। শাহজাদা মুরাদ পেশোয়ার দখল করে খাইবার গিরিপথ পাড়ি দিয়ে জালালাবাদ শহর পর্যন্ত নিরাপদ করে ফেললেন।
৬
আকবর জুলাই মাসের ১২ তারিখে সিন্ধু অতিক্রম করেন। কাবুলে সিন্ধুর মোহনায় পুরো বাহিনী একত্রিত হওয়ার মতো সময় দিয়ে আকবর দ্রুত পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মূল সেনাবাহিনী নিয়ে আকবর পেশোয়ারে পৌছান, ৩ আগস্ট শাহজাদা মুরাদ কাবুল নগরীতে প্রবেশ করে নগরীকে নিরাপদ করলেন। কাবুল বরাবর আকবরের অগ্রযাত্রার কথা শুনে মির্জা মুহাম্মদ হাকিম আগেই প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ছোটখাট একটি সংঘর্ষের পর পরাজিত হয়ে কাবুল ছেড়ে পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ৬ দিন পর, ১৫৮১ সালের ৯ আগস্ট তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর পা রাখলেন কাবুলে। মহান বাদশাহ জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের রাজধানী কাবুলে! কত স্মৃতি কত গল্পের সেই শহর কাবুল!
ইতোমধ্যেই কাবুলে আকবর পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তবে কাবুল আকবরের শহর না, আকবরকে ফিরে যেতে হবে নিজের জায়গায়, ফতেহপুর সিক্রিতে। পূর্ব সীমান্তে, সেই বাংলায় মুঘল বিদ্রোহ দুর্বল করা হয়েছে সত্য, কিন্তু বিপদ পুরোপুরি কেটে যায়নি। আকবরের মাথাব্যথার জন্য ১২ ভূইয়ারা তখনও সক্রিয় ছিলেন। তবে মুঘল বিদ্রোহ যে আর শক্তিশালী হবে না, তা নিশ্চিত। বিদ্রোহীদের মূল মানসিক শক্তির যোগানদাতা মির্জা মুহাম্মদ হাকিম খোদ নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজেই এই দিক থেকে আকবর নিরাপদ।
আকবর কাবুল ত্যাগ করবেন। তবে কাবুল ত্যাগের আগে কাবুলের ভাগ্য ঠিক করে যাওয়া উচিত।
৭
আকবর খবর পেয়েছেন মির্জা মুহাম্মদ হাকিম নিজের এলাকা ত্যাগ করে উজবেকদের কাছে যেতে চাচ্ছেন, হয়তো উজবেকদের থেকে সাহায্য নিয়ে কাবুল উদ্ধারের চেষ্টা চালাবেন। সেই উজবেক! উজবেকরা বলতে গেলে মুঘলদের চিরশত্রু। একজন মুঘল শাহজাদা উজবেকদের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবেন, বিষয়টা আকবরের নিজের কাছেই অপমানজনক মনে হচ্ছিল। কাজেই তিনি মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তবে আকবর মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন মির্জা হাকিম বেরিয়ে আসুক, এসে তার সামনে আত্মসমর্পণ করুক। তিনি কাবুলের ভাগ্য মির্জা হাকিমের হাতে ছেড়ে দিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। কিন্তু মির্জা মুহাম্মদ হাকিম ভয়েই হোক বা আত্মমর্যাদার বশেই হোক, পাহাড়ের গভীর থেকে বের হয়ে আসলেন না। বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসতে হলো মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের বোন বখত-উন-নিসা বেগমকে। তিনি বখত-উন-নিসা বেগমের হাতে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলেন। একইসাথে তাকে জানালেন, মির্জা মুহাম্মদ হাকিম চাইলেই কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন, আকবর আপত্তি করবেন না। মির্জা মুহাম্মদ হাকিম আকবরের কোনো ক্ষতি করতে না চাইলে আকবরও মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে কোনো উপদ্রব ছাড়াই কাবুল শাসন করতে দিবেন। তবে যে ভুল মির্জা হাকিম করেছেন, তা যেন আর একবারও না করেন। উভয়পক্ষের জন্যই এটা ভালো হবে।
মোট ৭ দিন কাবুলে অবস্থান করেন। কাবুলের ঝামেলা মিটিয়ে এরপর তিনি ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ১৫৮১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে আকবর তার রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে এসে পৌঁছান। আকবর কাবুল ত্যাগের কিছুদিন পরেই মির্জা মুহাম্মদ হাকিম পাহাড় থেকে নেমে এসে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। তিনি আর কখনোই আকবরকে কোনোভাবে বিরক্ত করেননি।
মির্জা মুহাম্মদ হাকিম ১৫৮৫ সালের ১০ অক্টোবর মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কাবুল শাসন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর কাবুল আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণয় হয়।
৮
সম্রাট আকবরের কাবুল অভিযান ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত, মাত্র ১০ মাসের। এই অভিযানে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো যুদ্ধও হয়নি। তবে এই অভিযানটি আকবরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো। আকবর সাম্রাজ্যের দুই দিক থেকে একইসাথে আক্রান্ত হতে যাচ্ছিলেন। পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলা সীমান্ত থেকে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি ছিল, কিন্তু আকবর এটাও অনুধাবন করলেন যে বাংলায় মুঘল বিদ্রোহীদের মূল শক্তি নিহিত আছে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের মাঝে। কাজেই তাকে দমন করতে পারলেন বাংলার বিদ্রোহ এমনিতেই মিটে যাবে। হয়েছিলও তা-ই। মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে দমন করার সাথে সাথে বাংলার বিদ্রোহী মুঘল অফিসারদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]