Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জার বোমা: সকল বোমার সেরা বোমা

পারমাণবিক অস্ত্রের নাম শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ফেলা ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ এর নাম। তবে এর থেকেও অনেক বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র মানুষ তৈরি করেছে। এরকমই একটা বোমার নাম ‘জার’ বোমা যার বিধ্বংসী ক্ষমতার সাথে কোনো বোমারই তুলনা হয়না। 

জার বোমা এবং এটা বহনকারী বিমানে তোলার বাহন; Image Source: Science Photo Library

১৯৫২ সালের ১ নভেম্বর আমেরিকার সামরিক বিভাগের বিজ্ঞানীরা মার্শাল দীপপুঞ্জে একটি বোতাম টেপার মাধ্যমে বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের নতুন যুগের উন্মোচন করেন। বোতামটি ছিল তাপীয়-পারমাণবিক হাইড্রোজেন বোমার। এই বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমার থেকে হাজার গুণ বেশি। আমেরিকা এই বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করে। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই রেকর্ড। কারণ আমেরিকা তাদের হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে নিউক্লিয়ার রেসের সূচনা করেছিল তা স্নায়ুযুদ্ধে জড়িত অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এই দৌড়ে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ক্ষমতা বহির্বিশ্বকে দেখানোর জন্য হাইড্রোজেন বোমার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থাকে। সোভিয়েত রাজনীতিবিদ জর্জি মালেনকভ এবং নিকিতা ক্রুশ্চেভের নীতি ছিল- যদি প্রতিপক্ষকে সরাসরি আক্রমণ না করা যায় তবে তাদের ভয় দেখাও যেন তোমাকে তারা আক্রমণ না করে। ইউএসএসআর-এর পারমাণবিক শক্তি কৌশলের অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তৈরি করে RDS-202 যা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ‘জার’ বোমা নামে পরিচিত।

এটাই হলো এখন পর্যন্ত মানব নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা। এই বোমা তৈরির প্রজেক্টকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয় ঐ সময়ে। প্রজেক্ট ৭০০০, প্রডাক্ট ভি, RDS-202 এবং ডাকনাম ছিল বিগ আইভান এবং কুজকিনা ম্যাট। সিআইএ এই প্রজেক্টের নাম দেয় JOE 111। তবে এই বোমার বিস্ফোরণের পর এই বোমা পরিচিতি পায় জার বোমা হিসেবে। কারণ রাশিয়ার বৃহৎ অনেক জিনিসের নামের আগে জার শব্দটি ব্যবহার করা হত, যেমন- জার ঘণ্টা এবং জার কামান।

 আর ডি এস ২০২ প্রজেক্টের ছবি; Image Source: twitter.com

প্রজেক্ট ৭০০০ এর কাজ শুরু হয় ১৯৫৪ এর শরতে। অনেকে মনে করে, সেই সময়ে সোভিয়েত মন্ত্রীসভার চেয়ারম্যান নিকিতা ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত আদেশে এই প্রজেক্ট শুরু হয়। এই ধরনের বোমার ডিজাইন করা সহজ ছিল না। স্নায়ু যুদ্ধের সময় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রধান উপাদান ইউরেনিয়াম প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা হয়। এই ইউরেনিয়াম দিয়ে সাধারণত টু স্টেজ তাপীয় পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যেত। তবে জার বোমার মতো শক্তিশালী বোমা তৈরি করতে বোমাটিকে তিনটি স্টেজে বিস্ফোরিত হতে হতো।

জার বম্ব তার পূর্বের অন্যান্য বোমার থেকে অনেক দিক দিয়ে আলাদা ছিল। অল রাশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স এর বিজ্ঞানী ইউরি আলেক্সিয়েভিচ ট্রুটনেভ এবং ইউরি বাবায়াভ এই থ্রি স্টেজ বোমার ডিজাইন করেন। ডিজাইনের সময় এই বোমার ক্ষমতা ধরা হয় ৫০ মেগা টন টিএনটির সমান। এটা ছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা বোমার সম্মিলিত ক্ষমতার ১৫৭০ গুনের সমান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত সব বিস্ফোরকের একত্রিত ক্ষমতার থেকেও দশ গুণ বেশি। প্রথম ডিজাইনে ছিল বোমাটি ১০০ মেগা টন টিএনটির সমান হবে এবং ক্ষমতা হবে তিন হাজার হিরোশিমা এবং নাগাসাকি বোমার সমান। তবে পরে অনেকে বলে যে এই ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা যে বিমান বহন করবে সেই বিমান বোমা বিস্ফোরণের পর ফিরে আসার পর্যাপ্ত সময় না-ও পেতে পারে। তাই এই বোমার ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে নেওয়া হয়।

এই বোমা তৈরির জন্য যে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয় তার নাম ছিল ‘টপিক-২৪২’। বোমা তৈরি এবং এই বিশাল বোমা বহনের জন্য যে বিমান তৈরি করা হবে তার জন্য সোভিয়েত আণবিক বোমা প্রজেক্টের ডিরেক্টর ইগর কুরচাটোভ এবং তৎকালীন রাশিয়ার প্রধান যুদ্ধবিমানের ডিজাইনার আন্দ্রেই টুপোলেভ ১৯৫৪ সালে একটি গোপন মিটিং করেন। টুপোলেভ তার সমরাস্ত্র বিভাগের সহকারী আলেকজান্ডার নাদশকেভিচকে দায়িত্ব দেন এই বিষয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য। রিপোর্টে দেখা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো পে-লোড বহনকারী বিমান এই বোমা বহনে সক্ষম নয়। ঐ সময়ে সবচেয়ে বড় পে-লোড বহনকারী বিমান ছিল টুপোলেভ টু-৯৫। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই বিমানের ইঞ্জিন, ফুয়েল ট্যাঙ্ক, বোমা বহনের জায়গা এবং বোমা রিলিজ মেকানিজম পুনরায় ডিজাইন করে কাজ চালানো হবে। এই নিয়ে মন্ত্রীসভা এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে কয়েক দফা মিটিং হয়।

১৯৫৬ সালে এই রূপান্তরিত বোমারু বিমানকে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হয়। কর্নেল এস এম কুলিকভ এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন পরিচালনা করেন এবং ১৯৫৯ সালে জার বোমা বহনের ছাড়পত্র দেন।

যে বিমানে জার বোমা বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; Image Source: Alamy

একদিকে যেমন বোমা বহনের জন্য গবেষণা চলছিল, তেমন অন্যদিকে বোমা তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই বোমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল অন্য বোমার মতো এর বিস্ফোরণ দুই ধাপে হয় না, বরং তিন ধাপে হয়। এর প্রথম ধাপে নিউট্রন রিফ্লেক্টর হিসেবে ইউরেনিয়াম থাকলেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপে নিউট্রন রিফ্লেক্টর হিসেবে সীসা ব্যবহার করা হয়। এটি ফাস্ট ফিউশন স্টেজে উৎপন্ন নিউট্রনের দ্রুত বিদারণের রেডিয়েশন ৯৭% কমিয়ে আনে। এই নতুন ডিজাইন সোভিয়েতের পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে, কারণ প্রচলিত পারমাণবিক বোমা যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা উৎপন্ন করতো তা পরিবেশ এবং প্রাণীজগতের জন্য ক্ষতিকর ছিল। শেষমেশ বোমার ওজন দাঁড়ায় ২৭ মেট্রিক টন। লম্বায় ছিল ৮ মিটার এবং প্রস্থে ২.১ মিটার। একটি প্যারাসুট বিশেষভাবে তৈরি করা হয় যা বিমানটিকে পর্যাপ্ত সময় দেবে বিস্ফোরণের স্থান থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে সরে আসার যা তাদের বাঁচার সুযোগ ৫০% বাড়িয়ে দেবে। প্যারাসুট তৈরির পর দেখা যায় শুধু এর ওজনই ৮,০০০ কেজি এবং ক্ষেত্রফল ১৭,০০০ বর্গ ফুট।

সব কিছু ঠিক থাকার পরও এই বোমার বিস্ফোরণ কিছু রাজনৈতিক কারণে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। টু-৯৫ভি বিমানটি ততদিন ইউক্রেনের উজিনে প্রশিক্ষণ বিমান হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। এই বিমান ১৯৬১ সালের ১৭ অক্টোবরের পর সামরিক বিমান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিমানটির দরজাগুলো সরিয়ে সেখানে স্বয়ংক্রিয় রিলিজ মেকানিজম লাগানো হয়। এতে এক বিশেষ প্রতিফলক সাদা রং করা হয় যা বোমার বিস্ফোরণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা প্রতিফলন করতে সক্ষম ছিল।

টু-১৬ থেকে তোলা জার বোমা ভূপৃষ্ঠে নিক্ষেপের ছবি; Image Source: medium.com

১৯৬১ সালের ১৭ অক্টোবরের সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২২ তম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ জার বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ঘোষণা দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই চায়নি এই বোমা দিয়ে আক্রমণ করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রধান শত্রু আমেরিকাকে সোভিয়েতের ক্ষমতা দেখানো। এই জন্য এই বোমার পরীক্ষার জন্য এক দূরবর্তী দীপপুঞ্জ বেছে নেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ অক্টোবর মেজর আন্দ্রেই দুরনভটসেভ কোলা অন্তরীপের অলেন এয়ার-ফিল্ড থেকে টু-৯৫ভি বিমানে করে জার বোমাকে বিস্ফোরণ স্থানে নিয়ে যান। টু-১৬ নামের পর্যবেক্ষক বিমান এই পুরো ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করে এবং বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রাও পরিমাপ করে। উড্ডয়নের দুই ঘণ্টার মধ্যেই বিমানটি মিতুশিখা উপসাগরের উপর চলে আসে। জার বোমা সুখয় নস অন্তরীপের ১০,৫০০ মিটার উপরে মুক্ত করা হয়। প্যারাসুটের মাধ্যমে নেমে ৪,০০০ মিটার উচ্চতায় রাশিয়ান সময় ১১:৩২ এ বিস্ফোরিত হয়। ততক্ষণে বহনকারী বিমান টু-৯৫ভি ৩৯ কিলোমিটার এবং টু-১৬ পর্যবেক্ষক বিমান ৫৬ কিলোমিটার দূরে চলে আসতে সক্ষম হয়। বিস্ফোরণের আঘাত তরঙ্গ টু-৯৫ভি বিমানকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে এসে ধাক্কা দিয়ে বায়ুমণ্ডলে ১ কিলোমিটার ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।বিস্ফোরণের শক ওয়েভ প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ অগ্নিগোলকটিকে প্রায় দশ হাজার ফুট উপরে তুলে নিয়ে যায় যার ঝলকানি প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়।

জার বোমার বিস্ফোরণ স্থান; Image Source: news.un.org

বিস্ফোরণে সৃষ্ট মাশরুম আকৃতির মেঘ এভারেস্টের উচ্চতার সাতগুণ উচ্চতায় পৌঁছে যায় অর্থাৎ মেসোস্ফিয়ারের মধ্যে চলে যায়। এই মেঘের সামনের অংশ প্রায় ৯৫ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়। আশেপাশের অঞ্চলে এই বিস্ফোরণের প্রভাব ছিল ধ্বংসাত্মক। টেস্ট সাইটের ৫৫ কিলোমিটার দূরে সেভারি দ্বীপের সমস্ত কাঠ এবং পাথরের বাড়ি এবং স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। যদিও দ্বীপটি আগে থেকেই জনশূন্য ছিল। কয়েকশ কিলোমিটার দূরের কাঠের ঘরও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পাথর নির্মিত বাড়িগুলোর চাল, জানালা ভেঙে যায়। এই বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট উত্তাপ প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত সব কিছু তৃতীয় মাত্রায় পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। টেস্ট সাইট থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে যে পর্যবেক্ষক দল অবস্থান করছিল তারাও বাতাসে তাপীয় কম্পন অনুভব করতে পারে। নরওয়ে আর ফিনল্যান্ডের কিছু জায়গায় ও জানালার কাচ ভেঙে যায়। ভূপৃষ্ঠের চার কিলোমিটার উপরে বিস্ফোরণ করার পরেও এর শক ওয়েভ ৪-৪.২৫ মাত্রার ভূকম্পন সৃষ্টি করে যা পুরো পৃথিবীকে প্রায় তিনবার প্রদক্ষিণ করার পরও শক্তিশালী ছিল।

অন্যান্য পারমাণবিক বোমার সাথে জার বোমার তুলনা; Source: Internet

এই বিস্ফোরণের পর বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করে। অনেক দেশ এই ধরনের পরীক্ষা রোধে চুক্তি করার প্রস্তাব দেয়। জার বোমা পৃথিবীতে নিক্ষেপিত এবং বিস্ফোরিত সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা। আর কোনো অস্ত্র এতটা বিধ্বংসী ক্ষমতার ছিল না। যদিও এই বোমা আক্রমণের উপযুক্ত ছিল না। এর আকার এবং ওজন দূরবর্তী কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল। বোমা বিস্ফোরণের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন যে লক্ষ্যে এটা তৈরি করেছিল তা সফল হয়। তারা বহির্বিশ্বকে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে এবং এর ফলে আমেরিকা আণবিক বোমার দৌড় থেকে সরে মহাকাশ জয়ের দৌড়ে অংশ নেয়। এজন্য অনেকেই জার বোমাকে প্রোপাগান্ডা বোমাও বলে।

In 1961, the Soviet Union tested a nuclear bomb named Tsar Bomba that was so powerful and giant to use in war. The test result shocked the world and shaped nuclear weapon history.

Necessary links are hyperlinked in the article. 

Related Articles