নিজ দেশ থেকে বহু মাইল দূরে অচেনা দ্বীপে আটকে পড়েছিলেন তারা। কারো পড়েছিল খাবারের অভাব, কেউ বিক্রি হয়েছিলেন দাস হিসেবে, কেউ কেউ আবার দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ হতে বসেছিলেন। কিন্তু এই অবস্থা থেকেও বেঁচে ফিরে এসেছেন তারা। কেউ কেউ আবার সেই অচেনা দ্বীপকেই বানিয়ে ফেলেছেন নিজের নতুন আবাসস্থল। আজকের লেখা এমনই কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনী নিয়ে।
সত্যিকারের রবিনসন ক্রুসো
In an ill hour, I went on board a ship bound for London.
“এক দুর্ভাগা দিনে লন্ডনের উদ্দেশ্যে এক জাহাজে চড়েছিলাম।” এই কথাগুলো দিয়ে একটি জনপ্রিয় গল্পের বই শুরু হয়েছিল। বইটির নাম ‘রবিনসন ক্রুসো’। ড্যানিয়েল ডেফোর এই উপন্যাসটি অবশ্য বিখ্যাত স্কটিশ নাবিক আলেক্সান্ডার সেলকার্কের সত্যিকারের অ্যাডিভেঞ্চারের কাহিনী নিয়ে রচিত। প্রশান্ত মহাসাগরের এক দুর্গম দ্বীপে ৪ বছর কাটিয়ে বেঁচে ফিরে আসার পর সেলকার্ক এই কাহিনী শুনিয়েছিলেন।
১৭০৪ সালে কেপ হর্নের কাছাকাছি সিংক পোর্ট নামের এক জাহাজে নেভিগেট করছিলেন সেলকার্ক। হঠাৎ ধেয়ে আসলো বিপর্যয়। জাহাজের ক্রুরা আক্রান্ত হলেন প্লেগ রোগে। খাবার পচে নষ্ট হতে লাগলো। জাহাজের কাঠগুলোতে পোকা ধরে গেল। অবশেষে প্রশান্ত মহাসাগরের হুয়ান ফার্নান্দেজ নামক দ্বীপে নোঙর ফেলা হলো কিছুদিনের জন্য। উদ্দেশ্য বিশ্রাম এবং খাদ্য সংগ্রহ।
সেলকার্ক প্রস্তাব দিলেন, জাহাজের আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য জাহাজের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন বেঁকে বসলেন। দুইজনের মধ্যে তর্কাতর্কি একসময় হাতাহাতিতে রূপ নিলো। কোনো খাবার কিংবা পানি ছাড়াই জোর করে দ্বীপের একাংশ ‘মাস এ তিয়েরা’য় ফেলে আসা হলো সেলকার্ককে। সৈকত থেকে প্রাণপণে চিৎকার করে মাফ চাইতে লাগলেন সেলকার্ক। কিন্তু নির্দয় ক্যাপ্টেনের মন গললো না তাতে। বাকি ক্রুরাও উপেক্ষা করলেন তার আকুতিকে।
হুয়ান ফার্নান্দেজ থেকে পালানো এক কথায় অসম্ভব। কাছাকাছি দ্বীপটি ছিলো প্রায় ছয়শো মাইল দূরে, অথৈ সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে যাবার আশাই দূরাশা। ভাগ্য ভালো, সেলকার্ক সহজেই ঝর্ণা খুঁজে বিশুদ্ধ পানির অভাব মেটালেন। তাছাড়া দ্বীপটিতে নানাধরনের ফলগাছে ভরা ছিল। হাত বাড়ালেই ধরা যেত নানা ধরনের মাছ। শুরুতে চরম নিঃসঙ্গতায় অবশ্য পাগল হবার দশা হয়েছিল সেলকার্কের।
এদিকে দ্বীপের বড় বড় ইঁদুরগুলো রাতে গায়ের কাপড় কাটতে গিয়ে বারবার ঘুম ভাঙিয়ে দিতো তার। বুদ্ধি করে বিড়াল পোষা শুরু করলেন। এছাড়াও তার সঙ্গী ছিল ছাগলের পাল। নিজেকে অন্যমনস্ক রাখার জন্য তাদের সাথে নেচেগেয়ে সময় কাটাতেন সেলকার্ক!
এভাবে একাকী ৫২ মাস কাটানোর পর দ্বীপে এসে ভিড়লো ব্রিটিশ জাহাজ ‘ডিউক’। ক্যাপ্টেন উডস রজারের নেতৃত্বে চলা ঐ জাহাজের উদ্দেশ্য ছিলো জলদস্যুদের খুঁজে বের করা। ডিউকের নাবিকেরা খাবার পানির খোঁজে দ্বীপের কাছাকাছি এসে লাফাতে লাফাতে আগুন ধরানো গাছের ডাল নাড়তে থাকা এক অর্ধপাগলের দেখা পান। সেলকার্ক তখন লজ্জা নিবারণ করছিলেন কেবলমাত্র ছাগলের চামড়া দিয়ে।
বেঁচে ফেরার পর লোকালয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি। আগে যে নির্জনতাকে অসহ্য লাগতো। পরে সেটারই অভাব অনুভব করতেন বারবার। রবিনসন ক্রুসো প্রকাশিত হবার দুইবছর পর ১৭২১ সালে সেলকার্ক মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে মাস এ তিয়েরার নামকরণ করা হয় ‘রবিনসন ক্রুসো আইল্যান্ড’।
যে স্প্যানিয়ার্ড লড়েছিলেন স্পেনেরই বিরুদ্ধে
আলেক্সান্ডার সেলকার্কের মতো নির্জন দ্বীপে নয়, বরং জাহাজডুবির পর একটি জনবহুল দ্বীপেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ১৬ জন স্প্যানিয়ার্ড। ১৬ জন হলেও কী হবে, তাদের পরিস্থিতি সেলকার্কের চেয়েও খারাপ ছিল। কেননা তাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল দ্বীপের আদিবাসী মায়ানদের সাথে। বাকি পৃথিবী তখনই প্রথম পরিচিত হয় মায়া সভ্যতার সাথে।
১৫১১ সালে ইউকাতান পেনিনসুলা নামের এক স্প্যানিশ জাহাজ মেক্সিকোর দক্ষিণ-পূর্বে গিয়ে ডুবে যায়। জায়গাটি ছিল পানামার কাছাকাছি। বেঁচে যাওয়া ১৬ জন স্প্যানিয়ার্ড ভাসতে ভাসতে চলে যান অচেনা এক দ্বীপে। বর্তমানে দ্বীপটি ‘কুইনটানা রু’ নামে পরিচিত। তবে দ্বীপে তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। মাত্র দুজন বাদে সবাইকেই উৎসর্গ করে দেয়া হয়েছিল মায়ান দেবতাদের কাছে!
বেঁচে যাওয়া একজন, গঞ্জালো গুয়েরো বিয়ে করেন উচ্চ-বংশীয় এক মায়ান নারীকে। প্রথমে তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। পরে নিজের অর্জিত যুদ্ধ সম্পর্কিত বিদ্যা দিয়ে মায়ানদের মন জয় করেন তিনি, বিয়ে করেন নিজের মালিক জাজিল হা এর মেয়েকে।
১৫১৯ সালে স্প্যানিশ অ্যাডভেঞ্চারার হার্নান করতেজ ঐ দ্বীপে গিয়ে গুয়েরোর অবস্থা দেখে থ। তিনজন আমেরিকান ইন্ডিয়ান সন্তানসহ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি রীতিমতো সংসার পেতে বসেছেন। নাক-কান ফুটানো, মুখে রঙ মাখা গুয়েরোকে অন্য মায়ানদের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। বেঁচে যাওয়া অপর স্প্যানিয়ার্ড, ব্রাদার জেরোনিমো অ্যাগুইলার দোভাষীর কাজ করলেন। কারণ গুয়েরো ইংরেজি বলতেও রাজি হচ্ছিলেন না।
এই ঘটনাকে পুরোপুরিই ব্রেইনওয়াশ হিসেবে ধরে নিলেন করতেজ। স্প্যানিয়ার্ডদের আগ্রাসী মনোভাব টের পেলেন গুয়েরো। তাই মায়ান আর্মিকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন নিজের দেশের লোকদের বিরুদ্ধেই। করতেজ তাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিলেও গুয়েরো নিজের দেশের লোকদেরকে ফাঁকি দিয়ে বেড়ালেন বেশ কয়েক বছর। অবশেষে হন্ডুরাসের একটি যুদ্ধক্ষেত্রে তার লাশ পাওয়া যায়। জন্মগতভাবে মায়ান না হয়েও তাদের স্বার্থে এভাবেই প্রাণ দিলেন তিনি।
ইংরেজী ভাষাভাষী দেশগুলোতে তার নাম প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। তবে মেক্সিকানেরা তাকে দিয়েছে বীরের সম্মাননা। অন্যদিকে স্পেনের ইতিহাসে তাকে এক বেইমান পিশাচ হিসেবে গণ্য করা হতো বেশ কয়েক শতক ধরে, নিজের দেশের বিপক্ষে যাবার কারণে।
ব্রিটিশ বিয়ে করলেন হাওয়াইয়ান রাজকুমারীকে
দুর্ভাগ্য তাড়া করেছিল ব্রিটিশ ম্যারিনার জন ইয়ংকে। ভুলবশত নিজের লোকদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে হাওয়াইয়ের এক দ্বীপে আটকে পড়েন তিনি। তবে দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যে রূপ নিতে সময় লাগেনি। ক’দিন বাদেই স্থানীয় রাজকুমারীকে বিয়ে করে রাজার ডান হাত হয়ে বসেন তিনি। ল্যাঙ্কাশায়ারে বেড়ে ওঠা ইয়ং ব্রিটিশ জাহাজে ইলিনরে কাজ করতেন। পশমের ব্যবসা করা জাহাজটিতে করে হাওয়াইতে এসে পৌঁছান ১৭৯০ সালে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সেখানকার মনোলোভা রমণীরা ছিলো দেশ-বিদেশের নাবিকদের কাছে দারুণ আকর্ষণের বিষয়।
তবে স্বর্গেও সাপ থাকে। অপরাধ-নৈরাজ্যের কারণে কুখ্যাতিও কম ছিল না হাওয়াই এর। অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করা ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৯ সালে খুন হয়েছিলেন এখানেই। দ্বীপে থাকাকালীন সময়ে এক আমেরিকান জাহাজের ওপরে হাওয়াইয়ানদের আক্রমণের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন ইয়ং।
এই কথা যাতে বাইরে না যায়, সেজন্য রাজা কামেহামেহা আটকে ফেলার আদেশ দেন ইয়ংকে। ফলে তার জাহাজ তখন তাকে ঐ দ্বীপে ফেলেই চলে যায়।
পরে ভাগ্য ঘুরে যায় ইয়ং এর। ১৭৯৩ সালে ক্যাপ্টেন ভ্যাঙ্কুভার যখন ইয়ংকে দেশে ফিরে যাবার প্রস্তাব দেন, তখন সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন তিনি। জাহাজে নাবিকগিরি করার চাইতে বহুগুণ উন্নত তার হাওয়াইয়ের জীবনযাত্রা। ইতিমধ্যেই রাজার সভাসদদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে বসেছেন তিনি। তাই তিনি ফিরিয়ে দিলেন ভ্যাঙ্কুভারকে। ইয়ং ১৭৯৫ সালে বিয়ে করেন রাজকুমারী ন্যামোকিউলুয়াকে। তার বংশধরেরা এখনো হাওয়াইতেই বসবাস করে।
আর্নেস্ট শ্যাকলটনের মেরু অভিযান
আধুনিক যুগে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ক্যাস্ট অ্যাওয়ে’ সম্ভবত আর্নেস্ট শ্যাকলটন। অ্যান্টার্কটিকে যাওয়া তার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। ২২ বছর বয়সে বলেছিলেন, ইচ্ছা করে বরফের রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতে মেরুর শেষ সীমায় চলে যেতে। সময় তখন ১৯১৪ সাল। চল্লিশ বছর বয়সী শ্যাকলটন ইতিমধ্যেই একজন পোড় খাওয়া অভিযাত্রিকে পরিণত হয়েছেন। মেরু অভিযাত্রার স্বর্ণযুগ তখন, অভিযাত্রিকদের মধ্যে শীর্ষ কয়েকজনের কথা বলতে গেলে শ্যাকলটনের নামও আসে। এক মাসের ব্যবধানে অ্যামুন্ডসেন এবং স্কট দুজনই দক্ষিণ মেরু জয় করেছেন। তবে শ্যাকলটনের মতে অ্যান্টার্কটিক ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দক্ষিণ মেরু অঞ্চল সাগরপথে পাড়ি দেয়া।
সেই উদ্দেশ্যেই ১৯১৪ সালের ৮ আগস্ট ‘এনডুরেন্স’ নামের এক ব্রিটিশ জাহাজে চড়ে বসলেন ২৩ জন অভিযাত্রিক। বুয়েন্স আয়ার্স আর দক্ষিণ জর্জিয়া পার হয়ে ওয়েডেল সাগরে এসে পৌঁছালেন ডিসেম্বর নাগাদ। দুঃখের বিষয়, এনডুরেন্স আর এগোতে পারেনি। শীত মৌসুমের আগে কোনো আভাস ছাড়াই হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেলো প্রবল তুষার ঝড়। ফলে বিশাল জাহাজটি বরফে আটকে গেল। তার ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়ে গেছে ওয়েডেলের আইসবার্গের নিচে।
বাধ্য হয়ে জাহাজ ছেড়ে তাদেরকে আশ্রয় নিতে হলো বরফের ওপরে। বরফের পাশ দিয়ে অল্প পানিতে লাইফবোট চালিয়ে অতি ধীর গতিতে অগ্রসর হতে থাকলেন তারা, এক বরফ খন্ড থেকে আরেক বরফ খন্ডের দিকে। অবশেষে বরফে ছাওয়া পাহাড়সদৃশ একটি দ্বীপে পৌঁছালেন ১৯১৬ এর এপ্রিলে। লাইফবোট এবং স্থানীয় এলিফ্যান্ট সিলের চামড়া দিয়ে নিজেদের অস্থায়ী আবাসস্থল বানিয়ে নিলেন তারা। একারণেই দ্বীপটি এখন পরিচিত ‘এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড’ নামে।
অ্যান্টার্কটিকের দুর্গম এলাকায় তুষার বন্দী হয়ে থাকলেও খুব বেশি কষ্ট হয়নি তাদের। হকি খেলে, ডগ-স্লেজ চালিয়ে, সিলমাছ শিকার করে ভালোই সময় কাটিয়েছেন। এই পুরো সময়টাতেই বরফের চাপে মড়মড় করে ভাঙছিল এনডুরেন্সের কাঠামো! অবশেষে মাস পাঁচেক পরে সাগরে চলার মতো অবস্থা হলো। কারণ দ্বীপে খুব বেশিদিন জীবন ধারণ করা সম্ভব হবে না তাই শ্যাকলটনের সাথে আরো পাঁচজন নৌকা বাওয়া শুরু করলেন, আটশ মাইল দূরে দক্ষিণ জর্জিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে।
সাহায্য নিয়ে ফিরে আসতে লেগে গেলো আরো ১০৫ দিন। দ্বীপের কাছাকাছি আসতে আসতে শ্যাকলটন চিৎকার করে জানতে চাইলেন, “তোমরা ভালো আছো তো?”। সেই আঠারোজন উল্লসিত কণ্ঠে জানালেন যে, তারা ভালোই আছেন। অনাহার, অর্ধাহারকে জয় করেছেন তারা। তাদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিলো প্রবল ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া দশটি পায়ের আঙুল, ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করে এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে থাকাকালীন নিজেরাই কেটে ফেলেছিলেন সেগুলোকে।
শ্যাকলটনের অভিযান সফল না হলেও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। কারণ তিনি তেইশজন অভিযাত্রিকের সবাইকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অ্যান্টার্কটিক অভিযাত্রিকদের মধ্যে স্কট বিখ্যাত ছিলেন তার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্য আর অ্যামুন্ডসেন বিখ্যাত ছিলেন তার গতিশীল কিন্তু কার্যকর পদ্ধতির জন্য। কিন্তু ঝড়-ঝঞ্ঝার সময়ে যখন বাঁচার কোনো আশা থাকে না, তখন সবাই শ্যাকলটনের এই কাহিনী থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করে।
শ্যাকলটনকে পরবর্তীতে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।