
১৫২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। পানিপথের প্রান্তরে বাদশাহ বাবরের ঐতিহাসিক বিজয়ের কিছুদিন পরেই স্বাধীন রাজ্য গুজরাটে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এসময় গুজরাটের মসনদে বসেন মুজাফফরি রাজবংশের শাসক সুলতান কুতুবউদ্দিন বাহাদুর শাহ। দুর্দান্ত সাহসী, দক্ষ যোদ্ধা এবং প্রশাসক বাহাদুর শাহ মানুষ হিসেবে যথেষ্ট উদার ছিলেন। আর সেই সাথে তার ছিল বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

গুজরাটের বাহাদুর শাহ; Source: historydiscussion.net
মসনদে বসেই তিনি মুজাফফরি সালতানাতকে বিস্তৃত করতে চাইছিলেন। সেই লক্ষ্যে নতুন সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর একে একে মালব, ভিলসা, উজ্জয়িনী, রায়সীন দখল করে নেন। একপর্যায়ে তিনি এতটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে যান যে মুঘল সালতানাতের দিকেও তিনি হাত বাড়িয়ে বসেন। এর সাথে সাথেই তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন।
মুঘল সালতানাতের মসনদে তখন বাবরপুত্র নাসরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন। তিনি বুঝে গেলেন বাহাদুর শাহের সাথে তার সংঘর্ষ অনিবার্য। বাহাদুর শাহকে বাঁধা দিতে এগিয়ে এলেন তিনি। ১৫৩৫ সালের শুরুর দিকে ঘাটি গাড়লেন বাহাদুর শাহের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে ১৫৩ কিলোমিটার দূরের সারাংপুরে। প্রথমেই তিনি যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মালব আর উজ্জয়িনীতে নিজের প্রভাব বিস্তার করলেন। বাহাদুর শাহ তখনো চিতোর অবরোধে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। অবশ্য তিনি হুমায়ুনের অভিযানের কথা ইতোমধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন।

আহমেদাবাদের ভদ্রা দুর্গ। ১৪১১ সালে সুলতান নাসিরুদ্দিন আহমদ শাহ আহমেদাবাদে এই দুর্গটি তৈরি করেন। ছবিটি ১৮৭২ সালে তোলা; Source: Wikimedia Commons
১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ চিতোর দুর্গের পতন ঘটলে বাহাদুর শাহ বাদশাহ হুমায়ুনের সাথে বোঝাপড়া করতে এগিয়ে আসেন। মন্দসৌরে উভয় বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে কয়েকদিন পড়ে থাকে। ১৫৩৫ সালের ২৫ মার্চ মুঘল সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বাহাদুর শাহ মন্দসৌর ছেড়ে মাণ্ডু দুর্গে আশ্রয় নেন। তবে বাদশাহ হুমায়ুনের আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়ে তাকে মাণ্ডু দুর্গও ছাড়তে হয়।
বাদশাহ হুমায়ুনের তাড়া খেয়ে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ এরপর প্রথমে আহমেদাবাদ এবং পরে চাম্পানীর দুর্গে গিয়ে পৌছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে এই দুর্গটিতে গুজরাটের রাজকোষ সঞ্চয় করে রাখা হতো। অনেক আগে থেকেই কৌশলগত দিক দিয়ে এই দুর্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

চাম্পানীর দুর্গের একাংশ; Source: gujarattourism.com
হুমায়ুন মাণ্ডুতে তিন দিন অবস্থান করেন। এরপর প্রায় ৩০ হাজার অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে বাহাদুর শাহকে ধাওয়া করতে করতে আহমেদাবাদ শহরে এসে পৌঁছান। আহমেদাবাদে অবস্থান দীর্ঘ না করে হুমায়ুন দ্রুত চাম্পানীরে গিয়ে পৌছলেন। অভিযানে হুমায়ুনের দ্রুততার সংবাদ পেয়ে বাহাদুর শাহ রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন। কারণ বাদশাহ হুমায়ুন প্রায়ই তার অভিযানগুলোতে ধীরগতি প্রদর্শন করতেন। মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন কোনো জায়গায় ঘাটি গেড়ে বসে থাকতেন। কিন্তু বাহাদুর শাহকে ধাওয়া করার সময় হুমায়ুন তার চিরাচরিত আচরণ প্রদর্শন না করে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে আসছিলেন।

চাম্পানীর ‘শহর কি মসজিদ’; Source: blog.zerogravitycommunications.com
বাহাদুর শাহ চাম্পানীর দুর্গে দীর্ঘদিন অবস্থান করার মতো রসদভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু হুমায়ুনের এই বেপরোয়া আচরণে ভড়কে যান তিনি। বুঝতে পারেন, হুমায়ুনের হাত থেকে চাম্পানীরও রক্ষা করতে পারবেন না। ১৫৩৫ সালের ১৯ মে মাত্র ২০০ সৈন্য নিয়ে চাম্পানীর ত্যাগ করে কম্বের দিকে চলে যান তিনি। যাবার আগে তিনি রাজকোষ আর হেরেমের নারীদের আসদ খাঁর মাধ্যমে দিউ দুর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এরপর দুর্গটি যে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। পাহাড়ের এই নগরটি মুহম্মাদাবাদ চাম্পানীর নামে পরিচিতি।

১৮৭৯ সালে অঙ্কিত চাম্পানীরের একটি তৈলচিত্র; Source: Wikimedia Commons
মুঘল বাদশাহ হুমায়ুন নগরে প্রবেশ করে প্রথমেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করেন। এরপর চাম্পানীর দুর্গ অবরোধ করেন। বাহাদুর শাহের পলায়নের সংবাদ জেনে ২০ হাজার সৈন্য দুর্গ অবরোধে নিয়োজিত করে বাকি সৈন্য নিয়ে বাহাদুর শাহের পিছু নেন। হুমায়ুন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাহাদুর শাহকে ধাওয়া করছিলেন, কিন্তু তার নাগাল পেলেন না।
বাহাদুর শাহ কম্বেতে প্রায় ১০০টি জাহাজের একটি নৌবহর গঠন করেছিলেন, যাতে পর্তুগীজ জলদস্যুদের সমুদ্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায়। কিন্তু হুমায়ুনের কম্বে যাত্রার সংবাদ শুনে তিনি দোটানায় পড়ে গেলেন। তিনি না পারবেন এতো দ্রুত এই বিশাল সংখ্যক জাহাজ সরিয়ে নিতে, আবার না পারবেন এগুলো কম্বেতে ফেলে যেতে। তাতে জাহাজগুলো মুঘলদের হাতে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই তিনি সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজটিই করলেন। কম্বে ত্যাগ করার পূর্বে ১০০টি জাহাজ আগুনে পুড়িয়ে দিলেন। এরপর দিউ-এর দিকে চলে গেলেন।
হুমায়ুন ও বাহাদুর শাহের অভ্যন্তরীণ রেষারেষির কবলে পড়ে জাহাজগুলোকে ধ্বংস হতে হলো। কে জানে হয়তো ভবিষ্যতে এই জাহাজগুলো দিয়েই সমুদ্র থেকে ঘৃণ্য পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎখাত করা সম্ভব হতো।

দিউ দুর্গের একাংশ; Source: chinmaye.com
এদিকে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে ধাওয়া করে কম্বেতে পৌছালেন। কিন্তু এরপর আর তার পিছু নিলেন না। কারণ চাম্পানীরে তখনো মুঘল যোদ্ধারা দুর্গটি অবরোধ করে বসে ছিল। ফলে তার হাতে খুব বেশি সৈন্য ছিল না। কম্বে থেকে আরো এগিয়ে তিনি তার মূল সেনাবাহিনী থেকে আলাদা হতে চাইছিলেন না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই তিনি গুজরাট, মালব, চাম্পানীর আর মাণ্ডুসহ বাহাদুর শাহের বিশাল এক ভুখণ্ড পদানত করে ফেলেছেন। এসব ভূখণ্ডের প্রশাসনিক কাজকর্ম গুছিয়ে নেয়ার জন্যও কিছুটা সময় প্রয়োজন।
হুমায়ুন কম্বেতে কিছুদিন অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্তে বাহাদুর শাহের দুই আমির মালিক আহমেদ লাড আর রুকন দাউদ খুশি হলো। তারা হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বাহাদুর শাহের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করল। ‘গাওয়ার’ আর ‘কোলী’ নামক দুটি বন্য জাতিগোষ্ঠীর যোদ্ধাদেরকে তারা মুঘলদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। রাতের আধারে এই বন্য যোদ্ধারা মুঘল ছাউনির উপরে আছড়ে পড়ল।
হুমায়ুন এই আক্রমণের খবর আগেই পেয়েছিলেন, কিন্তু কম্বেতে তিনি খুব অল্প সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ফলে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনী আক্রমণ ঠেকাতে পারলেও লুটপাটের শিকার হলো ঠিকই। বন্য জাতির এই যোদ্ধারা মুঘল শিবিরের মূল্যবান জিনিসপত্র দেখে লোভ সামলে রাখতে পারেনি, তারা যুদ্ধের চেয়ে লুটপাট করতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল।
গাওয়ার আর কোলীদের এই আক্রমণে মুঘল সেনাবাহিনীর অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও হুমায়ুনের সাথে থাকা বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এসব গ্রন্থের মাঝে মোল্লা সুলতান আলীর হস্তাক্ষরে লিখিত ও উস্তাদ বিহজাদ কর্তৃক চিত্রিত ‘তাইমুরনামা’ও ছিল। পরে অবশ্য এসব গ্রন্থ পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।
কম্বেতে মুঘল সেনাবাহিনীর উপর এই আক্রমণে হুমায়ুন বেশ বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি কম্বেতে আগুন লাগিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। এরপর মুঘল যোদ্ধারা কম্বেতে অবাধ লুটপাট চালাল। কম্বে ত্যাগ করে হুমায়ুন দ্রুত চাম্পানীরে ফিরে এলেন। চাম্পানীর অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী করার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না। তাই অবরোধের দায়িত্ব তিনি সরাসরি নিজের হাতে তুলে নিলেন।

চাম্পানীর জামে মসজিদ; Source: Wikimedia Commons
চাম্পানীর ত্যাগের সময় বাহাদুর শাহ দুর্গের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাজা নরসিংহ দেবের কাছে। হুমায়ুন অবরোধের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে সরাসরি আক্রমণ চালালেন। দুর্গ থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধ করা হলো। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত হওয়ায় হুমায়ুন সরাসরি আক্রমণ করে তেমন কোনো ফলাফল না পেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবরোধ শক্ত করলেন। তবে হুমায়ুনের প্রাথমিক আক্রমণেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজা নরসিংহ দেব মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর দুর্গের দায়িত্ব এসে পড়ে তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ইখতিয়ার খাঁ এর উপর। বাদশাহ হুমায়ুন কোনোভাবেই দুর্গে রসদ পৌছানোর সুযোগ দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু তারপরেও দুর্গের চারপাশে থাকা জঙ্গলের আড়াল নিয়ে ঠিকই রসদ সহায়তা পৌছাচ্ছিল। এমনই একটি রসদ সরবরাহকারী দল মুঘল যোদ্ধাদের কাছে ধরা পড়ল। জেড়ার মুখে তারা দুর্গে রসদ সরবরাহের রাস্তাটি দেখিয়ে দিল।
হুমায়ুন স্বশরীরে দুর্গে প্রবেশের গোপন রাস্তাটি পরিদর্শন করলেন। তবে এই রাস্তাটি দিয়ে আক্রমণ মোটেও সহজ নয়। এই রাস্তা দিয়ে আক্রমণ চালাতে হলে প্রায় ৬০-৮০ ফুট উঁচু দেয়াল টপকে দুর্গের ভেতরে ঢুকতে হবে। তবে বেপরোয়া হুমায়ুন পিছপা হলেন না। তার নির্দেশে প্রায় ৮০টির মতো মোটা ও লম্বা পেরেক নিয়ে আসা হলো। পেরেকগুলো গোপন রাস্তার প্রাচীরের গায়ে এক ফুট ব্যাবধানে বসানো হলো। এরপর এক এক করে বাছাই করা বেশ কিছু মুঘল সৈন্য এই পেরেকদ্বারা তৈরি সিঁড়ি ব্যাবহার করে দেয়াল টপকে দুর্গে প্রবেশ করলো। স্বয়ং হুমায়ুন এই দলটির সাথে ছিলেন। তার সাথে ছিল তার বিশ্বস্ত অনুসারী বৈরাম খাঁ।
গোপন এই অপারেশনটি পরিচালনা করার সময় যাতে দুর্গ প্রতিরোধকারীদের মনোযোগ এই দিকে সরে না আসে, সেকারণে দুর্গের সামনের দিক থেকে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। অন্যদিকে দুর্গের দেয়াল টপকে একে একে প্রায় ৩০০ সৈন্য নিয়ে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করেন স্বয়ং হুমায়ুন। মুঘল সৈন্যরা দ্রুতই দুর্গের প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলে শুরু হয় তুমুল লড়াইয়ের। শেষপর্যন্ত মুঘলরা দুর্গের প্রধান ফটক দখল করে খুলে দিতে সক্ষম হয়। স্রোতের বেগে মুঘল সৈন্যরা প্রবেশ করতে থাকেন। দুর্গের কমান্ডার ইখতিয়ার খাঁ বুঝে যান এই দুর্গ আর রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব না। তিনি হুমায়ুনের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন।
দুর্গ পতনের পর হুমায়ুন রাজকোষের দখল নিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি তার পদস্থ আমির আর সৈন্যদের মাঝে সম্পদের বন্টন করে দিলেন। তবে কথায় আছে, সম্পদ বিলাসিতা ডেকে আনে, আর বিলাসিতা ডেকে আনে ধ্বংস। বিপুল পরিমাণ সম্পদ হস্তগত হওয়ার পর হুমায়ুনের উচিত ছিল, অভিযান আরো শক্তহাতে পরিচালনা করা। তাতে মোটের উপর মুঘল সাম্রাজ্যেরই লাভ হতো। কিন্তু তিনি তার সেই চিরাচরিত স্বভাবে ডুব মারলেন। বিপুল পরিমাণ সম্পদ কাজে না লাগিয়ে তিনি বিলাসিতায় মেতে রইলেন।

বাদশাহ হুমায়ুন; Source: Wikimedia Commons
রাজা বিলাসিতায় মেতে রইলে যা হয়, এক্ষেত্রে তা-ই হলো। হুমায়ুনের সাথে সাথে তার সব আমির আর জেনারেলরাও বিলাসিতায় গা ভাসালেন। তবে বিলাসিতায় গা ভাসানোর আগে অন্তত তিনি একটি কাজের কাজ করেছিলেন। চাম্পানীর থেকে তিনি নিজের নামে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু কোনো রাজ্য জয় করার পর প্রধান যে কাজ থাকে, তা হলো সেই জায়গায় নিজের প্রসাশন গুছিয়ে নেয়া। বিলাসিতায় গা ভাসানো হুমায়ুন এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে ভুলে গেলেন।
এদিকে হুমায়ুনের অমনোযোগীতার ফলে গুজরাটে তার বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ের কোনো ব্যাবস্থাই করা হলো না। আর গুজরাট পদানত হলেও গুজরাটের জনগণ তখনো বাহাদুর শাহকে ভালোবাসতো আর তার প্রতিই অনুগত ছিল। তারা বাহাদুর শাহের কিছু কর্মচারীকে দিউতে অবস্থান করা বাহাদুর শাহের কাছে পাঠিয়ে দিলো রাজস্ব আদায়ের অনুমতি নেয়ার জন্য। ইতিহাসে সম্ভবত এমন ঘটনা প্রথমই ঘটলো, যেখানে রাজ্যের জনগণ আগ্রহ নিয়ে রাজস্ব আদায় করে দিতে চাইছিল!
প্রতিনিধি দল অনুমতি প্রার্থনা করলে বাহাদুর শাহ তার আমিরদের মধ্য থেকে কাউকে গুজরাটে গিয়ে রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব করলেন। কিন্তু কেউই মুঘলদের ভয়ে রাজী হলো না। শেষ পর্যন্ত ইমাদ উল মুলক নামে বাহাদুর শাহের এক আমির রাজি হলেন। তবে তিনি একটি শর্ত দিলেন। তিনি বললেন,
“এই কাজ করতে আমি রাজি আছি, কিন্তু শর্ত হলো প্রয়োজনমতো অর্থ ব্যয় করার অধিকার আমাকে দিতে হবে। এই কাজের জন্য নিয়োগকৃত লোকদের জন্য কৃত ব্যয়ের কোনো হিসাব নেয়া যাবে না। এই ব্যয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকবে, তা সুলতানের জন্য অবশ্যই রাজকোষে জমা করে দেয়া হবে।”

দিউ দুর্গের একাংশ; Source: chinmaye.com
বাহাদুর শাহ ইমাদ উল মুলকের সব শর্ত মেনে নিয়ে কিছু সৈন্যসহ তাকে রাজস্ব আদায় করতে প্রেরণ করলেন। দ্রুতই গুজরাটে এই সংবাদ রটে গেলো। ইমাদ উল মুলকের কাছে চারপাশ থেকে গুজরাটি সৈন্যরা ছুটে আসতে লাগলো। তিনি যখন আহমেদাবাদের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করলেন, তখন পথেই তার সৈন্যসংখ্যা প্রায় দশ হাজারে গিয়ে ঠেকল। আহমেদাবাদের জুনাগড়ে হাকিম মুজাহিদ খাঁর নেতৃত্বে তার বাহিনীতে আরো দশ হাজার অশ্বারোহী এসে যুক্ত হলো। বেতওয়া পৌছাতে পৌছাতেই তার বাহিনীর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে গিয়ে ঠেকলো।
ইমাদ উল মুলকের মাধ্যমে গুজরাট থেকে হুমায়ুনকে তাড়িয়ে দেয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিল। বাহাদুর শাহ আশাবাদী হয়ে উঠলেন। এদিকে গুজরাটের মাটিতে ইমাদ উল মুলকের সগৌরবের মার্চ দেখে মুঘল বাদশাহ হুমায়ুন হুশ ফিরে পেলেন। তরদী বেগকে চাম্পানীর দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তিনি দ্রুত আহমেদাবাদের দিকে ছুটে এলেন।

দিউ দুর্গের স্থায়ী কামানগুলো। সমুদ্র থেকে আসা যেকোনো হুমকি মোকাবেলার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতো এগুলো; Source: Wikimedia Commons
১৫৩৫ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে মাহমুদাবাদ আর নারিয়াদের মধ্যবর্তী মহেন্দ্র নদীর তীরে মুঘল সেনাবাহিনী ইমাদ উল মুলকের নেতৃত্বাধীন বাহিনীটির মুখোমুখি হলো। হুমায়ুন আসকারি মির্জার নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। গুজরাটের সৈন্যরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে আসছিল। এমনকি আসকারি মির্জা যুদ্ধবিন্যাসে যাওয়ার আগেই গুজরাটিরা আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়।
আসকারি মির্জা বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিনি তার যোদ্ধাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশেপাশে আড়াল নিতে বললেন। সত্যিকার অর্থে, যুদ্ধ শুরুর আগেই আসকারি মির্জা পরাজিত হলেন। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গুজরাটিদের ভাগ্যে পরাজয়ের চিহ্ন একে দিল। আসকারি মির্জার পলায়নের পর গুজরাটিরা মুঘল শিবির থেকে সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ভেতরেই যে তাদের ঘাড়ের উপর কাসিম হুসাইন খাঁ, মীর হিন্দু বেগ আর ইয়াদগার মির্জার নেতৃত্বে আরেকটি মুঘল সেনাবাহিনী এসে নিঃশ্বাস ফেলছে, সেদিকে তাদের খেয়াল ছিল না।
এদিকে নতুন এই বাহিনী দেখে আসকারি মির্জাও সামনে এগিয়ে এলেন। সাথে তার যোদ্ধারা। দুটি বাহিনী এক করে তিনি গুজরাটিদের উপর ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করলেন। গুজরাট সেনাবাহিনীর দুই হাজার যোদ্ধা সেখানেই মারা পড়ল। আকবরনামাতে এই সংখ্যা ৩-৪ হাজার উল্লেখ করা হয়েছে। বিশাল সংখ্যক সৈন্য মারা যাওয়ার পর অবশিষ্ট গুজরাটি সৈন্যরা যে যার বাড়ির পথ ধরল। মুঘল সেনাবাহিনীর হাত থেকে গুজরাট পুনর্দখল করা তো দূরের কথা, এই পরাজয়ের ফলে আহমেদাবাদ আর পাটন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসলো।
এ যুদ্ধে যদিও মুঘলদের তুলনায় গুজরাটিরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কিন্তু তারপরও বিগত পরাজয়গুলো তাদের মনে যে তীব্র মুঘল ভীতির জন্ম দিয়েছিল, তার প্রতিফলন হলো এই যুদ্ধটির মাধ্যমে। তারপরও, সামান্য সম্পদের লোভ সামলাতে পারলে নিঃসন্দেহে গুজরাটের সৈন্যরা এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করতো। কিন্তু সম্পদ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, গুজরাটি সৈন্যরা কথাটি আবারও প্রমাণ করে দেখাল।
মাহমুদাবাদের এই যুদ্ধে বিজয় লাভের পর হুমায়ুন আহমেদাবাদের এক মাইল দক্ষিণ-পূর্বে গিয়ে ছাউনি ফেললেন। আহমেদাবাদে প্রবেশ করলে তার বাহিনীর যোদ্ধারা শহরটিতে অবাধে লুটপাট চালাতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে তিনি মূল সেনাবাহিনীকে তৎক্ষনাৎ শহরে প্রবেশ করতে দিলেন না। কেবল আসকারি মির্জা আর তার কিছু যোদ্ধা শহরে প্রবেশের অনুমতি পেলেন।
আহমেদাবাদে প্রবেশ করে হুমায়ুন আসকারি মির্জাকে গুজরাটের প্রাদেশিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করলেন। সমগ্র গুজরাটকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একজন করে আমির নিয়োগ দেয়া হলো। এই ভাগাভাগিতে ইয়াদগার নাসির পেলেন পাটন, ইশাক বেগ আকা পেলেন কম্বে আর বারোদা, কাসিম হুসাইন সুলতান পেলেন সুরাত, নওসারি আর ভরৌচ, মীর বুচকা বাহাদুর পেলেন মাহমুদাবাদ, আর তরদী বেগ চাম্পানীরেই বহাল থাকলেন।
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫
২। State and Locality in Mughal India: Power Relations in Western India, C.1572-1730, Farhat Hasan
৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩
৪। The Indian Ocean in the Making of Early Modern India, Edited by: Pius Malekandathil
৫। Medieval India: From Sultanat to the Mughals Part – II, Satish Chandra
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল || ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons