প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া ও জার্মানি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯১৪ সালের আগস্ট থেকে ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী কিন্তু সংখ্যাগতভাবে দুর্বল জার্মান সশস্ত্রবাহিনী সংখ্যাগতভাবে শক্তিশালী কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল রুশ সশস্ত্রবাহিনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কিন্তু ১৯১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লবের কারণে রাশিয়ায় যে চরম নৈরাজ্য, অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়, তার ফলে ‘ইউরোপের স্টিমরোলার‘ নামে পরিচিত রুশ সশস্ত্রবাহিনী খণ্ড-বিখণ্ড ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত রুশ সরকার ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ জার্মানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে অপমানজনক ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া ১৮টি প্রদেশ কেন্দ্রীয় শক্তিগুলোর কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়, যেখানে ছিল রাশিয়ার ৩৪% জনসংখ্যা, ৫৪% শিল্পকারখানা, ৮৯% কয়লাখনি এবং ২৬% রেলপথ।
রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বহু কর্মকর্তা এই অপমানজনক পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং এই পরাজয়ের জন্য বলশেভিকদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু গৃহযুদ্ধে বলশেভিকরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় এবং এসব রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয় নেন দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোতে। অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার পর জার্মানির ওপর অবমাননাকর ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয় এবং জার্মান সশস্ত্রবাহিনীকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়। বহু জার্মান সামরিক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হন। ঘটনাচক্রে, তাদের মধ্যে অনেকেও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোতে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৩০-এর দশকে এই রুশ ও জার্মান সেনা কর্মকর্তারা দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে রুশ–জার্মান যুদ্ধ নতুন রূপে চালিয়ে গিয়েছিলেন। এই নিবন্ধটি সেই যুদ্ধের কাহিনি নিয়েই লেখা।
দক্ষিণ আমেরিকার দুই রাষ্ট্র প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্যে সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল বহু দশক ধরে। যে অঞ্চলটি নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল সেটির নাম গ্রান চাকো। এটি ছিল রিও দে লা প্লাতা নদীবিধৌত উষ্ণ ও প্রায় শুষ্ক একটি নিম্নভূমি। প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়া উভয়েই জনবিরল এই অঞ্চলটির মালিকানা দাবি করত। উভয়েই ছিল স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। গ্রান চাকো অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্যারাগুয়ে নদী প্রবাহিত। এই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নদীটির মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশাধিকার পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। ১৮৬৪-৭০ সাল পর্যন্ত চলা প্যারাগুয়ের যুদ্ধে প্যারাগুয়ে পরাজিত হয় এবং আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের কাছে তার অর্ধেক ভূমি হারায়। গ্রান চাকোর ওপর দাবি ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রে প্রবেশাধিকার হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছে তাই প্যারাগুয়ের ছিল না। অন্যদিকে, ১৮৭৯ সালের প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে বলিভিয়া তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চল চিলির কাছে হারিয়েছিল। গ্রান চাকোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বলিভিয়াকে আবার সমুদ্রে প্রবেশাধিকার দিতে পারত। এজন্য উভয় রাষ্ট্রের কাছেই অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কেউই এতদিন এটি নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। তবে ১৯২৮ সালে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে। হঠাৎ করে এমনটা কেন হলো? উত্তর: তেল!
১৯২৮ সালে ভূতাত্ত্বিকরা দাবি করেন, গ্রান চাকো অঞ্চলে তেলের খনি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে হঠাৎ করেই জনবিরল ও বসবাসের জন্য প্রায় অযোগ্য এ অঞ্চলটি প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়া উভয়ের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো এই দ্বন্দ্বে হস্তক্ষেপ করে আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থাবস্থা করে। ব্রিটিশ–ডাচ যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি রয়্যাল–ডাচ শেল এই দ্বন্দ্বে প্যারাগুয়েকে সমর্থন করে, অন্যদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল সমর্থন করে বলিভিয়াকে। ১৯২৮ সাল জুড়ে প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্যে বিচ্ছিন্ন সীমান্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। কেবল জাতিপুঞ্জের (League of Nations) প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণেই ঐ বছর রাষ্ট্র দুটির মধ্যে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়নি।
কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং বিরোধপূর্ণ অঞ্চলটি নিয়ে কোনোরকম মীমাংসায় পৌঁছাতে রাষ্ট্র দুটি ব্যর্থহয়। ১৯৩২ সালের ১৫ জুন আবার তাদের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয় এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে সার্বিক যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘চাকোর যুদ্ধ’ (Guerra del Chaco) নামে পরিচিত।
সংখ্যাগতভাবে বলিভিয়া ছিল প্যারাগুয়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। বলিভিয়ার জনসংখ্যা ছিল প্যারাগুয়ের জনসংখ্যার প্রায় তিন গুণ! বলিভিয়ার বিমানবাহিনী ছিল প্যারাগুয়ের বিমানবাহিনীর চেয়ে তিনগুণ বড়, এবং বলিভিয়ার ‘ভিকার্স এম কে ই’ হালকা ট্যাঙ্ক ও ‘কার্ডেন লয়েড ৬’ ট্যাঙ্কেট (ক্ষুদ্র ট্যাঙ্ক) বহরের বিপরীতে প্যারাগুয়ের একটিও সাঁজোয়া যান ছিল না। কেবল গোলন্দাজ বাহিনীর ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে সমতা ছিল।
বলিভিয়ার সশস্ত্রবাহিনীতে ১২০ জন জার্মান সামরিক কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। তারা ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা। বলিভীয় সশস্ত্রবাহিনীকে তারা জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর আদলে গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি, বলিভীয় সৈন্যদের সামরিক উর্দিও ছিল জার্মান সৈন্যদের অনুরূপ। সর্বোপরি, বলিভিয়ার যুদ্ধমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান ছিলেন একজন জার্মান সামরিক কর্মকর্তা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হ্যান্স কুন্ডট, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব রণাঙ্গনে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। বস্তুত, তার প্রচেষ্টায়ই বলিভিয়ার সেনাবাহিনীতে বিরাট একটি সাঁজোয়া বহর সংযোজিত হয়েছিল। তিনি বলিভীয় সৈন্যদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন, কারণ তিনি সাধারণ সৈন্যদের সুযোগ-সুবিধার দিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। সর্বোপরি, তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ প্রশাসক ও সামরিক প্রশিক্ষক। এককথায়, জার্মান উর্দি পরিহিত জার্মান অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত ও পরিচালিত বলিভিয়ার সশস্ত্রবাহিনী ছিল জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর একটি ল্যাটিন সংস্করণ!
যুদ্ধ শুরুর আগে কুন্ডট এক মার্কিন সাংবাদিককে বলেছিলেন, “প্যারাগুয়ে যদি আবার চাকো ইস্যু নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তবে তার সৈন্যরা সরাসরি আসুনসিওন (প্যারাগুয়ের রাজধানী) দখল করে নেবে এবং রাষ্ট্র হিসেবে প্যারাগুয়ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। তিনি দম্ভের সঙ্গে আরো ঘোষণা করেছিলেন, রুশদেরকে তিনি দেখে নেবেন!”
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্যারাগুয়ে আর বলিভিয়ার দ্বন্দ্বের মাঝখানে রুশরা কোথা থেকে এলো? এসময় জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়ানোর প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে ‘এক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেছিল এবং দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ে মস্কোর কার্যত কোনো আগ্রহই ছিল না।
আসলে কুন্ডট সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বোঝাচ্ছিলেন না। তিনি বলছিলেন, প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের কথা। বলিভিয়ার সশস্ত্রবাহিনীতে যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া বহু জার্মান সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীতেও তেমনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া বহু রুশ সামরিক কর্মকর্তা, যারা বলশেভিকদের বিরোধিতা করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
বলিভিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে জার্মান সেনা কর্মকর্তারা যেভাবে জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর আদলে গড়ে তুলেছিলেন, প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীকে সেভাবে রুশ সশস্ত্র বাহিনীর আদলে গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টা রুশ সেনা কর্মকর্তারা করেননি। কিন্তু প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনী এবং জাতীয় অবকাঠামোর উন্নতি সাধনে তাদের প্রচুর অবদান ছিল। প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীতে মোট ৮৬ জন রুশ সামরিক কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন, যারা আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সর্বত্র কর্মরত ছিলেন। প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের মানচিত্র নির্মাণ বিভাগের প্রধান এবং প্যারাগুয়ের রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন একজন রুশ সেনা কর্মকর্তা, জেনারেল ইভান বেলিয়ায়েভ (প্যারাগুয়েতে হুয়ান বেলাইয়েফ নামে পরিচিত), যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যিনি প্রথম গ্রান চাকো অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রণয়ন করেছিলেন।
বেলিয়ায়েভ আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারাগুয়ের সেনাপ্রধান না হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্যারাগুয়ের সৈন্যদের অধিনায়ক। প্যারাগুয়ের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিকোলাই এর্ন-ও ছিলেন একজন রুশ সেনা কর্মকর্তা। রুশ ক্যাপ্টেন প্রিন্স তুমানভ ছিলেন প্যারাগুয়ের ক্ষুদ্র নৌবাহিনীর প্রধান। প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীর ২৮টি রেজিমেন্টের মধ্যে ৭টির অধিনায়ক ছিলেন রুশ সেনা কর্মকর্তারা। এছাড়া প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীর আরো অনেকগুলো ব্যবস্থাাটালিয়ন ও ব্যবস্থাাটারি (ক্ষুদ্র সৈন্যদল) এবং নৌ ফ্লোটিলার অধিনায়কত্বও ছিল রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। রুশ সামরিক মানচিত্র নির্মাতারা গ্রান চাকোর মানচিত্র প্রণয়নে বেলিয়ায়েভের অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, রুশ সামরিক প্রকৌশলীরা সেতু ও প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নির্মাণ করছিলেন, রুশ অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা আসুনসিওনের অস্ত্র নির্মাণ কারখানায় কর্মরত ছিলেন এবং রুশ সামরিক প্রশিক্ষকরা প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় ১৯৩২ সালে প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীতে প্রথম অশ্বারোহী ডিভিশন সৃষ্টি করা হয়। এই বাহিনীটিকে শত্রুবাহিনীর পশ্চাৎভাগে ঝটিকা আক্রমণ করার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয় (সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য রুশ মেজর নিকোলাই কোরসাকভ রুশ সামরিক সঙ্গীতগুলোকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন)। জেনারেল বেলিয়ায়েভ চাকো যুদ্ধে প্যারাগুয়ের সশস্ত্রবাহিনীর আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক অভিযানগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়নে মূল ভূমিকা পালন করেন।
বস্তুত, চাকো যুদ্ধে লড়াই করেছিল প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়া, যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার সৈন্যরা, কিন্তু তাদেরকে সার্বিকভাবে পরিচালনা করেছিল যথাক্রমে রুশ ও জার্মান সামরিক কর্মকর্তারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এভাবে দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে নতুন করে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই শুরু করেছিল। চাকোর যুদ্ধ পরিণত হয়েছিল রুশ–জার্মান যুদ্ধে।
যুদ্ধের প্রথমদিকেই জেনারেলের এর্নের অধীনস্থ প্যারাগুয়ের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ক্যাপ্টেন সের্গেই কের্ন (আরেকজন রুশ সেনা কর্মকর্তা) বলিভীয় সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সংকেতের মর্মার্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এর ফলে প্যারাগুয়ের সশস্ত্রবাহিনী যুদ্ধের শুরুতেই একটি বড় সাফল্য অর্জন করে। বলিভীয়দের সামরিক সংকেতের পাঠোদ্ধার করে তারা সহজেই বলিভীয় সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে পারত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বলিভীয় সৈন্যরা তাদের নির্দেশ পাওয়ার আগেই প্যারাগুয়ের সৈন্যরা সেগুলো জেনে ফেলত। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে প্যারাগুয়ের সৈন্যদের বড় ধরনের সুবিধা প্রদান করে।
রুশ বৈমানিক ক্যাপ্টেন সের্গেই শ্চেতিনিন প্যারাগুয়ের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাবস্থাকে সংগঠিত করেন। শুধু তা-ই নয়, তার নির্দেশনায় প্যারাগুয়ের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে নকল কামান সজ্জিত করে রাখত। বলিভীয় যুদ্ধবিমানগুলো এগুলোকে আসল ভেবে এগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে নিজেদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে ফেলত।
১৯৩২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। জার্মানদের দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত জার্মান কায়দায় গড়ে তোলা বলিভীয় সশস্ত্র বাহিনী রুশদের দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীর মুখোমুখি হয়। ২,১০,০০০ বলিভীয় সৈন্যের বিপরীতে প্যারাগুয়ের সৈন্য সংখ্যা ছিল দেড় লক্ষের কাছাকাছি। কিন্তু সংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বলিভীয়রা এগিয়ে থাকলেও তারা প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করতে ব্যর্থহয়। আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ চলতে থাকে, যেগুলোতে কোনো পক্ষই বিশেষ সুবিধা অর্জন করতে পারেনি।
১৯৩৩ সালের জুলাই মাসে এই প্যারাগুয়ে–বলিভিয়া (বা রুশ–জার্মান) যুদ্ধের শীর্ষ মুহূর্ত উপস্থিত হয়। বলিভীয় সৈন্যরা এসময় প্যারাগুয়ের রাজধানী আসুনসিওনের একটি উপশহর নাভানা দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালায়। এই অভিযানের জন্য জেনারেল কুন্ডট প্যারাগুয়ের ৩,৬০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে ৬,০০০ বলিভীয় সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন। এই যুদ্ধে জার্মান ক্রু-দ্বারা চালিত বলিভীয় ট্যাঙ্ক-বহরের সমর্থনে বলিভীয় সৈন্যরা (যাদের সর্বাগ্রে ছিল জার্মানদের দ্বারা পরিচালিত একটি ফ্লেমথ্রোয়ার টিম) প্যারাগুয়ের সৈন্যদের অবস্থানগুলোর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়।
এই অভিযানের আগেই রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্যারাগুয়ের সৈন্যরা তাদের অবস্থানকে সুরক্ষিত করতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাবস্থা গড়ে তুলেছিল। প্যারাগুয়ের সৈন্যরা মেশিনগান ও মর্টারে সজ্জিত ছিল এবং তাদের অবস্থানের চারপাশে মাইনক্ষেত্র ও কাঁটাতারের বেড়া দেয়া ছিল। এমতাবস্থায় প্যারাগুয়ের সৈন্যরা বলিভীয় বাহিনীর ৮টি আক্রমণ প্রতিহত করে এবং তারপর প্রতি-আক্রমণ চালায়, যার ফলে বলিভীয় বাহিনীর ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা পশ্চাৎপসারণ করতে বাধ্য হয়। এই খণ্ডযুদ্ধে প্রায় ২,০০০ বলিভীয় সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের বেশ কয়েকটি ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, অন্যদিকে প্যারাগুয়ের মাত্র ১৪৯ জন সৈন্য নিহত ও ৪০০ জন সৈন্য আহত হয়। এই অভিযানের ব্যর্থতার ফলে বলিভিয়ার জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল কুন্ডটের খ্যাতি ব্যপকভাবে হ্রাস পায়। কুন্ডট তার পদত্যাগপত্র জমা দেন, কিন্তু সেটিপ্রত্যাখ্যাত হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে আরেকটি ব্যর্থঅভিযানের পর তিনি চূড়ান্তভাবে পদত্যাগ করেন।
এরপরও আরো প্রায় দেড় বছর ধরে এই যুদ্ধ চলে। জনবল ও অস্ত্রবলের দিক থেকে বলিভিয়ার সশস্ত্র বাহিনী বেশি শক্তিশালী হলেও প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীর অধিকতর কার্যকরী রণকৌশলের কাছে তারা হারতে থাকে। ১৯৩৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্যারাগুয়ের মাটি থেকে বলিভীয় সৈন্যরা বিতাড়িত হয় এবং বিরোধপূর্ণ গ্রান চাকো অঞ্চলের অধিকাংশ প্যারাগুয়ের দখলে আসে। এবার প্যারাগুয়ের সৈন্যরা বলিভিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সামগ্রিক পরাজয় এড়াতে বলিভীয় সরকার জাতিপুঞ্জের দ্বারস্থ হয় এবং জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় ১৯৩৫ সালের ১২ জুন উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। তবে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৩৮ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্সে (Buenos Aires) প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী গ্রান চাকোর তিন-চতুর্থাংশ প্যারাগুয়ে এবং অবশিষ্ট এক-চতুর্থাংশ বলিভিয়া লাভ করে।
চাকোর যুদ্ধে বলিভিয়ার ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ সৈন্য নিহত ও ৪০,০০০-এর অধিক সংখ্যক সৈন্য আহত হয় এবং প্রায় ২১,০০০ সৈন্য ও ১০,০০০ বেসামরিক নাগরিক প্যারাগুয়ের হাতে বন্দি হয়। এছাড়াও, ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ সৈন্য হয় পালিয়ে আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয় নয়ত নিজেরাই নিজেদের আহত করে যাতে তাদের যুদ্ধে না যেতে হয়। তদুপরি, প্যারাগুয়ের সৈন্যরা বলিভীয় সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে ৪২,০০০ রাইফেল, ৫,০০০ মেশিনগান ও সাব–মেশিনগান এবং আড়াই কোটি রাউন্ড গুলি দখল করে নেয়।
অন্যদিকে, প্যারাগুয়ের ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং ২,৫৫৬ জন সৈন্য বলিভীয় বাহিনীর হাতে বন্দি হয়। বিনিময়ে প্যারাগুয়ে লাভ করে বিরোধপূর্ণ গ্রান চাকো অঞ্চলের অধিকাংশ, যার ফলে প্যারাগুয়ের ভূমির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়। সামগ্রিকভাবে, চাকোর যুদ্ধে প্যারাগুয়ের কাছে বলিভিয়া (এবং সেহেতু রুশদের কাছে জার্মানরা) পরাজিত হয়।
জার্মান–প্রশিক্ষিত বলিভীয় সশস্ত্র বাহিনী কেন এই যুদ্ধে রুশ–প্রশিক্ষিত প্যারাগুয়ের সশস্ত্রবাহিনীর কাছে পরাজিত হলো?
প্রথমত, বলিভিয়ার জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল হ্যান্স কুন্ডট বলিভিয়ার সেনাবাহিনীতে ট্যাঙ্কবহর সংযোজনের পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন এবং চাকোর যুদ্ধে সাঁজোয়া যানবিহীন প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই ট্যাঙ্কবহর মোতায়েন করেছিলেন। কিন্তু জঙ্গলাকীর্ণ গ্রান চাকোর নিম্নভূমিতে এই ট্যাঙ্কবহর বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। গ্রেনেড ও মর্টারে সজ্জিত প্যারাগুয়ের সৈন্যরা বহু সংখ্যক বলিভীয় ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে এবং বেশ কিছু পরিত্যক্ত সাঁজোয়া যান দখল করে নেয়। ১৯৩৪ সালের মধ্যেই বলিভীয়দের কাছ থেকে দখলকৃত ট্যাঙ্ক, ট্যাঙ্কেট, ট্রাক ও অন্যান্য সাঁজোয়া গাড়িগুলো দিয়ে প্যারাগুয়ের সেনাবাহিনী তাদের সাঁজোয়া বহর তৈরি করে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, রুশদের দ্বারা পরিচালিত প্যারাগুয়ের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বলিভীয় গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে বেশি কার্যকরী প্রমাণিত হয়। যুদ্ধের শুরুতেই বলিভীয় সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সংকেতের পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে প্যারাগুয়ের গোয়েন্দা সংস্থা বড় একটি সাফল্য লাভ করে, যার ফলে বলিভিয়ার পরাজয় ত্বরান্বিত হয়।
তৃতীয়ত, জেনারেল কুন্ডট বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা সঠিকভাবে সংগঠিত করতে পারেননি। এর ফলে বহু বলিভীয় সৈন্যদল রসদপত্র, এমনকি পানির অভাবে প্যারাগুয়ের সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
চতুর্থত, জেনারেল কুন্ডট বিমানবাহিনীর ওপর আস্থা রাখতেন না এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্যারাগুয়ের সৈন্য-সমাবেশ সম্পর্কে বলিভীয় বৈমানিকদের প্রদত্ত বহু তথ্যকে তিনি অবজ্ঞা করেন। এটি তার সৈন্যদের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে।
পঞ্চমত, বলিভীয় সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত জার্মান কর্মকর্তারা চাকোর যুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবস্থাবহৃত রণকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং সম্মুখ সমর ও প্রচলিত রণনীতির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত রুশ কর্মকর্তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবস্থাবহৃত রণকৌশল প্রত্যাখ্যান করেন এবং সম্মুখযুদ্ধ যথাসম্ভব পরিহার করে আত্মরক্ষামূলক ও আধা-গেরিলা পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এর ফলে বলিভীয় বাহিনী বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল।
সর্বোপরি, প্যারাগুয়ের সশস্ত্র বাহিনী বা এর রুশ তত্ত্বাবধায়কদের প্রতি জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের ছিল অপরিসীম অবজ্ঞা। নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে উঁচু ধারণা এবং শত্রুর সামর্থ্য সম্পর্কে অবজ্ঞা তাদেরকে বেপরোয়া ও অসতর্ক করে তুলেছিল, যার ফলে তাদের কর্তৃত্বাধীন বলিভিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, যে তেলের জন্য এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটি কিন্তু সেসময় গ্রান চাকো অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দীর্ঘ ৭৭ বছর পর ২০১২ সালে এই অঞ্চলে তেল আবিষ্কৃত হয়।
সামগ্রিকভাবে, চাকোর যুদ্ধে প্যারাগুয়ের সৈন্যরা এবং তাদের রুশ পরিচালকরা জয়যুক্ত হয়। বস্তুত এই যুদ্ধে প্যারাগুয়ের জয়ের পেছনে চালিকাশক্তি ছিলেন রুশ সামরিক কর্মকর্তারা। যুদ্ধ শেষে প্যারাগুয়ের সরকার এই রুশ কর্মকর্তাদের অনেককে বিভিন্ন ধরনের পদক প্রদান করে এবং জাতীয় বীর ঘোষণা করে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে রাষ্ট্রটিতে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হন। চাকোর যুদ্ধে প্যারাগুয়ের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ৬ জন রুশ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এখন পর্যন্ত প্যারাগুয়ের রাজধানী আসুনসিওনের ৬টির রাস্তার নাম তাদের স্মৃতি বহন করছে।