১
মেরি কুরির বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানেন না, বোধ করি এমন মানুষের সংখ্যাটা খুব কম। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, মেরি কুরির ব্যবহৃত যেকোনো জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইলে নিতে হয় জীবনের ঝুঁকি। ধরুন, কেউ যদি তার গবেষণার কাজে ব্যবহৃত ডায়েরি ঘেটে দেখতে চায়, তবে তাকে এমন একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে যেখানে লেখা থাকবে, তার জীবন ঝুঁকিতে পড়লে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
মেরি কুরি পরিচিত ‘মাদার অফ মডার্ন ফিজিক্স’ নামে। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটি পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী যার অর্জনের তালিকায় রয়েছে দুই-দুইটি নোবেল পুরষ্কার। প্রথমবার যৌথভাবে নোবেল পান, ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায়, দ্বিতীয়বার ১৯১১ সালে পান রসায়নে।
মেরি কুরি সর্বাধিক পরিচিত তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে কাজ করার সুবাদে। তার আবিষ্কারের মধ্যে পলোনিয়াম ও পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথকীকরণ উল্লেখযোগ্য। এই আবিষ্কারগুলো তাকে সম্মানের উচ্চাসনে পৌঁছে দিয়েছিল সত্য, তবে শেষটায় ঘাতক হয়েছিল কি না সেই আবিষ্কারগুলোই!
মেরি কুরির আবিষ্কৃত পলোনিয়াম মৌলটিই প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল তার। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব একটা সতর্কতা মানার অভ্যাস তার ছিল না। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ লেগে থাকা টেস্টটিউব পকেটে নিয়ে চলাফেরা করতেন। এগুলো সংরক্ষণে ডেস্কের ড্রয়ার ব্যবহার করতেন। এভাবে প্রতিনিয়ত কোনো সতর্কতা ছাড়াই তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার কারণেই আক্রান্ত হন ‘অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া’ নামের এক ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে। এই রোগটি আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণ ঘটায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
মেরি কুরি ও তার স্বামী পিয়েরে কুরি ১৮৯৮ সালে পলোনিয়াম আবিষ্কার করেন। এরপরই তিনি অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়াতে আক্রান্ত হতে থাকেন। যদিও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার এই আবিষ্কার তাকে প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তবুও তিনি গবেষণার কাজে কোনো অবহেলা করেননি। বরং স্বাভাবিকভাবেই গবেষণার চালিয়ে গেছেন। শারীরিক অবস্থার অবনতির শেষটা হয় ১৯৩৪ সালে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
মৃত্যুর পর তার ব্যবহার্য সব কিছু ফ্রান্সের একটি মিউজিয়ামে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। তার ব্যবহৃত সব কিছু ছিল অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। এমনকি মৃত্যুর পর তার দেহ থেকে যেন তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে না পারে সেজন্য তার কফিনটি ১ ইঞ্চি সীসা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়!
মহান এই বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পরও তার প্রতি জ্ঞানপিপাসুদের আগ্রহ কমেনি। এখন পর্যন্ত অনেকেই তার ডায়েরি, গবেষণার কাজে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু এসব যদি কেউ দেখতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়। যদিও তেজস্ক্রিয় নিরাপত্তার বিশেষ পোশাক পরে তবেই মেরি কুরির জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার অনুমতি মেলে। আগামী ১,৫০০ বছর পর্যন্ত বিশেষ পদ্ধতিতেই মেরি কুরির ডায়েরিসহ বাকি সব কিছু সংরক্ষণ করা হবে। ধরে নেওয়া হয়, ১৫০০ বছর পর হয়তো তার জিনিসপত্রে তেজস্ক্রিয়তা থাকবে না।
২
পলোনিয়াম (Polonium)
পলোনিয়াম আবিষ্কারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে দিমিত্রি মেন্ডেলেভের কথা। তিনিই প্রথম পলোনিয়ামের খুব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের একটি মৌল সম্পর্কে ধারণা দেন। ঐ মৌলটির নাম দেন ‘টেলোমিয়ার’। ১৮৭০ সালে তিনি একটি নিবন্ধে এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ্য করেন।
ভারী ধাতুগুলোর মধ্যে টেলুরিয়ামের সদৃশ একটি মৌলকে আমরা আশা করতে পারি, যেটির পারমাণবিক গুরুত্ব বিসমাথের থেকে বেশি। এর ধাতব ধর্ম থাকা উচিত। সালফিউরিক এসিডের ন্যায় ধর্ম ও গঠনবিশিষ্ট এসিড মৌলটি থেকে পাওয়া যাবে, যে এসিডটির জারণক্ষমতা টেলুরিক এসিড থেকে বেশি হবে…। RO2 নামক অক্সাইডটির অম্লীয় ধর্ম আশা করা যায় না, যদিও টেলুরাস এসিডের অম্লীয় ধর্ম আছে। মৌলটি জৈব-ধাতব যৌগ উৎপন্ন করবে, কিন্তু কোনো হাইড্রোজেন যৌগ উৎপন্ন করবে না।
মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি ইউরেনিয়াম রশ্মি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পলোনিয়াম আবিষ্কার করেন। মেরি কুরির দেশ পোল্যান্ডের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় পলোনিয়াম।
পলোনিয়াম হচ্ছে অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় একটি মৌল। এটি থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয়। মানুষ বা কোনো প্রাণীদেহের সংস্পর্শে এলে এটি কাজ করে ভয়ংকর বিষের মতো। এটি মূলত প্রাণীদেহের কোষে আক্রমণ করে। এতে কোষগুলো একেবারে মরে যায় অথবা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে পরবর্তীতে সেগুলো আর সেরে ওঠে না। কোষের এমন মৃত্যুকে বলা হয় ‘Cell Suicide’।
এছাড়াও পলোনিয়াম প্রাণীদেহের ডিএনএ চেইনকে আক্রমণ করে ভেঙে দেয়। ফলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়। এটি এতটাই ভয়ংকর যে ১ গ্রাম পলোনিয়াম-২১০ ৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে এবং সেই সাথে আরো ৫০ মিলিয়ন মানুষকে অসুস্থ করে দিতে পারে।
৩
সভ্যতার চরম উন্নতির পাশাপাশি আমরা পলোনিয়ামকেও ব্যবহার করেছি মারণাস্ত্র হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডে অবস্থানরত রাশিয়ান গোয়েন্দা আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কোর কথা বলা যায়। ধারণা করা হয়, তাকে চায়ের সাথে পলোনিয়াম দেওয়া হয়েছিল এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে হাত ছিলো রাশিয়ান সরকারেই। যদিও এই হত্যার পেছনে ঠিক কার হাত রয়েছে তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে, তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তার মৃত্যু হয়েছিল পলোনিয়ামের প্রভাবেই।
অবশ্য সহনীয় মাত্রার পলোনিয়াম মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়। এমনকি মানুষের শরীরেও অতি অল্প মাত্রায় পলোনিয়াম থাকে, যা শরীরে আসে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে। সাধারণত সামুদ্রিক খাবারে পলোনিয়াম থাকে। আবার ধূমপানের মাধ্যমেও এটি মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। এজন্যই অতিরিক্ত ধূমপান ক্যান্সারের মতো বড় রোগের কারণ হয়ে থাকে।
মেরি কুরি সম্পর্কে আরোও জানুন “মেরি কুরি” বইটি পড়ে।