মক্কা, ৬৯২ সাল। তপ্ত দুপুরে একটি দেহকে ক্রুশবিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মৃতদেহটি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এর। ক্রুশে চড়ানোর আগে শিরশ্ছেদ করা হয়। উল্লাস করছিল আশপাশে জড়ো হওয়া সেনারা। অথচ সত্তর বছর আগে, এই আব্দুল্লাহ যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন বহু উল্লাস হয়েছিল মদিনার পথে প্রান্তরে, অলিতে গলিতে; কারণ তিনি ছিলেন হিজরতের পর মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু। আর আজ তার মৃত্যুই উল্লাসের কারণ। এসব হচ্ছিলো যার আদেশে, তিনি মক্কা অবরোধকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নাম শুনলে অনেকের কাছে ছোটবেলার সমাজ কিংবা ইতিহাস বইয়ের কথা মনে হয়ে যেতে পারে। সেই রাজা দাহিরের কাহিনী। যে হাজ্জাজের হুকুমে মুহাম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু বিজয় করেন, আর ভারতবর্ষ পরিচিত হয় ইসলামের সাথে। কিন্তু সে বইগুলোতে অবশ্য এটা লেখা ছিল না যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একজন সাহাবী হত্যাকারীও ছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা), জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) এবং কুমাইল ইবনে জিয়াদ (রা)- এ তিন সাহাবী শাহাদাতবরণ করেন তার হাতে।
এতটুকু পড়ে আপনার অবশ্যই মনে হবে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের চেয়ে খারাপ শাসক হতেই পারে না। এটা খুবই সত্য, হাজ্জাজ ছিলেন একজন অত্যাচারী শাসক, রক্তপিপাসুও বলা উচিত। তার নানা অভিযানে প্রায় এক লাখ থেকে সোয়া লাখ মানুষ মারা যায়, এবং এ কারণে পারস্য ও আরবের কুখ্যাত চারজনের তালিকায় তৎকালীন সময়েই তার নাম উঠে যায়, যারা কি না লক্ষাধিক মানুষ মেরেছেন। ইরানের প্রখ্যাত লেখক আল-সালাবী সে তালিকাটা করেছিলেন। কিন্তু জেনে অবাক হতে হবে, হাজ্জাজ তার দৃঢ় শাসনের জন্য বহুল বিদিত, কঠোরভাবে তিনি রাজ্যশাসন করতেন- নিয়মের যেন কোনো ব্যত্যয় না হয় কোথাও।
তার চরম ঘৃণাকারীরাও আবার তাকে বুদ্ধিমান, বিশুদ্ধভাষী আর চমৎকার বক্তা হিসেবে অভিহিত করেন। হাসান বসরী (রঃ) এর পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফই ছিলেন সেরা বক্তা। এই অত্যাচারী আর খুনী ভদ্রলোক কিন্তু একই সাথে ছিলেন কুরআনের হাফেজ। প্রতি রাত তার কাটতো কুরআন পড়ে পড়ে। এমনকি আজকের যুগে অনারব মুসলিমরা যে কুরআন পাঠ করছে সহজভাবে, তার জন্য দায়ী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, কারণ তিনিই আরবি অক্ষরগুলোর সাথে নুকতা চিহ্নগুলো যোগ করেন কুরআনে! (১০ম খণ্ড, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, পৃষ্ঠা ১৯৬)
ভালোর তালিকায় নাম যাবে হাজ্জাজের, নাকি তার নাম লেখাতে হবে খারাপের তালিকায়? এ বিতর্ক চলেছে বহুদিন। নিরপেক্ষ ইতিহাসের পাতায় বিতর্কিত এক চরিত্র হাজ্জাজ, তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণে বিশেষ করে আব্বাসীয় খেলাফতের যুগ থেকে নিন্দিত ও ঘৃণিত তিনি। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এর সাথে তার দেখা হলে তিনি কখনোই হাজ্জাজকে সালাম দিতেন না, তার সাথে নামাজও পড়তেন না। তাকে মিথ্যেবাদী বলতেন। তবে সহিহ বুখারিতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হাজ্জাজের ইমামতিতে নামাজ আদায় করেছেন বলে উল্লেখ আছে।
এত নিষ্ঠুর এ হাজ্জাজের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল জানেন কি? চলুন তার জীবনের অধ্যায়গুলো জেনে নেয়া যাক। তার জীবনী জানবার জন্য আমরা অনুসরণ করব ঐতিহাসিক ইবনে কাসির (র) এর লেখা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থটি।
আজকের সৌদি আরব অর্থাৎ হেজাজের তাইফ শহরে ৬৬১ সালে জন্ম হাজ্জাজের। তার গোত্রের নাম ছিল বনু সাকিফ, এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন মক্কা থেকে, ফিরেছিলেন রক্তাক্ত হয়ে। তখন বনু সাকিফ পূজা করতো লাত দেবীর।
হাজ্জাজের পরিবার খুব একটা অর্থবান ছিল না। দরিদ্রই বলা চলে। তার মায়ের নাম ছিল ফারিয়া। বলা হয়ে থাকে, তার বাবা চিকিৎসক ছিলেন। তবে দরিদ্র পরিবারটির অন্যান্য সদস্যরা রাজমিস্ত্রী বা পাথর বয়ে নেবার কাজ করতো। হাজ্জাজের ছোটবেলা নিয়ে একদমই কম জানা যায়। শুধু এটুকু নিশ্চিত যে, একটা পর্যায়ে স্থানীয় স্কুলে পড়াতেন হাজ্জাজ আর তার বাবা। কোনো এক কারণে ছোটকালের হাজ্জাজের ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘কুলাইব’ বা ‘কুকুরের বাচ্চা’। বলা হয়েছে, তার জন্মের সময় প্রস্রাবের রাস্তা এবং পায়ুপথ ছিল না, অর্থাৎ অপরিপক্ব অবস্থায় তার জন্ম হয়; পরে তা চিকিৎসক দ্বারা ঠিক করিয়ে নেয়া হয়। আরও বলা হয়েছে, কিছুদিন শিশু হাজ্জাজ দুধ পান করেনি, যতক্ষণ না এক বছরের বকরির বাচ্চার রক্ত তাকে পান করানো না হয়। এরপর এক অস্ত্রধারীর রক্ত দ্বারা তার মুখমণ্ডল রঙিন করা হয়। এরপর সে দুধ পান করে।
হাজ্জাজের তরুণ বয়সে খলিফা মুয়াবিয়া মারা যাবার পর দ্বিতীয় ফিতনার (৬৮০-৬৯২) যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন বটে, তবে খুব একটা নাম কামাতে পারেননি। তার প্রথম বলার মতো সরকারি চাকরি ছিল আরব উপদ্বীপের লোহিত সাগরের তীরের তিহামা (تهامة) অঞ্চলের তাবালার অখ্যাত এক গভর্নর হওয়া।
৬৮৫ সালে খলিফা হলেন আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান। হাজ্জাজ তখন নিজ শহর ছেড়ে রাজধানী দামেস্কে চলে যান। খলিফার নিরাপত্তা দলে (শুরতা/شرطة/পুলিশ) তিনি যোগ দিলেন। সেখানে তার ভাগ্য খুলে গেল। খলিফা একবার ইরাকে মুসাব ইবনে জুবাইরের বিরুদ্ধে অভিযান করতে যাবার সময় তার সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসে; হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সেই বিদ্রোহ চমৎকারভাবে দমন করেন। এতে খুশি হয়ে যান খলিফা আব্দুল মালিক। তাকে তার সেনাবাহিনীর বড় একটা অংশের দায়িত্ব দিয়ে দেন।
দায়িত্ব পেয়ে আরো চমক দেখান হাজ্জাজ। মুসাব ইবনে জুবাইর পরাজিত হলেন। তখন খলিফা হাজ্জাজকে দায়িত্ব দিলেন মুসাবেরই ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে পরাজিত করার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ ইবন জুবাইর (রা)-ই ইমাম হুসাইন (রা)-কে বলেছিলেন মক্কাকে কেন্দ্র করে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। হুসাইন (রা) কারবালায় শহীদ হবার পর মক্কাবাসীরা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে খলিফা হবার দাবিদার মনে করে। এটা শুনেই ইয়াজিদ কর্তৃক ওয়ালিদ বিন উতবাহকে পাঠানো হয় এক রুপার শিকলসহ যেন আব্দুল্লাহ (রা)-কে গ্রেফতার করা হয় খলিফার বিরোধী হওয়ায়। আব্দুল্লাহ (রা) ছিলেন হযরত আবু বকর (রা) এর কন্যা আসমা (রা) এর ছেলে, অর্থাৎ হযরত আয়িশা (রা) এর ভাগ্নে।
নিজের খেলাফতের হুমকি হওয়ায় খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাকে দমন করতে মক্কায় পাঠালেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে। মক্কার কাছাকাছি গিয়ে হাজ্জাজ আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে পত্র পাঠালেন। সেখানে জানানো হলো, আব্দুল্লাহ (রা) এর সামনে তিনটি পথ খোলা আছে-
১) শিকলবন্দি হয়ে দামেস্কের খলিফার কাছে প্রেরণ
২) সকল দাবি ত্যাগ করে নিজের ইচ্ছা মতন যেখানে ইচ্ছে চলে যাওয়া
৩) মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করা
আব্দুল্লাহ (রা) তখন গেলেন তার মা আসমা (রা) এর কাছে যার বয়স তখন ছিল শত বছরেরও বেশি। বললেন, “মৃত্যুতে আমি শান্তি খুঁজে পাবো। আমার লোকেরা আমাকে ছেড়ে গেছে, আমার পরিবারও নেই আমার সাথে। গুটিকয়েক লোক বাকি আছে কেবল। আপনার পরামর্শ কী?”
আসমা (রা) বললেন, “তোমার অবস্থা তুমি আমার থেকে ভালো জানো। কিন্তু আমি যেটা বলব সেটা হলো, তোমার সঙ্গীদের মতো এগিয়ে যাও, শহীদ হও। যদি ইহজগতের লাভ তোমার দরকার পড়ে, তবে তুমি বিপথগামীদের অন্তর্গত হবে…”।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) বললেন, “আমার মৃতদেহ শামের এ লোকেরা বিকৃত করবে বোধ করি।”
আসমা (রা) বললেন, “কোরবান হওয়া ছাগলটি কখনো ব্যথা পায় না যখন তার চামড়া ছিলিয়ে নেয়া হয়।”
আব্দুল্লাহ (রা) মায়ের কপালে চুম্বন করে বললেন, “আল্লাহর কসম, এটাই আমার মতামত। এ দুনিয়াতে আমার বেঁচে থাকবার আর আগ্রহ নেই। আমার আশা পরকাল নিয়ে। সারা জীবন আমি সত্যের পথে ছিলাম। আমি কেবল আপনার মতামত নিয়েছি আমার মতামতকে জোরদার করতে।”
আসমা (রা) বললেন, “বাছা আমার, কাছে এসো।” আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) কাছে এলে আসমা (রা) তাকে জড়িতে ধরলেন। তিনি অনুভব করলেন, পোশাকের নিচে বর্ম পরিহিত আছেন আব্দুল্লাহ (রা)। তিনি বলে উঠলেন, “এ কী? শহীদ হতে চাওয়া কেউ তো এটা পড়ে থাকবে না!”
আব্দুল্লাহ (রা) বললেন, “আমি এটা কেবল আপনার সান্ত্বনার জন্য পড়েছি।”
আসমা (রা) বললেন, “খুলে ফেলো এটা… সাহসের সাথে লড়বে, কারণ তুমি জুবাইরের ছেলে, আবু বকরের নাতি, তোমার দাদী সাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব।”
সেদিন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) লড়েছিলেন বীরের মতো, পরাজিত করেছিলেন অসংখ্য লোককে। কিন্তু তাকে থেমে যেতে হলো যখন তার শত্রুরা তার উপর পাথর ফেলে, কিন্তু মাটিতে পড়ে গিয়েও তিনি লড়ছিলেন। তারা তার পা কেটে ফেললো এবং অবশেষে তাকে হত্যা করলো।
হাজ্জাজ তখন আসমা (রা) এর কাছে এলেন, বললেন, “আল্লাহ তার শত্রুর সাথে কেমন আচরণ করলেন?”
আসমা (রা) উত্তর দিলেন, “তার প্রাণ তুমি ধ্বংস করেছো বটে, কিন্তু তোমার পরকাল সে ধ্বংস করেছে!”
তারা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এর মৃতদেহ থেকে মাথা কর্তন করে নিল, এরপর তার দেহ ক্রুশবিদ্ধ করল। হাজ্জাজের লোকেরা চিৎকার করছিল, “তাকবির, আল্লাহু আকবার!”
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) পাশ দিয়ে যাবার সময় তার লাশের দিকে তাকালেন, বললেন, “যেদিন আব্দুল্লাহর জন্ম হয়েছিল আমি সেখানে ছিলাম, আজ তার মৃত্যু হলো এদিনও আমি তার কাছে আছি। তার জন্মের দিনে যতগুলো মানুষ তাকবির দিয়েছিল, আল্লাহর কসম, তার থেকে আজ তার মৃত্যুর দিনে তাকবির দেয়া লোক অনেক অনেক কম!”
সৈন্যরা হাজ্জাজের কাছে গেল, বলল, “অনেক দিন তো হলো, উনার লাশ নামানো দরকার।”
হাজ্জাজের উত্তর ছিল, “আল্লাহর কসম, আসমা আমার কাছে ভিক্ষা না চাইলে আমি নামাবো না তার লাশ।”
আসমা (রা) এ কথা শোনার পর বললেন, “আমাকে নিয়ে চলো আমার ছেলের লাশের কাছে।”
তিনি দুয়া শেষ করবার পর বললেন, “সময় কি হয়নি আল্লাহর বীরসেনাকে তার ঘোড়া থেকে নামাবার?”
এ কথা হাজ্জাজের কানে আসবার পর তার এত নিচু অনুভব হয় যে লজ্জায় তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের (রা) মৃতদেহ নামিয়ে আনেন।
মক্কা অবরোধের এ ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে হয়েছিল। হাজ্জাজ ৬৯১ সালে কুফা থেকে ২০০০ সিরীয় সেনা নিয়ে বেরিয়েছিলেন, এরপর তাইফ অধিকার করবার পর তিনি মক্কার দিকে এগিয়েছিলেন। খলিফার নির্দেশ ছিল রক্তক্ষয় এড়াতে, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কোনো ফলাফল হবে না দেখে খলিফার অনুমতিতে মক্কা আক্রমণ করেন হাজ্জাজ।
উমাইয়া সেনারা আবু কুবাইস পাহাড় থেকে গোলা নিক্ষেপ করছিল মক্কার দিকে, এমনকি হজ্জ মৌসুমে কাবাও সে গোলা থেকে রক্ষা পায়নি। হাজিরাও পায়নি রক্ষা। তখন হঠাৎ শুরু হলো বজ্রসহ বৃষ্টি। আর এতে ভয় পেয়ে যায় উমাইয়া সেনারা, এ বুঝি আল্লাহর গজব। কিন্তু হাজ্জাজ তার বাগ্মিতার দ্বারা তাদেরকে বোঝাতে সমর্থ হন যে, এটা আসলে বিজয়ের চিহ্ন।
সাত মাস অবরোধের পর অবশেষে হাজ্জাজের বাহিনী আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে হত্যা করতে সমর্থ হয়। তবে এতে তার বাহিনীর কয়েক হাজার সেনা মারা যায়। ইবনে জুবাইর (রা) আর তার সাথীরা কাবার প্রাঙ্গণে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন।
এর পুরস্কার হিসেবে খলিফা হাজ্জাজকে হেজাজ (সৌদি), ইয়েমেন আর ইয়ামামার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন।
৬৯৩ এবং ৬৯৪ সালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজে হজ্জ করেন এবং কাবাকে নবী (সা) এর আমলের আকৃতিতে ফিরিয়ে আনেন। আগের আকৃতির কথা বুঝবার জন্য একটি হাদিস সম্পর্কে জানতে হবে।
সহিহ বুখারী শরিফে পাওয়া যায়, একদিন নবী মুহাম্মাদ (সা) স্ত্রী আইশা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, “তুমি কি জানো কুরাইশরা যখন কাবা পুনর্নির্মাণ করেছিল, তখন তারা ইব্রাহিম (আঃ) এর বানিয়ে যাওয়া আদি ভিত্তি থেকে কমিয়ে ফেলেছিল?” তখন আইশা (রা) বলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি তবে কেন সেটা আগের আকারে ফিরিয়ে নেন না?” তিনি উত্তর দিলেন, “যদি তোমার লোকেরা (কুরাইশ) অন্ধকার যুগের এত নিকটে না থাকত, তবে সেটাই করতাম।” আইশা (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাবার পাশের বাঁকানো দেয়াল কি কাবার অন্তর্ভুক্ত?” তিনি হ্যাঁ বললেন। আইশা বললেন, “তবে তাদের সমস্যা কী ছিল? কেন তারা একে অন্তর্ভুক্ত করলো না?” তিনি উত্তর দিলেন, “দেখছো না, তোমার লোকদের (কুরাইশদের) টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল?” আইশা জিজ্ঞেস করলেন, “প্রবেশদ্বারের ব্যাপার কী? এত উঁচুতে কেন?” নবীজী (সা) উত্তর করলেন, “তোমার লোকেরা এমন করেছিল যেন তারা যাকে ইচ্ছে কেবল তাদের ঢুকতে দিতে পারে, আর ইচ্ছেমত ঢুকতে বাধা দিতে পারে। তারা যদি জাহেলিয়ার এত কাছে না থাকত, আর যদি এটা আমি না জানতাম যে তারা এটা পছন্দ করবে না, তবে আমি ঐ বাঁকানো দেয়ালকে কাবার অন্তর্গত করতাম, আর এ প্রবেশদ্বার মাটির উচ্চতায় নিয়ে আসতাম।”
আব্দুল্লাহ (রা) শুনেছিলেন আইশা (রা) থেকে এ হাদিস। এজন্য তিনি মক্কায় থাকাকালীন কাবা শরিফ ইব্রাহিম (আঃ) এর আদি ভিত্তি অনুযায়ী গড়ে তোলেন। দুটো দরজা বানান তিনি তাতে, একটি ঢুকবার, আরেকটি বের হবার। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সেটি ধ্বংস করে কুরাইশদের মতো করে আবার বানিয়ে নেন, এরপর সিল্ক দিয়ে কাবাকে ঢেকে দেন। এর আগে মিসরীয় লিনেন কাপড়ে ঢাকা ছিল।
হাজ্জাজ যতদিন শাসন করেছিলেন হেজাজে, কোনো বিদ্রোহ হয়নি আর, অর্থাৎ তথাকথিত ‘শান্তি’ বজায় ছিল। কিন্তু শান্তি বজায় রাখতে তিনি মাঝে মাঝে এত কঠোর হতেন যে খলিফা বাধ সাধতে বাধ্য হতেন।
৬৯৪ সালের গোড়ার দিকে খলিফা তাকে পাঠান ইরাকের গভর্নর হিসেবে। ফলে কুফা আর বসরার দায়িত্ব একত্রীভূত করা হয়। ইরাকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিল মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া আর ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা পর্যন্ত। ৬৯৭ বা ৬৯৮ সালের দিকে তার দায়িত্বের সাথে পারস্যের খোরাসান আর সিস্তান প্রদেশও যোগ হয়। মোটামুটি পুরো খেলাফতি সাম্রাজ্যের অর্ধেক তখন হাজ্জাজই শাসন করতে লাগলেন, খেলাফতের পূর্ব পাশ।
খলিফা আব্দুল মালিকের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন হাজ্জাজ, খলিফা তাকে বিশ্বাস করতে খুব। শুধু এ খলিফা নন, পরবর্তী খলিফাদের সাথেও ছিল তার সুসম্পর্ক। যেমন, পরের খলিফা আল ওয়ালিদের ছেলে মাসরুরের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেন তিনি। আর ভাই মুহাম্মাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দেন খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের। খুশি হয়ে দ্বিতীয় ইয়াজিদ নিজের ছেলের নাম রাখেন হাজ্জাজ। আজও খলিফার সাথে হাজ্জাজের চিঠির নিদর্শন পাওয়া যায়, যা তাদের সুসম্পর্কের প্রমাণ। তবে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আব্দুল মালিকের সাথেই ছিল।
ইরাকের কুফাতে দায়িত্ব নিয়ে যাবার পর সেখানের স্থানীয় মসজিদে তিনি এত অসাধারণ একটি ভাষণ বা খুতবা দেন যে সেটি আরবি ভাষার সেরা ভাষণগুলোর একটি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সেখানে একটি বিদ্রোহও দমন করেছিলেন। যদিও বলা হয়ে থাকে উমাইয়াপ্রেমী হবার দরুণ আলী (রা) এর অনুসারীদের তিনি অপছন্দ করতেন, তথাপি তিনি আলী (রা) এর হত্যাকারী ও বিরোধিতাকারী খারেজি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও সেনাভিযান করেছিলেন, খারেজিদের বিদ্রোহ দমনেও তিনি একহাত নিয়েছিলেন; তবে সেটি করতে গিয়ে তিনি জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন, আর্থিক ক্ষতিও হয়েছিল। [খারেজিদের সাথে আলী (রা) এর বিরোধ আর তার শাহাতাদের ঘটনা পড়তে ক্লিক করুন এখানে- হযরত আলী (রা): উত্তাল গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মুসলিম বিশ্বের কর্ণধার]
৭০২ সালে তিনি বসরা আর কুফার মাঝামাঝি ওয়াসিত নামে শহর বানান, আর সেখানে তার কাজকর্ম স্থানান্তর করেন। খোরাসানের গভর্নর ইয়াজিদ কেন তার ডাকে সাড়া দিয়ে ওয়াসিত শহরে হাজির হতেন না, সেজন্য হাজ্জাজ খলিফার কান ভারী করেন। ফলে, খলিফা ৭০৪ সালে ইয়াজিদকে জেলে ভরেন।
এরপরই আসলে তার নজর ফেরে ভারতের দিকে। আর এখানে চলে আসে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নাম। তায়েফে জন্ম নেয়া মুহাম্মাদের চাচা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তার কাছে তিনি যুদ্ধবিদ্যা আর রণকৌশল শেখেন। নিজের মেয়ে জুবাইদার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন হাজ্জাজ এই মুহাম্মাদ বিন কাসিমের। (হাজ্জাজের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণেই কিন্তু খলিফা সুলাইমান বিন আব্দুল মালিক মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে, তবে সে অন্য এক কাহিনী)
খলিফার জন্য পাঠানো সিংহল রাজের উপহারভর্তি ৮টি জাহাজ সিন্ধু প্রদেশের দেবল বন্দরে জলদস্যু দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুরাজ দাহিরের কাছে এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু দাহির অস্বীকৃতি জানায়। জলদস্যুরা তার শাসনের বাহিরের, তিনি তাদের শাস্তি দিতে পারেন না- এমনটা জানান দাহির।
তৎকালীন খলিফা ওয়ালিদ থেকে অনুমতি নেন ক্ষিপ্ত হাজ্জাজ সিন্ধু আক্রমণের। প্রথম দুটো অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি পাঠান মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে।
১৭ বছরের মুহাম্মাদ বিন কাসিম ৭১২ সালে তার ৬০০০ অশ্বারোহীর সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হন সিন্ধুর দেবল বন্দরে। যুদ্ধের ফলাফল সংক্ষেপে দাঁড়ায়, মুহাম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু বিজয় করে নেন, রাজা দাহির সম্মুখ সমরে নিহত হন। দাহিরের স্ত্রী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর তিনি মুলতানও বিজয় করেন।
হাজ্জাজ তার শাসনকালে তার সাম্রাজ্যে বাইজান্টিন খ্রিস্টান মুদ্রা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এখানে অবশ্যই ইসলামি দিনার ব্যবহার করতে হবে, যার উপর আল্লাহর নাম লেখা থাকবে। এর ফলে বাইজান্টিন অর্থনীতিতে সাড়া পড়ে যায়। তারা যখন ইসলামি সাম্রাজ্যে ব্যবসা করতে আসতো, তখন তাদেরকে ইসলামি দিনার ব্যবহার শুরু করতে হতো; কিন্তু বাহিরে দুই মুদ্রাই গ্রহণযোগ্য ছিল। যেহেতু দুই রকম মুদ্রা সাথে বহন করা খুব ঝামেলার, তাই একপর্যায়ে বণিকেরা কেবল ইসলামি মুদ্রাই বহন করতে লাগলো। ফলে বাইজান্টিনরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এটি ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যের বিজয়ের জন্য হাজ্জাজের কুশলী এক চাল। হাজ্জাজ এত সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেছিলেন যে, এ মুদ্রা পরিবর্তনের ফলাফল সেবাস্তোপলিস যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছিল, যেখানে বাইজান্টিনরা পরাজিত হয়।
ইরাকে স্থিতিশীলতা আনবার পর হাজ্জাজ মনোযোগ দেন বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিমদের মাঝে একতা আনবার দিকে, পূর্বে হযরত উসমান (রা) কুরআনের মুসাফ নিয়ে কাজ করেছিলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আমলেই কুরআনকে ত্রিশ খণ্ডে ভাগ করা আর পাঠকের সুবিধার্থে নুকতা যুক্ত করা হয়। নুকতার ব্যাপারে পূর্বে কেউ কেউ প্রচেষ্টা করবার উল্লেখ থাকলেও হাজ্জাজের চেষ্টাটাই প্রসিদ্ধ। তাফসির আল-কুরতুবি থেকে জানা যায়, হাসান বসরি (র), ইয়াহিয়া বিন ইয়ামুর নাসর ইবনে আসিমের সহায়তায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নুকতা প্রচলনের আদেশ দেন।
জীবনের শেষভাগে এসে হাজ্জাজ যে হত্যাকাণ্ডটি করেন সেটি ছিল বিখ্যাত সাইদ ইবনে জুবাইরের। তিনি হাজ্জাজের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এ বিদ্রোহ দমনের পর সাইদ পালিয়ে যান মক্কায়, কিন্তু তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় হাজ্জাজের দরবারে। সাইদের সাথে হাজ্জাজের কথোপকথন ছিল দীর্ঘ, যার অনেকগুলো সংস্করণ পাওয়া যায় ইবনে কাসিরের গ্রন্থে। (১০ম খণ্ড, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, পৃষ্ঠা ১৬৩) যেমন একটি সংস্করণ এরকম-
হাজ্জাজ: তোমার নাম কী?
সাইদ: সাইদ বিন জুবাইর।
হাজ্জাজ: না, তুমি শাকিই বিন কুসাইর (সাইদ মানে খুশি, কিন্তু শাকিই মানে অখুশি। জুবাইর মানে যে হাড় জোড়া লাগায়, কিন্তু কুসাইর মানে যে হাড় ভাঙে)।
সাইদ: আমার মা আমাকে সঠিক নাম রেখেছেন।
হাজ্জাজ: তুমি আর তোমার মা দুজনেই বিপথগামী। আল্লাহর কসম, আমি তোমার দুনিয়াকে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত করবো (দোযখ)।
সাইদ: তুমি সেটা করতে পারবে জানলে তো তোমাকেই ঈশ্বর মানতাম।
হাজ্জাজ: আমার অনেক সম্পদ আছে। সোনাদানা আছে। (তার সামনে বস্তাভর্তি সোনাদানার লোভ দেখানো হলো)
সাইদ: হে হাজ্জাজ, তুমি কি তোমার ধনসম্পত্তির প্রতিপত্তি দেখাতে চাচ্ছ? এগুলো দেখিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরাবে? আল্লাহর কসম, হবে না তা। (এ বলে তিনি কিবলামুখী হলেন)
হাজ্জাজ: একে ধরে কিবলামুখ থেকে সরাও। আল্লাহর কসম, সাইদ বিন জুবাইর, তোমাকে এমনভাবে মারবো যেভাবে কাউকে কোনোদিন মারিনি।
সাইদ: আল্লাহর পছন্দমাফিক হত্যাপন্থা বাদে অন্য কোনোভাবেই তুমি আমাকে মারতে পারবে না।
হাজ্জাজ: (আবার) তাকে কিবলার দিক থেকে সরাও!
সাইদ: “তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা।” (কুরআনের আয়াত ২:১১৫)
হাজ্জাজ: তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলো।
সাইদ: “তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, আর এ মাটিতেই তোমরা ফিরে যাবে, এবং এরপর আরেকবার সেখান থেকে তোমাদের বের করে আনবো।” (কুরআন ২০:৫৫)
তখনই হাজ্জাজ নির্দেশ দিলেন সাইদকে শিরশ্ছেদ করতে। সাইদ বলেছিলেন, “হাজ্জাজ! মহান আল্লাহর দরবারে আমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হব!” এবং তিনি হাসলেন। হাজ্জাজ হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সাইদ বললেন, “আমার প্রতি তোমার হিংসা আর তোমার প্রতি আল্লাহর ধৈর্য দেখে হাসছি।”
সাইদ তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পাঠ করেন, প্রথমবার স্পষ্ট শোনা যায়, পরের দুবার অস্পষ্ট। তার মাথা গড়িয়ে পড়লো। সেটি ছিল ৭১৪ সালের মে মাস। সাইদের বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর।
এরপরই হাজ্জাজ পাগল হয়ে যান। যখনই তিনি ঘুমাতেন, ঘুমের মাঝে সাইদকে দেখতেন, যেন তিনি তার সমস্ত কাপড়চোপড় আঁকড়ে ধরছেন আর বলছেন, “হে আল্লাহর দুশমন! তুমি আমাকে কী জন্য হত্যা করলে?” হাজ্জাজ পাগলের মতো বলতেন, “হায়রে! আমার আর সাইদের মাঝে কী হলো!”
তার পেটে পোকা হয়েছিল, দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছিল বলে শোনা যায়। হযরত হাসান বসরীর কাছে সাইদ বিন জুবাইরের হত্যার সংবাদ পৌঁছানোর পর তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! হে পরাক্রমশালীদের চূর্ণ-বিচূর্ণকারী! হাজ্জাজকে তুমি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দাও!”
সাইদকে হত্যার এক মাসের মাঝে (১৫ থেকে ৪০ দিনের মাঝে) এবং হাসান বসরির কাছে সংবাদ পৌঁছানোর তিনদিনের মাঝে হাজ্জাজ মৃত্যুবরণ করেন। এ খবর হাসান (র) জানবার পর খুশিতে সিজদায় পড়ে যান।
মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে হত্যার পর ক্রুশবিদ্ধ করবার কথা আগে বলা হয়েছে। তখন মক্কায় কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। তখন হাজ্জাজ জনগণকে মসজিদে একত্রিত হবার আদেশ দান করেন। সবাই মসজিদে এলে, হাজ্জাজ মিম্বরে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বললো,
“হে মক্কাবাসীগণ! আব্দুল্লাহ (রা) এর হত্যা আপনাদের জন্য একটি বিরাট ঘটনা মনে হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সাবধান! জেনে রাখুন, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর এ উম্মতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি খিলাফতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং যাদের হাতে খিলাফত বর্তমান আছে, তাদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করেন এবং আল্লাহর আনুগত্যের সাথেও বিরোধিতা করেন, আল্লাহর হারামে (মক্কায়) আশ্রয় নেন। যদি কোনো বস্তু নাফরমানদের রক্ষা করতে পারতো, তাহলে তা আদম (আ)-কে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারত। আল্লাহ নিজে তাকে সৃষ্টি করেছিলেন! তার মাঝে রুহ ফুঁকে দিয়েছিলেন! তাকে মহাসম্মান দিয়েছিলেন। জান্নাতে থাকতে দিয়েছিলেন! কিন্তু, তিনি যখন ভুল করলেন, তখন তার ভুলের জন্য তাকে জান্নাত থেকে বের করে দিলেন। আদম (আঃ) আল্লাহর কাছে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) থেকে বেশি সম্মানিত। আর জান্নাতও কাবা থেকে বেশি সম্মানিত। কাজেই আপনারা মহান আল্লাহকে স্মরণ করুন, মহান আল্লাহও আপনাদের স্মরণ করবেন।”
আসমা (রা) হাজ্জাজকে বললেন, “রাসুল (সা) বলেছিলেন, সাকিফ গোত্র থেকে দুজন লোক আসবে, একজন হবে মিথ্যুক, আর আরেকজন ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনাকারী। মিথ্যুককে তো ইতোমধ্যে দেখেছি (আল মুখতার)। তুমি সেই ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনাকারী।”
একবার হাজ্জাজ খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন জোরে তিনি বলে উঠলেন, “নিশ্চয়ই হাজ্জাজ কাফির (অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারী)।” এরপর চুপ রইলো। আবার বললেন, “নিশ্চয়ই হাজ্জাজ কাফির।” এরকম কয়েকবার বললেন। এরপর যোগ করলেন, “হাজ্জাজ লাত উজ্জা দেবীর ব্যাপারে কাফির (অস্বীকারকারী)।”
খলিফা আব্দুল মালিক একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দুনিয়াতে এমন কেউ নেই যে নিজের দোষ জানে না। তোমার কি দোষ আছে নিজের কোনো?” হাজ্জাজ বললেন, “আমি বিবাদ সৃষ্টিকারী, বিদ্বেষ পোষণকারী আর হিংসুক।” খলিফা বললেন, “শয়তানেরও তো এত খারাপ দোষ নেই বুঝি যা তোমার আছে। মনে হয় তোমার আর শয়তানের মাঝে আত্মীয়তা আছে পিতার দিক থেকে।”
ইবনে কাসির (র) হাজ্জাজ সম্পর্কে বলেন, “হাজ্জাজের যেসব কাজ আমরা নিশ্চিত জানি তার মাঝে তার রক্তপাত ঘটানো প্রধান। এটিই আল্লাহর কাছে তার শাস্তি পাবার জন্য যথেষ্ট। তবে সে জিহাদের কাজে ও নানা শহর জয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। সে কুরআন চর্চায় অনেক বেশি খরচ করতো। যখন হাজ্জাজ মারা যায়, তখন তার মাত্র ৩০০ দিরহাম ছিল।”
হাসান বসরী (র)-কে হত্যার জন্য অনেকবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন হাজ্জাজ, গিয়েছিলেনও মারতে। কিন্তু হাসান বসরী (র) এর কথার কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন।
হাসান বসরী (র) ছিলেন তাদের একজন যারা হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হোক চাইতেন না। তার মতে, হাজ্জাজ একটা গজব, তলোয়ার দিয়ে গজবের মোকাবেলা হয় না। কাজেই, ধৈর্য ধরে প্রার্থনা করতে হবে।
উমার বিন আব্দুল আজিজ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন, হাজ্জাজের শেষ দিককার বাণীর জন্য। তিনিও হাজ্জাজের মতো সেই বাণী বলেছিলেন মৃত্যু ঘনিয়ে এলে।
হাজ্জাজের শেষদিককার বাণী ছিল, “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও! কারণ, জনগণ ধারণা করে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না। জনগণ আমার আশা কেড়ে নিতে চায়, কিন্তু তোমার প্রতি আমার আশা কখনোই হারাবে না।”
হাসান বসরী (র)-কে যখন এ কথা জানানো হলো, তখন তিনি বললেন, “সত্যি কি হাজ্জাজ এমন বলেছে?”
জনগণ বললো, “হ্যাঁ।”
তখন হাসান (র) বললেন, “তাহলে হাজ্জাজের ক্ষমার আশা করা যায়।”
হাজ্জাজ মৃত্যুর সময় কবিতার ভাষায় যা বলেছিলেন তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “হে আমার প্রতিপালক! আমার শত্রুরা হলফ করে বলছে যে, আমি জাহান্নামী। তারা তা প্রচারের অহরহ চেষ্টা করছে। তারা কি অজানা একটা ব্যাপারে শপথ করছে না? তাদের দুর্ভাগ্য, মহাক্ষমাকারীর বড় ক্ষমা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বলতে কিছুই নেই… তুমি আমাকে জাহান্নামের গোলামি থেকে মুক্তি দিও।”
এ ব্যাপারে হাসান বসরি (র) বলেন, “আল্লাহর কসম, যদি হাজ্জাজ নাজাত পায়, তবে এ কবিতার দ্বারাই পেয়ে যাবে।”
প্রবল রক্তপাতকারী হাজ্জাজ কখনো সাহাবী-হন্তারক নামে ঘৃণিত, আবার কখনো সিন্ধু বিজয় আর তার কুরআন-প্রেমের জন্য প্রশংসিত। ইতিহাসের পাতায় তাই বিতর্কিত শাসকের পাতাতেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নাম।
ফিচার ইমেজ: Lore Hound