“তুমি কোনোভাবেই স্বীয় প্রাণ সংহার করতে পারবে না। হয়তো লাগতে পারে তিন বছর, কিংবা পাঁচ; কিন্তু যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। ততক্ষণ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার অধীনস্থ একজন সৈনিকও (যুদ্ধক্ষেত্রে) বেঁচে থাকবে। তোমাকে নারিকেল খেয়ে বেঁচে থাকতে হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তবে তা (নারিকেল) খেয়েই বেঁচে থাকবে! কোনো অবস্থাতেই স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেবে না।”
ডিভিশন কমান্ডার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচির এই নির্দেশকে অমোঘ বিধান হিসেবে শিরোধার্য করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চলে গেলেন তরুণ হিরু ওনোদা। আর যখন জন্মভূমিতে ফিরে আসলেন, মহাযুদ্ধের তামাম লীলাখেলা তখন ধূসর অ্যালবামের স্মৃতিতে সেই বহুদূর। মাঝখান থেকে ডিভিশন কমান্ডারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ভুল যুদ্ধে কাটিয়ে আসেন জীবনের প্রায় ত্রিশটি বসন্ত। বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে বিভীষিকাময় ও নিষ্ঠুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জাতির এক ‘জয়ী’ যোদ্ধার নির্মম সত্য কাহিনী শোনানো হবে আজ। ¹,²
হিরু ওনোদা
জন্ম তার ঐতিহ্য প্রাচীন সামুরাই যোদ্ধা পরিবারে; ১৯২২ সালের ১৯ মার্চ জাপানের কাইনান শহরে। সাত ভাইবোনের ভিতর ওনোদা ছিলেন পঞ্চম। বয়স যখন ১৭ তখন কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয় মধ্য চীনে; হুবেই প্রদেশের তাজিমা ইয়োকো ট্রেডিং কোম্পানিতে। কিন্তু বেশিদিন সেখানে কাজ করতে পারেননি। কারণ ততদিনে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ২০ বছর বয়সে তাই শত্রুদেশ থেকে ফিরে আসেন ওনোদা। যোগ দেন জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীতে। সেখানে তাকে একজন ইন্টেলিজেন্ট অফিসার হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হিরু ওনোদা ছিলেন ফুতামাতায় অবস্থিত নাকানো সামরিক স্কুলের এলিট কমান্ডো দলের একজন সদস্য। ট্রেনিং শেষে তাকে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপপুঞ্জে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। তার উপর আদেশ বর্তে ছিল– যেকোনো উপায়ে শত্রুপক্ষের চলাচল, আক্রমণে বাধা প্রদান করা; হোক সে লুবাং এয়ারফিল্ড ধ্বংস করে কিংবা পোতাশ্রয়ের জেটি আক্রমণ করে ।
মহাযুদ্ধের করাল থাবায় ক্ষতবিক্ষত এক দ্বীপ লুবাং
লুবাং ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী এক সমুদ্রবিধৌত দ্বীপপুঞ্জ। দ্বীপটি চওড়ায় প্রায় দশ কিলোমিটার আর লম্বায় তার প্রায় তিনগুণ।
১৯৪৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ওনোদা যখন এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপপুঞ্জে পা রাখেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংস নগ্নতায় সমগ্র ফিলিপাইন তখন নিমজ্জিত। সব জায়গায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির জয়জয়কার। শেষ চেষ্টা হিসেবে অক্ষপক্ষের অন্যতম সদস্য জাপান যা করতে পারতো ওনোদার অর্পিত দায়িত্ব ঠিক তাই ছিল- পদে পদে শত্রুপক্ষকে বাধাপ্রদান করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওনোদা তার কাজ ঠিকমতো করতে পারেনি। আর সেটা হয়নি ওনোদার গ্যারিসন কমান্ডারদের নানারকম গাফিলতির কারণে। লুবাং দ্বীপপুঞ্জে আসার সাথে সাথেই সেখানে অবস্থানরত সুগি ব্রিগেডের জাপানী সৈন্যদের সাথে সাক্ষাৎ হয় ওনোদার। সেখানকার যেসব অফিসার ওনোদার থেকে র্যাঙ্কের দিক থেকে উচ্চপদস্থ ছিল তাদের কেউ কেউ ওনোদাকে ঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করেনি। তাদের এই অসহযোগিতা মিত্রপক্ষকে দারুণভাবে সহযোগিতা করলো। ফলে যা হবার তা-ই হল। ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন কমনওয়েলথ ফোর্সের সম্মিলিত আক্রমণে লুবাং জাপানের হাতছাড়া হতে শুরু করলো এবং এক সময় হয়েও গেলো। ওনোদা সহ মোট চারজন সৈন্য কোনোমতে পালিয়ে বাঁচতে পারলো। বাকিরা হয় মারা গেছে, নয়তো যুদ্ধবন্দীত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ওনোদা, যিনি ইতোমধ্যেই লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়েছেন, বাকিদের নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন। তারপর…
অজানা পথে শুরু এক অযাচিত পথচলা
প্রাইভেট উইচি আকাতসু, কর্পোরাল শইচি শিমাদা এবং প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস কিনশিচি কজুকা- ওনোদার সাথে থাকা এই তিনজনের প্রত্যেকেই ছিল সৈনিক পদমর্যাদার। এর মধ্যে উইচি আকাতসু ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে দলত্যাগ করে (ছয়মাস পর) ফিলিপিনো ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এমনিতেও তারা অনেক সতর্ক ছিল, উইচির দলত্যাগ অন্যদের আরো সতর্ক করে দিলো। আর সতর্ক হবেই বা না কেন! আত্মসমর্পণের পর এই উইচিকে দিয়েই ফিলিপিনো ফোর্স আকাশ থেকে যুদ্ধসমাপ্তির লিফলেট বিলি করা ও তার সাথের সঙ্গীদের খোঁজা শুরু করলো। কিন্তু এতে ফল হল উল্টো। তারা ধরেই নিলো যে, উইচি শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে। আর এখন লিফলেটের মাধ্যমে তাদের ধোঁকা দিয়ে শত্রুর হাতে ধরিয়ে দিতে চাইছে। ফলে জঙ্গলের আরো গভীরে সেঁধিয়ে গেলো ওনোদারা। এই লিফলেট অবশ্য অনেক আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু মহাযুদ্ধের দামামা শেষ, সমর ডঙ্কার গর্জন হয়েছে গত, সময় এখন জীবনে ফেরার- এই কথাগুলো ওনোদাদের বোঝাবে কে! তারা সবগুলোকেই শত্রুপক্ষের প্রোপ্যাগান্ডা আর ধোঁকা বলে মনে করলো।
অতি স্বাভাবিক এই মনে করা। তাদের ফিরে আসার জন্য প্রথম লিফলেট ছাড়া হয় পঁয়তাল্লিশের অক্টোবরে অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরপরই। এরপর আরো ছাড়া হয় যার কোনো কোনোটিতে ১৫ আগস্ট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে আর তাদের পাহাড় থেকে নেমে আসার কথা লিখা ছিল। কিন্তু এসব লিফলেটের কোনটিই ওনোদাসহ বাকি দু’জন বিশ্বাস করলো না। এমনকি বোয়িং বি-১৭ থেকে ফেলা জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার “বাড়ি ফিরে আসো” টাইপ লিফলেটও তাদের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে পারেনি। অবশ্য জেনারেলের স্বাক্ষর করা একটি কাগজ, তার তো একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। তাই কাগজটি আসলেই আসল কিনা তা নিয়ে তারা অনেকদিন ধরে গবেষণা (!) করলো। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রত্যেকেই এই মর্মে তাদের মতামত দিলো যে- লিফলেটটি ভুয়া! বহাল থাকলো সেই পালিয়ে থাকার জীবনই।
এবার ১৯৫২ সাল, প্লেন থেকে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের পক্ষে চিঠি ও ছবি ফেলা হল। বলা হল ফিরে আসার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিনজন এটাকেও ধোঁকা হিসেবে ধরে নিলো। পরের বছর (১৯৫৩) জুন মাসে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। একদল ফিলিপিনো জেলের সাথে বন্দুকযুদ্ধে শিমাদার পায়ে গুলি লাগে। সেবার ওনোদার ঐকান্তিক সেবায় সুস্থ হয়ে উঠে শিমাদা। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৭ মে লুবাং দ্বীপের গন্টিন সৈকতে শিমাদা মারা পড়লো তাদেরকেই খুঁজতে আসা অনুসন্ধানকারী দলের গুলিতে। ওনোদার সাথে এখন শুধুই কজুকা। শিমাদা মারা যাবার দশ দিনের মাথায় আবারো লিফলেট ফেলা হল। সাথে লাউডস্পিকারে ঘোষণা করা হল, “ওনোদা, কজুকা, যুদ্ধ শেষ।” বরাবরের মতো এটাকেও তারা আমেরিকানদের একটা কূটকৌশল হিসেবে ধরে নিলো। এক্ষেত্রে ওনোদাকে দোষ না দিলে দোষের কিছু হবে না হয়তো।
ওনোদা ও কজুকার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, একদিন তার স্বদেশীরা আমেরিকানদের হটিয়ে আবার এই দ্বীপপুঞ্জের দখল ফিরে পাবে। একজন জাপানি নাগরিক বেঁচে থাকতে তাদের জন্মভূমি হেরে যেতে পারে না। আর এতো বড় যুদ্ধ তো আর রাতারাতি থেমে যাবার নয়। একশ’ বছর লেগে যাবে এই মহাযুদ্ধে জিততে। এই বিশ্বাসই তাদের ঐ অবিশ্বাসের কারণ ছিল। আর তাই আপন ভাইয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধেও অবিশ্বাস গেলো না ওনোদার। আমেরিকানরা নিশ্চয়ই তার ভাইয়ের মতো কাউকে সাজিয়ে এনেছে- এই ভেবে এটাকেও সে ফেলে দিলো বাতিলের খাতায়। ফিলিপাইনের গহীন অরণ্যে পালিয়ে বেড়ানো, কখনো খাবারের জন্য স্থানীয় ফিলিপিনোদের আক্রমণ করা, তারপর আবার পালিয়ে বেড়ানো, ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত পতঙ্গের কামড় সহ্য করে টিকে থাকা- এই ছিল ওনোদাদের ‘সংগ্রামী’ জীবনের দৈনন্দিন চক্র।
স্থানীয়দের কাছে তারা মূর্তমান আতঙ্ক রূপে দেখা দিলো। স্থানীয়রা তাদের “পাহাড়ি দস্যু”, “পাহাড়ি শত্রু” ইত্যাদি উপাধিতে (!) ভূষিত করা শুরু করলো। আর না করেই বা যাবে কোথায়! মাঝে মাঝেই যে তাদের দুজনের হাতে এসব সাধারণ দ্বীপবাসী বেঘোরে প্রাণ হারাতো। ওনোদারা এইসব সাধারণ মানুষকে শত্রুপক্ষ মনে করতো। তাদের গেরিলা কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ জনের মতো ফিলিপিনো নিহত হয়। স্থানীয় পুলিশের সাথেও তাদের বেশ কয়েকবার ছোটোখাটো খণ্ডযুদ্ধ (Skirmish) হয়েছে। ’৬৫ এর শেষের দিকে ওনোদা ও কজুকা একটা ট্রানজিস্টার রেডিও সংগ্রহ করলেন যেখানে পিকিং থেকে সংবাদপ্রবাহ হচ্ছিলো। যেহেতু তাদের মন সেই ’৪৫ এই আটকে ছিল, তাই কোনো কিছুই তারা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তবে শিল্প পরাশক্তি হিসেবে জাপানের উত্থানের খবর তাদের মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো তাদের দিনগুলো।
১৯ অক্টোবর ১৯৭২; ওনোদা ও কজুকা ধান সিদ্ধ করছিলো। এসব ধান স্থানীয়দের থেকে পাওয়া; মানে জোর করে পাওয়া আর কি! কিন্তু সেদিনের এক ছোট্ট ভুলে বড় ধরণের এক মাশুল দিতে হয় তাদের। একটু বেশি সময় নিয়ে ধান পোড়ায় ওনোদা আর কজুকা। সেই ধোঁয়া স্থানীয় পুলিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের ছোড়া দুটি গুলি কজুকার শরীরে বিদ্ধ হয়, যার মধ্যে একটি হৃদপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে চলে যায়। সাথে সাথে মারা যায় সে; ওনোদার দীর্ঘদিনের সাথী প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস কিনশিচি কজুকা। নিঃসঙ্গ ওনোদা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লো। “শত্রুকে” এখনই আক্রমণ করতে গেলে খামোখা প্রাণবায়ু উড়ে যেতে পারে। এদিকে কজুকার মৃত্যুর পরে আবার সবাই নড়েচড়ে বসলো। কারণ ওনোদা ও কজুকাকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার কারণে মৃত ঘোষণা করা হয়। আবার শুরু হয় সার্চ পার্টির দৌড়াদৌড়ি, লাউডস্পীকারে ঘোষণা আর লিফলেট ফেলা। এমনকি তাকে নিয়ে লেখা ম্যাগাজিন ও পত্রিকা ফেলাও বাদ যায়নি। হাস্যকর হলেও সেগুলোর কোন কোনটিতে তার সুদীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকার ভিত্তিতে হওয়া গায়েবানা (!) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিস্তারিত খবরও ছিল। কিন্তু কোন কিছুই ওনোদা বিশ্বাস করলো না। সে এই দ্বীপেই তার জীবনের বাকি দিনগুলো কাটানোর জন্য মনস্থির করে ফেললো। আর তখনই ঘটলো এক ঘটনা…
বোহেমিয়ান সুজুকির সাথে বন্ধুতা
এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া তরুণ ওনোদার আক্রমণের শিকার হল। তিনটি জিনিসের সন্ধানে বের হওয়া জাপানের সুজুকির ভাগ্য সেদিন ভালো ছিল। ওনোদা তাকে দেখামাত্রই মেরে ফেলতে পারতেন। কী কারণে যেন মারলেন না বোহেমিয়ান এই জাপানি তরুণকে। জাপানের হোসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র নোরিও সুজুকির গতানুগতিক ধারার পড়াশোনা মোটেই ভালো লাগতো না। তার রক্তে যে মিশে ছিল ঘোরাঘুরির অদম্য নেশা। সেই নেশার টানে ১৯৬৯ সালে বেরিয়ে পড়েন সুজুকি। সমানে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা চষে বেড়ান। কিন্তু ’৭২ সালে আবার জাপানে ফিরে আসেন। কিন্তু এই পরিবেশ, জীবন কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না। এমন সময় জাপানি মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে কিনশিচি কজুকার মৃত্যুর খবর এবং একই সাথে ওনোদার বেঁচে থাকার বিষয়টি। সুজুকি মনস্থির করে ফেললেন। ওনোদাকে খুঁজে বের করবেন তিনি, সাথে আরো দুটো জিনিস। একটি হল পাণ্ডা, আরেকটি Abominable Snowman বা ইয়েতি। তিনি একটি ক্রমধারাও ঠিক করে ফেললেন। প্রথমে মহাযুদ্ধের হারানো যোদ্ধা হিরু ওনোদা, তারপর পাণ্ডা এবং সবশেষে ইয়েতি।
সুজুকি ওনোদার খোঁজে চলে আসলেন লুবাং দ্বীপপুঞ্জে। সুজুকির নিজে থেকে ওনোদাকে খোঁজা লাগলো না। তাঁবুর ভিতরে ওনোদাই সুজুকিকে খুঁজে বের করলেন। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ, ১৯৭৪ সাল। অবাক চোখে সুজুকি দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিস্মৃত মহাযুদ্ধের এক গোঁয়ার যোদ্ধা। ওনোদা আর সুজুকি একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো। দুজনের মাঝে বেশ ভাব জমে উঠলো। ওনোদা সুজুকির সাথে কিছু ছবিও তুললেন। সুজুকি তাকে জীবনে ফিরতে আহ্বান জানালেন। ‘বন্ধু’ সুজুকির কথায় সরাসরি সায় দিলেন না ওনোদা। তিনি জানালেন, তার কমান্ডারদের কেউ যদি তাকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন তো তবেই তিনি ফিরবেন। নতুবা নয়। সুজুকি কথা দিলেন তিনি তার কমান্ডারদের সাথে কথা বলবেন। ওনোদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলেন সুজুকি। প্রমাণ হিসেবে জাপান সরকারকে তাদের দুজনের মধ্যে তোলা ছবিগুলো দেখালেন। ওনোদা তাকে কী কী বলেছিল তা-ও তাদের বললেন। নড়েচড়ে বসলো সবাই। খুঁজে বের করা হল ওনোদার সেই কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচিকে।
জীবন পানে যাত্রা এবার
৯ মার্চ, ১৯৭৪ সাল; দিনটি ছিলো শনিবার। ওনোদা তাদের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দেখলেন সেখানে সুজুকির রাখা একটি চিরকুট, সাথে প্রথমবার সাক্ষাতে তাদের দুজনের তোলা দুটি ছবি এবং দুটি সামরিক আদেশপত্র। ওনোদা ঠিক করলেন একটা সুযোগ নেওয়া যেতে পারে। ফলে পরদিন তিনি সুজুকির সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। দুইদিনের যাত্রা শেষে দেখা পেলেন বন্ধু সুজুকির। কিন্তু একি! সাথে ইনি কে! এ যে সেই ডিভিশন কমান্ডার যিনি ৩০ বছর আগে ওনোদাকে আদেশ দিয়েছিলেন। যেই আদেশের কারণে ওনোদা সবকিছুকে মিথ্যাজ্ঞান করে মাতৃভূমির জন্য আজও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এ যে সেই মেজর তানিগুচি! তানিগুচি ওনোদাকে জীবনে ফিরে আসার আদেশ দিলেন। তাকে জানালেন,
“১. ইমপেরিয়াল কম্যান্ড অনুযায়ী ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সমস্ত সামরিক কার্যাদি রহিত করা হল;
২. সামরিক হেডকোয়ার্টার কম্যান্ড নং এ-২০০৩ মতে, স্টাফ হেডকোয়ার্টার্সের স্পেশাল স্কোয়াড্রনকে সব সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল;
৩. স্পেশাল স্কোয়াড্রনের আওতাধীন সমস্ত ইউনিট ও ব্যক্তিবিশেষকে যাবতীয় সামরিক কর্মকাণ্ড এবং অপারেশন স্থগিতকরণপূর্বক নিকটবর্তী ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে রিপোর্ট করার জন্য বলা হল। যদি সেরকম কেউ না থাকে তো তখন আমেরিকা কিংবা ফিলিপাইনের ফোর্সের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নির্দেশনা নেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হল।”
ওনোদার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। পুরো ব্যাপারটা হজম করতে তার অনেক সময় লাগলো।
“আমরা সত্যি সত্যিই যুদ্ধে হেরে গেছি! কীভাবে তারা (জাপানিরা) এটা মেনে নিতে পারলো? হঠাৎই যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। আমার ভিতরে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। এতদিনের এত কষ্ট আর সতর্ক পদক্ষেপের জন্য নিজেকে বোকা বোকা মনে হতে লাগলো। তার থেকেও খারাপ লাগছিলো এই ভেবে যে, এতটা বছর তাহলে আমি করলামটা কি? ধীরে ধীরে আমার ভিতরের ঝড়টা স্তিমিত হয়ে আসতে লাগলো। আর প্রথমবারের আমি বুঝতে পারলাম, আমার ত্রিশ বছরের গেরিলা জীবনের এখানেই সহসা সমাপ্তি। আজ সব শেষ। আমি আমার রাইফেলের বোল্টটা পিছন দিকে টানলাম, বের করে আনলাম বুলেটগুলোকে। আমার কাঁধের বোঝাটিকে পিঠ থেকে নামিয়ে তার উপর রাইফেলটি রাখলাম। সত্যিই কি এই রাইফেলটি আমার আর কোনো কাজে আসবে না যাকে এত বছর ধরে নিজের সন্তানের মতো অতি সযতনে রেখে দিয়েছিলাম! কিংবা কজুকার রাইফেল, যেটিকে পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে রেখে এসেছি? সত্যিই কি ত্রিশ বছর আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিলো? যদি তাই হয় তো কিসের জন্য শিমাদা আর কজুকা প্রাণ দিলো? যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে কি তাদের সাথে আমারও মরে যাওয়া ভালো ছিল না?”
এতো প্রশ্নের উত্তর কে দেবে তাকে? কারো কাছেই যে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। ওনোদা কিন্তু আত্মসমর্পণ করলেন না। তিনি মেজর তানিগুচির কাছে তার তলোয়ার, পয়েন্ট টু ফাইভ ক্যালিবারের আরিসাকা ৯৯ রাইফেল, ৫০০ রাউন্ড গুলি আর হ্যান্ড গ্রেনেডগুলো হস্তান্তর করলেন। এমনকি তার সাথের ড্যাগারটিও দিয়ে দিলেন যেটি তার মা তাকে আত্মরক্ষার জন্য সুদীর্ঘ ৩০ বছর আগে দিয়েছিলেন। তবে অনেকে বলেন, ওনোদা ফিলিপাইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোসের কাছে তার তলোয়ারটি সমর্পণপূর্বক আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কারণ, আনুষ্ঠানিক একটি অস্ত্র হস্তান্তর প্রক্রিয়া হয়েছিল। তবে ইতিহাস তো সবসময়ই জয়ীদের দ্বারা রচিত হয়; অতএব আত্মসমর্পণের এরকম কথা কেউ কেউ বলতেই পারেন।
১২ মার্চ ওনোদা ফিরে আসলেন তার প্রিয় জন্মভূমি জাপানে। বীরোচিত সম্মান দেওয়া হয় ওনোদাকে। শত-সহস্র উৎসুক মানুষ ঘিরে ধরল এই সাহসী বীরকে। এর আগে তাকে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষমা করে দিলেন ফিলিপাইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস।
ওনোদা এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন যে কেউ কেউ তাকে জাপানের জাতীয় আইনসভা পরিচালনার অনুরোধ জানালেন। ১৯৭৪ সালে ওনোদা তার ৩০ বছরের গেরিলা জীবনের উপর মাতৃভাষায় একটি বই লিখলেন। এটি পরের বছর ইংরেজিতে অনুবাদিতও হয়- No Surrender: My Thirty-Year War। কিন্তু এতো কিছুর পরেও ওনোদা মানিয়ে নিতে পারছিলেন না নতুন এই পরিবেশের সাথে। পরিবর্তিত জাপান যেন তার কাছে বড়ই বেমানান লাগছিল। তাই ’৭৫ এর এপ্রিলে ওনোদা জাপান ত্যাগ করে তার বড় ভাই তাদাও এর কাছে চলে যান। তাদাও ব্রাজিলের এক পশু প্রজনন কেন্দ্রে কাজ করেন। ওনোদা তার সাথে যোগ দেন।
১৯৭৬ সালে ওনোদা বিয়ে করেন। ১৯৮৪ সালে আবার জাপানে ফিরে আসেন তিনি। কিশোর বয়সীদের জন্য গঠন করেন ওনোদা শিজেন জুকু অর্থাৎ ওনোদা নেচার স্কুল নামের এক প্রতিষ্ঠান যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। তবে তার স্বদেশে ফেরত আসা আর এরকম একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ১৯৮০ সালে ১৯ বছরের এক কিশোর বালক কর্তৃক তার (কিশোর বালকের) মা-বাবার খুন হবার মর্মান্তিক ঘটনা। একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায়। ওনোদার কি আর কখনোই ইচ্ছা করেনি সেই লুবাং দ্বীপে ফিরে যাবার? করেছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি সেই লুবাং দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছিলেন। এবার আর যোদ্ধার বেশে বা হত্যাকারীর ভূমিকায় নয়; বরং একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে, দাতার ভূমিকায়। স্থানীয় এক স্কুলে দশ হাজার মার্কিন ডলার দান করেন হিরু ওনোদা।
২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ওনোদা তার বন্ধু সুজুকির কাছে চলে যান। মনে আছে তো নোরিও সুজুকির কথা, যার জন্য ওনোদা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন? ২০১০ সালের এক সাক্ষাতকারে ওনোদা সুজুকির ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করে বলেন,
“এই হিপ্পি বালক সুজুকি এক জাপানি সৈন্যের অনুভূতি জানতে লুবাং দ্বীপপুঞ্জে আসে। সুজুকি আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন আমি ফিরে যাচ্ছি না…”
কিন্তু অশীতিপর এক বৃদ্ধ কেন তার বন্ধুর স্মৃতিচারণ করবে? কারণ অনেক আগেই যে বন্ধুটি ওনোদাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সুজুকির কথা একটু বলিই তাহলে। ওনোদার সাথে সাথে সুজুকিও বিখ্যাত হয়ে যান। কিন্তু এই খ্যাতি সুজুকিকে তার শেষোক্ত অভিপ্রায় থেকে নিবৃত করে রাখতে পারেনি। তাই ইয়েতির সন্ধানে তিনি আবার বেরিয়ে পড়েন। আর সেই ইয়েতি সন্ধানের মিশনেই মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে হিমালয় পর্বতমালার বরফ ধ্বসে প্রাণ হারান নোরিও সুজুকি। বন্ধুর মৃত্যুর ২৮ বছর পর ৯১ বছর বয়সে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান জীবনের ৩০ বসন্ত এক ভুল যুদ্ধে কাটানো অপরাজিত, অদম্য যোদ্ধা জাপানের হিরু ওনোদা।
ফিচার ইমেজ- youtube.com
ফুটনোট:
- Onoda, H. ( 1974). No surrender: My thirty-year war. Kodansha International. p 44.
- Trefalt, B. (1999). A Straggler Returns: Onoda Hirō and Japanese Memories of the War. War & Society, 17(2), 111-124.